আমলাতন্ত্রঃ সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া – ‍১

প্রারম্ভিকাঃ এই সেমিস্টারে একটি বিষয় নিয়ে পড়ছি যার নাম পাবলিক সেক্টর ম্যানেজমেন্ট। সেখানে দেয়া পাঠ্যবই গুলোর একটি হলো Bureaucracy: What Government Agencies Do and Why They Do it. লিখেছেন James Q. Wilson, মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গণ-প্রশাসন অধ্যাপক, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অনুবাদ করার মত কোন বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম নয় এটি। তবে ১৯৮৯ সালে প্রথম ছাপানো এই বইটি সমগ্র আমেরিকার গণ-প্রশাসন বিষয়ক পড়াশোনার পাঠ্যবই হিসেবে বহুদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখানে আমি যেটা করার চেষ্টা করবো সেটা হয়তো অনুবাদও বলা যাবে না সবসময়। কারণ চেষ্টা করবো অনুবাদের মাঝে বাংলাদেশের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরার ও আলোচনা করার। বইটির প্রায় অর্ধেক সিলেবাসের সাথে তাল মিলিয়ে পড়ে ফেলা হয়েছে আমার। মূলত সেখান থেকেই এই উদ্ভট চিন্তার উদ্রেক। বইটি গতানুগতিক পাঠ্যবই নয়। অর্থাৎ কড়া ভাষায়, কঠিন সব শব্দগুচ্ছ ও অনুচ্ছেদ দিয়ে বইটি বোঝাই করা হয়নি। লেখক মার্কিন সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক কর্মকান্ডকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন কেন সরকারী একটি দপ্তরের কর্মকান্ড বেসরকারী দপ্তর থেকে ভিন্ন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন পর্যায়ে তারা কিভাবে চিন্তাভাবনা করে? তাই মার্কিন নাগরিক না হয়েও এই বইয়ের বিষয়বস্তু বুঝতে বেশী বেগ পেতে হবে না। মনে হতে পারে মার্কিনি সরকার ব্যবস্থার উপর লেখা বই পড়া আমাদের জন্য কতটুকু সহায়ক? পড়তে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অভিমত হলো‌, সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার ভিন্নতা থাকা সত্বেও কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যগত ও আদর্শগত দিক দিয়ে — যথাঃ কংগ্রেস ও জাতীয় সংসদ, ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (IRS) ও ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভিনিউ (NRB), কিংবা যেকোন রাজ্যের ডিপার্টমেন্ট অফ মোটর ভেহিকেল (DMV) ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (BRTA) — এদের মাঝে বেশ খানিকটা মিল পাওয়া যায়। দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা ইত্যাদি বিভিন্ন অভিযোগ হয়তো বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তোলা যাবে কিন্তু বইটি পড়ার এক পর্যায়ে ভাবছিলাম বাংলাদেশের সরকারী সংস্থাগুলোর কথা। এবং আমার ধারণা একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী কেন ঘুষ গ্রহণ করছেন কিংবা দায়িত্বে অবহেলা করছেন এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব। বাংলাদেশে এই বিষয়ে যারা পড়াশোনা করেন বা পড়ান তারা এই বিষয়ে কতটুক লিখেছেন সেটা জানা গেলে ভালই হতো। হয়তো সামনে থিসিস এর কাজে সেই কাজগুলোও খুঁজে পড়ে দেখতে হবে। এই সিরিজ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অধ্যাপক বা গবেষকের লেখা এরকম কোন একাডেমিক জার্নাল আর্টিকেল কারো নজরে এসে থাকলে কিংবা সংগ্রহে থাকলে দয়া করে মন্তব্যের ঘরে জানাবেন। আমি বিশ্বাস করি নাগরিক হিসেবে গণ-প্রশাসনের কিছু মৌলিক বিষয় সবার জানা উচিৎ।
প্রথম পর্বঃ সংস্থা
অধ্যায় ১ – সেনাবাহিনী, জেলখানা, স্কুলঃ প্রথম ভাগ
১৯৪০ সালের মে মাসের ১০ তারিখ জেনারেল জিড ভন রানস্টেড (Gerd von Rundstedt) উনার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ফ্রান্স আক্রমন করলেন। পথে লুক্সেমবার্গ সম্পূর্ণ বিনা বাধায় ও বেলজিয়ামের দক্ষিণাঞ্চল পার হবার সময় স্বল্প পরিসরে বাধার সম্মূখীন হয় তার বাহিনী। এদিকে ১৩ মে এর মাঝে জেনারেল আরউইন রোমেলের অধীন ৭ম প্যানজার ডিভিশন ফ্রান্সের দি’ন্যা (Dinant) শহরের নিকট দিয়ে ও জেনারেল হাইন্টস (এর অধীন গোটা ১৯তম প্যানজার কর্প সেডান (Sedan) শহরের নিকট দিয়ে ম’জ (Meuse) নদী পার হয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করেছে। ১৪ মে জেনারেল হাইন্টস দুটো আর্মার্ড ডিভিশন পশ্চিমে পাঠালেন যেগুলো ১৯ মে এর মধ্যে শো’ম নদী অতিক্রম করে ইংলিশ চ্যানেলের নিকট অ্যাবেভিলি পৌঁছায়। মে মাসের শেষ নাগাদ জার্মান সেনাবাহিনী বৃটিশদের ডানকার্ক শহরের শক্ত ঘাঁটি থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। ২২ জুন ফ্রান্স আত্মসমর্পণ করে। ছয় সপ্তাহে জার্মান সেনাবাহিনী বৃটিশ, ফরাসি, ও বেলজিয়ান যৌথ বাহিনীকে পরাজিত করে। অনেকের মতে এটি ছিল আধুনিক যুগের সর্ববৃহৎ যুদ্ধ জয়।

