কিছুকথাঃ এই ঘটনার বয়স এক বছরের বেশী। গত বছর মার্চে ঘটে যাওয়া কাহিনী। পুরো ঘটনা প্রথম দুই পর্বে লিখে শেষ অার করা হয় নাই। এরকম মোট দুইটি অসমাপ্ত লেখা পড়ে অাছে ড্যাশবোর্ডে যেগুলো শেষ করা হয়নি। খুব বাজে অভ্যাস। সৌভাগ্যক্রমে এই লেখাটির দুই তৃতীয়াংশ শেষ অর্থাৎ এই পর্বে শেষ করে দিতে পারবো। চেয়েছিলাম অাগের দুটি পর্বের লিংক এখানে দিয়ে দিতে কিন্তু সেটা অাপদত কাজ করছে না। অাগের ঘটনা চোখ বুলিয়ে অাসতে চাইলে অামার প্রোফাইলে গিয়ে কষ্ট করে দেখে অাসতে পারেন।
সাব্বির ফোন করে জানালো, ‘ভাই সমস্যা হয়ে গিয়েছে। এক খালা অামার হাতের চোট দেখে ফেলেছেন এবং বাকিটা বুঝে নিয়ে বাসায় এখন শোকের মাতম।’ রাজিব হাউমাউ করে উঠলো, ‘ভাই অামি শেষ। অামাকে জবাই করবে অাজকে বাসায় গেলে। কিছু একটা বুদ্ধি বাইর করেন।’ খুড়িয়ে হাঁটছি অার চিন্তা করছি। দুর্ঘটনার মানসিক ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মাথা কাজ কম করছে। পুরো দুর্ঘটনাটা অাবার চিন্তা করলাম। কে কোথায় ব্যথা পেয়েছে দেখলাম। সবার চোট দেহের সামনের দিকে। ‘অামরা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে অাসছিলাম, রাস্তা ফাঁকা দেখে অামি অার রাজিব রাস্তায় হাঁটছিলাম। সাব্বির ছিল ফুটপাথে। হঠাৎ প্রচন্ড জোরে শব্দ। পিছে তাকাতেই দেখি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একটি নসিমন অামাদের দিকে প্রায় উড়ে অাসছে। সাব্বিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, রাজিবকে পুরো সরাতে পারি নাই। অামিও সামনে ঝাঁপ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। অামি বেঁচে গিয়েছি। অার রাজিবের কাধে নসিমন হাল্কা ধাক্কা দেয়ায় সে জোরে রাস্তায় পড়ে গিয়ে থুঁতনি কেটে ফেলল। বাচ্চা ছেলে চালাচ্ছিল ওই নসিমনটা। অামাদের পিছনে অারেক মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অামাদের উপর এসে পড়লো। দুর্ভাগ্যজনক!’
পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মালামাল বোঝাই নসিমনটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
‘কি ভাই কিছু পাইলেন? কি বলবেন ঠিক করসেন?’ রাজিবের প্রশ্নে বাস্তবে ফেরত এলাম।
‘চলো বাসায়। বলছি কি বলতে হবে। অাগে দেখতে হবে সাব্বির ইতমধ্যে কি বলেছে। সেটা শুনে তার সাথে একটু ঘষামাজা দিয়ে কাহিনিটুকু বসাতে হবে। তবে বাসায় সবার এখন মন খারাপ দুটো কারণে। এক সুষমা নাই। দুই একটা সম্ভাব্য দুর্ঘটনায় অামরা দুইজন অাহত। অামি ব্যথা পাইসি এইটা যাতে কোন মতেই কেউ না জানে। অামি অামার দিক থেকে কাভার দিব। তুমি মুখ খুলবে না একদম। ঠিকাছে?’ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে শেষে মাথা নাড়লো রাজিব। সাব্বিরকে ফোন করে ঘটনা ফাইন টিউনিং করে নিলাম।
