যেদিন আমার মৃত্যু হলো ……………

সংবিধিবদ্ধ সতর্কিকরন – জাতি, ধর্ম, বর্ণ, মত – কাউকে আঘাত দিতে লিখিনি। আঘাত পেলে ক্ষমা করে দেবেন। এটা আমি আমার কল্পনা থেকে লিখেছি, এই চরিত্রগুলো বাস্তব নয়। কেউ যদি চরিত্র বা ঘটনার মধ্যে বাস্তব কিছু খুজে পান, সেটাকে পাঠকের কল্পনাশক্তির বিশালত্ব হিসেবে গন্য করা হবে।
—————
আগের গল্প ——-
একজন অসুস্থ মানুষ
ও, আমি এবং আমরা ……

প্রতিদিন ঘুম থকে উঠে সবাই একটা ছক করে নেয়, আজকের দিনে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে। গত কয়েক সপ্তাহ, আমি ছক করতাম আমার খুব প্রিয় প্রেমগুলোর মধ্যে একটা নিয়ে, ফুটবল। কলেজে থাকতে দুটো বিশ্বকাপ পেয়েছিলাম। এখন ভার্সিটি জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ। গোটা হল জুড়ে শুধু ফুটবল নিয়ে আলোচনা। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকরা নাকি নিজেদের মধ্যে ক্যারাম বোর্ড খেলে খেলে বোঝার চেষ্টা করছে, কাদের প্রিয় দল জিততে পারে এই বিশ্বকাপ। আমি হলের যে ফ্লোরে থাকি, সেখানে দুয়েকজন বাদে সবাই ব্রাজিলের সমর্থক। সেই বেচারী দুয়েকজনকে সব সময় দৌড়ের ওপরে রাখা ছিলো আমাদের খুব প্রিয় একটা বিনোদন। মোটের ওপরে, জীবনের সেরা সময়গুলোর মধ্যে একটা কাটছিলো।

দুপুরে বারী ভাইয়ের রুমে বসে তর্ক হচ্ছিলো, সেনেগালের কাছে হেরে ফ্রান্সের যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে কিনা, তা নিয়ে। হঠাৎ পটকার আওয়াজে বারান্দাতে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কারা পটকা ফাটায়। কিছুক্ষন পরে একজন এসে জানালো, আমাদের ক্যাম্পাসে নাকি গোলাগুলি হয়েছে। আমাদের ক্যাম্পাসে গোলাগুলি ??!! – ছেলেটিকে উড়িয়েই দিলাম আমি আর বারী ভাই। কিছক্ষন পরে দেখি ও ফোন করেছে। ফোন ধরে জানতে পারলাম, আসলেই আমাদের ক্যাম্পাসে গোলাগুলি হয়েছে এবং আমাদের জুনিয়র একটা মেয়ে গুলিতে আহত হয়েছে। কাদতে কাদতে ও অনুরোধ করলো, রক্ত দিতে হতে পারে, আমি যেন প্রস্তুত হয়ে ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। কিন্তু হাসপাতালের কাছাকাছি গিয়েই বুঝলাম অনেক দেরী হয়ে গেছে আসতে অথবা হয়ত আমাদের হাতে আসলে কোনো সময়ই ছিলো না।

আজ আমরা সবাই ওই মেয়ের বাসায় যাচ্ছি সবাই মিলে মেয়েটিকে মাটির মধ্যে রেখে আসবো বলে। রশীদ নুপুরকে নিয়ে আসছে ওর বাসা থেকে। তিথী মেয়েটির বাসা চেনে, তাই কাজল আর আমি এসেছি তিথীর সাথে। মেয়েটির ব্যাচের একটা ছেলে, আবির আর অনুপকে নিয়ে এসেছে। আমরা বাসার কাছাকাছি একটা জায়গাতে একত্র হব, তার পরে সেখান থেকে সেই বাসাতে। বাসার কাছাকাছি পৌছাতেই আমার পা কাপতে শুরু করলো। আশ্চর্য …… আমি অবাক হয়ে ভাবি, তিন তিন বার ফাইনাল ওয়ার্নিং খাবার জন্যে প্রিন্সিপালের অফিসে যাবার সময়ও তো কখনো এরকম লাগেনি।