এই জয়টি ছিল ব্লিট্জক্রিগ blitzkrieg বা আক্ষরিক অর্থে বজ্রসম যুদ্ধ বা lightning war তথা জার্মান সমর কৌশলের একটি সফল প্রয়োগ। সেনাবাহিনীতে পড়াশোনা করেছেন কিংবা সামরিক ইতিহাসবিদ যারা আছেন তাদের কাছে ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকলেও সাধারণ জনগন আমরা যারা এই নাম শুনেছি, তাদের কাছে শব্দটি এতটাই পরিচিত যে খুব সহজেই আমরা এই শব্দের আক্ষরিক অর্থটিকে জার্মান যুদ্ধ জয়ের মূল ব্যাখ্যা হিসেবে ধরে নেই। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান সেনাবাহিনী বলতেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে ক্ষিপ্র, দ্রুতগামী, হঠাৎ আক্রমণকারী ও সম্পূর্ণ যান্ত্রিক সেনাবাহিনী যারা শত্রুর প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অগণিত ট্যাংক ও বিমানের অতর্কিত হামলার সাহায্যে গুঁড়িয়ে দিয়ে শত্রুকে নিমেষে পরাজিত করতে সক্ষম। জার্মান সেনাবাহিনী কৌশলগত, রসদ সরবরাহ, সাংগাঠনিক দিক ও যুদ্ধ করার মনোবলের দিক দিয়ে ফরাসী সেনাবাহিনীর থেকে বহুলাংশে উন্নত। জার্মান সেনাবাহিনীর কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে সৈনিকদের মাঝে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বীজ বপন ও শক্ত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই ছিল ওদের সাফল্যের মূল পাথেয়।

প্রকৃতপক্ষে উপরের ব্যাখ্যাটির প্রত্যেকটি যুক্তি ভুল ভাবে উপস্থাপিত। একটি যুদ্ধ নিকটবর্তী এরকম ইঙ্গিত জার্মানি, ফরাসি ও বৃটিশদের বহু আগে থেকেই দিয়ে আসছিলো। ১৯৩৯ সালের সেপে্টম্বরে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করে বসে। সতর্কতা সরূপ ফরাসি ও বৃটিশ যৌথ বাহিনী সামনে অগ্রসর হয়। দীর্ঘ আট মাস ধরে যুদ্ধের আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্কতায় থেকেও যুদ্ধ না হওয়ায় যৌথ বাহিনীর মাঝে অবসাদ, আলস্য, ও মনোবলের ঘাটতি দেখা দেয়। কিন্তু পোল্যান্ড ও বেলজিয়াম দখল করে নেয়াটা যথেষ্ট রকমের উষ্কানি হিসেবে ধরে নেয়া যায়। ১৯৪০ এর মার্চ মাস নাগাদ ফরাসী গোয়েন্দারা সেডান শহরের অপর পাশে জার্মান সেনাবাহিনীর ভীড় জমানোর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এদিকে সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত ফরাসি সামরিক এট্যাশে নিশ্চিত করেন যে জার্মান সেনাবাহিনী রাইন নদীর উপর আটটি সেতু নির্মান করেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে ফরাসি গোয়েন্দারা অনুমান করে যে জার্মান সেনাবাহিনী ৮-১০ মে এর মাঝে সেডান আক্রমন করবে যা প্রকৃতপক্ষে শতভাগ সঠিক ছিল। এদিকে ফরাসি বিমান রেকি (air reconnaissance) ব্যবস্থা এতটা সংগঠিত ছিলনা। তাই এক ফরাসি বোমারু বিমান পাইলট এসে যখন জানালো সে প্রায় ১০০ কিলোমিটার লম্বা জার্মান গাড়ি বহর হেডলাইট জ্বালিয়ে আরডেনস (Ardennes) শহরের দিকে আগাতে দেখেছে তখন কেউ তাকে বিশ্বাস করে নাই অথচ আসন্ন যুদ্ধের সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল সেখানেই।

