ইদানিং ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাফেরা করা হয় না। তাই ছবিব্লগ লেখার মত ছবি তুলতে পারছি না। গত গ্রীষ্মের মত এবার খুব একটা গায়ে বাতাস লাগিয়ে চলাফেরা করা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিং এর মেয়াদ ফুরিয়েছে গত বসন্তেই। তাই জীবিকার সন্ধানে সামার স্টুডেন্ট কাস্টডিয়ান হিসাবে কাজ নিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তম ছাত্রাবাসটিতে। বলে রাখি এই ছাত্রাবাসটির একটি বিশেষত্ব আছে। তা হলো এটি দৈর্ঘ্যে সিকি মাইল লম্বা অর্থাৎ কিলোমিটারে রূপান্তর করলে প্রায় ৪০০ মিটার। চিন্তা করলাম ক্যাডেট কলেজের এ্যাথলেটিক গ্রাউন্ডের ৪০০ মিটার ট্র্যাকে এক চক্কর ও এই ছাত্রাবাসের এক কোণা থেকে আরেক কোণা দৌড়ানো একই কথা। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ছাত্রাবাসে ডায়নিং হল, ছাত্রদের থাকার কক্ষ থেকে শুরু করে নিজস্ব জিমনেশিয়াম, সাময়িক থাকার জন্য হোটেল সুইটের মত কক্ষ সবই আছে। যা বলছিলাম, ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পরে সকালে জোরপূর্বক উঠার পুরোনো নিয়মে প্রথম ফিরে গিয়েছিলাম যখন নরসিংদী জেলা জজ আদালতে আইনজীবি ছিলাম তখন। তার দুই বছরে পরে আবারো ভোর পাঁচটায় উঠার অমানুষিক নিয়ম শুরু হলো কারণ, কাজ যোগ দেয়ার শেষ সময় ভোর ৬টা। প্রথম মাস বড় কষ্টে গিয়ে থাকলেও সাময়িক সবুজে ঘেরা এই ছোট শহরটিতে ভোর পাঁচটায় হেঁটে কাজে যেতে ভাল লাগে। তারপরেও নতুন কিছু পাচ্ছিলাম না। যা দেখি দেখছি তা গত দুই বছর ধরেই দেখে আসছি, বা ছবি হিসেবে তুলে ফেলেছি। দৈনিক আট ঘন্টার এই চাকুরীতে ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে রং মিস্ত্রির ভূমিকা সবই পালন করতে হয়।
আজকের দিনটি ছিল ভিন্ন। পাশেই ওয়াকার ফাইন আর্টস ভবন থেকে ডাক পড়লো একজন স্টুডেন্ট কাস্টডিয়ানের। সুপারভাইজার ড্যান জিজ্ঞাস করতেই কি মনে করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি রঙ করতে হবে। কাজটা খুব একটা আনন্দের নয়। যদিও এদের রঙে কটু গন্ধ নেই বললেই চলে, আছে উন্নত ধরণের যন্ত্র। বসে বা দাড়িয়ে থেকে রোলার টেনে যাও কাজ হয়ে যাবে। এই ভবনের অনুষদ বাকিদের থেকে ভিন্ন। ফাইন আর্টস মানেই মনন শৈলীর ব্যাপার। রঙতুলী, ক্যানভাস, ভাস্কর্যের হাতছানি। এই প্রথম যাবার পরে দেখি সাথে আরো আছে অডিও সিস্টেম বিল্ডিং, অডিও ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্কেস্ট্রা, জ্যাজ, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর পড়াশোনা করার সুযোগ। মিশিগান টেকে এসব বিষয়ে পড়ানো হয় গত দুই বছরে তা জানা হয় নি এই ভেবে বিরক্ত হলাম। অডিও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়া আদার ব্যাপারী ধরণের আগ্রহ বহু আগে থেকেই। যাই হোক এই ভবনের সুপারভাইজারের পিছু পিছু গেলাম একটি কক্ষে। দরজা খুলে দিতেই পা বাড়িয়ে দিতেই নোংরামি দেখে বিরক্ত হবার আগেই অদ্ভূত এক ভালোলাগা এসে ভর করলো। এই কক্ষটি একটি স্টুডিও। এখানে বসেই শিক্ষানবিশ শিল্পীরা তুলির আঁচড় বোলায় ক্যানভাসে, কিংবা চারকোলে কালো হয়ে যাওয়া হাতে নাক চুলকে সং সাজে কেউ। কেউ বা নরম চিনামাটি নিয়ে অদ্ভূত দক্ষতায় গড়ে তোলে পছন্দের ভাস্কর্য। মেঝে, দেয়াল, টেবিল চেয়ালের রঙের ছোপ, পোড়া দাগ, পেন্সিলের হিজিবিজি আঁকিবুকি। রসিকতা করে সুপারভাইজারকে বললাম, “Whats the point of painting a studio? Its already colorful and beautiful.” এক চোট হেসে নিয়ে বললো, “Good for you. You don’t have to be very careful. Just paint and leave.”
