আমরা তখন ক্লাস সেভেনে।একাডেমিক ব্লকের উত্তর পশ্চিমের তিনটা গাছের কামরাঙা হাতছানি দিয়ে ডাকে।মনে মনে বলি আর একটু বড় হ, তারপর খাব। কামরাঙা বড় হল।এক দিন মিল্ক ব্রেকের পর মাহফুজ ,শরিফ , হাবিব ছুটল লবন নিয়ে ।কামরাঙা খাবে। আমিও ছুটেছি।ওরা তো পটাপট বেশ কয়েকটা ছিড়ে নিল। সবার আগে মাহফুজ কামড় দিল। আরে! টকও না আবার কোন স্বাদ ও নাই।আবার রস কম। কামরাঙা না অন্যকিছু ! পরে জানা গেল ওগুলো অর্জুন ফল।ক্যাডেট কলেজের ভিতরে বলে ভাল আছে। বাইরে থাকলে কবিরাজের অত্যাচারে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যেত।আমি মাহফুজের কথা বলতে চাচ্ছি। ক্যাডেট নম্বর ১১০১,খালিদ হাউস।বাড়ি আক্কেলপুর। গণিতের মন্ডল স্যার ( আব্দুল আজিজ মন্ডল) ওকে বলতেন ” ইউ মিও আক্কেলপুরি কি বুঝলে ?” ” গাঁজা খাইছ ?” মাহফুজ খুব সহজ সরল ছিল। পাম দিয়ে ফুলিয়ে দেয়ার পর ওর প্রতিক্রিয়া দেখাটা বেশ মজার ব্যাপার ছিল। আমার মনে আছে একবার ভূগোল বই হারিয়ে ফেলি। ও তখন আমাকে একটা বই দিয়েছিল।পরে কোন এক সময় আমার বই নিয়েছিল বলে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আগে ঢাকায় যাবার পথে অসংখ্য ব্রিজ পার হবার সময় ভয় পেতাম। কোচ কোন ভাবে ব্রিজের নিচে পড়ে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। ১৯৯০ সালে নওগা-ঢাকা রুটের একটি নওশাদ কোচ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের নিচে পড়ে যায়। মাহফুজ চলে যায় না ফেরার দেশে। অকৃতজ্ঞ আমি, বেঁচে থাকতে ক্ষমা চাইনি।কামরাঙা কিংবা অর্জুন গাছ দেখলেই মনে পড়ে যায় তোর কথা ।গাছ আর ফলকেই বলি আমাকে ক্ষমা করিস মাহফুজ।
কুয়াশার চাদর গায়ে বনভোজনের মাইক।মনে পড়ে যায় কলেজ পিকনিক।ভেনু রাজশাহী পার্ক। দিনভর আনন্দ উল্লাস।ফিরতে ফিরতে রাত। হতে পারত কাল রাত।বাসে ফেরার পথে কয়েক জন ছাদে উঠল। হৈ হল্লার মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছে। হঠাৎ ভূমি কম্পে আর চিৎকারে চমকে উঠি।মনে হল অতল হ্রদে পড়ে যাচ্ছি।বাসের সামনে একটা ছোট খেজুর গাছ। তার পর একটা গর্ত।একটুর জন্য তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা।বাসের ড্রাইভার আগের দুইরাতও জেগেছিল। ঘুম চলে আসায় বাস রাস্তা থেকে নিচে নেমে যায়।খেজুর গাছটা বোধ হয় আমাদের বাঁচাতেই জন্মেছিল।আল্লাহর রহমত রক্তপাতহীন দুর্ঘটনা আর জীবিত আমরা।পরদিন গ্যালারীতে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে মতবিনিময়ের সময় শওকতের বিপ্লবী কণ্ঠ।” ম্যানেজমেন্টের ত্রুটির জন্য এমন হয়েছে।” লেঃ কর্ণেল নুরুজ্জামান স্যারের সামনে এমন দুঃসাহস একটু জুনিয়র ক্লাশের ক্যাডেটই করতে পারে।ফলাফল অনুধাবন ব্যর্থতায়।ক্যাডেট নম্বর ১১১৩, খালিদ হাউস। বাড়ি দিনাজপুর।শওকত আমাদের এ ফরমেই ছিল। ওর সাথে মিজানের দ্বন্দ আমরা বেশ উপভোগ করতাম। শওকতের মাথায় এক বর্গ সেন্টিমিটার মরুভূমি ছিল । মিজানের নাকটা বড়। নাক গলানো আর টাকলেপনা।দুইজনই ভাল ক্রিকেট খেলতো।একবার ভ্যাকেশনের পর এক বিকালে কলেজ এম্বুলেন্সে শওকতকে নিয়ে গেল। ভাবলাম একবারে গেল। পরদিন দেখি ব্যান্ডেজসহ ফেরত এসেছে। হাত ভাংলো কিভাবে ? এমন জোরে কলমের হেড খুলতে লাগছি, কনুই দেয়ালে লেগে হাত ভাংলো। অবাক ব্যাপার। “এই গল্পটা না দিলে খবর ছিল। বাড়িতেই হাত ভেংগেছিল।” পরে চুপি চুপি আমাকে জানায়। ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পর অনেক দিন কোন খবর পাইনি। আসলে ওর সাথে যোগাযোগ ছিলনা। একদিন স্প্যানে ব্যাচ নিউজে দেখি শওকত/১১১৩ সাফার্ড সেভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। তার পর একদিন সবশেষ। পলু মামার কাছে জানা গেল আসল কাহিনি। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল শওকত। বিয়েটা কোন পক্ষই মানেনি। অনেক কষ্টে টিউশনি করে চলছিল।প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পরও কেউ বিয়েটা মানেনি। টেনশনে টেনশনে ২য় বার হার্টঅ্যাটাক। হসপিটালের বেডেই ৩য় হার্ট অ্যাটাক। অভিভাবকদের একগুয়েঁমি বোধকরি আল্লাহ সহ্য করেনি।
