পবিত্রতা

অনিন্দ্য ইমতিয়াজঃ

দেখে কে বলবে। এখন রাত সাড়ে ১০টা বাজে? রাজপুরীর মত ঝলমলে আলোয় ভরে আছে গোটা শহর। চারিদিকে মানুষের চিৎকার, চেঁচামেচি, আনন্দোৎসব। সবার মুখেই একটা খুশি খুশি ভাব। নাহ! সবাই এই কথাটা ঠিক না। কোথাও না কোথাও অন্তত একজন তো থাকবেই যে খুশি নয়। অখুশি বলবনা, কিন্তু হয়ত সে  বিষন্ন। একা একা চারিদিকে হাটছে আর নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সে চেষ্টা যে বৃথা । এমন দিনে দিনে এইরকম বিষন্ন প্রতিবিম্ব আরেকটা খুঁজে পাওয়া দুর্লোভ। সেই ‘ সে ’ টা আমি ছাড়া আর কেও নয় এটা বুঝতে হয়ত কারও বাকি নেই। কান জানি বাসায় ভাল লাগছিল না, তাই বেরিয়ে এলাম। কাঁধে আমার অবলম্বন সাইড ব্যাগটি। যেখানে ১টা ডায়রি, দু’একটা কলম, একটা প্যাড আর একটা পানির বোতল আছে। আমি এখন বেইলী রোড় ধরে হাটছি। এই রাস্তাটায় সর্বদাই প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধবদের কলরব। তাই এখানে আসলে অন্তত বোর হবার সম্ভাবনা নেই। ঘুরে ঘুরে নানান মানুষদের গল্প শোনা যায়, প্রেমিক-প্রেমিকাদের খুনসুটি দেখা যায়। আর কোন কাজ নাই থাকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখা তো আছেই। তাই তো আমরা সম্ভাবনাময়, আমরাই উদারচেতা । আমাদের কার্পন্য শুধু মোবাইলে কথা বলা, যাতায়াত ভাড়া দেওয়া আর বন্ধুদের সাথে খাবারের বিল দেবার সময়ই মাত্র। অন্য সকল সময়েই আমরা জান বিলিয়ে দেই সকলের তরে।  কিন্তু দেখাদেখি  আর ভাবাভাবির ব্যাপারে আমাদের কোন ধরনের কার্পন্যই নেই। তা সে দেখাদেখি পরীক্ষার খাতায়ই হোক, রাস্তায় পড়ে থাকা আহত ব্যাক্তি কিংবা বেওয়ারিশ লাশ দেখাতেই হোক, অন্যের বিবাহিত স্ত্রী অথবা গার্লফ্রেন্ড দেখাতেই হোক, মিছিল কিংবা মারামারি দেখাতেই হোক  আর রাস্তায় উত্তপ্ত পোশাকের আগুন ঝরানো সুন্দরি দেখাই হোক। দেখতে আর যাই লাগুক পয়সা তো লাগেনা। আর ভাবনা চিন্তার কথা তো বাদই দিলাম। আমাদের চিন্তার গভীরতা ব্যাপক কিন্তু সে চিন্তায় খুব বেশি রকম-ফারাক নেই। তা সে চিন্তা ঘুমের ভেতরই হোক আর ঘুমের বাইরেই হোক , দুইয়ে তেমন অন্তর নেই।