দূর থেকে রাস্তায় সাব্বির অার রাজিবের বন্ধুবান্ধবদের দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। অাত্মীয়-স্বজনদের চোখ এড়িয়ে সোজা দোতালায় গিয়ে প্যান্ট বদলে জিন্সটা পরে নিলাম। হাঁটুর কাছে জ্বলে উঠলো। ব্যান্ডেজ সরে গিয়েছে। এরপর বামহাতে একটা রুমাল খুব কায়দা করে বেধে নিলাম যেন দেখে মনে হয় এটা ফ্যাশনের অংশ। অারো ঘন্টা খানেক সময় নষ্ট করে নিচে গেলাম। ততক্ষণে কান্নার রোল একটু থেমে এসেছে। কিন্তু নিচের ঘরে সবাই বসা। অার এরমাঝে লেপ মুড়ি দিয়ে রাজিব শুয়ে অাছে। অাড়চোখে ইশারা করলো, যেটার মানে ধরে নিলাম এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে অাছে পরিস্থিতি। ধরে নিলাম মামলার সময় নিতে হবে। জজ সাহেব ইতমধ্যেই অনেকবার সময় নেয়ার ফলে বিরক্ত। ঘরের কোনে সাব্বির চুপ করে দাড়িয়ে অাছে। শুরু করলাম কাহিনী বলা। ধীরে ধীরে বলছি অার শ্রোতামন্ডলীর দিকে তাকাচ্ছি। থামার পরে সবার চেহারা দেখে বুঝলাম মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য ছিল।
‘তুমি ব্যথা পাও নাই বাবা?’ রুমালসহ হাত ততক্ষণে জিন্সের পকেটে নিয়ে, ব্যথায় চোখে তারাবাতি দেখতে দেখতে বললাম, ‘নাহ!’ এই দুঃখের মাঝে কোন মতেই উনাদের এই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা যাবে না। কিছুক্ষণ পরে সুষমার বাবা এসে দেখে গেলেন অবস্থা। সবার সাথে কথাবার্তা বলে এরপর সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
‘চলবে ভাই। চমৎকার কাভার হইসে।’ রাজিবের উজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে সাব্বির, অামি হেসে দিলাম। সতর্কতার সাথে পকেট থেকে হাতটা বের করে এনে রুমাল খুলে বসলাম। কেউ ঘরে অাসলে হাত পিছনে নিয়ে যাচ্ছি। ল্যাপটপ নিয়ে গুঁতোচ্ছিলাম, “অার কোথায় ব্যথা পাইসো তুমি?” মুখ ঘুরিয়ে দেখি এক খালা অামার হাতের ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে অাছেন। অনুরোধ করলাম, ‘অল্প একটু ছিলে গিয়েছে। অার কাউকে বইলেন না। সবাই মন খারাপ করবে। লজ্জারও ব্যাপার।’ হাতটা নেড়েচেড়ে দেখে অনেক কষ্টে চোখের পানি অাটকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যেই পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এত প্রস্তুতি সেটা পুরোটা সফল হলো না।
ফিরতি বাসের টিকেট কাটা ছিল। এই জখম নিয়ে বাসে করে ঢাকা যেতে কষ্ট হবে। কিছু করার নেই যদিও। রাতের খাবার খেয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। সুষমার কাছে বিদায় নেয়া হলো না, এই অস্বস্তিটা থেকেই গেল। পরে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। এই এলাকার লোকজন যেন দেখেই বলে দিতে পারে কোনটা মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টের যখম। খুচরো কথায় জানতে পারলাম, গতসপ্তাহেও একজন মারা গিয়েছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এই এলাকায় প্রচুর। অাবারো জানে বেঁচে গেলাম। বাসের ঝাঁকুনিতে হাঁটু অার হাতের ব্যথায় অাধো ঘুমে নানান উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে দেখতে ভোর ছয়টায় ঢাকা পৌঁছালাম। বাসায় ঢুকে দেখি মা বসে অাছে। বামহাত ততক্ষণে পেছনে লুকানো।
‘একটা ঘটনা ঘটসে, কিন্তু রাগ করতে পারবা না।’ মায়ের চেহারায় অপরাধী ধরা পড়বার সাফল্যমন্ডিত চেহারার ঔজ্জল্য এবং অনাকাঙ্খিত ঘটনা শোনার গম্ভীরতার মিশেল। অাস্তে করে বামহাতটা সামনে বের করে অানলাম। অার টেপ রেকর্ডারের মত নসিমন কাহিনী বলা শুরু করলাম। কাহিনী শেষ করার পর দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে উঠলেন, ‘উচিৎ শিক্ষা হইসে!’ রান্নাঘরে ঘরে যেতে যেতে বললেন, ‘নাস্তা দিব?’
