এক তারা ভরা রাতে মাঝ দরিয়ার ঝিরিঝিরি বাতাসের মাঝে বসে আমরা হঠাৎ শুনতে পেলাম, থাবা বাবাকে জবাই করা হয়েছে। মেরুদন্ডের ঠিক মাঝ দিয়ে ঠান্ডা কিছু একটা সরসর করে নেমে গেলো। আমার ছাব্বিশ বছর বয়স্ক মস্তিষ্ক খবরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। রুমে ফিরে এসে আবীরকে ধরে আমি ফুপায় ফুপায় কিছুক্ষণ কাঁদলাম, আমি জানতাম সুযোগ পেলে ওরা এই ছেলেকেও ছাড়বে না।
সেই রাতটা ছিল অসহনীয়, ঘুমের মাঝে একটু পর পর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠছিলাম, দেখছিলাম বিশাল বিশাল সমস্ত দা নিয়ে আমাদের জবাই করতে ছুটে আসছে, রক্ত, রক্ত আর রক্ত…
শহীদ রুমি স্কোয়াড জামাত নিষিদ্ধের দাবীতে অনশন শুরু করেছে যার অলরেডি সাড়ে ৫ দিন চলে গেছে, এই লেখা যখন লিখছি, তখন একশ উনচল্লিশতম ঘন্টা চলছে, গতকাল অনশনের ওখানে গিয়ে গাধার মত সারাক্ষণ ফ্যাচফ্যাচ করে কান্দাকাটি করসি। আমার খুব কাছের বন্ধু, আমার ডিপার্টমেন্টের খুব প্রিয় একটা জুনিয়র- ওরা অনশন করতেসে। কি বুঝে যে এই কর্মসূচী দিসে, আমি জানি না। বাংলাদেশের একটা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও এখন জানে যে জামাত নিষিদ্ধের জন্য সরকারের কোন চিন্তা ভাবনা নাই। এর জন্য অনশন করে সরকারকে কি **এর চাপে ফেলা যাবে?
ব্যক্তিগত ভাবে অনশন, মানববন্ধন এইসব কর্মসূচী আমার কাছে খুব ফানি লাগে। কারও স্বার্থ না আটকালে কেউ কাউকে কিছুই দিবে না। অনশন করলে আমার ক্ষিদা লাগবে, সরকারের কিছুই হবে না। বরঞ্চ এই শক্তিগুলা জামাতের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য আমরা ব্যয় করতে পারতাম। এখন পর্যন্ত ২৩জন হাসিখুশী তরুণ স্বেচ্ছা মরণ বেছে নিয়েছে, এবং এরা না খেয়ে কেম্নে আছে এটা চিন্তা করতেই আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
মানুষের সামনে কাঁদতে আমার খুব অস্বস্তি লাগে। কিন্তু গতকাল যতবার তানভীর দিকে তাকাচ্ছিলাম, আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতেসিল। এরা কি বুঝে আসলে অনশনে যোগ দিচ্ছে? কেন দিচ্ছে? এরা কি আসলে জানে এরা কি পাবে? জামাত শিবিরের নখেরও কিছু হবে না, অথচ আমাদের এই তেইশটা তরুণ না খেয়ে লেটায় আছে।
এই অনশন মিডিয়া কিংবা সরকারের দৃষ্টি কাড়েনি, সম্ভবত সরকার ‘করছি, করব’ বলে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবী এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিল, শহীদ রুমি স্কোয়াড হুট করে এই কর্মসূচী দিয়ে সবাইকে একটু অসুবিধা করে দিয়েছে, এজন্য। সুস্পষ্ট ভাবে বলতে হলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ‘দল’ গুলোর প্রতি সাধারণ জনগণের অবিশ্বাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে শাহবাগ দেখিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন এখন ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আর ‘শাহবাগ’ এ দুটো ভাগে সম্পূর্ণ ভাগ হয়ে গেছে। আওয়ামী ব্যাকাপের যে কথা এতদিন মুখে শোনা গেছে এখন সেটা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। শাহবাগে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না সরকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধের প্রতি আন্তরিক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে আন্তরিক। ব্লগারদের নামে হলেও এখন আর ব্লগারদের কথা শুনে কেউ গণ জাগরণ মঞ্চ থেকে কর্মসূচী দেয় না। ব্লগারদের কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় শহীদ রূমী স্কোয়াড আমরণ অনশন কর্সূমচী দিয়ে আসলে আওয়ামী লীগকেই প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে। প্রো-আওয়ামী কিছু ব্লগার, ফেইসবুকার ইতিমধ্যেই এদের পিছনে কোমড় বেঁধে লেগেছে এবং অদ্ভুত প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। দুঃখজনক ভাবে হলেও সত্য এরা সবাই শাহবাগ আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন।
শহীদ রুমি স্কোয়াড গতকাল ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে, আমি একটু উদ্ধৃত করিঃ
”মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবী করলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি করা যায় না । রুমি স্কোয়াডের মানিক বারডেমে এক রাত থেকে প্রথম চোখ খুলেই বলেছে “আমি কিন্তু অনশন ভাংবো না।” আজকে মনে পড়ছে আমাদের প্রধান মন্ত্রী কি খুশীই না হয়েছিলেন শাহবাগে তরুনদের শ্লোগান দেখে । ভেবেছিলেন জয় তো তারই । জয় বাংলা শ্লোগান শুনে ভেবেছিলেন আহা এইত হয়ে গেল । কি প্রশংসা, কি প্রশংসা তরুনদের !!! এখন মানিকের মত ছেলেরা মরে গেলেও উনি খোঁজ নেন না । কি এমন হলো এই তরুনদের? রুমি স্কোয়াড নিয়ে কোথাও কোনো বক্তব্য নেই কেন? কালকে অনশনকারীদের একজনের মা বলেছিলেন এই সরকার জামাত শিবির নিষিদ্ধ করবে না, মাঝখান দিয়ে আমার সন্তানের জীবন শেষ, ক্যারিয়ার শেষ ।”
সরকারের হাতে ৮৪ ব্লগারের নামের একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, ট্রাইবুনাল হবে, নাস্তিক ব্লগারদের ধর্ম অবমাননার শাস্তি হবে। শহীদ রুমি স্কোয়াড ট্রাইবুনাল চায় জামাত নিষিদ্ধের জন্য, সরকার তাদের ট্রাইবুনাল দিলো, একটু অন্য ভাবে। পত্র পত্রিকায় খবর এসেছে নাস্তিক ব্লগারদের তওবা করাবার একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে, এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন কর্তৃপক্ষ।
আজ সময় টিভিতে একটা ক্লিপে দেখলাম এক পুলিশকে ইট দিয়ে থেঁতলে মারছে শিবিরেরা। আমার বমি পেয়ে গেলো। নিজেরই দেশের, নিজেরই চেহারার মানুষকে মারতেছে, কেন? এরা কিভাবে মুসলমান হয়?? এই ছেলেগুলাকে কে, কারা কনভিন্স করসে? দুঃখজনক যে, যেই দাড়িওয়ালা ধার্মিক লোকটি এই ছেলেদের এ পথে নিয়ে এসেছে, সে চাঁদেই বসে থাকবে, ফোনে তার কলিজুদের সাথে আলাপ করবে, আর এই ছেলেগুলো পুলিশের গুলি খেয়ে আবার পুলিশকে হামলা করে আরও কোন পুলিশের কবজি উড়িয়ে দেবে। ভোটের সময় শুনবে, ভোট দিলে পাল্লায়, খুশি হবে আল্লায়।
ঠিক একই চেহারার কিছু ছেলেরাই বিশ্বজিৎ কে মেরেছিল।
ক্লান্তি লাগে, বড় ক্লান্তি লাগে। বাসায় পানি থাকে না সারাদিন, মিনিট বিশেকের জন্য আসে, তা দিয়ে তিন বালতি পানি ভরানো যায়, তাও আবার ঘোলা। সেটা দিয়েই সারাদিন কাটানো লাগে। ডায়রিয়া হয়ে বারবার বাথরুমে যেতে হলে কি করবো তা নিয়ে একটু দুশ্চিন্ন্তায় আছি।
