ও, আমি এবং আমরা ……

সংবিধিবদ্ধ সতর্কিকরন – জাতি, ধর্ম, বর্ণ, মত – কাউকে আঘাত দিতে লিখিনি। আঘাত পেলে ক্ষমা করে দেবেন। এটা আমি আমার কল্পনা থেকে লিখেছি, এই চরিত্রগুলো বাস্তব নয়।

আগের গল্প … একজন অসুস্থ মানুষ

ক্লাশ ১২ এর শেষ ছুটি। কেমিস্ট্রি পড়া শেষ করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিছুক্ষন আগে মোটামুটি ভালো একটা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। ফার্মগেটের মোড়ের সিনেমা হলটার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি এক লোক, বেশ ফিটফাট জামা কাপড় পরা, সিনেমা হলের সামনে দাঁড়ানো রিকশাগুলোর সাথে দরাদরি করছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা রিকশা লোকটার পেছনে এসে থামতে গিয়ে একটু স্লিপ করে লোকটার সাথে হালকা বাধিয়ে দিল। আমি দূর থেকেই বুঝতে পারছিলাম, এই ধাক্কাতে লোকটার কোনো ব্যথা পাবার কথা না, কিন্তু তারপরেও সে বেশ
উত্তেজিত। একটু কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম লোকটা আসলে কাপড় নোংরা হবার কারনে রিকশাওয়ালার ওপরে ক্ষেপে আগুন হয়ে আছে। যা হোক, নির্বিকার মুখে সিগারেট টানতে টানতে উত্তেজিত লোকটা আর কিছু মজাদর্শী জনতাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হলো বাস্তবিকভাবেই মানুষ যদি রেগে আগুন হয়ে যেতো, তাহলে ব্যাপারটা কেমন হতো। একটা কার্টুন ছবির মতন করে যদি কল্পনা করি – খুবই রাশভারি এক লোক রাগে কাপছে, বয়েলিং পয়েন্টে পৌছে যাবার পরে রাগে তার শরীরে আগুন জ্বলে উঠল এবং শুধুমাত্র তার কাপড়চোপড়্গুলো পুড়িয়ে দিয়ে আবার নিভে গেলো। বেচারী তখন হতভম্ব হয়ে খেয়াল করলো, সে পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যটা মাথায় ভেসে উঠতেই হাসির চোটে ধোয়া গিলে ফেললাম। হাসির এবং কাশির দমকে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো। কোনো রকমে হাসি, কাশি এবং ধোয়া গিলে নিজেকে ধাতস্ত করছি, এমন সময় দেখি সিগারেটের স্টলে বসে থাকা এক ছেলে খুব সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার একা একা হাসার কারন বোঝার চেষ্টা করছে। ওই ছেলেটার কাছ থেকেই আরো পাঁচটা সিগারেট কিনে আবার হাটা দিলাম। সেই থেকে আমার যখন খুব বেশি রাগ হতে থাকে, এই দৃশ্যটার কথা মনে পড়ে যায়। এবং কল্পনাতে নিজেকে ওই লোকটার জায়গাতে দেখে আমার হাসি পেয়ে যায়।

তবে আজকের ব্যাপারটা মোটেও সে রকম না। আমার আজকের রাগটা বিরক্তিজনিত। ও আমাকে মোটামুটি ধরে বেধে চারুকলার সামনে নিয়ে এসেছে, কবিতা শুনবে বলে। কে কোন বিখ্যাত আবৃত্তিকার মণিশ ঘটকের একটা বিতা আবৃত্তি করবে বলে কার কাছ থেকে যেনো শুনেছে, সেই থেকে বিশাল তাল ধরেছে কবিতা শুনতে হবে। আমাদের বাকিদের সবাই নানারকম অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। প্রেমহীন এবং আজকের দিনে টিউশনি ফ্রি থাকার কারনে আমি জীবনে অনেকতম বারের মতন উপলব্ধি করছি, আমি আসলে বন্ধু বান্ধবদের অনুরোধে শুধু ঢেঁকি না, সাবমেরিনও গেলার চেষ্টা করি। তবে আজকের তরুন কবিরা যেসব স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করছে, আমার মনে হয়না, আমি আর বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারব।

বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি, ও মনোযোগ দিয়ে কবিতাটা বোঝার চেষ্টা করছে। সেই একই প্যাচাল, এই পর্যন্ত শোনা দশ পনেরটা কবিতার প্রতিটার সারমর্ম করলে দাঁড়াবে, হয় – “আমি তোমাকে কত ভালোবাসি, কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারোনি”, নাহয় – “এই সমাজ আমার ভাল্লাগছে না, হেন কারন, তেন কারন, তবে আমি কেমন সমাজ চাই সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আইডিয়া নেই”। কি মজা পাচ্ছে মেয়েটা ?

ও আমার দিকে তাকিয়ে ওর সব চাইতে মিষ্টি হাসিটা দিলো।
– কি রে অয়ন, তোর কি পেটে ব্যথা করতেছে ?
বিরক্ত মুখেই জবাব দিলাম,
– নাহ।
– তাহলে মুখটাকে বানরের পেছন দিকের মত করে রাখছিস কেনো ?

আমি হতবাক, হতভম্ব আর হতবিহ্বল – সব একসাথে হতে গিয়ে তালগোল ফেললাম। ও আমার অবস্থা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। একবার মনে হলো, মুগ্ধ হয়ে ওর হাসিটা দেখতে থাকি, তবে টের পেলাম, আশেপাশের লোকজন একটু বিরক্ত চোখে আমাদের দিকে তাকানো শুরু করেছে। কি এমন কবিতা যে এত মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে? ও হাসি থামানোর পরে বললাম,
– এই রকম অশালিন কথা বলতে তোর লজ্জা লাগলো না। আর তোর চেহারা নাহয় তিলোত্তমা টাইপের, তাই বলে আমার চেহারা নিয়ে এই রকম কথা বলবি? দুঃখে যদি আমার চোখ থেকে এখন পানি পড়ে, তাহলে খোদার আরশও কেপে উঠবে কিন্তু।
– তিলোত্তমা ? খোদার আরশ ?? দেখছিস, আমি বলছিলাম কবিতা শুনলে তোর ভাষাগত উন্নতি হবে।
– হুমমম …… আর তুই কি টের পাচ্ছিস, তোর অবনতি ঘটছে ?
ক্যাজুয়াল একটা হাসি ঝুলিয়ে ও বললো,
– নারে, এইটা সংগদোষ। এখন একটু চুপ থাক, আরেকটু পরেই কুড়ানী।

কথাটা অবশ্য ও খুব মিথ্যা বলেনি। ও আর ওর বান্ধবীদের সাথে আমাদের পরিচয় কোচিং সেন্টারে। রোজার সময় ছিলো তখন, আমি অবশ্য রোজা থাকার দিকে তেমন একটা মনোযোগি ছিলাম না আর অনুপের তো প্রশ্নই আসেনা। আমরা দুজন সিগারেট টেনে ক্লাশে ঢুকে দেখি, আবির আর রশিদ আমাদের জন্য লাস্ট বেঞ্চে জায়গা রেখেছে। আর আমাদের ঠিক আগের বেঞ্চে তিনটা মেয়ে। শিপন দেখলাম খুশিতে দাঁত সবগুলো বের করে রেখেছে। যেনো কোনো বিশাল কাবিলিয়াতির কাজ হয়ে গেছে।
— আচ্ছা, তুমি এই কাবিলিয়াতি, শব্দটা কেন ব্যবহার কর বলোতো ?
.– এটা আসলে ক্যাপাবিলিটি শব্দটার বাংলা …
— ওহহহ, আচ্ছা আচ্ছা …… ভালো।
ক্লাশ শুরু হবার কিছুক্ষন পরেই মনে হল, মেয়েগুলো কেনো যেনো অস্বস্তি বোধ করছে। আমি এদিক অদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, ব্যাপারটা কি … কিন্তু কিছুই পেলাম না।