– এই তোরা যা, আমি আসছি।

সবাই ওরা আমার দিকে মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলো। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করি। আমার খুব ভয় লাগে, ইচ্ছে করে দৌড়ে পালিয়ে যাই। আমি জানি, আমাকে ওই গেটটা দিয়ে ঢুকতে হবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া দুজন মানুষকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কেউ বোধ হয় দেখছে না, ভেবে বার বার চোখ মুছতে থাকা কিছু বন্ধু বান্ধবকে। আমার খুব ভয় লাগে। কয়েকদিন আগে পড়া শুরু করা একটা বইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। লেখক এক যুদ্ধে মারা যাওয়া কিছু সৈনিকদের নিয়ে লিখেছিলেন, এক একটা চ্যাপ্টারে একেক জনের জীবন, একেকজনের মৃত্যু। দুটো চ্যাপ্টার পড়েই বইটা ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার খুবই ভয় লাগে।

হাতে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা লাগতেই সম্বিত ফিরে পাই। সেটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাপতে থাকা পা নিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। মেয়েটির মা হাহাকার করে কাদছেন। ভার্সিটির মেয়েগুলো কয়েকজন ওনাকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিতে দিতে কাদছে, আর, যা ভেবেছিলাম, ছেলেগুলো অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে। আমার নিজেকে হঠাৎ শকুনের মতন মনে হয়, যে লাশের গন্ধে ছুটে এসেছি। একই ভার্সিটিতে পড়ে এসেছি তার সাথে গত কয়েক বছর, বেচে থাকতে খোজ নেয়া থাকুক, চেনারও দরকার মনে করিনি। আজ এসেছি লাশ দেখতে। আমার মধ্যে আবার আতংক ভর করতে থাকে। পিছু হটতে হটতে দেওয়ালের সাথে মিশে যাবার চেষ্টা করি, এমন সময় চোখ পড়ল মেয়েতার বাবার ওপরে। নাড়ীছেড়া সব সন্তানের জন্যে মায়েরা মনে হয় একই রকম অনুভুতি পুষে রাখেন, আমি জানি না ব্যাপারটা ঠিক কিনা। তবে আমি জানি মেয়েরা তাদের বাবার জন্যে অন্যরকম। সব বাবারা তাদের সব সময়ের জন্যে ছোট্ট মেয়েটিকে ঘিরে সারা জীবন ধরে মনে মনে অনেক বিশাল বিশাল পরিকল্পনা করেন। বাবা ভদ্রলোকটি আমার মতই যেনো দেয়ালে ঢুকে যাবার চেষ্টা করছেন, দিশেহারা চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, বিশ্বাস করে উঠতে পারছেননা, যে আর কিছু পরেই তার মেয়েটিকে তিনি চিরতরে রেখে আসতে যাবেন। আমি জানি, তিনি স্রষ্টার কাছে অভিযোগ করছেন, নিতেই যদি হতো, তার মেয়ের বদলে তাকে নিলেই তো হতো। আচ্ছা, তাই যদি হতো, মৃত্যু মূহুর্তে, যখন নাকি চোখের সামনে সারা জীবনটা ভেসে ওঠে, উনি কি চিন্তা করতেন, যে, ইসস … মেয়েটার আরেকটু বড় হওয়া দেখতে পারলাম না অথবা মেয়েটার বিয়েটা দিতে যেতে পারলাম না ? আচ্ছা, ওই বইটার গল্পদুটোর সৈনিক দুজন জ্বলে ওঠা মাজল ব্লাস্ট আর তারপরে ধেয়ে আসা বুলেট দেখতে দেখতে শেষ কি চিন্তা করছিলো ? বাবা মার কথা ? অথবা স্ত্রী বা বন্ধু বান্ধবের কথা ? নাকি ছোট্ট ফুটফুটে সন্তানগুলোর কথা ? মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে চিন্তাগুলো ফেলে দেবার চেষ্টা করি। আমি আর এখানে থাকতে পারবনা। পালিয়ে যাবার জন্যে পা টিপে টিপে দরজার এগুতে গিয়ে নজর পড়লো অনুপের ওপরে, সে অবাক হয়ে দুই মুরুব্বীগোছের লোকের কথা শুনছে।