সংখ্যার তুলনায় আসা যাক। জার্মান সেনাবাহিনী আকারে প্রকৃতপক্ষে ফরাসি সেনাবাহিনীর চেয়ে ছোট ছিল এবং তাদের ফরাসীদের চেয়েও কম সংখ্যক ট্যাংক ছিল। ১৯৩৯ সালে ফরাসি সেনাবাহিনীর আনুমানিক ২,৩৪২ টি ট্যাংক ছিল যেখানে জার্মানির ছিল ২,১৭১ টি। সবচাইতে শক্তিশালী ফরাসী ট্যাংক গুলো আকারে জার্মান গুলোর বড় ছিল এবং শক্তিশালী ছিল। তবে জার্মান ট্যাংকের মত ফরাসী ট্যাংক গুলোতে রেডিও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। তাই দলবদ্ধ আক্রমনের ক্ষেত্রে ফরাসী ট্যাংক বহরের অনেক বেগ পেতে হতো। ফরাসী বিমানবাহিনী জার্মান বিমানবাহিনী থেকে খুব সরু দাগে দুর্বল ছিল। কিন্তু ফরাসি-বৃটেন-বেলজিয়াম যৌথ বিমানবাহিনী নিঃসন্দেহে জার্মানদের থেকে শক্তিশালী ছিল। যদিও জার্মান ট্যাংক বহর বা প্যানজার ডিভিশন, যারা প্রথম আঘাত হেনেছিল, শক্তিশালী ও সম্পূর্ণ যান্ত্রিক ছিল, কিন্তু জার্মান সেনাবাহিনী সামগ্রিক ভাবে মোটেও যান্ত্রিক ছিলনা। ব্লিট্জক্রিগ বলতেই ক্ষিপ্র ট্যাংক বহরের ভয়াল আক্রমনের চিত্র কল্পনার পাশাপাশি যে ব্যাপারটি আমরা অনেকেই ভুলে যাই সেটা হলো ১৯৪০ সালের জার্মান সেনাবাহিনীর বেশীরভাগ ছিল পদাতিক সৈন্যদের নিয়ে তৈরী যাদের রশদ সরবরাহ করার জন্য ঘোড়া টানা গাড়ি ব্যবহৃত হতো (১৯৪৩ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত একটি আদর্শ জার্মান পদাতিক ডিভিশনে ৯৪২ টি মোটরগাড়ি থাকতো এবং ১,১৩৩ টি ঘোড়াটানা রশদ সরবরাহকারী গাড়ি থাকতো। সেইসব সরবরাহকারী গাড়ি যেই পরিমান ডিজেল ও অন্যান্য তেল বহন করতো তার চাইতে দ্বিগুন পরিমান খড়-ভূষি বহন করতো ঘোড়ার খাদ্য হিসেবে।)

