পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ১

কিছু কথাঃ বিপুল পরাক্রমে বিভিন্ন কোর্সের পেপার, এসাইনমেন্ট লেখার কাজ করে যাচ্ছি। আর শেষ সময়ের পূর্বে কাজ শেষ করার শেষ চেষ্টা করছি। খুব গোছানো কম্পিউটার ফাইলের মাঝেও আমার বাজে অভ্যাস হলো এই জায়গায় ঐ যায়গায় বিভিন্ন চিন্তা, গানের কথা, দিনলিপি লিখে রাখা এবং সেটা ভুলে যাওয়া। একটা ক্লাইমেট চেঞ্জ এডাপ্টেশান ফ্রেইমওয়ার্ক খুঁজছিলাম। ফোল্ডারে ঘুরতে ঘুরতে এসে দেখি একটা ফাইল নাম, “life at mtu” খুলে দেখি গত বছরের কয়েকদিনের দিনলিপি। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু রেকর্ডে থাকা দরকার তাই চোথা সিসিবির প্লাটফর্মে চালান করে দিলাম। দেখি এবারের পড়াশোনার ফাঁকে আরো কয়েক পাতা লিখা যায় কিনা।

০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (সোমবার) রাত ১০টা ২০ মিনিট
তন্বী আর আমার ছবিটার দিকে কতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম। ছবির ফ্রেমটা ওরই গিফট্‌ করা। বসুন্ধরা সিটিতে কেনাকাটা এবং ডেটিং এর ফাঁকে কিনে দিয়েছিল। ছবিটা সাবিহা আপার বাসায় ফেরদৌস ভাই তুলে দিয়েছেন। ইচ্ছাকৃত রোমান্টিক পোজের এই ছবিটা এখন আমার কাছে অনেক বেশী মূল্যবান। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। অনেক কিছু অনেক মানুষ ফেলে এসেছি। গত আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি মাস্টার্স করতে এনার্জি এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল পলিসির উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম মিশিগান টেকনোলোজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। ১৮৮৫ সালে চালু হওয়া এই মাইনিং কলেজ বর্তমানে বেশ বিখ্যাত একটি ইউনিভার্সিটি বিশেষ করে যন্ত্রকৌশল এবং তড়িৎকৌশল বিভাগের জন্যে। মোটামুটি নাগালের মাঝে অটোমোবাইল শিল্পের শহর ডেট্রয়েট রয়েছে তাই চাকুরীর জন্যে এখানকার ছাত্রদের শুনেছি বসে থাকতে হয় না। যাই হোক এর মাঝেই ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্ট বিখ্যাত টেক্সাস রাজ্য এবং মরমনদের রাজ্য ইউটাহ ঘুরে মিশিগান রাজ্যের এক প্রান্তে নিঃশব্দে দিনযাপন করতে থাকা হোউটন শহরে পৌঁছেছি গত ২৬ আগস্ট। গ্রীষ্মের মন্ত্রমুগ্ধ সবুজ নৈঃসর্গ এবং পোর্টেজ লেকের নান্দনিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে সময় হয়ে গেলো পড়াশুনা করবার। আগামীকাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আমার মাস্টার্সের পড়াশুনা সেই সাথে টিচিং এসিস্ট্যান্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন। গতকাল নিজেদের বাসায় উঠেছি। দুই বেডরুমের এই বাসায় আমি এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের দুই ব্যাচ জুনিয়র জোসেফ থাকছি আপাদত। বাসাটি মূলত একটি পরিত্যক্ত সিনেমা হল। নিচতলায় বাড়িওয়ালার ইনস্যুরেন্স কোম্পানী আর দুই তলায় আমাদের বসবাস। চলচিত্র এবং সঙ্গীত অনুরাগী এই বাড়িওয়ালা খুব ভালো একজন মানুষ। পুরোনো রেকর্ড সংগ্রাহক। আমুদে এবং আড্ডাবাজ এই মানুষের সাথে আড্ডায় বসলে সময় কর্পূরের মত ফুরিয়ে যায়। আজকেও গিয়ে বসেছিলাম উনার অফিসে। একটি ঘন্টা কোনদিক দিয়ে গেলো টের পাইনি। ভদ্রলোক আমাদের থাকার জন্যে বাড়ি সম্পূর্ণ মেরামত করিয়েছেন, রঙ করিয়েছেন, আমাদের খাবার সুবিধার জন্যে কিছু প্লেট, বাটি, চামচ দিয়েছেন এবং প্রতিনিয়ত সাহায্য করেই যাচ্ছেন। বাবা সিরিয়ান এবং মা বৃটিশ এবং নিজে স্থাবর গেড়েছেন আমেরিকায়, এ যেনো এক আন্তঃমহাদেশীয় মিশ্রণ। মধ্যবিত্ত পরিবারের পঞ্চাশোর্ধ এই ভদ্রলোকের সাথে যে কেউ গল্প করে আনন্দ পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