এভাবে প্রতিদিন আমরা ওদের পেছনে বসি আর ওরা কিছুক্ষন পরে থেকে অস্বস্তি বোধ করা শুরু করে। যখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল, ওদের পেছনে আমরা বসে আছি, এইটাই ওদের অস্বস্তির কারন, তখন ওদের সাথে প্রথম কথা হলো। একটা মডেল টেষ্ট টাইপের পরীক্ষা হয়েছিলো, আমি, যে ভাই খাতা দেখেছিলো, তার কাছে থেকে একটা অংক বোঝার চেষ্টা করছিলাম। অনুপ, আবির আর রশিদ নিচে চলে গিয়েছে, কারন, আমি তো ওদের পরে বুঝিয়ে দেবই। আতলামি করার দায়টা যেনো পুরোপুরি আমার। নিচে নামতে যাবো, এমন সময় ডাক,
– এই শোনো।

উলটো ঘুরে তাকিয়ে দেখি ওরা তিন জন দাঁড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন বোঝার চেষ্টা করছি আসলে আমিই ওয়ান্টেড কিনা, তখন সামনের মেয়েটা নিশ্চিত করলো,
– হ্যা, তুমিই।

ক্ষনিকের জন্য মাথায় চিন্তা এসেছিলো, ওরা বোধহয় ওই অংকটাই বুঝতে চাইবে, তখুনি যে মেয়েটা আমাকে ডাক দিয়েছিলো, সে কঠিন সুরে বলা শুরু করলো,
– তোমরা রোজা রাখনা, ভালো কথা, তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু সিগারেট খেয়ে আসো কেনো? রোজা রাখলে সিগারেটের গন্ধ কি রকম বিশ্রী লাগে কোনো আইডিয়া আছে তোমাদের ? রীতিমতন গা গুলিয়ে বমি আসার অবস্থা হয়।

গা গুলিয়ে বমি আসার অন্য আরো কারন এবং সম্ভাবনা নিয়ে কিছু কঠিন কথা গলা বেয়ে মুখে চলে এসেছিলো, ঠোঁট দিয়ে চেপে গেলাম। আসলে বড় দোষটাতো আমাদেরই। আন্তরিক দুঃখিত এমন মুখ করে উত্তর দিলাম,
– খুবই দুঃখিত। তবে তুমি যদি ঝাড়ির ভঙ্গিতে না বলে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলতা, তাহলে কিন্তু খুবই ভালো লাগত। আমরা ব্যাপারটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবো। আচ্ছা …… বাই।

উলটো ঘুরেই হাটা দিচ্ছিলাম, আবার ডাক,
– এই দাড়াও দাড়াও …
– আরো ঝাড়ি দিবা ? এইবার আবার কি ব্যাপারে ?

আমার বলার ভঙ্গি দেখে মেয়েটা হেসে দিলো। বুকের মধ্যে যেনো রীতিমতন কাঁপন ধরে গেল …
— তখন কয়েক দিন আগেই তুমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েছ …… যে কোনো মেয়ের হাসিই তোমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতো …
.তা ঠিক অবশ্য …

খেয়াল করে দেখলাম বাকি মেয়েদুটোও মুচকি হাসছে। যাক, তাহলে আপাতত ঝাড়ির ব্যাপার না।
– আমি খুবই সরি। আমরা ভাবসিলাম তুমি মনে হয় তর্কাতর্কি করবা …… আসলে আমাদের তিন জনেরই পরীক্ষা জঘন্য হইসে। এই জন্য মেজাজও ভালো নেই।
– হুমমম, উধোর পিন্ডি সুলেমানের ঘাড়ে পড়ার পারফেক্ট উদাহরন।
– কি ? কি বললা ?
– না তেমন কিছু না। আমার নাম অয়ন। তোমরা ?
– তোমার নাম জানি ……