উপরন্তু ম’জ নদীর উপারে শত্রু প্রতিরোধ বেষ্টনী ট্যাংক কিংবা বিমান ভেদ করে নাই। সেটা করেছে পদাতিক বাহিনী, প্যাডেল চালিত রাবারের নৌকা দিয়ে নদী অতিক্রম করে। এই যুদ্ধে সেই পদাতিক বাহিনীকে নদীর ওপারে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে, খোলা ময়দানে শত্রুর মুহুর্মুহ গুলি পাশ কাটিয়ে সামনে আগাতে হয়েছে। অবশ্য পথ পরিষ্কার করার জন্য গোলন্দাজ বাহিনী, বিমানবাহিনী ও ট্যাংক বহর পিছনে থেকে সহায়তা করেছে কিন্তু যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাফল্য নির্ভর করেছে পদাতিক বাহিনীর সাফল্যের উপর।

যখন ফরাসি সেনাবাহিনীর প্রতি সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডাক দেয়া হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ওরা যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। সেনা নিয়োগ দপ্তর গুলোতে ছিলনা লম্বা লাইন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ঘা সদৃশ স্মৃতি তখনো মুছে যায় নি ওদের মন থেকে। ইতিহাসবিদ এলিস্টার হর্ন বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফরাসী স্লোগান ছিল, “যেভাবেই হোক, চলো শেষ করি এই যুদ্ধ।” তবে জার্মান সেনা নিয়োগ দপ্তরে জনগণ যুদ্ধে যাবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল এমনটি ভাববারও কোন কারণ নেই কারণ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি উভয় দিকেই সমান ছিল। তবে জার্মান রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর মাঝে নাৎসি চিন্তাধারার বীজ বপন করার চেষ্টা করেছিল এবং সামরিক কর্মকর্তাদের (যেমন এস এস ডিভিশন) ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিল। এক পর্যায়ে ইতিহাসবিদরা সর্বসম্মতিক্রমে দাবী করেন যে এই নাৎসি চিন্তাধারার সাথে জার্মান সেনাবাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্রের শক্তিশালী একতার কোন সম্পর্ক নেই। যদিও এই দাবীকে সম্প্রতি (১৯৮৯) নতুন করে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা করতে নাৎসি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যতই সফল হোক না কেন নাৎসি উগ্রপন্থী ধ্যানধারণা সেনাবাহিনীর প্রত্যেকটি সৈনিকের মনে কতটুকু দাগ কাটতে পেরেছিল এ বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। ১৯৪০ সালে জার্মানরা যেভাবে যুদ্ধ করেছে, ১৯৪৪ সালে পরাক্রমশালী যৌথ বাহিনীর আক্রমনপ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটার সময়ও একই ভাবে যুদ্ধ করেছে। এখানে নাৎসি উগ্র ধ্যানধারণার শক্ত ভূমিকা ছিল এরকম ভাবার কোন কারণ নেই। জার্মানিতে, পৃথিবীর আর যেকোন সেনাবাহিনীর মত, সৈনিকরা যুদ্ধ করেছে ও করছে ভয় এবং প্লাটুনের সহযোদ্ধাকে হতাশ না করবার ইচ্ছার মিশ্রণ থেকে।

আসল ইতিহাস বলে হিটলার ফ্রান্স আক্রমন করতে চেয়েছিলেন হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের মধ্য দিয়ে গিয়ে চ্যানেল কোস্ট দিয়ে প্রবেশের মাধ্যমে। ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল এরিক ম্যানস্টিইন জানালেন এই সমর কৌশলের লক্ষ্য স্পষ্ট নয় এবং এ দিয়ে ফ্রান্স আক্রমন সফল হবে না। তাছাড়া বেলজিয়াম আক্রমনের পরিকল্পনা বহনকারী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেলজিয়ানদের হাতে পড়ায় ফরাসি সেনাবাহিনী সতর্কতা সরূপ উত্তরে অগ্রসর হচ্ছে। ম্যানস্টিইন বেলজিয়ামের পরিবর্তে বেলজিয়াম-লুক্সেমবার্গ সীমান্তবর্তী আরডেনসের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আক্রমনের উপদেশ দেন। সমস্যা হলো এই ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিভাবে লক্ষাধিক সৈন্য, সহস্র ট্যাংক, ট্রাক পার হবে। এরপরে ম’জ নদী তো আছেই।