০৪ সেপ্টেম্বর ২০১২ (মঙ্গলবার) রাত ৯টা ১৮ মিনিট
নিকোলাস গতকাল আড্ডায় বলছিলো শতকরা ৯০ ভাগ স্নাতক ছাত্রদের সাথে কথা বলে আমার নাকি মনে হবে এরা কিভাবে এতদূর পর্যন্ত এলো? অনেক হেসেছিলাম কথাটায়। এখনো চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়নি তবে সে নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। নিকোলাস আরো বললো পড়াশুনার চাপ এখানে যতটা ভয় ভীতি সহকারে দেখানো হয় বাস্তবে ততোটা না। একি কথা অবশ্য ভাইয়াও বললো শুনলাম সেদিন। নিয়মিত পড়াশুনাই ভালো রেজাল্টের চাবিকাঠি কারণ শিক্ষকগণ কোর্স কারিকুলাম অনুসরণ করতে বেশ কঠোর পন্থা অবলম্বন করেন। আশা করি তাদের সাথে তাল মিলানো খুব একটা কষ্টকর কিছু হবে না। এর মাঝে বড় ভাই ফোন দিয়েছিলো অনেক্ষণ কথা হলো। উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। যা ভাবছি তাই হচ্ছে কি? উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেয়া মাত্রই ঠান্ডা ভেজা বাতাস এবং মেঘের মৃদু গর্জন একসাথে বৃষ্টির উপস্থিতি জানান দিলো। এই এলাকার আবহাওয়ার মতিগতি এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই। তবে সম্ভবত এ বৃষ্টি হেমন্তের বার্তা বয়ে আনছে। তন্বীর দেয়া চিঠিটা আবারো বসে পড়লাম। এখন পর্যন্ত কয়বার পড়েছি জানি না। যতবার পড়ি ততবার নতুন করে এক ভালো লাগার সূচনা হয়। ওই লোভেই অনিয়মিত বিরতিতে রিভিশান দেই। সেদিন বলছিলো পরীক্ষা শেষ হলে নতুন একটি লিখতে বসবে। ঠিকানা দিয়ে এসেছি। বলেছি চিঠি লিখতে ডিয়ার জন মুভির মত। তন্বীর খুব প্রিয় একটি মুভি এটি।

দিনটি ব্যস্ত গিয়েছে। সকাল ৮টা ৩০মিনিট থেকে বিকাল ৪টা ৩০ পর্যন্ত টানা চলেছে ক্লাস। এর মাঝে টিএ ক্লাসে প্রথমবারের মত গেলাম। ৩৫জন ছাত্রছাত্রীর এই ক্লাসে শিক্ষক যখন পরিচয় করিয়ে দিলো আমাকে তার টিএ হিসাবে এবং আমাকে সুযোগ দিলো কিছু কথা বলবার, তখন বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম। তবে শুরু করা মাত্র যখন তাদের মাথা ঝুঁকিয়ে আমার কথা অনুসরণ করতে দেখলাম তখন অন্তত শান্তি পেলাম যে না এরা সবাই আমার কথা বেশ ভালো মতই বুঝতে পারছে। অন্তত যেকোন চীনা ছাত্রের চেয়ে কিছুটা হলেও ভালো আমার ইংরেজী বলার ক্ষমতা। দুপুরে এবং রাতে পিৎজা দিয়ে চালিয়ে দিলাম। এখনো অনলাইন অর্ডারের বাসনকোসন, হাঁড়ি পাতিল এসে পৌঁছায়নি তাই সহজ তড়িকার খাবার উপর দিয়েই চলছে আমার আর জোসেফের জীবন। আশা করি কাল পরশু নাগাদ সব এসে পৌঁছে গেলে স্বাভাবিক খাদ্যভ্যাস গড়ে তুলতে পারবো। আপাদত কিছু পড়াশুনা করা যাক। কালকে আবার সোস্যাল সিকিউরিটি অফিসে যেতে হবে নাম্বারের জন্যে আবেদন পত্র নিয়ে। আবেদন না করলে আবার বেতন পাওয়া সম্ভব না। তাই নিজের গাঁটের পয়সা ফুরিয়ে যাবার আগেই এই কাজটি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা যায় ততই মঙ্গল। সুখের বিষয় হলো আগামীকাল আমার কোন ক্লাস নাই।