– আরে, ওই যে, পিছনের দিকে বাম দিক দিয়া চার নম্বর।
– ঐ, ফর্সা করে লম্বাটা ??
– হ। আমগো তমালের সাথে ভালা মানাইব। খোজ লাগাও তো মিয়া ……

হঠাৎ অনুপ আমাকে খেয়াল করে তড়িঘড়ি করে আমার হাত টেনে ধরে বাইরে নিয়ে গেলো। আশ্চর্য …… কি ভাবছে সে ? আমি বুঝি লোকগুলিকে গালাগালি করা শুরু করবো ? আমি তো খুশি …… কারন এই মাত্র টের পেলাম, এই আসরের আসল শকুন আসলে আমি না।

আসরের নামাজের পরে জানাজা। আমি আবির বা রশিদের মতন তেমন ধার্মিক না। তবে নামাজ না পড়তে পারি, মেয়েটার জন্যে প্রার্থনা তো করতে পারি। ও আমার হাতে নামাজের টুপি ধরিয়ে দিয়ে বললো,

– যা তুই। আমরা অনুপের সাথে আছি। তুই আসলে সবাই একসাথে ভার্সিটি যাবো।

আমি ক্লান্ত পায়ে আগাতে থাকি। এই মেয়েটার কি এটা প্রাপ্য ছিলো কোনোভাবে ? যারা আমাদের ক্যাম্পাসে গোলাগুলি করছিলো, তাদের কেউ তো মারা যেতে পারত এই মেয়েটির জায়গাতে। অথবা ঢাকার বাইরের একটা ভার্সিটির সেই ছেলেটা, যে বিশেষ সেঞ্চুরী করে তার ক্যাম্পাসে মিষ্টি খাইয়েছিল। নাহ … আমি এখন না হলেও একশত জনের কথা মনে করতে পারব, যাদের শুধুই একজন এই মেয়েটির জায়গাতে মারা গেলে, পৃথিবীটা অবশ্যই আর একটু সুন্দর হয়ে যেতো। এখন কিছুই আসে যায় না, কিছুই না। কেমন জানি ঘোরের মধ্যে
দেখলাম, জানাজা শেষে দাফনও হয়ে গেলো। দোয়া শেষে সবাই একে একে বিদায় নিচ্ছে। মেয়েটির ব্যাচমেট ছেলেগুলো এখনো বার বার মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখ মুছছে। আমার হাসি পায়, ইচ্ছে করে ওদের বলি, কাদতে ইচ্ছে করলে চিৎকার করে ডুকরে কাদো, কান্না চেপে রাখলে আমার মতই অসুস্থ যাবে এক সময়। জীবনে অনেক না করা হয়ে ওঠা ভালো কাজের মতই ওদেরও এটা বলা হয়ে ওঠে না আমার। আবির আর রশিদ ডাক দেয় আমাকে,