আচ্ছা আমার মাথাটা যে খারাপ হতে বাকি নেই তা বোঝাই যাচ্ছে। কিসব তাত্তিক কথাবার্তা বলছি এইগুলা। মোবাইল বাজছে না’কি? একি!!! বারটা বেজে গেছে! এতটা সময় ধরে এসব অথর্ব জিনিস ভাবছি? সাংঘাতিক! এখনও আসল কাজটাই সারা হয়নি। “ শুভ ভালবাসা দিবস, অনু ।” হ্যাঁ আজকের দিনটা অন্যরকম, হয়ত বিশেষ। আজ না’কি ভালবাসা দিবস? হয়ত তাই অন্যরকম, তাই হয়ত বিশেষ। কি অদ্ভুত! তাই না? ভাল্বাসার জন্য একটা আলাদা দিনই আছে। যেন এই দিন ছাড়া কখনও কাওকে ভালবাসা যাবে না অথবা এই দিনে ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই করা যাবেনা। আজব দুনিয়া। সত্যি আজব কান্ড। ভালবাসার আবার দিন-কাল-বার-তারিখ আছে না’কি? যেদিন ভালবাসা যায় সেই দিনই তো ভালবাসা দিবস ।  যারা ভালবাসে তাদের জন্য প্রতিটা দিনই তো ভালবাসা দিবস, তাই না? চারিদিকে প্রেমিক-প্রেমিকারা হা করে গিফট নিচ্ছে, জড়িয়ে ধরছে একে অন্যকে। কেমন যেন একটা নষ্টামি, ভন্ডামি চারদিকে। আমি কিছুই সঠিক জানিনা, কিন্তু ভালবাসা তো আর লেনদেন নয়। যে গিফটের দাম আর পরিমাণের উপর ভালবাসা নির্ভর করবে। আমার মনে হয় কি—এরা সবাই পরের ভালেন্টাইন্স ডে’তে অন্যদের সাথে থাকবে। কে জানে হয়ত গত বছর এই দিনে আরেকজনের কাছ থেকেই দামি গিফটগুলা নির্লজ্জের মত চেয়ে নিচ্ছিল। আমার এইসব দামি দামি গিফটগুলা ধীরে ধীরে না নিয়ে একবারে টিভি, ফ্রিজ, ওভেন এইগুলা দেয়াই ভাল। প্রেমটা যখন চুক্তি আর গিফট ভিত্তিক তখন এমনি তো ভাল। প্রেম হবে চুক্তিভিত্তিক। ৬ মাসের প্রেমে ওভেন, ১ বছরে টিভি আর ১০ বছরের বৃহৎ চুক্তির প্রেমে গাড়ি  (সাথে ৬ মাসের ফ্রি প্রেমের ইন্সুরেন্স ) অদ্ভুত! প্রেমভালবাসাকেও অর্থনৈতিক দিকে নিয়ে গেছে সবাই। আমার নিজেরই মাঝে মাঝে আফসওস হয়, এই আকাম না করলে হয়ত এতদিনে আমি একটা গাড়ির মালিক থাকতাম। আমার মনে হয় আমাকে এয়ারটেল কোম্পানির বেতন দিয়ে পোষা উচিত। শুধু আমাকেই কেন? সব প্রেমিক-প্রেমিকাদেরকেই এয়ারটেলের টাকা দিয়ে পালা উচিত। আমাদের জন্যই তো এয়ারটেল নিজেদের নেটওয়ার্ক বাড়ায় না, এই ভাঙ্গাচুরা অবস্থাতেই যে ব্যাবসা আরও বাড়ালে যে কি অবস্থা হবে! দেশে তাই কানের ডাক্তারের পরিমাণ বাড়ানো আবশ্যক, কারন ছেলেপেলেরা যে হারে কথা বলে তাতে কয়দিন পরেই সবার কান চিলে না মোবাইলেই নিয়ে যাবে। ঐ যে দেখা যায় ‘বেইলি স্টার’… ওখানটায় যেই ছেলেটা বসে আছে ঐ টার মাথায় মনে ছিট আছে। প্রতি বছর নতুন নতুন মেয়ের সাথে এই দিনে থাকে। আর গিফট দেয় কি? কোনবার ফ্রাইং প্যান, কোনবার হটপট, পাতিল, টিফিন বক্স, হাতপাখা, রাইস কুকার ইত্যাদি। এবার মনে হয় ওয়াটার হিটার দিয়েছে।