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (শনিবার), দুপুর ১টা ৪০মিনিট
বিদেশে এসে প্রথম উইকেন্ড। এখানে শনি-রবি ছুটি আর বৃহস্পতিবার কাজের চাপ কম থাকে। গতকাল রান্না করে ঘুমাতে বেশ দেরী হয়ে গেলো। তন্বীর সাথে কথা বলছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে নাস্তা খেয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে এর মাঝে তন্বীর সাথে আবার কথা বলছিলাম। ও বলছিলো আমাকে লেখা চিঠিটা নতুন করে লিখতে চায় কারন আগেরটাতে এমন কিছু লিখেছে যেটা পড়ে আমার খারাপ লাগতে পারে। কেনো যেনো তার সাথে খুব ভাব-গাম্ভীর্য নিয়ে বেশ কিছু কড়া কথা বলে ফেলেছি যেটা সম্পূর্ন রূপে অযৌক্তিক ছিলো। ফলস্বরূপ রাগ করাটাই স্বাভাবিক এবং অনেকটাই রাগ করেছে এবং এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কতটা কষ্টকর তার জন্যে। মুখের উপর অনেক কিছুই বলে দেয়া যায় সহস্র মাইল দূরে থেকে কিন্তু সেটা অপরপ্রান্তে কতটা কঠিন শোনায় সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা বেশীর ভাগ সময় থাকে না। আশা করি ক্ষমা আমাকে করবে সে। ভালো লাগছে না। ভালো লাগার কথাও না। পড়াশুনা কিছু বাকি আছে। দেখি শুরু করি। এর মাঝে তার রাগ কমে আসলে সুখবর আর না আসলে খুবই দুঃখের খবর।

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (রবিবার), সন্ধ্যা ৮টা ১০মিনিট
উপরে সময়ের ঘরে ৮টা ১০মিনিটকে সন্ধ্যা বললাম দেখে নিজেরই কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। কারণ সূর্য ডুবেছে মিনিট আটেক আগে। বেশ কিছুদিন ধরে লিখতে পারলাম না। কাজ, পড়াশুনা ইত্যাদি মিলিয়ে সময়ের সংকুলান হয়নি। সেটা ব্যাপার না। গতকাল (আসলে বলতে গেলে আজকে) ঘুমিয়েছি ভোর ৬টায়। দুই দফায় বাংলাদেশী ছাত্র/বন্ধুদের সাথে ম্যারাথন আড্ডা চললো আমার বাসায়। রান্না করেছিলাম তাই কিছু খেতে দিতে পারি নাই এই লজ্জায় পড়তে হয়নি। সন্ধ্যার দিকে এসে হাজির হলো মামুন এবং আসিফ। হাল্কা পাতলা গড়নের লম্বা চুলের একটা ছেলে। খুব দ্রুত কথা বলে। চুল লম্বা কারণ চুল কাটাতে ভালো লাগে না এবং খরচটাও নেহায়েত কম না। মামুনের বাসায় আমি হুটনে এসে উঠেছিলাম প্রথম কয়েদিনের জন্যে। সঞ্জয়দা, মিন্টুদা এবং মামুনরা থাকে এক বাসায়। বয়সে এক বছরের ছোট ছেলেটি আমার কাছে ভালো লাগে। কথাবার্তায় চটপটে, চলচিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে ভালো জ্ঞান আছে এবং পছন্দ করে। চট্রগ্রামের ছেলে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ার সখ ছিলো ছোটবেলা থেকেই কিন্তু চোখের সমস্যার কারনে পারেনি। গতকালের আড্ডায় তার মতে এটা তার জীবনের একমাত্র ব্যর্থতা। হয়তো এই কারণে ক্যাডেট সার্কেলের সাথে তার উঠা বসা বেশী। দেশে থাকতে ছোটভাই ইকবাল, হোসেনদের কাছে শুনেছিলাম ওর কথা। পড়েছে বুয়েটে যন্ত্রকৌশলে। মিশিগান টেক-এও যন্ত্রকৌশলের উপর মাস্টার্স করতেই এসেছে গত সেমিস্টারে।