– চল দোস্ত।
– তোরা আগাইতে থাক, আমি আসতেসি।

রাকিন ভাইয়ের একটা কবিতা তখন থেকে মাথায় ঘুরছে —
মৃত্যুকে গর্ভে ধরেই জন্মেছিলো জীবন,
মৃত্যুও ধরে আছে বন্ধ্যা এক জীবনের ভ্রুন আপন জঠরে ……
—–
সে জীবনে সুখে থেকো বোন।
মেয়েটির বাবা এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার খুব কষ্ট লাগতে থাকে ওনাকে দেখে। ওনার ভাই, বোধ হয়, ওনার হাত ধরে টানতে থাকেন। হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কবরের ওপরের উচু মাটি জড়িয়ে ধরে ঊনি ডুকরে কেদে ওঠেন — মাগো ……… মা রে ………

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে আগের মতন প্রানোচ্ছল পরিবেশ নেই। কিছু ছেলে মেয়ে মেয়েটির খুনীদের শাস্তির দাবিতে অনশন শুরু করেছে। অনেক ছেলে মেয়ে ক্যাফেটেরিয়ার সীমানার দেয়ালের ওপরে মাথা নিচু করে বসে আছে। আমরা ভেতরে ঢুকে চায়ের অর্ডার দেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে চারিদিক থেকে আসা টুকরো টুকরো কথা শুনতে থাকি আমরা। তাদের মধ্যে কিছু কথা আমাকে হঠাৎ আমাকে অবাক করে,

– পুরা শো অফ শা … রা, অনশনের ভং ধরসে, রাইত আইলেই দেখবি বিরিয়ানির প্যাকেট মারতেসে।
– কি শুরু করসে এরা, লেখাপড়ার পরিবেশ আর রাখলো না। মারা গেসে দোয়া টোয়া করলেই তো হয় ………
কারা বলছে এইসব কথা ?? ঘুরে দেখি, আরে, পড়ার পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত ছেলেটা তো ওদের হলে জুয়ারী হিসেবে খুবই বিখ্যাত। আর শো অফের ছেলেটার কথা নাই বা বললাম। ও মৃদু গলায় বললো,

– বাইরে ওদের দেখে মন খারাপ হচ্ছে, ভেতরে এদের কথা শুনে হচ্ছে মেজাজ খারাপ। কি করি ……
আবির বললো,
– চল, বাইরে কোথাও চল। এই ক্যাম্পাসেই আর ভাল্লাগতেসে না।
– তোরা বাইরে ২০ মিনিট ওয়েট কর, যাস্ট হল থেকে আসব।

বিল মিটিয়ে দিয়ে আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি। মেয়েরা তিন জনেই হলের দিকে চলে যায়। আমরা আর বাকিদের মতন দেয়ালের ওপরে মাথা নিচু করে বসে থাকি। এক টিচার, কোন বিভাগের জানিনা, এসে যারা অনশন করছিল, তাদের গালাগালি করা শুরু করলেন। আমাদের আরেক বন্ধু, শাওন, খুব ভালো ছেলে বলে পরিচিত, সে দেখি তীব্র ঘৃণার চোখে ওই বয়স্ক টিচারটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি, তিন চার টার্মের জন্যে বহিষ্কার হয়ে যাবার ভয় মনে না থাকলে এতক্ষনে সে ওই টিচারকে একটা থাপ্পড় মেরে আসত।