আমি এখন “সুইস” এর উলটা পাশে আছি। এইখানটায় আমি আর অন্বেষা বসে থাকতাম কখনও ওর হাতে হাত রেখে, কখনও ওর কোলে মাথা রেখে , কখনও ওর ঘাড়ে মুখ গুজে। কিন্তু প্রথম ১০ মিনিট ও কখনি আমার দিকে তাকাতে পারতনা। ওর লজ্জা ভাঙ্গাতেই লেগে যেত ১০/১৫ মিনিট। এইখানটায় বসে ও আমাকে বকা ঝকা করত, পরা ধরত, শাসন করত, আবার মাথায় হাতও বুলিয়ে দিত। “ চুলে এত ময়লা কেন? শ্যাম্পু করিস না কয় বছর?  নখ কাটিস না কেন? স্যান্ডেল ছেঁড়া কেন? শার্টটাও স্ত্রী করিস নাই? তোর পারফিউমটা পাল্টাবি না? ……”  প্রতিটা দিন আমার জন্য বসে থাকত আমি এসেই একটা দুঃখ দুঃখ ভাব করতাম।  আর ও বলত,” ২২ মিনিট…।।   আজকে ২৭ মিনিট…।।  আজকে এত তাড়াতাড়ি!! মাত্র ৩ মিনিট? বাহ!”  কেন জানি আজ সেসব কথা মনে পড়ছে শুধু। ইশ! ছবি আঁকতে কত পছন্দ করত ও। সবসময় ব্যাগে থাকত একটা প্যাড, আর হরেক সাইজের পেন্সিল। ঐ প্যাডটা পেন্সিল স্কেচে ভরিয়ে ফেলতে সবথেকে বড় অব্দান আমার। আমার জন্য বসে থাকতে থাকতে ওটা ভরে উঠত। কি সুন্দরই না আঁকত আমার অনু, আমার অন্বেষা। “ ভাইয়া ফুল নিবেন?” শব্দ শুনে তন্দ্রা কাটল আমার। অনেকক্ষন লাগল বুঝতে যে আমি কোথায় আছি? প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে রাস্তা। মনে হয় অনেক রাত হয়েছে। আমি প্রথম কথা বললাম, “ ক’টা বাজে? “ মেয়েটি জানি কেমন করে তাকায় আমার দিকে। ঠিক অন্বেষার মত করে। ওর চোখ দু’টি এমনই ছিল। কিন্তু ওর চোখটা খুব কম মানুষই দেখতে পারত। মোটা চশমার আড়ালে হারিয়ে যেত ওর মায়াবী চোখ দু’টি। তাতে তো আমারই সুবিধে হত, কেননা সেই চোখ দুটি আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পারতনা। আমার যতক্ষন থাকত ওকে চশমা প্রতে দিতামই না। “ ভাইয়া ফুল কয়টা নিয়ে যান” আবার তনদ্রা কাটল আমার। পকেটে শেষ ৫০ টাকা দিয়ে কিনে নিলাম সবগুলি ফুল।