আসিফ স্বাস্থ্য ভালো কিছুটা গোলগাল, চশমা পড়ে আমার মত। চোখে মুখে সবসময়েই একটা হাসি লেগে থাকে। দেখতে ভালো লাগে। এই বাসাটি আসিফের খুঁজে ঠিক করে দেয়া। এ নিয়ে কৃতজ্ঞতার শেষ নাই আমার। ভালো ছেলে। পড়াশুনা করেছে আই,ইউ,টি তে তড়িৎকৌশলে। বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবে কিন্তু যুদ্ধ করে বের হয়ে এসেছে বলছিলো গতকাল। ভ্রমনপিপাসু একটি ছেলে। গল্প শুনলাম বিভিন্ন ভ্রমনের। মিশিগান টেক-এ এসেছে তড়িৎকৌশলের উপর পি,এইচ,ডি করতে। এটা তার দ্বিতীয় বছর।
গতকালের আড্ডার বিষয়বস্তু বেশ খানিকটা এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছে। প্রাত্যহিক জীবন দিয়ে শুরু হয়ে কোন এক ফাঁকে সেটা চলে গেলো সুইসাইড এবং ডুর্খেইমিয়ান থিওরীর উপর, এর মাঝে ফেরত আসলো ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার সমাজে প্রত্যক্ষ অবদান কার। তর্ক এখান থেকে আবার হঠাৎ এক লাফে চলে গেলো ফ্রয়েডের ইডিপাস কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে আরো কিছু দাঁত ভাঙা মানসিক রোগের আলোচনা পর্যালোচনা শেষে ফেরত আসলো প্রেম ভালোবাসা সম্পর্কের উপর। জানতে চাইলো তন্বীর কথা। কমিটমেন্ট, লয়ালটি, বিয়ের বয়স, দুজনার মাঝে বয়সের পার্থক্য পক্ষে বিপক্ষে, স্টেরিওটাইপ চিন্তাধারা ইত্যাদি নিয়ে মামুন আর আসিফের তুমুল তর্ক চললো রাত তিনটা পর্যন্ত। এরপর খেয়ে নিয়ে শুরু হলো আবার দ্বিতীয় দফায়। চলচিত্র, গান ইত্যাদি নিয়ে চলতে চলতে একটা সময় আসিফ ঘড়িতে সময় দেখে লাফ দিয়ে উঠে বিদায় নিলো অবশেষে। ঘুম থেকে উঠতে দুপুর হয়ে গিয়েছিলো। কিছু খেয়ে পড়তে বসেছিলাম। তারপরে আবার একটু ঘুমিয়ে এখন উঠে তেলাপিয়া মাছ, সবজী মাশরুম দিয়ে রান্না করে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে আসবো। আপাদত পড়তে বসি। বেশ কিছুটা বাকি আছে।