ডানদিকের শ্যামলা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো – ও কাজল, বাম দিকেরটাকে দেখিয়ে বললো – ও নুপুর, আর আমি তিথী।
– একই কলেজের তোমরা ?? একটু ভদ্রতা করার জন্যে জিজ্ঞেশ করলাম।
– আমি আর তিথী ভিকারুন্নেসা তে পড়তাম, আর নুপুর রাজউকে। কাজল প্রথমবারের মতন কথা বললো।
– আচ্ছা তোমরা চারজন প্রথম পরীক্ষাতেই এত ভালো করলা কেমনে ?
হুমমম, নুপুর দেখা যায় লেখাপড়ার ব্যাপারে চারদিকের লোকজনের খবর রাখে।
– অনুপের বড় ভাই আমাদের সাজেস্ট করেছেন এখন থেকেই গ্রুপ স্টাডি করার জন্যে। সেটাই কাজে লেগেছে।
– তোমরা চারজন এক কলেজের ? তিথী জানতে চাইলো।
– হুমমম।
– নটরডেম না ঢাকা কলেজ ? এইবার নুপুর।
– না …… আসলে আমরা ঢাকার বাইরে মফস্বলে লেখাপড়া করসি।
– তোমরা তো ক্যাডেট কলেজের …… । কাজলের মতামত।
– তুমি কেমনে জানো ?
– ওই বেস্ট স্কোরারদের লিস্টে তোমার আর অনুপের নাম আছে। তোমাদের বাকি দুজনের নাম জানিনা। তবে আমি নিশ্চিত ওদের নামও আছে।
– রশিদ আর আবির।
– তবে যে তুমি বললা মফস্বলে লেখাপড়া করসো ? নুপুর জিজ্ঞেস করলো।
– তুমি কোনো শহরের মধ্যে কোনো ক্যাডেট কলেজ দেখাইতে পারবা ? সব ক্যাডেট কলেজই মফস্বলে।
আমার কথা শুনে ওরা তিনজনই এবার হাসলো। আমি মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করলাম “ও”র হাসিই সবচে সুন্দর ওদের মধ্যে।
– আর দেরি করলে ওরা আমার জন্যে সার্চ পার্টি পাঠাইয়ে ফেলতে পারে। আমি যাই … সি ইউ এরাউন্ড।

নিচে নেমে দেখি, ওরাও আমার জন্যে ওপরে উঠছে।
আবির জানতে চাইলো,
– কি ব্যাপার, তরে বললাম একটা অংক দেখতে, তুই গোটা চ্যাপ্টার সল্ভ করার ট্রাই দিসিলি নাকি ?
ওদের খুলে বললাম কেনো দেরি হয়েছে। অনুপ মারাত্বক গা জ্বালানো একটা হাসি খুব চমৎকার হাসতে পারে।
– খ্যাক খ্যাক …… আসলে দোস্ত মেয়েদের ব্যাপারে …… খ্যাক খ্যাক …… তোর লাক বড়ই পিকুইলার ……… খ্যা খ্যা ……
– হুমমম … আবির একমত হয়। … এই যেমন ধর, কলেজে ম্যাডামের কাছ থেইকা লম্পট উপাধি পাইলি ……
– দোস্ত, আমি ঠিক দোষ কইরা ওই উপাধি পাইতাম দুঃখ থাকতো না। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
– তবে আমার মনে হয় তর উন্নতি হইতেসে …… ভুল বুঝাবুঝি থেইকা গালি আর থাপ্পড় খাইসিলি, আজকা ভুল বুঝাবুঝি থেইকা ঝাড়ি খাইলি। ভার্সিটি পাশ করতে করতে ভুল বুঝাবুঝি থেইকা তর অ্যাফারও হয় যাইতে পারে। রশিদের সুচিন্তিত বিশ্লেষন।
– নিশ্চিন্ত করলি দোস্ত। বলার জন্য বললাম আমি।

এরপরের ক্লাশগুলোতে আমরা আর ওরা মোটামুটি কথা চালানো শুরু করলাম। ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবার দুই তিন মাস আগে আগে আমরা দুই গ্রুপ মিলে গ্রুপস্টাডি শুরু করি। শুরু হয়েছিলো সেন্টারেরই একটা খালি ক্লাশ রুমে। পরে সেখান থেকে নুপুরের বাসাতে। নুপুরের আম্মা চমৎকার আলুর চপ বানাতেন। আমরা ছেলেগুলো নির্লজ্জ রাক্ষসের মতন সেগুলো খেতাম। এর মধ্যেই কখন আমরা এক গ্রুপ হয়ে নিজেদের মধ্যে তুই তোকারি শুরু করেছি টেরও পাইনি। সবাই মিলে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। দেখা গেলো, আমরা সবাই এক জায়গাতেই টিকেছি। তবে নুপুর আর আমি এক ডিপার্টমেন্টে, কাজল, আবির আর অনুপ আরেকটাতে, তিথী আর রশিদ আরেকটাতে। এখন প্রতিদিন না পারলেও, সপ্তাহে একদিন আমরা আড্ডা দেবার জন্যে ফ্রি রাখি। আমাদের ক্যাডেট আচরনের সাথে ওরা বেশ মানিয়ে নিয়েছে এখন।

– কুড়ানী … কুড়ানী … শোন … শোন …

কবিতার আসরটা ফেজ় আউট করে দিয়েছিলাম প্রায়। কনুইয়ের গুতো মেরে ভয়ংকর বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনলো ও আমাকে। মনোযোগ দিতে দিতে দেখি শুরু হয়ে গিয়েছে।
…… ……… ……… ……… ………
কুড়ানী তাহার নাম, দুচোখ ডাগর
এলোকেশ মুঠে ধরি দিলেম থাপড়
…… ……… ……… ……… ………
আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কি মুগ্ধ হয়ে সে শুনছে। শেষ বিকেলের আলোয় সব মেয়েকেই কি এমন জলপরীর মত দেখায় ?

.– কি ব্যাপার, আজকে আমি ওকে এভাবে দেখছি কেনো ?
— হ্যা …… আমিও অবাক হচ্ছি, তোমরা তো পুকুরপাড়ে বসে নাই। ওকে তো জ়লপরী লাগার কথা না। আসলে ঝামেলা অন্য জায়গাতে।
— কোথায় ???
— খুজে দেখো।

আমি মোহগ্রস্তের মতন ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
…… ……… ……… ……… ………
মা, তোমার বুদ্ধি তো জবর
নিজের বউয়ের লাইগা, কে বিছরায় বর ?
…… ……… ……… ……… ………

ও এই লাইন দুটো শুনে হেসে দিলো। আশা আর স্বপ্ন সফলের অনুভুতি মেশানো একটা হাসি।
আবৃত্তি শেষ হতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে তালি দেয়া শুরু করল। তার পরে আস্তে চোখ মুছে আমাকে বললো,
– চল। তোর টর্চার টাইম শেষ হইসে।
– শাহবাগের দিকে চল। আমার ক্ষিদা পাইসে। কিছু নাস্তা করা যাবে।

একটা রিকশা ঠিক করে দুজনে চড়ে বসলাম।
– কবিতাটা কেমন লেগেসে তোর ??
– চলে ।
– চলে ??? কি বলিস চলে ? এই কবিতাটা সে ক্লাশ টেন থেকে আমার প্রিয়।
– দেখ, মণিশ ঘটক সাহেব তোর জন্য ভালো ঘটকালী হয়ত করে দিতে পারে এই কবিতাটা দিয়ে, কিন্তু আমার এসবে পোষায় না।
– ওহহহহ ……… তোর ভালোবাসা তো আবার দীপাবলি ……
– অবশ্যই। কি করতেসে, কেনো করতেসে এসব জানে, বোঝে – তেমন মেয়ে আমার পছন্দ।
– তোর কি ধারনা, কুড়ানী জানে না সে কি করতেসে ??
– দাড়া দাড়া, আলোচনা আতলামিতে যাওয়ার আগে বল, তোর আসলে কি হইসে ? তুই তো এই কবিতা নিয়ে এত আগ্রহী ছিলিনা। তাহলে কি ছোটবেলার কোনো খেলার সাথির সাথে দেখা হয়ে গেসে ?? সে কি এখন আবার রান্নাবাটি – ঘর সংসার খেলতে চায় ?
মুখে ফিচলে হাসি কিন্তু বুকে সাসপেন্স জমিয়ে আমি প্রশ্ন করি।
– ধ্যাত …… না। তেমন কিছু না।
– অ অ অ …… তাহলে তোর মনে পড়েছে ছোট বেলার কোনো বিশেষ …………
– থামবি তুই ? থাবড়া খাবি কিন্তু বলে দিলাম।
– তুই তো অনেক দজ্জাল বউ হবি রে। তোর জামাই ভদ্রলোকটার জন্য আমার এখনই খারাপ লাগতেসে।

ও আর কিছুই বলে না, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। শাহবাগের মোড়ে নেমে আমরা দুজনে রাস্তা পার হলাম। একটা রেস্টরেন্টে ঢুকে দুজনের জন্য হালিম আর মোগলাই অর্ডার দিয়ে দেখি ও মুখে মেঘ জমিয়ে বসে আছে। আমি নরম স্বরে বললাম,
– যা, আর ফাজলামি করবো না। এখন বল, কি হইসে ?
ও কিছুই বলে না। আবার মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। সর্বনাশ, মুখের মেঘ চোখে বৃষ্টি হবার আগেই কিছু একটা করতে হবে। আবার চেষ্টা করি,
– তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড …… আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারবি ?
এইবার ও আমার দিকে তাকালো। যাক, মেঘ কেটে যাচ্ছে ……। যদিও এখনো মুখে রাগ ধরে রেখেছে ……
– এবার বল। তোর কি হইসে ?
সে আস্তে আস্তে শুরু করলো,
– আসলে এই যে কুড়ানী আর তার বন্ধু ছোটবেলা থেকেই খেলতে খেলতে, মারপিট করে বড় হইসে তারপরে সংসার করতে চাইসে, এই ব্যাপারটা আমার কাছে খুব কিউট লাগে। অনেক পুরাতন বন্ধুত্বের একটা রুপান্তর। ………… একটা বন্ধুকে সারাজীবন নিজের করে পাওয়া … কি রকম অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার … না রে ??

আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে করে, ……… আমি আছি, আমি আছি …… আমি তোর বন্ধু … তুই চাইলে তোর সাথে মারপিটও করব … আমার বড় হবারও এখনো অনেক বাকি ……
— হাস্যকর চিন্তাভাবনা …………
— হুমমম, তা ঠিক ……

মনের কথা মনে চেপে রেখে গরম পরটাতে ফু দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম,
– তা কোনো এলিজিবল ক্যান্ডিডেট আছে নাকি ?
– কেন ?
– যদি কেউ থাকে ………
— তাকে খুন করবা ??
— চোপ।
– ……… তাইলে তুই চাইলে তোকে তার সাথে জমায়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি।
কিছুক্ষন চিন্তা করে ও উত্তর দিলো,
– নাহ …… নিজেরটা নিজে সামলানোই ভালো। আর তারও তো বুঝতে পারতে হবে আমি তাকে পছন্দ করি।
– তা, তুই যদি তাকে বোঝানোর চেষ্টা না করে আমার সাথে বসে বসে হালিম খাইতে থাকিস, সে কেমনে বুঝবে তুই তাকে পছন্দ করিস ? আমার মতে, একেবারে ডাইরেক্ট এ্যাকশনে যা। আমরা তোকে ব্যাক আপ দেব। সরাসরি গিয়া বল – “অই পোলা, আতি কেয়া খান্ডালা ?”।