তবে এসবের মধ্যেও আমরা দুজন ভালো আছি। চারপাশের অবস্থা দেখে দেখে ক্লান্ত হই, ঝগড়া ঝাটি করি, আবার মিলমিশ করি, ভালবাসি। বড় আশা হয়, কোন এক দিন, এই পৃথিবীর সকল মানুষ, সকল মানুষকে ভালবাসবে ঠিক নিজের মত করে।
লেখাটা পোস্ট করার সময় কারেন্ট চলে গেলো, রাত্তির বেলা পাবলিশের একটু আগে জানতে পারলাম, শহীদ রুমি স্কোয়াডের সদস্যরা অনশন ভেঙ্গেছে। আজ রাতে পরিকল্পনামন্ত্রী এ.কে.খন্দকার এসেছিলেন, তিনি বলেছেন জামায়াত নিষিদ্ধ না হলে তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবেন। কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য আস্বাস জানি না, তবে স্বস্তির কথা যে রুমী স্কোয়াড সেই আশ্বাস মেনে নিয়ে অনশন ভেঙ্গেছে।
শহীদ রুমি স্কোয়াডের প্রতি প্রচন্ড ভালবাসা।
বাস্তবতা হচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো -- সব, সবগুলো চামচামিতে আক্রান্ত, ভয়াবহভাবে। নইলে দেশের এসময়েও, জনতার কাছ থেকে এত শক্ত বার্তা পাবার পরেও সরকারের এ দোদুল্যমানতা দেখলে মুখ ভরে একদলা থুতু চলে আসে। ভোট আর টাকার কাছে সবাই বিক্রি হয়ে গেছে।সরকার আবার এখন লেগেছে ব্লগারদের পেছনে -- নাস্তিক-আস্তিক বাছাবাছিতে।
'মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি' - মাই ফুট!
এই লেখাটার দরকার ছিল।
শহীদ রুমি স্কোয়াডের মতো মানুষগুলি আছে দেখেই দেশ স্বাধীন হইছে একদিন, শাহবাগ আন্দোলন হয় ... হয়তো অন্য নামে এরা ফিরে ফিরে আসে। এবং আসবে। কোন লেবেল এঁটে দিয়ে এদের আটকে ফেলা যাবে না কখনোই।
তিনজন ব্লগারকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তারা অপরাধ করেছে কি করেনি সেটা কথা না। কথা হলো, আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, বাঁশের কেল্লা, ইসলামী ছাত্রী সংঘের মতো পেইজগুলোর পিছনের জানোয়ারগুলি থাকে বহাল তবিয়তে।এত ডিবি, গোয়েন্দা, আইনকানুন তাদের কিছুই করতে পারে না। অক্ষম এবং অপারগ। জামাত শিবিড় মাইরা সাফা করে দিতেছে, সরকার তখন ভয়ে নেড়ি কুত্তার মতো লেজ গুটায়ে বসে থাকে। ধর্মীয় উন্মাদনা যখন ছড়ায় সহিংসতা জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষন হয় তখন ধর্ম থাকে অনুভূতিহীন।
এখন আন্তঃ রাজনৈতিক দল প্রতিযোগীতা চলছে - কে বেশি এসলামিক? এটাই একমাত্র প্রতিযোগীতা যেখানে বর্ণ, গন্ধ, মতভেদ নির্বিশেষে সব দল অংশ নিতে পারে। এমনই যাদুকরি এই প্রতিযোগীতা বিশুদ্ধ তৃতীয় পক্ষের জন্যও উন্মুক্ত। আমাদের দর্শক হিসেবে ডাক পড়বে মাঝে মাঝে হাততালি দেবার জন্য।
বাংলাদেশে শুধু ইসলামেরই শুড়শুড়ির অনুভূতি আছে। আর তাই শুড়শুড়ি লাগে এমন চিন্তাভাবনা নিষিদ্ধ করা হইতেছে। এবং যারা শুড়শুড়ি দিতে পারে বেঁছে বেঁছে এদের মধ্যে থেকে নিরীহ কয়েকটাকে বলির পাঠা করলে মন্দ কি। কি সুন্দর দেখা গেলো - সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না!
আমার বন্ধুয়া বিহনে
''বাংলাদেশে শুধু ইসলামেরই শুড়শুড়ির অনুভূতি আছে''
আপত্তিকর ।
পুরো লিখাটি চমৎকার এবং বাস্তব ।