ক্যাডেট কলেজ ছেড়েছি বারো বছর হল, কলেজের প্রতি টান তবু কোনওভাবেই কমেনি। বারো থেকে আঠেরো বছর- কৈশোরের সেই নানা রঙের দিনগুলো জানি চাইলেও আর ফিরে পাবোনা, তবুও গত বারো বছরে এমন একটা দিন যায়নি যেদিন অন্ততঃ একবারের জন্যেও প্রিয় কলেজ ক্যাম্পাসকে মিস করিনি। বের হবার পর শুরুর দিকে প্রচন্ড কষ্ট হত, প্রতিটা ঘন্টায় মনে হত, ইশ, কলেজে থাকতে এই মুহূর্তে কি করতাম? এখন তো গেমস টাইম- ইশ, বৃহষ্পতিবারের ইমপ্রুভ ডায়েটে আজ সুইট ডিশ কি দিয়েছে?!
প্রতিটা সিস্টেমের মতই ক্যাডেট কলেজের ভালো খারাপ দুটো দিকই আছে।আমার পরম সৌভাগ্য, এর ভালো দিকগুলোকে সযত্নে ধারণ করে নিয়েছি বুকের ভেতর, খারাপ দিকগুলো সময়ের সাথে সাথে ঝরে ফেলেছি।
বিগত কদিনের ঘটনায় আমি সম্ভবত নতুন এক্স ক্যাডেটদের কাছে সবচাইতে ঘৃণিত, আনপপুলার এক্স-ক্যাডেট। অনেক সিনিয়র এক্স ক্যাডেটও আমাকে এরকম চোখেই দেখেন।ক্যাডেট কলেজের কিছু অসঙ্গতির সমালোচনা করায় এই ঘৃণার উৎপত্তি|
ঘৃণিত হওয়া আমার জীবনে নতুন কিছু না, পেশাগত কারণেই মানুষের ঘৃণা চন্দ্রসূর্যের মতই আমার জীবনের অপরিহার্য অংশ।তাছাড়া, আমি সামান্য মানুষমাত্র, আমার সব কিছু সবার কাছে ভালো লাগবে এটাও আশা করাটা বোকামি।
আমার আজকের লেখা নতুন এক্স ক্যাডেটদের জন্যে, যারা সদ্য ক্যাডেট কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তব জীবনের কঠোর, নির্মম রণাঙ্গনে পা রেখেছে। এই কথাগুলো আমাকে কেউ বলেনি, বাস্তবতার লাত্থিগুঁতো খেয়ে খেয়ে এগুলো আমাকে শিখতে হয়েছে।
নতুন এক্স ক্যাডেটরা আমার চাইতে মেধা,বুদ্ধিবিবেচনায় অনেক এগিয়ে আছে- বারো বছর পরের নতুন জ্ঞান ওদের হাতের মুঠোয়। আমরা ফেসবুক কি জানতাম না, কম্পিউটার চালানো বলতে শুধু গান শোনা আর গেম খেলা বুঝতাম। তবে একটা জায়গায় আমি এগিয়ে আছি-সেটা হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আমার ছোট ভাইটি/বোনটি ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হলে ওকে যা যা বলতাম, অকপটে আজ তাই লিখছি এখানে।
১)মেয়েরা আমার কাছে এলিয়েন টাইপ ছিল। দুটো লিটারেচার এ্যান্ড মিউজিক মীটে গার্লস ক্যাডেট কলেজের মেয়েদের দেখেছি, কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভ্যাকেশনে গিয়ে প্রেম করার মত স্মার্ট/বুদ্ধিদীপ্ত ছিলাম না, তাই বাইরের মেয়েদের সাথে প্রেম করাও হয়ে ওঠেনি। এমজিসিসিতে শ্রুতি ধর(ছদ্মনাম) নামে এক মহিলা কর্মচারী ছিলেন,মেয়েরা তার হাত দিয়ে চিঠি পাঠাতো আমাদের ধোপা মতিন ভাইয়ের(ছদ্মনাম) কাছে, আমরা পাঠাতাম উনার মাধ্যমে। গুজব আছে, দুই কলেজের এই দুই কর্মচারীর মধ্যে নাকি ক্যাডেটদের কারণে প্রেমও হয়ে গিয়েছিল!
ইয়ে, আমিও চিঠি আদান প্রদান করতাম। আমার এক দুজন বান্ধবী(এমজিসিসি) এখনো এই প্রোফাইলেই আছে। দোস্তরা, খবরদার মুখ খুলবি না!!