– আচ্ছা, তোদের কি মনে হয় না, যে ভার্সিটিতে শিক্ষকদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেটা রিভাইজ করা উচিত।
আমরা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অনুপের দিকে তাকাই।
– এই যেমন ধর এই লোকটা, বস্তির মানুষের মতন গালাগালি করতেছে। কাদের করতেছে ? কিছু ছেলেপেলে একটা হত্যাকান্ডের বিচার চাইছে, তাদের করতেসে। যদি তার মেয়ে গুলিটা খাইত, তাইলে কি এই ছেলেগুলাকে …
আমি অনুপকে থামিয়ে দেই।
– দোস্ত, ফ্যাক্ট হলো তার মেয়ে গুলি খায় নাই, আর তিথী কল দিসে। চল অন্য কোথাও গিয়ে বসি।
ঠিক হলো কলা ভবনের সামনে গিয়ে বসব। রাস্তাতে এই শিক্ষকদের ব্যাপার নিয়ে অনেক তর্ক হলো, আসলে তর্ক বললে ভুল হবে, অনুপ একাই কথা বলে গেলো আমরা হাটতে হাটতে শুনলাম। রশিদ আর আবিরের সুবিধা হল, তারা দরকার মতন কান্নাকাটি করে হাল্কা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু অনুপ আর আমি কাদতে পারি না দেখে সহজে হালকাও হতে পারি না। কোনো কিছুর ওপরে ঝাল ঝাড়তে হয়। অবশ্য ওর কথাগুলোর সাথে এখন একমত নাহয়ে পারছিনা। শিক্ষকদের দায়িত্ব ছাত্র ছাত্রীদের ছেলেমেয়ে বা ভাই বোনদের মতন দেখা। আর এই সম্পর্ক বানানোর জন্য তাদেরকেই আগাতে হবে। বড়দের দায়িত্ব ছোটদের থেকে সন্মান আদায় করা। আমার চাইতে বয়েসে বড় বলেই কোনো লোককে আমার সন্মান করতে হবে, এইটা আসলে খুব ভুল কথা। তাকে প্রমান করতে হবে তিনি সন্মানের যোগ্য।

কলাভবনের সামনে আমরা গোল হয়ে বসে আছি। এখানে মৃত্যুর ছায়া নেই, শুধু আমরা কয়জনের মধ্যে ছাড়া। বটগাছটার নিচে যথারীতি বেশ কিছু জুটি বসে আছে, ওদের দেখে মনে হচ্ছে না দুনিয়াতে ওরা নিজেরা বাদে আর কেউ আছে। প্রত্যেকটা জুটি যেনো নিজেদের জন্যে দুজন মিলে একা একা থাকার একটা ছোট জগৎ বানিয়ে নিয়েছে।

— দুজন মিলে একা একা ?? কেমন ব্যাপারটা ??
— আমি শিওর না, তবে এদের দেখলে আমার এই কথাটাই মাথায় আসে …

নুপুরের মন মনে হয় এখনো খারাপ, রশিদের কাধে মাথা রেখে বসে আছে সে। ওদের দেখে ঈর্ষা হয়, সুখ দুঃখ শেয়ার করার জন্যে সম্পুর্ন নিজের একজন মানুষের কোনো তুলনা হয়না। মাথা ঘুরিয়ে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দেড় বছর আগে করা আমাদের পাকা ষড়যন্ত্রের ফসল এই প্রেম। আমরা পরিস্থিতি হাতে না তুলে নিলে মনে হয়না ওরা এখনো নিজেদের কাছে নিজেদের অনুভুতিগুলো স্বীকার করতে পারতো। আবির গুন গুন করে গান গাইছে,

কাম এন্ড গো উইথ মি টু দ্যাট ল্যান্ড, কাম এন্ড গো উইথ মি টু দ্যাট ল্যান্ড,
কাম এন্ড গো উইথ মি টু দ্যাট ল্যান্ড, হোয়্যার আই অ্যাম বাউন্ড, হোয়্যার আই অ্যাম বাউন্ড
………………………………………………………………………………………………………………………
আমরা চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনি। অনেক পুরাতন গান এইটা, আবির কোত্থেকে যে এই সব গান খুজে পায় কে জানে।

………………………………………………………………………………………………………………………
উই’ল অল বি টুগেদার ইন দ্যাট ল্যান্ড, উই’ল অল বি টুগেদার ইন দ্যাট ল্যান্ড,
উই’ল অল বি টুগেদার ইন দ্যাট ল্যান্ড, হোয়্যার আই অ্যাম বাউন্ড, হোয়্যার আই অ্যাম বাউন্ড

