হাত ও প্রভাতফেরী

হাত

“এইখানে, স্যার, শালা মুক্তির বাচ্চা এই পোড়া ঘরের মইদ্দে মইরা পইড়া আছে , আমি খবর পাইয়া আপনেরে জানাইলাম-পাকিস্তানরে বাচাইতে এইগুলারে শ্যাষ করন লাগবো”-এক নি:শ্বাসে শুনলাম রাজাকারটার কথা| একা ছিলাম, আশে পাশে কাউকে না পেয়ে নিজেই ঢুকলাম ওর সাথে| মুক্তিবাহিনীর এই কমান্ডার খুব জ্বালিয়েছে, ব্যাটার লাশটা নিয়ে যেতে পারলে ক্যাপ্টেন থেকে আমার মেজর হওয়া ঠেকায় কে! পাক আর্মি বলে কথা!!

উল্টে পড়ে আছে লাশটা, পা থেকে গলা পর্যন্ত পোড়া, কিভাবে জানি মাথাটা অক্ষত আছে| হাতে এখনও রাইফেল ধরা ব্যাটাচ্ছেলের, শখ কত! পোড় খাওয়া পাক আর্মির সাথে লাগতে এসেছিস তোরা মেছুয়া বাংগালির জাত, এবার বোঝ মজা!

কোমর থেকে কমান্ডো নাইফটা বের করলাম, মুন্ডুটা কেটে সিও স্যারের কাছে নিয়ে যাব| রাজাকারটা আমার ঠিক পেছনে এসে দাড়ালো , প্রভুভক্ত ঘেয়ো কুকুরের মত বিগলিত হাসি ওর মুখে| ব্যাটাকে বললাম লাশটা উল্টাতে, যাতে গলায় ছুরি বসানো সহজ হয়|

একী! রাজাকারটার মুখ আর লাশটার মুখ হুবহু এক কেন?! আশেপাশে এভাবে হাসছে কারা!!! ইয়া খোদা!!!!

লাশটার পোড়া দুটো হাত ঠিক সেই মুহূর্তে মড়াৎ করে ঘাড়টা মটকে দিলো ক্যাপ্টেন সরফরাজ খানের|

প্রভাতফেরী

“ম্যাজিস্ট্রেট স্যার অর্ডার দিছেন, গন্ডগোল থামাইতে হইবো, বুঝলা মিয়ারা?”

সাব ইন্সপেক্টর কামালউদ্দিন তার অধ:স্তন কন্সটেবলদের বলছিলেন| ত্রিশ বছরের চাকুরি, এই সামনের মার্চে রিটায়ার করে দেশে যাবেন| আর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক|

কি মুশকিল, এর মধ্যে ডিউটি পড়েছে ঢাকা মেডিকেলের সামনে| অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, আজ এখানে একটা গণ্ডগোল না হয়েই যায়না| সরকারের নিমক খেয়েছেন, সরকারী আদেশকে দৈববানীর মতই পালন করে এসেছেন সারাজীবন|সিনিয়র অফিসাররাও তাই সবচেয়ে ঝামেলার জায়গাটাতেই ডিউটিতে পাঠিয়েছে তাকে|

এই রে! মিছিল দেখি এদিকেই আসছে! “অন গার্ড, পজিশন নেও সবাই, সাবধান!!” – কামালউদ্দিনের চিৎকারে সব কজন কন্সটেবল টানটান হয়ে দাড়ালো| বন্দুক সোজা মিছিলের দিকে|

“রাষ্ট ভাষা বাংলা চাই!” “উর্দু ভাষা মানি না, মানব না”-মিছিলটা আরো এগিয়ে আসছে|আরে যন্ত্রণা! ভাষা নিয়ে এত লাফানির কি আছে,একটা হইলেই তো হয়! এইটার জন্য একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাংতে হবে?? মরার ভয় নাই তোদের!?! প্রমাদ গুনলেন কামালউদ্দিন।

“স্যার, কি করুম???” কন্সটেবল ফারুক জিজ্ঞাসা করল| বাচ্চা ছেলেটা, দুদিন হয়নি চাকুরিতে এসেছে কিন্তু দারুন চৌকশ| ঝামেলার সময় মাথা ঠান্ডাও রাখতে পারে খুব| মিছিল বিপজ্জনকভাবে কাছে চলে এসেছে, এখন শুধু অর্ডারের অপেক্ষা|

কামালউদ্দিন মিছিলটার দিকে তাকালেন, তারপর হাতের তালু দিয়ে ভ্রু আর কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নিলেন| মিছিলের সবচাইতে সামনে লম্বা, পাঞ্জাবি পরা একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে| হ্যাংলা পাতলা এই ছেলেটাই হাতের মুঠি তুলে নেতৃত্ব দিচ্ছে মিছিলের। ওর ঠিক মাথা বরাবর ইশারা করে তর্জনী তুলে বললেন- “ফায়ার!”

গুলি করার সাথে সাথে পুলিশের দলটি অবাক হয়ে দেখল, ছেলেটির বুক আর মাথা থেকে রক্তের বদলে অক্ষর বেরুচ্ছে- অ আ ক খ বৃষ্টির মত বেরিয়ে ঢেকে দিচ্ছে নীল আকাশ, সবুজ গাছ আর পীচঢালা কালো রাস্তা|

আর তার তেষট্টি বছর পর বাংলাদেশে জন্ম নেয়া একুশ বছরের কোন এক বাংগালী তরুনকে তার প্রিয়তমা কোন এক বংগ ললনা জিজ্ঞাসা করল, “ওয়াসসাপ, হানি! ক্যান ইউ টেল মি হোয়াট ইজ দিস প্রভাতফেরী শিট?”

৮৭৩ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “হাত ও প্রভাতফেরী”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    “ওয়াসসাপ, হানি! ক্যান ইউ টেল মি হোয়াট ইজ দিস প্রভাতফেরী শিট?”

    :clap: :clap: :clap:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    প্রিয় মাসরুফ,

    অনেক ধন্যবাদ অনুরোধ রাখার জন্য।

    শেষটা হয়েছে দুর্দান্ত। :hatsoff:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।