ক্যাডেট কলেজ থেকে অল্প কয়দিন আর্মিতে থেকে পরে যখন নর্থ সাউথে এলাম, মরুভূমি থেকে আমাজনে আসার মত অনুভূতি হল। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, কিশোর বয়েসের কৌতুহল থেকে প্রাণ ভরে “চোখের ব্যায়াম” করতাম ওল্ড ক্যাম্পাসের SPZ বিল্ডিং আর ক্যাফেটেরিয়ার মাঝামাঝি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে।
“চোখের ব্যায়াম” মানে অশালীন কিছু না, অবজারভেশন মাত্র। হ্যাঁ, ছেলেবন্ধুদের সাথে রসালো সব আলাপ করতাম, দুষ্টুমি করতাম, আর সুযোগ পেলে মেয়েদের সাথে হালকা পাতলা ফ্লার্ট করতাম।
লাইফ লেসনঃ মেয়েরা আসলে এলিয়েন না, ওরা আমাদের চেয়ে একটু ভিন্ন হলেও তোমার মতই রক্তমাংসের মানুষ, স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি। মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ থাকাটাই স্বাভাবিক, না থাকলেই বরং অবাক হব। এটা খারাপ কিছু না। যেটা খারাপ তা হচ্ছে ওদেরকে মানুষ না ভেবে মাংসের টুকরা আর পর্ণ ফ্যান্টাসির উপকরণ ভাবাটা।
কাউকে ভালো লেগেছে? সাহস করে প্রপোজ করে ফেল! যদি সে না-ও বলে দেয়, ক্ষতি কি!সাহস করে যে বলেছ, এটা পরবর্তীজনকে প্রপোজ করার সময় তোমাকে এগিয়ে দেবে! প্রেম করো, ডেট করো, যা-ই করো না কেন, দুটো জিনিস খালি মাথায় রাখবেঃ নো জবরদস্তি, নো অসম্মান।
তুমি একজন জেন্টেলম্যান ক্যাডেট, কোন মেয়েকে অসম্মান বা তার প্রতি জোর জবরদস্তি করা তোমার জন্যে হারাম। কারও প্রত্যাখ্যানে বেশি অপমানিত বোধ করারও কিছু নেই, তমার যেমন সবাইকে ভালো লাগেনা, সবার যে তোমাকে ভাল লাগবে এমনও তো কথা না, তাইনা?!
২) ছয়টা বছর বন্দী থেকে কে না চায় একটু মজা করতে? মজা না করাটাই তো আঁতলামি!! ইচ্ছেমত মজা করবে, তবে সেই “মজা” গুলো যেন ড্রাগসের দিকে ধাবিত না হয়।কোন বন্ধুবান্ধব যদি ড্রাগ অফার করে, জেনে রেখো ওই বদমায়েশ তোমার বন্ধু নয়।সময় থাকতে সরে পড়ো, আই বেগ ইউ!
৩) ক্যাডেট কলেজে আমরা সবাই একই ছাঁচে, একই সিস্টেমে বেড়ে উঠেছি- বাইরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে সামলে উঠতে আমার বেশ অসুবিধাই হয়েছে শুরুতে। নর্থ সাউথে প্রথম ক্লাসের কথা এখনো মনে আছে, খালিদ মাহমুদ খান( কে এম কে) স্যারের ইএনভি ১০১ ক্লাস। আমার পাশে দেখলাম এক হাতে বার্গার আরেক হাতে কোক নিয়ে স্লিপিং গাউন টাইপ পোশাক পরা এক অতি সুন্দরী তরুনী চেয়ারে পা গুটিয়ে বসল। ক্লাসে যে এভাবে কোক আর বার্গার খাওয়া যায় এটা আমার কল্পণারও বাইরে ছিল। স্যার ক্লাসে ঢুকতেই আরেক কাহিনী,আমি সটান দাঁড়িয়ে গেলাম- বাকি সবাই বসে বসে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন আমি এলিয়েন!
এরকম হাজারটা পার্থক্য থাকবে, এগুলোকে মেনে নিতে হবে।কেউ তোমার চেয়ে ভিন্ন মানেই যে তোমার চাইতে নীচু, এমনটি ভেবোনা ভাই! এই পৃথিবীতে হাজার রকমের হাজার মানুষ থাকবে, তাদের থাকবে ভিন্ন ভিন্ন রুচিবোধ, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিকতা, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস।
তবে হ্যাঁ, দুটো বেসিক জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে নাও। জাফর ইকবাল স্যারের ভাষায় বলিঃ
“বাংলাদেশে একটা কেন, একশটা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ থাকবে-তবে তাদের সবাইকে হতে হবে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এর বাইরে হলেই ইউ আর আউট।”
দ্বিতীয়টা আমার কথাঃ
ধর্মের নামে মানুষ হত্যার বা খুনোখুনির কোন অধিকার তোমাকে কেউ দেয়নি। এধরণের ব্রেইনওয়াশ যদি কেউ তোমাকে দিতে চায়, দ্রুত সরে পড়ো।যদি বেশি সন্দেহজনক লাগে, আমাকে জানাও।তোমার এই ভাই তোমাদেরকে অনেক বকাবকি করলেও পুলিশ হিসেবে খুব বেশি খারাপ না!
৪) পড়াশোনা/ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু বললাম না, তোমাদের মত মেধাবী ছেলেমেয়েদের এসব নিয়ে কথা বলার মত ধৃষ্টতা আমার নেই।তবে কেউ বিসিএস/পুলিশ/আর্মিতে যোগ দিতে চাইলে আমাকে নক করতে পারো, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব তোমাদের হেল্প করতে।
রঙিন স্বপ্নের পৃথিবী থেকে বাস্তবের কঠোর মাটিতে পা রাখতে আমার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, তোমাদেরও হবে।ক্যাডেট কলেজ ব্লগে অনেক দিন আগে পড়া একটা কথা দিয়ে শেষ করিঃ
সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফুরিয়ে আসছে জেনেও প্রাণপণে লড়াই করার ট্রেনিং পেয়েছো তুমি, ইউ আর এ ক্যাডেট।
It doesn’t matter how big the obstacle is,how impossible the situation looks like- a Cadet just cannot give up. Its not in your system, its not what you are made of.
লড়ে যাও, মহাবিশ্বে এমন কিছু নেই যা তোমাকে ঠেকাতে পারে।
শুভকামনা সবাইকে!!!!!
আমাদের চিরচেনা "মাস্ফু" ইজ ব্যাক! :guitar: :party:
[টানা ২৩ দিনের মোটরযাত্রার ক্লান্তিতে শরীরের প্রায় সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিদ্রোহ করছে...... তারপরেও তোমার পোষ্টে মন্তব্য করার জন্যই শুধু লগ-অন করলাম।]
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
শুধুমাত্র আপনার আর জুনাদার কারণে। আপনারে আমি ছোটখাট পীর স্টাইলে পছন্দ করি- আপনি এই গরীবের লেখা শেয়ার দিছেন দেখে আর থাকতে পারলাম না 😀
আপনি ২৩ দিনের মোটর যাত্রা করে কি পুরা আম্রিকা প্রদক্ষিণ করসেন নাকি? করে থাকলে এইবার একটা লিখা দেন পড়ি! :dreamy: :dreamy:
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
@ মোকাব্বির,
আমেরিকা না, ইউরোপে; একটা অংশমাত্র। বুঝলাম, আবার আসতে হবে, আরো দীর্ঘ সময় নিয়ে।
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
এইবার তো আমার গায়ে হিংসার আগুন ধরায় দিলেন। আর ইউরোপ। খুব সখ আছিলো একটা ঘুরান্টি দিমু। দেখি সামনে কপালে রাখসে কিনা! 🙁
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফুরিয়ে আসছে জেনেও প্রাণপণে লড়াই করার ট্রেনিং পেয়েছো তুমি, ইউ আর এ ক্যাডেট :thumbup: :thumbup:
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বার বার
এই লিখাটা সদ্য বের হয়ে আসা ক্যাডেটদের গিলায় খাওয়ায় দিতে হবে। কিন্তু পড়ে প্রথমেই পুলাপান কইবো, 'এহ! বড় ভাই আইসে।' নগদে বোরিং, ব্যাটিং করা বড় ভাই হিসাবে ট্যাগ খায়া গেলেন। তারপরে ওরা যখন এই পর্যায়ে আসবে, কোন একদিন সার্চ করে এই লেখাটা দেইখা দীর্ঘশ্বাস ফালায় চিন্তা করবে, ১২ বছর আগে এই ভাই চরম কিছু সত্য কথা বলসিলো, আগে পড়ি নাই কেন? এই হইলাম আমরা! 😀
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
🙂
বেড়ে বলেছ মোকা।
নতুন ক্যাডেটদের জন্যে হিংসা হচ্ছে। আহা মাসরুফ কেন আর ৩০ বছর আগে এলো না!
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
আগেই পড়েছিলাম ফেসবুকে। এখানে এসে হাজিরা দিয়ে গেলাম।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
ভেরী ইন্সপায়ারিং!
মাস্ফু, তোরে অনেক ধন্যবাদ লেখাটা দেবার জন্য।
আশা করি কেউ না কেউ উপকৃত হবে।
সেটা যদি মাত্র একজনও যদি হয়, তবুও এই লেখাটা স্বার্থক হবে... 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
ভাল লিখেছো।
স্ট্যাটাস হিসাবেই দেখেছি। আবারো দেখলাম।
এখানে থাকার ভাল দিক হলো, যখন তখন রেফার করা যাবে।
এখানে দিয়ে খুবই ভাল একটা কাজ করেছো...
:boss: :boss: :boss:
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
মাস্ফ্যুকে আবার সিসিবিতে দেখে :just: খুব ভাল লাগতেছে 🙂
খুব উপকারী একটা লেখা, নতুন এক্স ক্যাডেটদের কোন উপদেশ দিতে গেলে আমি এর সাথে শুধু একটা জিনিষই যোগ করতাম, নিজেদের এলিট ভেবো না।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহা, এলিটিজম নিয়ে কিছু বইলেন না আকাশদা। B-)
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\