– এই লাইনটা আমার কাছে সুইসাইডিক মনে হয়।
তিথী বলে উঠলো। আমিও মনে মনে একমত হলাম। আবির হাসে, এই কথার উত্তর না দিয়ে বলে উঠল,
– তোদের কি মনে হচ্ছে আমরা পালায়ে আসছি, আই মিন, ভার্সিটির পরিস্থিতিটার থেকে ??
– কেনো মনে হচ্ছে তোর এমন ??
– এই যে যারা অনশন করছে তাদের কোনো সাহায্য করতে পারছিনা আর যারা ওদের গালাগালি করছে তাদের দুইটা থাপ্পড় দিতে পারছিনা …………
কাজল ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
– দেখ, তুই ভালো করেই জানিস, যারা অনশন করছে, তারা অনশন করতে করতে মরে গেলেও যারা ক্যাম্পাসে গোলাগুলি করেছস তাদের কিছুই হবে না। জাস্ট আরেকটা কোল্যাটারাল ড্যামেজ এর মতই দুই মাসের মধ্যেই সবাই এই ঘটনাও ভুলে যাবে। ওরা অনশন করতেসে বিচারের দাবীতে, খুব ভালো কথা, মনে কর বিচারও হলো ……… ফাঁসী হয়ে গেলো … কি লাভ ?? ফাঁসী দেবার জন্যে তুই আসামী কোথায় পাবি। খোজ নিয়া দেখ, আমাদের মামা-খালুরাই ওদের এর মধ্যেই বাইরে পাঠায়ে দিসে, থাকা খাওয়ার সুযোগ সুবিধা, টাকা পয়সা সব সহ।
আমি হেসে উঠে বললাম,
– হুমমম …… সরকারী স্কলারশীপের মতই। আসলেই শুধু শুধু লেখাপড়া করতেসি ……………
কাজল একটু কড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়,
– সে যাই হোক, আমাদের জন্যে যতটুকু করা সম্ভব আমরা সেটা করতে পারি। অনশন বা মিছিল করার সাহস নাই আমাদের … সত্যি কথা। যারা ওদের গালাগালি করতেসে তাদের থাপ্পড় দেবার সাহস নাই … সত্যি কথা। কিন্তু মেয়েটাকে একেবারে ভুলে না গিয়ে মনে রাখতে পারি ………

আবির একটু হতাশ গলায় বলে,
– কি লাভ?
– দেখ, আজকে ওরা এতো লাফালাফি কিভাবে করতেসে, পলিটিক্যাল ব্যাক বলে, সময় ওদের দিকে আছে বলে। সময় কি আমাদের আসবে না ? …………
আমার মোবাইল বেজে ওঠে। রিসিভ করে দেখলাম কাজলের আম্মা, কাজলের ফোন মনে হয় বন্ধ হয়ে আছে। কাজলকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম,
– বীরাঙ্গনা সখীনা, আপনার ফোন মনে হয় বন্ধ। আপনের আম্মিজান ফোন দিসে …………
ঝট করে আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে বললো,
– তুই যখন এইসব ফালতু জোক্স করিস, আমার মারাত্বক রাগ লাগে।

কথা শেষ করে জানালো বাসায় যাবে এখন। একে একে আমরা সবাই উঠে পড়লাম। কাজল আর তিথীকে রিকশা ঠিক করে দিলাম। রশিদ নুপুরকে নিয়ে যাবে। আবির আর অনুপ হলে ফেরার জন্য রিকশা ঠিক করছে।

– কি রে তুই যাবি না ??