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (মঙ্গলবার), সন্ধ্যা ৭টা ৩৮মিনিট
উদ্ভট এক লুপে পড়লাম। জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা যেটা বিটিভির অধিবেশন শেষে দেখার জন্যে ছোট বেলায় অপেক্ষা করতাম। যেকোন সময় শুনলে একটা শিরশিরে ভালো লাগা অনুভূতি তৈরী হয়। তবে আজকে উপভোগ করছি অন্যভাবে। এক এক সময় এক একটি বাদ্যযন্ত্র অনুসরণ করছি। তবে যেটা বুঝতে পারলাম এই গানটিতেও রবি ঠাকুরের সুরে বিলেতি সঙ্গীতের অনুপ্রেরণা চলে এসেছে। শুধু গানটি শুনলে হয়তো আমার মত সাধারণ শ্রোতার কাছে ধরা পড়বে না। কিন্তু অর্কেস্ট্রা মন দিয়ে শুনলে চরণের শেষের ফিলার গুলো প্রতিবার জানান দিয়ে যাচ্ছে বিলেতি ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের আবেশ। গতকাল রাতে ঘুমাইনি। তন্বীকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। এই ব্যারমটা ইদানিং কালের। আগে শুধু দেখতে ইচ্ছে করতো এখন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। গতকাল মাছ ভাজতে গিয়ে ওর কথা ভেবে ডুবে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। মাছের পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। কি যে হচ্ছে। এই মেয়েটা আমার জীবন নষ্ট করে দিলো। তবে সেটা ভাল কিন্তু তারপরেও এই যে ওর অনুপস্থিতির বুক চৌচির করা দুঃখ এটাতো বজ্জাতটা আর দেখছে না। তবে ওরও হয়তো খারাপ লাগে। সেদিন হঠাৎ ওদের ভোর বেলায় মেসেজ “Ms. U”. বুঝতে পারলাম বাংলার মার্গারেট থেচারের মন বিচলিত ভোরবেলায় ঘুম ভেঙ্গে। অনুভূতি প্রকাশ – সে খুব সহজে হয় না উনার। যাই হোক। রান্না করতে ফেরত যাই।

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২ (বুধবার), বিকাল ৫টা ০৫ মিনিট
ডিপার্টমেন্টে বসে আছি। আজকে ক্লাস নাই তবে সন্ধ্যা ৭টায় একটি ক্লাস আছে আমেরিকান রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর। ক্লাস নিবেন প্রফেসর ম্যারী ডারফি। খুবই আমুদে স্বভাবের একজন মানুষ। সব সময় হাসছেন, কথা বলছেন। উনার মুখের সাথে শরীরও কথা বলে যে কারণে দেখতে ভালো লাগে। অনেক কিছু জানেন উনার বিষয়ে। শুনেছি আন্তর্জাতিক আইনের উপর নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকেন উনি। চিন্তা করছি আগামি সেমিস্টারে দেখবো নেয়া যায় কিনা। এই ক্লাসটি করা লাগছে আরেকটি ক্লাসের পরিপূরক হিসেবে। মানে এনভায়রনমেন্টাল পলিসি অ্যান্ড পলিটিক্স এই বিষয়টি পড়তে গেলে আমেরিকান রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর সম্যক ধারণা থাকাটা জরুরী। তবে যেটা বুঝলাম বাকি ছাত্রদের খুব একটা আগ্রহ নেই এই ক্লাস করাতে। আমার জানতে ভালো লাগে। যেই কারণে প্রায়শই আঁতেল উপাধিটা আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। তবে বিশেষ বিচলিত নই আমি এ ব্যাপারে। গত কয়েকদিন ধরেই আক্কেল দাঁতের ব্যথা বেশ যন্ত্রণা করছে। যদিও রুট ক্যানালিং করে ঠেকা দেয়া হয়েছে কিন্তু মাঝে মাঝেই মাড়ি ফুলে যাচ্ছে। তবে যেটা হয় এক থেকে দেড় সপ্তাহের মধ্যেই ব্যথা চলে যায়। কিন্তু এবারে বুঝতে পারছি না। দেড় সপ্তাহ হয়েছে কিনা। যাই হোক তাড়াতাড়ি সেরে যাক এই চাই।