রাত এখন ৪টা। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। পুলিশরা আমাকে দেখে পাগল প্রেমিক ভাবছে। হাসাহাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে টহল পুলিশগুলো । আমি একটা হিমু টাইপ হাসি দিলাম। ভাবলাম এত রাতে ফুল নিয়ে কোথায় যাব? অনুকেই বরং দিয়ে আসি। ওকে কখনও ভালবাসি এই কথাটা বলিনি, তাই কখনও ফুলও দেই নি। সারারাত ওর জন্য যেগে থাকতাম, ও আমার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমাতে ঘুমাতে যেত বাসে। আমার খেয়াল রাখত আম্মুর থেকেও বেশি। এসব কি ভালবাসা? আমি জানি না । জানতে চাই ও না। জেনে কোন লাভ নেই। ফেসবুকেও আমরা ২জন ২জনের পাসওয়ার্ড জানতাম। আমাকে অন্য মেয়ের সাথে চ্যাট করতে দেখলে যে কি রাগ করত। মাঝে মাঝে ওকে ইচ্ছে করেই রাগাতাম। এত সুন্দর লাগত ওকে রাগলে। পহেলা ফাল্গুনে ১ম শাড়ি পরা ওকে দেখেছিলাম। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না এত  সুন্দর লাগছিল ওকে । পুরা  পুতুলদের মত। প্রায় এসেই গিয়েছি । একটা বিয়ে বাড়ী সামনে। ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে , দারুন তাই না? প্রায় ৫ টা বাজে । আমাকে সবসময়  নামাজের জন্য ৫টার সময় ডেকে দিত , যদিও বেশিরভাগ দিন কথা বলতে বলতেই বেজে যেত ৫ টা । কিন্তু যেদিন ঘুমিয়ে যেতাম ৫/১০ মিনিট লেট করে উঠতে না উঠতেই দেখি ৩০/৩২ টা মিসকল। পুরাই পাগল একটা। এখন ওকে ফোন দিব না’কি টেক্ট? আরে ওটা কে আসছে? অনুর ভাই অয়নের মত লাগছে। কি করব এখন? ওকেই বলি। আমাকে খুব পছন্দ করত ছেলেটা, অনেক হেল্পও করত। আমাকে দুলা দুলা ডাকত। ও নামাজের যাচ্ছে মনে হয়।  “অয়ন” হতচকিয়ে দাড়াল অয়ন। “ ইমতি ভাইয়া তুমি? কেমন আছ? কোন খোঁজ নেই কেন? আর আজকে এলেনা যে? “ “ অয়ন তুই কি চাস আমি অনুর হলুদে আসি? “ অয়ন নির্বাক। “একটু ডেকে দিবি অনু কে। প্লিজ” অয়ন অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে । কালকে যে মেয়ের বিয়ে তাকে  প্রেম নিবেদন করে , ভালবাসা দিবস এর শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি হাতে ফুল নিয়ে ভাবতেই অবাক লাগে। “ ভাইয়া তুমি সিরিয়াস? বাসার সবাই কেবল ঘুমিয়েছে। আপু হলুদের ড্রেস্টাও পালটায় নি” “ অয়ন লক্ষী ভাই আমার । এই শেষ বার অনুর সাথে দেখা করব । আর কখনও আসব না। নিজের দুলার জন্য এই টুকু কর। প্লিজ ” অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভেতরে চলে গেল। প্রায় সাথে সাথেই এল অনু। বোঝাই যায় ধড়ফড় করে উঠে এসেছে। ওর পরনে আবারও হলুদ শাড়ি।

আমি এগিয়ে গেলাম। “কেমন আছিস অনু?” “ তুই এই কথা বলছিস? তুই? …… ফুল গুলা কার জন্য? “ “ প্রথম এবং শেষবার তোকে ফুল দিচ্ছি অনু। ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।“ অনু নিল ফুলগুলো। “ আমি যাই অনু? ভাল থাকিস? “ আমি উলটা ঘুরলাম। আড়চোখে দেখতে পারছি অনু চোখ মুছল বোধহয়। এটা কোন ছবি হলে পেছন থেকে এসে অনু আমাকে জড়িয়ে ধরত। ওটা আমিও চাইছিলাম, কিন্তু এটা কোন ইয়াস চোপ্রার ছবি নয়।  আমার চোখে পানি চলে আসছে বোধহয়। কেননা ঝাপসা লাগছে সব কিছু। একফোটা জলও বোধহয় গড়িয়ে পড়ল। এই পবত্র জল দান করলাম একটি পবিত্র অনুভুতির জন্য। এই হ্যর পবিত্রতা, চির পবিত্রতা, যাতে কোন লেনদেন নেই । শুধুই পবিত্রতা । চির পবিত্রতা।

 

৮৪৩ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।