ওদের মিথ্যা বললাম,
– আমি দেখি টিউশনির দিকে যাব, তোরা যা। আর ফোন দিস কিছু হলে।

ওরা সবাই চলে যায়। আমি হাটতে থাকি একা একা। মাথা থেকে ওই বাবা ভদ্রলোকটির কান্নার দৃশ্য মুছতে পারছিনা। ফুলার রোডের রাস্তার ধারে ঠিক পনের ফিট পর পর একেকটা করে অনেক জুটি বসে আছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন মানুষ মারা যাবে, কিন্তু তাই বলে জীবন থেমে থাকবে না। প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের উষ্ণতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করবে। কেউ কেউ ঝগড়া করবে, আবার সেই ঝগড়া মিটমাট করবে। মৃত্যু একেবারে ঘাড়ের ওপরে না পড়ে গেলে আসলে আমরা কেউ এই ব্যাপারে চিন্তা করিনা। আসলে সময় কোথায়? লেখাপড়া, একটু
ছাত্রজীবনের মৌজমাস্তি, যারা প্রেম করে তাদের জন্যে প্রেম, যারা করেনা তাদের জন্য পাখি দর্শন, বা কিছু আড্ডাবাজী …… খুবই জ্যাম প্যাকড শিডিউল। এর পরে আসবে চাকরি, ক্যারিয়ার। তারপরে সংসার, চাল-ডাল-তেলের হিসেব, বাচ্চাকাচ্চা, তাদের লেখাপড়া ………… আসলেই জীবিত মানুষদের ধরে রাখার সময়ও তো নেই।

ও এসএমএস করেছে, বেশি রাত পর্যন্ত যেনো রাস্তাতে না থাকি। এখনো জানালো না ও কাকে পছন্দ করে, ওই এক কথা, সময় হলে জানতে পারবি। নুপুরকে ধরেছিলাম একবার, ও এই ব্যাপারে কিছু জানে কিনা জানার জন্য। রীতিমতন অপমান করেছে আমাকে, বলেছে, আমি নাকি সাধারনত বুদ্ধি খরচ না করে কাজ করতে পছন্দ করি। আমাকে জানালে আমি নিশ্চিতভাবেই নাকি ওই ছেলের সাথে সম্পর্ক হবার সম্ভাবনা নষ্ট করে দেব। কি আর করা। ওকে ফিরতি মেসেজ পাঠালাম, দেখা যাক। আচ্ছা, ওকে কি আমার অনুভুতির কথা জানানো উচিত ? থাক, বেচারী তাহলে হয়ত আরও আরো কনফিউজ হয়ে যাবে। ও একেবারে বিয়ে শাদি করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যাক, তখন দেখা যাবে। তখন কোনো কনফিউশন থাকবে না।

ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে হলের দিকে ফিরছি। অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসলো,
– অয়ন বলছেন।
– জ্বী।
– ……… ফাউন্ডেশন থেকে বলছি। ভাইয়া একটা অপারেশনের জন্য রক্ত লাগবে ………
– কবে ?
– কাল সন্ধ্যাতে আসতে পারবেন?
– আচ্ছা।
– কাকে রক্ত দিচ্ছেন জানবেন না?
– কোন বিখ্যাত সন্ত্রাসী ?
খিল খিল শব্দে ওপ্রান্তের নারী কন্ঠ হেসে দিয়ে বলল,
– না ……
– তাহলে কি আসে যায় বলেন ? আচ্ছা কাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে আসবো তাহলে, বাই।

ফোনটা রাখার পরে মনে হল, আহারে, রোগীর পরিচয় জানার ছলে তো একটু গল্প করা যেত হয়ত। আসলেই বোধহয় আমি বুদ্ধি তেমন একটা খরচ না করেই কাজ করি।

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে মৃদু আলোয় অনশনকারী ছেলেমেয়েগুলো বসে আছে। ওদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। ছেলেটা মুখ শক্ত করে স্যালাইন প্যাকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিখুত কাপুরুষের মতন মাথা নিচু করে ওদের সামনে রাস্তা দিয়ে হলের দিকে চলে যাই। ওদের জন্যে আমার কিছুই করার নেই। কারন, মন হচ্ছে, ওই মেয়েটির মতই, আজ আমারও মৃত্যু হয়েছে।

—————————-
পরের গল্প —
বলতে চাই … তোমাকেই চাই
তুমি আজ ভালোবাসোনি ………
আজ কাজলের বিয়ে ………