“অবসর সময় লেখাপড়া করে কাটায়।” পড়ুয়া বোঝানর জন্য বেশ মজার একটা কথা। এর জন্মদাতা ক্যাডেট মাকসুমুল হাকিম।ক্যাডেট নম্বর ১১২৫, খালিদ হাউস।২০তম ব্যাচের লাস্ট ক্যাডেট। নিরিহ একটা ছেলে । কারও সাতেও নেই, পাচেঁও নেই। বিধায় ঘটনাবহুল নয়।খুন দূরের কথা, ওর উপর রাগ করাটাও অসম্ভব।অদৃষ্টের পরিহাস। ওকে হারালাম পিলখানায়।যতদূর মনে পড়ে ওর বাড়ি সিলেট জেলায়। মাহফুজ , ফিরোজ এবং শওকত এর মত মাকসুমও ছিল এ ফর্মে। এইচএসসি পরীক্ষায় পাশাপাশি সিট পড়েছিল। কিন্তু দূরত্ব তিন গজ। ফিসফিসানির জন্যে স্যারের কাছে বকা খেয়েছিলাম। গিভ এন্ড টেক পুরো না হওয়ায় বিরক্ত হয়েছিলাম। ও পরীক্ষা ভাল দিচ্ছে বলে আমি রাগ করছি। বলেই দিল একদিন। ভুলটা ধরানো গেলনা। যাই হোক ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়েই মাকসুম আর্মিতে গেল। ২০০৬ সালে আমাদের রেশিওনাল ম্যাড ওরফে খাটাশ ওরফে বাবুলের ফোন। কুশলাদি জিজ্ঞেস না করে অন্য প্রশ্ন। ” কারও সম্পর্কে আগে থেকে জানলে তার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ?” আমি বল্লাম- বলাতো মুশকিল , কি হয়েছে ? মাকসুম কি কারও দোষ খুজে বেড়াত ? আমি বল্লাম নাতো। মেজর মাকসুম এখন চট্টগ্রামে আছে । গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। এ নিয়োগের সিদ্ধান্ত তোর ক্ষমতায় থাকলে মাকসুমকে দায়িত্ব দিতি? না দিতাম না । তা হলে বোঝ- ” কারও সম্পর্কে আগে থেকে জানলে তার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়”।২০০৯ সাল। এসএসসি পরীক্ষার ডিউটিতে আছি। হঠাৎ আব্বার ফোন পেলাম।খবর পেয়েছ ? আমি বল্লাম না তো। তাহলে টিভি দেখ।তার পর টিটু মানে জাকিরের এসএমএস। পিলখানায় দরবার হলে আছে মাকসুম। কল ধরছেনা । নাম্বার পেয়ে অনেক কল দিলাম। গ্রাহক উপস্থিত নেই।মুর্খদের বর্বরতায় রত্ন ধ্বংস।
🙁 লেখা অসম্ভব ভাল লেগেছে।
পড়া শেষে কিছু বলতে পারলাম না। থ্রি কমরেডস এর জন্য শুধুই কিছু দীর্ঘশ্বাস।
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
তিন বন্ধুর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
তিন কমরেডের দুঃখজনক প্রস্থান। আর শেষের জনেরটা লজ্জাজনক প্রস্থান। শান্তিতে থাকুক উনাদের আত্মা! 🙁
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
দুঃখজনক প্রস্থান 🙁
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
শান্তি হোক এখন...
আমি চোখ মেললুম আকাশে
জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে
🙁
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
"মুর্খদের বর্বরতায় রত্ন ধ্বংস।"
ক্যাডেট রশীদ ২৪তম,প ক ক
পুরো লেখার সারবস্তু।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
মন খারাপ হয়ে গেলো। থ্রি কমরেডস শান্তিতে থাকুন।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
:thumbup:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
লেখাটা অসাধারণ।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমাদের ৪০তম ব্যাচে এখন সবাই ঠিক আছি।
মাঝে মাঝে ভয় লাগে, কবে যে ওপার থেকে ডাক আসে ?
Any man's death diminishes me,
Because I am involved in mankind,
And therefore never send to know for whom the bell tolls;
It tolls for thee.
জন ডান-এর নো ম্যান ইজ অ্যান আইল্যান্ড থেকে।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
প্রিয় মোস্তাফিজ,
মন খারাপ হয়ে গেল। তবে বন্ধুদের জন্য তোমার যে অনুভূতি তা জেনে ভাল লাগল। ভীষণ সংবেদনশীল মন তোমার। ক্যাডেট কলেজ থেকে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সম্ভবতঃ এক ঝাঁক অকৃত্রিম বন্ধু আর তাদের অপরিসীম ভালবাসা।
আব্দুল্লাহ আল মামুন/ আর সি সি/ ১১/৬৪১/খালিদ হাউস
ধন্যবাদ মামুন ভাই :hatsoff: :hatsoff:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
::salute::
::salute::
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল