স্বপ্ন

জীবনে কখনো যা হয়নি আজ তাই হচ্ছে । মন হচ্ছে আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল দেলওয়ার স্যার কে আজ পাইলে ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিতাম ।
( ইনি দিলওয়ার নন )
এই লোকটা কলেজের ডিসিপ্লিন ঠিক রাখার জন্য যখন জরিমানার সিস্টেম চালু করলেন, সাথে সাথে আমার মতন যে ছেলেগুলা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে কলেজে এসেছিল, তাদের আকাশে ওড়ার স্বপ্নের পাখাটাও কেটে দিলেন । শুধুমাত্র জরিমানা আর বাবার সেন্টিমেন্টের ওপর আঘাত বাঁচাতে কখনো কলেজ পালানো হয়নি । আমি জানি এই ব্লগে এই কথাটা দেখে অনেকেই কী ভাবছেন, কিন্তু আমার জীবনে এটা একটা বড় সত্য । নিয়ম ভাল না লাগলেও নিয়মের মাঝে এডজাস্ট করাটা যেন রক্তে ঢুকে গিয়েছিল । এখনো তা রক্তে এত গাঢ় ভাবে মিশে আছে যে শরীরের কোথাও কেটে গেলে হয়ত লাল রক্তের সাথে খানিকটা ডিসিপ্লিনও বের হয়ে আসবে । সেই সাথে বের হবে নিজের সাথে প্রতারনা করার ইতিহাস । এতটাই ভীরুতার মাঝে বাস করেছি যে, কখনো কোন স্বপ্নও ভাল করে দেখতে পারি নি। স্বপ্ন দেখার আগেই মনে হত আমি তো এমন ভাবছি, কিন্তু বাবা তো এমন চাননা , মার স্বপ্নটা তো অন্য রকম ।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম পিতা-মাতার পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত । সেই বেহেশতের দরজায় কেবল দাঁড়িয়েই থাকলাম, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে কখনো ইচ্ছা করে না । যা নিজে মনে মনে চেয়েছিলাম, তাই যদি না থাকে তাহলে বেহেশতে গিয়ে কী করব ?

আমি মানুষটা খুবই অদ্ভুত । তা এমনই মাত্রায় যে, আমি এখনো নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি আমি আসলে কি চাই । জীবনে কখনো বাবার কাছে চেয়ে কিছু নিতে হয়নি , অথবা কোন কিছু চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি , যেকারনে কারো কাছে ঠিক কিভাবে কোন কিছু চাইতে হয়, সে শিক্ষাটাও আমার পাওয়া হয়নি। মাঝখান থেকে যা হয়েছে তা হল নিজের ভিতরের কনফিডেন্স নামক জিনিসটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে ছিবড়ে হয়ে গেছি ।আর যতদূর মনে পড়ে শুরু হয়ছিল ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পর দিন থেকেই।

কলেজ জীবনের শেষ দিকে খুব ইচ্ছা হয়েছিল পরের জীবনে শিল্পী হবার । মিডিয়া জগতটা প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করত । নূরলদীনের সারাজীবন পড়তে গিয়ে কতবার যে মনের মাঝে থিয়েটারে চলে গিয়ছি, অথচ এই জীবনে এখনও একটা মঞ্চ নাটক দেখা হল না । খানিকটা সময়ের অভাব , খানিকটা বাস্তবতার আঘাত, আর খানিকটা আলসেমীর জন্য । হারমনিয়মটা এখনো শেখা হল না , কে জানে রুমের কোণে পড়ে থাকা জিনিসটা কখনো বেজে উঠবে কী না ।
অনেক স্বপ্ন ছিল নিজ হাতে গীটার বাজিয়ে ভরা আসরে নিজে গান করব। গীটার একটা কিনেছিও, কিন্তু শিখতে যাবার সময় করে উঠতে পারিনি । অফিসের কাজ শেষ হবার পর এত্ত আলসেমী লাগে যে কখনো বুঝেই উঠতে পারলাম না যে, আমি এই যন্ত্রটা আসলে কতটা ভালবাসি ।

প্রচন্ড রোমান্টিক ধাঁচের মানুষ ছিলাম, তবে সবসময়ই ভুল সাবজেক্টের প্রেমে পড়তাম । হয় অন্য ধর্মের কোন মেয়েকে ভাল লাগত , না হয় এমন কাউকে ভাল লাগত যে দেবীর আসনে সমাসীন , অথবা এমন কেউ যাকে আমি কখনো বলার আগেই অন্য কেউ বাগিয়ে ফেলেছে ।ওই যে বললাম, ছোটবেলা থকেই ঠিকমতন চাওয়ার অভ্যাসটা আয়ত্ত করতে পারিনি । মুভি দেখতে গেলে একটা যদি ওয়ার মুভি দেখি , তবে ২টা থৃলার , আর ১০ টা রোমান্টিক । শুধু তাই নয় কোন মুভি ভাল লেগে গেলে সেটার ডায়লগও অনেক সময় মুখস্ত বলতে পারতাম,আর মনে মনে শিহরিত হতাম আমার জীবনে এই মুহূর্তটা ঠিক কীভাবে আসবে ।
কখনো কাউকে প্রেম নিবেদন করা হয়নি । মাঝে প্রেমের কাছাকাছি সম্পর্ক যা হয়েছিল, তাতে নিজে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে পরিবার, সমাজ, বাস্তবতার কথা ভেবে পিছিয়েছিই বেশি । এখনো একা থাকতে থাকতে এখন এজীবনে কাউকে সঙ্গী করার কথা ভাবতেই ভয় লাগে , মনে হয় এই তো বেশ আছি । সংসার, পরিবার না হলে অন্তত দুর্নীতিতে জড়াবার সম্ভাবনা তো অনেক কমে গেল । আমাদের দেশের বর্তমান এই দশায় এটাই বা কম কী । আবার এমনো ভাবি যে স্বপ্ন দেখার বয়স তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি । বোমান ইরানি তো ৪৪ বছর বয়সে অভিনেতা হয়েছেন , তাহলে ???? এখনো তো এতটা বুড়িয়ে যাই নি।

আমার সবচেয়ে প্রিয় নাটক “কোথাও কেউ নেই” এই নাটকটার প্রিয় হবার পিছনে বাকের ভাই এর প্রভাব যততা, ঠিক ততটাই মুনা চরিত্রের সূবর্ণা মুস্তাফার । টাইম পাস হিসেবে যত ন্যাকা মেয়েই চলুক না কেন , আমরা ভালবাসতে চাই এরকমই শক্ত মনের মেয়েকে । যে পাশে থাকলে সব প্রতিকূলতাকেই জয় করা যায়। অথবা যে পাশে থাকলে মনে হয় আমার আর কিছুর দরকার নেই। অথবা যে জীবনে এসে আমাদের জীবনকে একটা ধারায় নিয়ে আসবে , জীবনের গতিকে একটা লক্ষ্য দেবে , অথবা যার মুখের হাসির জন্য পৃথিবীর সব কিছুকেই তুচ্ছ জ্ঞান করা যায় । যাকে বুকে করে বনের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখোমুখি হওয়া যায় ।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এর “চিতা বহ্নিমান” বইটাও অনেকবার পড়েছি । তপনের অবিচল প্রেমে তপতীর দীর্ঘশ্বাস মুখস্ত করে ফেলেছি সেই ছোটবেলাতেই , তবে জীবনে চলার পথে বুঝতেই পারিনি তপতী সেই কখন আমার পাশ দিয় চলে গিয়েছে । প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েও পেছন ফিরে থাকার কারনে ট্রেনটা আমার সামনে দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলে গেল, আমি 500 miles গানটা তখনো গুনগুন করছিলাম ।

প্রবাস জীবনে এক বড়ভাই এর মুখে গল্প শুনে তাকে আমাদের ক্যাডেট কলেজের ছকে ফেলে নিজের জীবন থেকে খানিক মসলা ধার করে নিদারুন এক ব্যার্থ জীবনের গল্প বানিয়ে ফেললাম । আজ এই লেখার মাধ্যমে হয়ত আমি আমার এখনকার সকল সিনিয়র, জুনিয়রের কাছে এক জন হাসির পাত্র উপস্থাপন করেছি , সে সম্ভাবনাই আছে ষোল আনা । তবে আমি যা জানি তা হল- এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মত এখানে আরো অনেক হাসির পাত্র আছে, যারা কখনো নিজের ভিতরে তাকানোর সাহস করেনি । আজ এই লেখা পড়ে ভাবছে “ আরে এই শালা তো পুরা আমারই মত”
তাই আজ আমি তাদের জন্য লিখছি । হয়ত এখানে কোন কমেন্ট পড়বে না , কোন লাইক থাকবে না , তবে যদি কেউ পড়ে , শতকরা ৫০ % মধ্যবিত্ত সংসারের ছেলে এখানে হয়ত নিজেক খুঁজে পাবে । অথবা উচ্চবিত্তের ঘরে জন্ম নেওয়া একমাত্র সন্তানটাও এর ভিতরে নিজের খানিক ছায়া খুঁজতে পারে। যে হয়তো দুঃসাহসী কোন বৈমানিক হতে চেয়েছিল , সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে চেয়েছিল , অথবা পর্বত আরোহণ করতে চেয়ছিল, কিন্তু আজ তাকে ৯-৫ টা অফিস করতে হয় । প্রতিদিন একই টাই, একই রঙের পোষাক , আর একই রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকা ।

আমার খুব ক্লোজ এক বন্ধুর বাবা ডাক্তার হতে চেয়েছিলন । যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন মেডিকেল কলজে ভর্তি হবার। তবে পরিবারের দায় তাকে সে স্বপ্ন পুরণ করতে দেয় নি। নিজের ছেলে-মেয়েক ডাক্তার বানানোর মাঝ দিয়ে সে আক্ষেপ ঘুচাতে চেয়েছিলেন, তাও হয় নি । ছেলে- মেয়েগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও ডাক্তার হয়নি । বেচারা এখনও স্বপ্ন দেখছেন –ছেলের বউ অথবা মেয়ের জামাই এর কেউ একজন যদি ডাক্তার হত !

তাই আজ আমার সব ছোট ভাই- বোনদের বলছি, বিশেষ করে যারা এখনো ভাবছ কদিন পর কোথায় ভর্তি হবে অথবা ভবিষ্যতে কি করবে তাদের —
যদি কখনো কোন স্বপ্ন দেখতে শুরুই কর তবে সে স্বপ্ন শেষ হবার আগেই ঘুম থকে লাফ দিয়ে ঊঠে বিছানা ভেঙ্গো না । আগে সে স্বপ্নকে শেষ হতে দাও । স্বপ্ন দেখার পর যদি টের পাও যে তোমার মনের মাঝে কোন পরিবর্তন এসেছে, সে স্বপ্নটা তুমি আবার দেখতে পছন্দ করছ , তবে বুঝে নিও যে তুমি ঠিক স্বপ্নই দেখছ । পরিবার, সমাজ যে যাই বলুক না কেন- সে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না। বারবার দেখতে থাক । এর ফলাফল চিন্তা করো না । বরং বারবার দেখার ফলে সে স্বপ্নটা মনে করার জন্য যখন তোমাকে ঘুমাতে হবে না বুঝে নিবে সময় হয়েছে সে স্বপ্নের পরিনতি নিয়ে ভাবার । মনে রেখ- ঘুমিয়ে আমরা যা দেখি সেটা স্বপ্ন নয়, বরং স্বপ্ন সেটাই যা তোমাকে ঘুমাতে দিচ্ছেনা । এখন সময় হয়েছে সে স্বপ্নের পেছন ধাওয়া করার । এখন সময় হয়েছে সে স্বপ্নের বাধাগুলোকে নিয়ে ভাবার । এর আগে নয় । এখন তুমি ভাব সে বাধাগুলোকে কীভাবে জয় করা যেতে পারে । থেমে যেওনা । শুরুতে পরিবার , সমাজ থেকে খানিক বাঁধা আসবে । যদি থেমে যাও তবে বুঝে নিও আবার ঘুমানোর সময় হয়েছে নতুন করে স্বপ্ন দেখার । আর যদি লেগে থাক, তবে দেখবে বাঁধাগুলোই একদিন তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে । কারন পরিবার আমাদের চলার পথের বাঁধা নয়, বরং চলার শক্তি ।

মনে রেখ, জীবন এমন নয় যে তুমি প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস নাও , বরং জীবন সেই মুহূর্ত, যে মুহূর্ত তোমাকে শ্বাস নেওয়ার কথা ভুলিয়ে দেয় ।

১,৮১৪ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    আমার খুব ক্লোজ এক বন্ধুর বাবা ডাক্তার হতে চেয়েছিলন । যোগ্যতাও অর্জন করেছিলেন মেডিকেল কলজে ভর্তি হবার। তবে পরিবারের দায় তাকে সে স্বপ্ন পুরণ করতে দেয় নি। নিজের ছেলে-মেয়েক ডাক্তার বানানোর মাঝ দিয়ে সে আক্ষেপ ঘুচাতে চেয়েছিলেন, তাও হয় নি । ছেলে- মেয়েগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও ডাক্তার হয়নি । বেচারা এখনও স্বপ্ন দেখছেন -ছেলের বউ অথবা মেয়ের জামাই এর কেউ একজন যদি ডাক্তার হত !

    এই ব্যাপারটা আমার কাছে সিকেনিং লাগে।
    নিজে যা হতে পারলো না তার দায় টানতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। মানে হয়?


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      পরিবার বড় একটা বাধা রাজিব ভাই। আমি এই একটা দিক দিয়ে পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। বাধা দেয় নাই। আবার বলেও নাই। শুধু চেয়ে দেখেছে আর বলেছে চমৎকার! এগিয়ে যাও। আমার মায়ের মুখ থেকে আজো বের করতে পারি নাই অন্তত আমাকে কি হিসাবে দেখতে চেয়েছিল। সবসময় বলেছে, এখনো বলে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হউ। আর কিছু চাই না। বড় অস্বস্তি লাগে এরকম লেখা দেখলে। কারণ আমার সেই ডার্ক সাইড অফ দ্য মুন দেখা হয় নাই। সম্ভবত বড় বেশী সৌভাগ্যবান আমি সেদিক দিয়ে।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দূর্দান্ত লিখেছো শিবলী :hatsoff: :hatsoff: আর তোমার গিটার আর হারমোনিয়ামের দরকার নাই, খালি গলাই যথেষ্ঠ 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)
    জীবন এমন নয় যে তুমি প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস নাও , বরং জীবন সেই মুহূর্ত, যে মুহূর্ত তোমাকে শ্বাস নেওয়ার কথা ভুলিয়ে দেয় ।

    ::salute:: অসাধারণ লাগলো ভাই। ব


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  4. জিয়া নূরনবী (২০০২-২০০৮)

    দারুণ লাগলো স্যার। আপনার গান মিস্‌ করি এখনো।
    "পাখিরা চায় আকাশের নীল,
    কবিতা চায় ছন্দের মিল,
    আর আমি শুধু চাই তোমাকে।।"
    🙂


    ব্জলে উঠুক বারুদ

    জবাব দিন
  5. হা-মীম(২০০০-২০০৬)

    < জীবন এমন নয় যে তুমি প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস নাও , বরং জীবন সেই মুহূর্ত, যে মুহূর্ত তোমাকে শ্বাস নেওয়ার কথা ভুলিয়ে দেয় ।>


    \\\"।নিউট্রন বোমা বোঝ. মানুষ বোঝ না ! ।\\\"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।