৪,৮৪৯ বার দেখা হয়েছে

৩৯ টি মন্তব্য : “যেদিন আমার মৃত্যু হলো ……………”

  1. মাহফুজ (৯২-৯৮)

    এইটা কি সনির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে লিখেছিস? আমার এখনো মনে আছে দিনটি ছিল জুন ৮, ২০০২। পরবর্তীতে মনে হয় না বুয়েট এর ছাত্রী হলের নামকরণ সনির নামে করা হয়েছে। তোর লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে।

    জবাব দিন
  2. ভাইয়া কি সনি আপু'র মৃত্যু ঘটনা লিখছেন ??

    আপনার কথাগুলো সেই সময়কার বুয়েটিয়ানদের জন্যে ১০০% প্রযোজ্য কারণ আমার ২ রুমমেট '০০ ব্যাচের ছিল আর উনারাও ঠিক এরকমই বলছিলেন......

    খুব খুব সুন্দর লিখছেন ভাইয়া... একটানে পড়লাম...

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমি তখন প্রথম আলোর বার্তা সম্পাদক। সনির বাবা হাবিবুর রহমান সাহেব নিয়মিত আসতেন। তার সঙ্গে প্রতিবার কথা বলতে গিয়ে নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগতো। সনি হত্যার বিচারের দাবিতে উনি যা করেছেন, প্রথম আলো থেকে আমরা শুধু উনার পাশে থাকতাম। অনেকদিন দেখি না উনাকে।

    কিন্তু বাকি দেশটার কি হলো, মানুষগুলো- এই রাজনীতিবিদরা, বিচারকেরা??

    তোমার ভাষাতেই বলি,

    মৃত্যু একেবারে ঘাড়ের ওপরে না পড়ে গেলে আসলে আমরা কেউ এই ব্যাপারে চিন্তা করিনা। আসলে সময় কোথায়? লেখাপড়া, একটু
    ছাত্রজীবনের মৌজমাস্তি, যারা প্রেম করে তাদের জন্যে প্রেম, যারা করেনা তাদের জন্য পাখি দর্শন, বা কিছু আড্ডাবাজী …… খুবই জ্যাম প্যাকড শিডিউল। এর পরে আসবে চাকরি, ক্যারিয়ার। তারপরে সংসার, চাল-ডাল-তেলের হিসেব, বাচ্চাকাচ্চা, তাদের লেখাপড়া ………… আসলেই জীবিত মানুষদের ধরে রাখার সময়ও তো নেই।

    আসলেই ভেড়ার পাল আমরা!!


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    দিন দিন আপনার লেখা মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিচ্ছে :clap:


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    জটিল জটিল।
    তিন সেগ্মেন্টেরলেখা খুব সহজেই আলাদা তিনটা ব্লগ হতে পারতো। আবার সবগুলো যেভাবে একই সূত্রে আনলি :hatsoff: :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. মাহবুবা সোনিয়া (৯৭-০৩)

    ছাত্রী হল এখনো ছাত্রী হলই আছে, সনি হল হয়নি এখনো!!!!!
    সনি মনুমেন্ট আছে হল এর সামনে.... প্রতিদিন যাওয়া আসা করতাম সামনে দিয়ে........ কিন্তু কোনদিন ফিল করিনি এভাবে.......

    খুব ভালো লাগলো লেখাটা........

    জবাব দিন
  7. শহীদ (১৯৯৪-২০০০)

    পুরো লেখাটাই অসাধারণ সুন্দর। তার মাঝে খুব ভালো লেগে যাওয়া একটি লাইন-

    আমার চাইতে বয়েসে বড় বলেই কোনো লোককে আমার সন্মান করতে হবে, এইটা আসলে খুব ভুল কথা। তাকে প্রমান করতে হবে তিনি সন্মানের যোগ্য।
    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।