১ অক্টোবর, ২০১২ (সকাল ১১টা ২০মিনিট)
গতকাল রাত ৯টা থেকে টানা আজকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। শেষে ঘুম ভাঙলো মুঠোফোনের ক্রমাগত শব্দের কারণে। এর মাঝে কোনটা ছিলো ইমেইলের শব্দ, কোনটা ব্যক্তিগত মেসেজ, কোনটা ফেইসবুক নোটিফিকেশান এবং সবশেষে কর্কশ শব্দে বেজে উঠা এলার্ম। সবগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে চিন্তা করছিলাম কতক্ষণ ঘুমালাম। বের করার আগেই ক্যালেন্ডার নোটিফিকেশান টিএ অফিস আছে আজকে ১০টা থেকে ১২টা। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। এই সপ্তাহটা বেশ ধকল যাবে আমার উপর দিয়ে। যেই বিষয়ের টিচিং এসিস্ট্যান্ট আমি সেটার একটা পরীক্ষার খাতা দেখতে হবে। আগামীকাল একটা পরীক্ষা আছে নিজের যেটার সিংহভাগ চ্যাপ্টার পড়ে দেখিনি এখনো। একটা বিষয়ের রিসার্চ টপিক জমা দিতে হবে আরেকটার জরিপের প্রশ্ন। আর সেই সাথে ক্লাসের আগে দিয়ে দেওয়া চ্যাপ্টার গুলোতো আছেই।
বিলাতি কিংবা মার্কিনি শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিষয়টি আমার কাছে বেশ উপযুক্ত মনে হয়। ক্লাসের আগে চ্যাপ্টার দিয়ে দেয়া এবং ক্লাসে সেটা এবং সাথে আনুষাঙ্গিক বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা। এই পন্থা অবলম্বন করতে গেলে আপনা থেকেই ক্লাসে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং আমার মতে ছাত্ররা ক্লাসে বেশি জানতে পারে। কারণ ১) যদি পড়ে আসে তাহলে সেটার উপর আলোচনার ভিত্তিতে সেটা মাথায় ভালোভাবে গেঁথে যায়, ২) যদি না পড়ে আসে তাহলে সবার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর যদি দেখা যায় বেশীরভাগ ছাত্র ক্লাসে পড়ে আসছে না সেই ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ দেখেছি ছোট এসাইনমেন্ট কিংবা ক্লাস টেস্টের স্মরণাপন্ন হন। এতে ছাত্ররা আবার পড়াশোনায় মন দেয়।

২৩ অগাস্ট, ২০১৩ (দুপুর ১২টা ৫৬মিনিট)
মাঝে বড় সময় চলে গিয়েছে। প্রায় একবছর। প্রতি বছর, প্রতি সময় যখন চিন্তা করেছি হ্যা এবার নিয়মিত দিনলিপি লিখবো। প্রতিবার থেমে যাই। যাই হোক অাবার শুরু করি। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ থেকে ক্লাশ শুরু হচ্ছে ফল সেমিস্টারের। সকালে নতুন বছরের বাড়ি ভাড়ার চুক্তি নবায়ন করতে গিয়ে দেখি মিশিগান সরকার পানির দাম দ্বিগুণ করেছে গত একবছরে। চিন্তিত বাড়িওয়ালা অনুরোধ করেছে বাড়ি ভাড়ার সাথে মাসে ২৫ ডলার যোগ করতে। কিছু করার নেই। অামি ও অামার রুমমেট জোসেফ (ফকক, ০৬) এই এলাকায় থাকতে পছন্দ করি। অবস্থানগত সুবিধার কথা চিন্তা করলে তুলনায় বাড়ি ভাড়া এখনো কম। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় এই সেমিস্টার থেকে নতুন ফন্দি করেছে ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা উপার্জনের। অান্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য প্রতি সেমিস্টারে ১৫০ ডলার সারচার্জ। প্রদত্ত ইন্সুরেন্স সুবিধায় কোন পরিবর্তন অানা হয়নি অথচ দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৪১৯ ডলার। এদিকে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়া লাগবে একটি অাইনী বিষয় সমাধান করতে; তাতে বিমান ভাড়া বাবদ চলে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ ডলার। তাও যেতে গিয়ে সেমিস্টারের শুরুর ক্লাশ করা হবে না। ব্যাপারটা খুব একটা ভাল কিছু না। সব মিলিয়ে মানসিক যন্ত্রণাতে অাছি। দেশে দিনের পর দিন পকেটে ‍‍১০০৳ এর নিচে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি কখনো চিন্তিত ছিলাম না। থাকার প্রয়োজন ছিলনা। এখানেও পকেটে টাকা থাকেনা। থাকে চৌকো প্লাসটিকের একটি টুকরো। কিন্তু সেটাও ভুগছে অপুষ্টিতে অার তা নিয়ে দিনরাত উদ্বিগ্ন থাকা লাগছে। অাপনজনহীন বিদেশের মাটিতে দৈন্যতার বিলাসিতা মানায় না। তবুও অাশা রাখি ঝড়ের শেষে অালো ফুটবে। হাল্কা মেঘে ঢাকা অাকাশে রংধনুর দেখা মিলবে। তবে অাপাদত সংশয়পূর্ণ জীবন অাগামী ঘোষণা দেয়ার অাগ পর্যন্ত চলতে থাকবে।