সুপারভাইজার চলে যেতেই ঘুরেঘুরে দেখা শুরু করলাম। হাতে চলে এল চলনসই ছবি তুলতে সক্ষম বুদ্ধিমান মুঠোফোন। আমি এর আগে কখনো স্টুডিওতে আসি নাই। অদ্ভূত এক অনুভূতি। শিল্পীদের সম্পূর্ণ, অর্ধেক কিংবা পরিত্যক্ত কাজ। কোনটাই ফেলে দেয়া হয় নি। খুবই আগোছালো কিন্তু পরে আছে একোণে ঐকোণে। প্রথমেই চোখ আটকালো চিনামাটির তৈরী এই ক্ষুদে রোবোটের দিকে। স্টারওয়ার্সের এই বিখ্যাত রোবোটকে চিনেনা এরকম লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কল্পনা করলাম, স্টারওয়ার্স প্রেমী কোন শিল্পীর মনের খেয়ালের ফসল এই চিনামাটির রোবটটি। মনে পড়লো হলিউড নায়িকা নাটালিয়া পোর্টম্যানের প্রেমে পড়েছিলাম স্টারওয়ার্স – এপিসোড ১ ফ্যান্টম মিনেস দেখে।
ভালোলাগাটুকু রেখে সামনে আগালাম। থমকে দাঁড়ালাম নিচের ব্স্তুটিকে দেখে। এই মহাশয় কোন যুগের বোকা বাক্স ধরতে পারলাম না। বাম কোণায় লেখা সলিড স্টেট। তড়িৎ কৌশলের ছাত্ররা হয়তো বলতে পারবেন। কিন্তু একি জাদুঘর নাকি স্টুডিও? হঠাৎ মনে পড়লো কেউ হয়তো স্টিল লাইফ আঁকার জন্য পাশের অডিও ল্যাব থেকে ধার করে এনেছে।
এই চেয়ারটিকে দেখে ভাল লাগলো। খুব আহামরি কোন কাজ নয়। কাজে অনেক স্থূলতা আছে কিন্তু সুন্দর। আবারো কোন এক শিল্পীর অদ্ভূত মনের খেয়াল। স্টুডিওর চেয়ার এভাবে রঙ করে ফেলা। কতই না মজার। আচ্ছা ওদের মনে হয় এই ধরনের পাগলামি করতে উৎসাহী করা হয়। উৎসাহ না দেয়া হলেও অন্তত কিছু বলা হয় না এটা নিশ্চিত। শৈল্পিক স্বত্বাকে বের করে আনতে যা অত্যন্ত জরুরী মনে হলো আমার কাছে। ভাল মতন পরখ করে মনে হলো ডান পাশের রঙের চলটা উঠিয়ে ফেলাটাও ইচ্ছাকৃত। হঠাৎ ঈর্ষান্বিত হলাম এরকম স্বাধীনতার প্রতি।
এরপরে ঘুরে ফিরে চেষ্টা করলাম বিভিন্ন কোন থেকে বিভিন্ন ছবি তুলে স্টুডিওর আবহটি তুলে ধরতে। নিচের ছবিগুলোতো তা কতটুকু ফুটে উঠেছে বলতে পারছি না। প্রতি কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাম না জানা রঙ, আঁকিবুকির জন্য নাম না জানা রাসায়নিক তরল, হরেক রকমের তুলি, পেন্সিল আরো কত কি। হাতের কাছে সবসময় রঙের কৌটা পাওয়া যাবে এমন হয়তো সম্ভব নয়। তাই কফি বোতলই সই। ওহ পিছনের যেই কাদামাটি লেগে আছে মনে হচ্ছে যেই দেয়াল সেটা সাদা রঙ করার দায়িত্ব পড়েছে আমার ঘাড়ে। অসম্পূর্ণ কাজের একটি অংশ। হয়তো পছন্দ হয়নি। কিন্তু ফেলেও দেয়নি। এ্যাক্রলিক সম্ভবত একধরনের রঙয়ের নাম। উঁচু দেয়ালে রঙ করার জন্য ছোট সিড়ি আছে সেগুলোর একটিতে উঠে স্টুডিওর একাংশ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ক্যামেরার ১৮ মিমি ওয়াইড এ্যাঙ্গেল খুব দরকার ছিল। তাহলে আরো অনেকটখানি নিয়ে আসা যেত ছবিটিতে। এরমাঝে পেয়ে গেলাম ছোট এই কাজটি। শৈল্পিক ভাবে কতটা উঁচু দরের কাজ সে বিতর্কে যাচ্ছিনা কিন্তু কাজটা খুব ভাল লাগলো এই ভেবে যে এই শহরের ইতিহাস এই ক্ষুদে ভাস্কর্যে অনেকখানি উঠে এসেছে। এককালে তামাখনির জন্য বিখ্যাত এই ছোট শহরটি ছিল একই সাথে তামা উৎপাদন ও পর্যটনের তীর্থস্থান। যে গড়েছে হয়তো তার পরিবারেই পিতামহ বা প্রপিতামহ ছিলেন তামাখনিতে কর্মরত। এতকিছুর মাঝে কিছু পুস্তকের অবহেলিত অবস্থান না থাকলে ষোল কলা পূর্ণ হচ্ছে না। আরো কিছু রঙের বাহার। মূলত সবই অ্যাক্রলিক দেখা যাচ্ছে। কোকাকোলার গেলাস, কফির মগ কোনটিই রঙ রাখার পাত্র হিসেবে ছাড় পায়নি।