ওর হাসি দেখে আমার বুক ভেতরে মুচড়ে ওঠে।
– ধ্যাত ……
– না, সিরিয়াসলি ……… কোনো ছেলে যদি একটা মেয়েকে পছন্দ করে, তাহলে এক্সপেক্টেড যে ছেলেটা মেয়েটাকে প্রোপোজ করবে। কিন্তু যখন উলটোটা হয় তোরা কেনো এ্যাকশনে যাবিনা ??
– আমরা এমনই ……
– এই ডায়ালগটার ওপরে ক্যাডেটদের কপিরাইট আছে, এখন আমাকে সিগারেট কিনে দিতে হবে তোকে। আর প্রোপোজ করতে পারিস না, সমানাধিকার আন্দোলন করিস কেনো ?
– হ্যা, আমিও বুঝি এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য। আই মিন, আমি কেনো সেধে সেধে তোদের লেভেল এ নামতে যাবো ………
আসলেই ওদের ওপরে আমাদের কুপ্রভাব পড়েছে। তর্ক বাঁধলে সবচে উদ্ভট যুক্তিটা আগে বলবে। আমি আর এ লাইনে তর্ক বাড়াইনা।
– কমপক্ষে কে সেটা বল …
– না রে, বললে তুই চিনে যাবি। নিজের বুদ্ধিতে কাজ করতে গিয়ে আমার ফিউচার সম্পর্কের বারোটা বাজিয়ে দিবি।
– ওহ … আমার ওপরে তোর এতো আস্থা দেখে আমি মুগ্ধ ……
– রাগ করিস না রে। সময় হলে, প্রমিস, তোকে আমি সবার আগে জানাবো।
– প্লীইইইইইইইইজ, তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ……
– আচ্ছা … এক ডায়লগ একদিনে তুই আর কয়বার বেচবিরে … আজকে তোর এই ডায়লগের কোনো ভাত নাই। এখন তাড়াতাড়ি শেষ কর।

বিল মিটিয়ে রাস্তা পার হয়ে আবার রিকশায় উঠলাম।

– প্লীইইইইইজ …
– না, বলসি না সময় হলে …
– একটা হিন্টস দে কমপক্ষে …
– না।
– হুমমমম … মনে কষ্ট পাইলাম।
আমরা দুজন চুপচাপ রিকশায় বসে আছি। আজকের দিনটা আমার জন্য খুব ইন্টেরেস্টিং গেলো। আজ আমি বুঝলাম আমি ওকে ভালোবাসি, আজ আরো বুঝলাম ও অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, আমার কেমন অনুভব করা উচিৎ। আমার এলকোহল দিবসটা বোধহয় এগিয়ে দিতেই হচ্ছে।
হঠাৎ বোমা ফেলার মত ও জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, রশিদের ব্যাপারে তোর কি মনে হয় রে?

পরের গল্প —————
যেদিন আমার মৃত্যু হলো ……………
বলতে চাই … তোমাকেই চাই
তুমি আজ ভালোবাসোনি ………
আজ কাজলের বিয়ে ………

৮,০৫৮ বার দেখা হয়েছে

৮৫ টি মন্তব্য : “ও, আমি এবং আমরা ……”

  1. রকিব (০১-০৭)
    কলেজে ম্যাডামের কাছ থেইকা লম্পট উপাধি পাইলি ……

    আপনি ও :grr: :grr:

    সাসপেন্স বিদিক জমাইছিলেন বস।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    সবাইকে ধন্যবাদ । 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
    কারো কাছে যদি মনীষ ঘটকের কুড়ানী কবিতাটা থাকে, দয়া করে আমাকে এখানে মন্তব্য আকারে বা ই-মেইলে (mainulbd2002@msn.com) পাঠাবেন। ওই চারটা লাইন বাদে মোটামুটি পুরোটাই ভুলে গিয়েছি।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      দিতে পারব, তয় টাইম লাগবে। ওয়েট। 🙂

      আবার যদি না ভুইল্যা যাই, "আমি দুই বাংলার প্রেমের কবিতা" বলে একটা ঢাউস সাইজের বইয়ে এটা পেয়েছিলাম। বইটা মারতিং হয়ে গেছে, যোগাড় করতে হবে আরেকটা।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
      • কামরুলতপু (৯৬-০২)

        আমিও অপেক্ষায় থাকলাম কবিতাটার। আমি অনেক আগে একটা কবিতা চাইছিলাম কোন লেখায় ভুলে গেছি। কেউ আমারে পাঠায় নাই। রবীবাবুর। নামটা জানিনা, লাইনটা হচ্ছে, " সহজ কথা কইতে আমায় কহযে, সহজ কথা যায়না বলা সহজে" । ভাইয়া থাকলে এই কবিতাও পিলিজ...

        জবাব দিন
  3. জাহিদ (১৯৮৯-৯৫)

    পরবর্তী প্রজন্মের 'হুমায়ুন আহমেদ'। তুমি লেখাগুলো এক করে বই বের করলে আমাদের জানিয়ো। আমি অন্ততঃ কিনব! 🙂

    চরিত্রগুলো আসলেই কাল্পনিক? আমার সন্দেহ আছে!

    জবাব দিন
  4. রবিন (৯৪-০০/ককক)
    – তখন কয়েক দিন আগেই তুমি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েছ …… যে কোনো মেয়ের হাসিই তোমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতো …

    ভাইয়া, লেখাটা গতি খুব ই জোস। প্রতিটা লাইনেই পরের লাইন পড়ার আগ্রহ জাগে। কিন্তু লাস্টে কি ছ্যাকার গন্ধ পাইতেসি। আমারে কি জানি কইছিলেন?

    আমার এলকোহল দিবসটা বোধহয় এগিয়ে দিতেই হচ্ছে।

    :boss:
    অফ টপিকঃ ইস, ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া থেকে ঘুরে আসলাম অনেকদিন। আগে জানলে হোটেল খরচ টা কমতো

    জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    একটা খারাপ কথা বলি, কথপোকথন বেশি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।

    কিছু মনে কর না, কারন তোমার প্রথম গল্পটা পড়ে মনে হচ্ছে তুমি আরও ভাল করতে পারবে। 🙂


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. এহসান (৮৯-৯৫)

    জটিল হইসে। :clap:
    আসলে কবিতা সপ্তাহ চলে বলে আজকাল সিসিবি তে বেশী থাকা হয় নাই। তাই তোমার গল্পটা পড়তে দেরী হয়ে গ্যাছে। অনেকদিন কমেন্ট করে কাটাইলা; এখনতো দেখী সব দারুন দারুন জিনিস ছাড়ছো।

    জবাব দিন
  7. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    মামা জটিল লিখছোস :boss:
    দারুন লাগছে পড়তে, তুই সেরকম লিখিস দোস্ত :hatsoff:

    মারাত্বক গা জ্বালানো একটা হাসি খুব চমৎকার হাসতে পারে।

    একেবারে নিজেগো কাহিনি 😀
    খালি কোচিং এ ৩/৪ জন একলগে না গিয়া ১৫ জন গেছিলাম 🙁 এইটাই সবচেয়ে ভুল ডিসিশন হয়া গ্যালো :bash: ব্যাক বেন্চ দখলে নিয়া সামনে ক্যাডায় বইছে না বইছে দেখনের আর টাইম থাকতোনা :bash:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  8. তানভীর (৯৪-০০)

    মইনুল ভাই, দেরী করে কমেন্ট করে ফেললাম। 🙁
    গল্প দারুন আগাচ্ছে। :thumbup: :thumbup:
    রশিদকে আপাততঃ একটা উটকো ঝামেলা মনে হলেও মন বলতেছে যে, রশিদের বেইল নাই। 😀 😀

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।