‘যাক কমের উপর দিয়ে গেল দেখা যায়।’ ততক্ষণে কাকা ঘুম জড়ানো চোখে উঠে এসে কি ঘটলো, কার উচিৎ শিক্ষা হলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।
এক সপ্তাহ পরের ঘটনা
নিকটবর্তী হাইটেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালের একটা রুমে বসা। হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে এসেছি। নার্স উপরের গজ কাপড়ের অাবরণটি খুলে দেখেন নিচের অংশ পুরোটা হাতের জমাট রক্ত ও ক্ষতের সাথে বসে অাছে। ডিউটি ডাক্তারের ডাক পড়লো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই স্লো-মোশন ইফেক্ট (ব্যাকগ্রাউন্ডে শাহরুখ খানের ৯০ এর দশকের যেকোন একটি পুতুপুতু রোমান্টিক ছবির গান বাজতে পারে এখানে), অাধা ভেজা খোলা চুলের ডিউটি পরী, থুক্কু ডিউটি ডাক্তারের অাগমন। বেশখানিকটা হাসি দিয়ে ফেললাম। উনিও হাসির ভলি ফেরত পাঠালেন। ব্যথা ভুলে গেলাম। এই না হলে ডাক্তার। হাতের ব্যান্ডেজটা দেখলেন। হাতে হেক্সাসলের বোতল দিয়ে বললেন একটু করে ভিজিয়ে অাস্তে করে তুলতে থাকুন। অামি তুললে ব্যথা পাবেন। তারপরে সদর হাসপাতালের প্রেসক্রিপশান দেখে জানালেন ঠিক অাছে। কিভাবে হলো জিজ্ঞাসা করতে খুশি হলাম। যাক কথা বলার উপলক্ষ পাওয়া গেল। মোটরসাইকেল এ্যাক্সিডেন্ট, মেহেরপুর বন্ধুর বিয়ে খেতে ঢাকা থেকে যাওয়ার মত কাজ করা, কোন মেডিক্যালের, এইখানে কতদিন ইত্যাদি মিলিয়ে পাঁচ মিনিটের বেশ খানিকটা গল্পগুজব চললো। ততক্ষণে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছি। উনি ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে অাসলেন। অালতো করে হাতটা ধরলেন। শরীরে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়া শুরু হলো। ভাললাগার মাঝে খেয়াল করা হলোনা উনার অারেক হাতে হেক্সাসলের খোলা অারেকটি বোতল উঠে এসেছে। কিছু বুঝে উঠার অাগেই জোরে চেপে ধরে রাখা হেক্সাসলের বোতল থেকে সরু ও তীক্ষ্ণ ধারায় তরল ক্ষতের উপর পড়তে লাগলো। দাঁতে দাঁত চেপে গোঙানোর শব্দ চাপার চেষ্টা করলাম। ৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র কমিশনিং এর অাগেই ডিকমিশন্ড। মনের সুখে হেক্সাসল দিয়ে ধুয়ে খুব যত্ন নিয়ে মুছে নার্সকে বললেন নতুন হালকা ড্রেসিং করাতে।
‘এভাবে হুটহাট দূরে কোথাও যাবেন না। অার যখনতখন মোটরসাইকেলেও চড়বেন না। নিরাপদে থাকুন, সুস্থ থাকুন।’ বিদায়ী হাসির মাঝে দুষ্টামির ছাপ স্পষ্ট হবার অাগেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
(ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকঃ অামার বলার কিছু ছিল না।)
পুরো লেখার সেরা অংশ হলো শেষের প্যারা। লাইকাইলাম :thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ অাহসান ভাই। ট্র্যাজেডি এভাবেই ঘটে! :((
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
Mokubai...CCB te to ami abar "Nishiddho"....kintu tomar ei blog ta na poira o parlam na, comment na diya o parlam na.
Hi-tec e eirakom porir moto doctor o ase naki?? Shesh para ta te pura naraya dila bro. Doctor er entrance ta jevabe dila...,bohu pathoker ghore PowerStation on hoya gese 😀
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