আরো কিছু ছবি ছিল তবে পুনরাবৃত্তি হবে ভেবে আর দিলাম না। তবে সবশেষে নিজের তামাটের রঙের চাঁদ বদনের একখানা ছবি না দিলেই নয়। আমরা পার করছি এইজ অফ সেল্ফি। মানুষজন আন্তর্জাতিক থেকে ব্যক্তিগত প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাতিক্রম ধর্মী সেল্ফি তুলে আসছে। নেলসন ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ওবামার সেল্ফি কিংবা অস্কারে এলান ডিজেনারস সহ হলিউড তারকাদের সেল্ফি এখন বিখ্যাত। এত সব বিখ্যাতের মাঝে থাকুক আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাটি। অল্প কিছু কাজ ছিল। আজকেই শেষ করতে পারতাম। কিন্তু আরো একবার এখানে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না তাই কিছু কাজ বাকি রেখেই আজ এসে পড়েছি।
সাধারণত মানুষজন অগোছালো পছন্দ করে না। মেস, হোস্টেলে থাকা ছাত্ররা আগোছালো জীবন যাপন করে ঠিকই কিন্তু সেটা পছন্দের তালিকায় নয়, আলস্যের তালিকায়। আমার মনে হলো স্টুডিও এমন এক জায়গা যেখানে সাজানো গোছানো থাকা বড্ড বেমানান। গোছানো পরিস্কার স্টুডিও মানে এখানে কাজ হয় না। স্টুডিওর সৌন্দর্য অগোছালোতে, মেঝেতে দেয়ালে ছোপ ছোপ রঙে, আধা ভাঙা পরে থাকা তুলি পেন্সিলে, দুই মাস আগের অসমাপ্ত কাজের উপর জমা ধুলোয়।
দারুন লাগলো। জীবন পুরো ছকে বন্দি হয়ে গেছে অফিস-রুম, রুম-অফিস করে করে দিন পার হয়ে যাচ্ছে, বহুদিন ক্যামেরা হাতে নেয়া হয় না 🙁
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
প্রায় একই অবস্থার দিকে আগাইতেসিলাম ভাই। ছবি তোলাটাও একটা অভ্যাস। অভ্যাস করে নিতে হয় যদি ছবি তুলে তৃপ্তি পাইতে হয়।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
ডিব্বার ভিতরের সেলফিটা চাই 😀 😀
তুমি গেছো
স্পর্ধা গেছে
বিনয় এসেছে।
আচ্ছা ঐটা বাসায় আইসা দিতাসি। 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
অসাধারণ লাগলো মোকাব্বির।
বর্ণণা, ছবি -- সব।
:clap: :clap: :clap:
ধন্যবাদ নূপুরদা। :hatsoff:
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
Solid State ছবিটার ভেতরে তোমার বাঁ হাতে কি ব্রাশ?
হ্যা বলার পরে খেয়াল করলাম! 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
ছবি গুলা দারুন হইছে 🙂
ছবিগুলো দারূণ। ইদানীং রং-তুলি দেখলে নেশাবোধ হয়। :dreamy:
You cannot hangout with negative people and expect a positive life.
চমৎকার ছবি ব্লগ
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ধন্যবাদ জিহাদ! 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