একদিকে শুধু একটি প্যানজার ডিভিশন ট্রেনযোগে পরিবহন করার জন্য প্রতিটিতে ৫৫টি বগি সহ ৮০টির মত ট্রেন লাগবে। ট্রেন পরিবহনের পর পুরো ডিভিশন যখন সড়ক পথে যাত্রা শুরু করবে সেটার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৭০ মাইলের মত এবং গতি থাকবে মানুষের হাটার গতির সমান। যেকোন ফরাসী পরিদর্শক বিমান এক পলক দেখা মাত্রই বলে দিতে পারবে এরা কোথায় যাচ্ছে। অপরদিকে একই প্যানজার ডিভিশন জঙ্গলের ভেতরের সরু রাস্তা, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করল‌ো। সামনের দিকে থাকা কোন একটি ট্যাংক নষ্ট হলে পিছনের শত শত ট্যাংক, ট্রাক আটকা পড়বে। ধরলাম দ্বিতীয় সিদ্ধান্তে কোন ঝামেলা হলো না। কোন বিমান দেখলো না, সরু রাস্তায় কোন ট্যাংক কিংবা ট্রাক নষ্ট হলো না, ৬০০ ফুট চওড়া নদীর ওপারের প্রায় খাড়া তীর বেয়ে উঠে, শত্রুর প্রতিরক্ষা বেষ্টনী ভেদ করে সামনেও আগানো গেল, তবেই সামনে খোলা ময়দান যা প্যারিস ও ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত বিস্তৃত। জার্মান ফিল্ড মার্শাল ফেডর ভন বক বললেন এই সিদ্ধান্ত স্রেফ আত্মঘাতি পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয় কারণ উত্তরে বেলজিয়ামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার বদলে পশ্চিমে আরডেনস জঙ্গলের মধ্যদিয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করলে সেনাবাহিনীর মূল অংশ ফরাসী ম্যাজিনো’ লাইনের (Maginot Line) ১৫ কিলোমিটারের মধ্য দিয়ে পার হবে এবং ফরাসি সেনাবাহিনী সেটা চেয়ে চেয়ে দেখবে এটা ভাবা অবান্তর। এরপরে সামনে প্যারিস পর্যন্ত ৩৪০ কিমি বিস্তৃত খোলা ময়দান ভাবো সেটাও বোকামী কারণ সেখানে অপেক্ষা করছে ফরাসি সেনাবাহিনীর মূল অংশ।

ম্যাজিনো’ লাইন, সমসাময়িক ইতিহাসবিদদের কাছে একটি উপহাসের বিষয়, কারণ ফরাসিরা এই নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করার সময় জার্মান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য সমর কৌশলের উপর বেশী জোর দিয়েছিলো। বিখ্যাত ম্যাজিনো’ লাইন ছিল কনক্রিটের তৈরী ফরাসী নিরাপত্তা বেষ্টনী যা লুক্সেমবার্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণা হতে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্বে সুইস সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা অসম্ভব। অন্তত ইতিহাস কিছুটা হলেও তাই বলে। তবে বেশীদিন সেই গর্ব করার সুযোগ হয়নি তাদের। এদিকে জার্মান সেনাবাহিনীও ম্যাজিনো’ লাইন সরাসরি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই বেষ্টনী থেকে পাল্টা আক্রমণ ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে তাদের। এদিকে ফিল্ড মার্শাল বক-এর যুক্তি কার্যকরী ঠেকে নাই হিটলারের কাছে। তাই আক্রমনের তিন মাস আগে হিটলার, জেনারেল ম্যানস্টিইনের আরডেনস জঙ্গলের উচ্চাভিলাসী কৌশলেই সায় দেন। অবশ্যই সেটি সফল হয়েছিল। ইতিহাস তাই বলে।

আমার মত যাদের ম্যাপের উত্তর দক্ষিণ নিয়ে সমস্যা হয় তারা এই ম্যাপটি দেখতে পারেন। কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন।

অধ্যায় ১ আগামী দুই পর্বে সমাপ্য

ভুল বানান, অসম্পূর্ণ বাক্য, অস্পষ্ট বাক্য চোখে পড়লে উদ্ধৃতি সহকারে মন্তব্যের ঘরে দেয়ার জন্য অনুরোধ রইলো।

৭ টি মন্তব্য : “আমলাতন্ত্রঃ সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া – ‍১”

    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      বইটা শুরু হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উদাহরণ দিয়ে। তারমাঝে শুরু করা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দিয়ে। এখানে যতটা না ইতিহাস বলা হচ্ছে তারচেয়ে বেশী আলোচনা করা হয়েছে কারণ গুলো। তবে স্বল্প পরিসরে এইটুকুও বেশ মজার। 🙂


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।