১,৪৪৯ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ১”

  1. নাফিস (২০০৪-১০)

    দিনলিপি পড়তে সব সময় ই অসাধারণ লাগে। :thumbup: এই দিনলিপি আর ব্লগর ব্লগর টাইপের লেখা গুলো পড়তে গিয়েই তো সেই ২০০৯ এর শেষের দিকে প্রথম সিসিবি র সাথে পরিচয়।
    সামনের সপ্তাহে ফাইনাল শেষ হওয়ার একটা সফরে বের হচ্ছি। আম্রিকার পথে ! ওই রোড ট্রিপের সময় ভাবতেছি ডায়েরি লিখে রাখবো। পরে সিসিবি তে দিয়ে দিবো। ক্লাস ইলেভেনের শিক্ষাসফরের সময় খুটিনাটি অনেক কিছু লিখে রেখেছিলাম। ডায়েরিটা পরে হারিয়ে গেছে। যাই হোক, তখন তো আর সিসিবি ছিল না ! এবার হারাবে না আশা করি ! 🙂
    আর অন এ সাইড নোট, সকল নারীর ই উচিত আপনার প্রেমিকার প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া। ডেঞ্জারাস অবস্থা ভাই :gulli2: :gulli2:

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      :shy: :shy: :shy: :shy: নাহ জগতের সব নারীই ঈর্ষা করার মত! :shy: :shy:

      দয়া করে খাতায়, টিস্যু পেপারে যেখানো পারো কিছু লিখে রাইখো। স্প্রিং ব্রেকে উতাহ গেলাম, ভেগাস গেলাম কিছু লিখিনি। তাও কপাল ভাল ছবি তুলেছি। সেগুলো দেয়া যাবে।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    রোববার রাতে এতক্ষণ জেগে থাকার পাপটা পেয়ে বসেছে -- ঘুমাতে যেতে হবে, তাই পুরো না পড়েই কমেন্ট করছি।
    নস্টালজিক লেখা। পড়াশোনা শেষ করো। তোমার মায়ের কাছে, প্রেমিকার কাছে ফিরে যাও -- আর ফারুকের মত চিৎকার করে বলো -- "আমি পাশ করেছি"
    😛 😛

    জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    আলসেমি করে দিনলিপি লেখা হয় নাই আমার কোনদিন। আপনের লেখা পড়ে এত ভাল লাগলো যে ভাবছি আজ থেকেই শুরু করে দেবো। 🙂

    আম্রিকা যাওয়ার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে। না, পারমানেন্টলি থাকার জন্য নয়। ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে। (সম্পাদিত)


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  4. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    পড়তে পড়তেই শেষ! আরো কয়েকটা দিনের দিয়ে দেন।

    ঝড়ের শেষে অালো ফুটবে। হাল্কা মেঘে ঢাকা অাকাশে রংধনুর দেখা মিলবে।

    জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  5. মামুনুর রশীদ খান(২০০১—২০০৭)

    " আগে শুধু দেখতে ইচ্ছে করতো এখন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।"......
    "কি যে হচ্ছে। এই মেয়েটা আমার জীবন নষ্ট করে দিলো।"

    অনিরামেয় ব্যারাম ভাই।


    ক্যাডেট রশীদ ২৪তম,প ক ক

    জবাব দিন
  6. হারুন (৮৫-৯১)

    কথা ছিল শুধু ছুঁবে একখানি হাত
    তুমি চাও তারাভরা সবক'টি রাত,
    বলেছিলে এনে দেবে মেঘরাঙা ফুল
    নিয়ে এলে মেঘমালা ভাসে দুই কুল।

    বলেছিলে শুধু ছুঁবে মেঘকালো কেশ
    তুমি ধরো দেহজুড়ে সব মহাদেশ,
    মুখে বলো দেবে তুমি এক নদী জল
    লুটে নিলে দুই হাতে এই ধরাতল।


    শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।