শিরোটীকাঃ
মইনুল ভাইয়ের ফুটবল লিজেন্ড লেখাটা ভালো লেগেছে ভীষন। কথা ছিল অন্যরা তাদের প্রিয় ফুটবলার নিয়ে লিখে এটাকে সিরিজ হিসেবে চালু রাখবে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। কেউ লিখছেনা দেখে ভাবলাম আমি চেষ্টা করে দেখি।
——————————————————————————————–
———————————————————————————————
‘ছোট্ট মোটা ছেলেটাকে দেখেছ? চল, আজ আমরা ওকে খুন করে ফেলি’-খেলা শুরুর আগে হাঙ্গেরির এক ফুটবলারকে দেখিয়ে পাশে দাঁড়ানো সতীর্থকে ঠিক এ কথাটাই বলেছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক বিলি রাইট। ১৯৫৩ সালে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হওয়া ইংল্যান্ড-হাঙ্গেরি ম্যাচের কথা এটা। ফুটবল ইতিহাসে যা এখনো স্মরণীয় ‘ম্যাচ অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে। কেন শতাব্দীসেরা ম্যাচ, সেই উত্তর পাওয়া গিয়েছিল ৯০ মিনিট পরই। বিলি রাইট যাঁকে খুন করতে চেয়েছিলেন, সেই ছোট্ট মোটা ছেলেটার দলের কাছে ৬-৩ ব্যবধানে হেরে গেল ৯০ বছর ধরে ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অপরাজিত থাকা ইংল্যান্ড! ম্যাচটা শুধু এই রেকর্ড বা গোল ব্যবধানের জন্য স্মরণীয়, এমন নয়। আসলে বিশ্বকে সেদিন এক নতুন ধরনের ফুটবল দেখাল হাঙ্গেরি। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামের দর্শকদেরও যে কারণে মনে হলো, এরা নিশ্চিত এই গ্রহের কোনো দল নয়!
আর দেখতে ছোটখাটো, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি মোটা সেই ছোকরাটা? একাই নাকের পানি, চোখের পানি এক করে দিলেন ইংল্যান্ডের। উল্টো খুন করাটাই যেন বাকি থাকল শুধু!
ফেরেংক পুসকাস। প্রথম দর্শনে তাঁকে আসলেই ঠিক ফুটবলার বলে মনে হতো না। বেশ ছোটখাটো, চওড়া বুক, শরীরটাও অন্যদের চেয়ে একটু ভারী। তার ওপর হেড করতে পারেন না ঠিকমতো, চলার মধ্যে চলে শুধু বাঁ পা-টা। এবং এই বাঁ পা দিয়েই মাঠে যা ইচ্ছে, তাই করেছেন পুসকাস। তাঁর সময়ের হাঙ্গেরি তাই খ্যাত হয়েছিল ‘অ্যানিসসাপাত’ বা ‘গোল্ডেন টিম’ হিসেবে। হবেই তো। টানা চার বছর অপরাজিত থেকে ১৯৫৪ সালে ফিফা ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেটিং নিয়ে শীর্ষে উঠেছিল তারা, ৪২ জয় আর ৭টি ড্রয়ের পর যাদের একমাত্র পরাজয়টি এসেছিল ১৯৫৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে!
কিন্তু কেউ কেউ হেরে গিয়েও জিতে যায়। পুসকাস যেমন জিতেছেন। স্কোর বলছে জার্মানি জিতেছিল, রেকর্ড বুকেও তা-ই লেখা। কিন্তু মাঠের খেলা আর ফুটবল নন্দনতত্ত্বে তাদের ছাপিয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিল পুসকাসের হাঙ্গেরি, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কারো। জয়টাও এখানেই। শুধু সেদিনের ফাইনাল নয়, তার আগে-পরে যা করেছেন পুসকাস, সবই এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে ‘ভয়াল সুন্দর’ ফুটবলের বিজ্ঞাপন হিসেবে। সব সময়ই থাকবে।
বুদাপেস্টের এক গউন্দ (রাস্তার পাশের ফাঁকা মাঠ) থেকে বিশ্ব ফুটবলের ‘দ্য গ্যালোপিং মেজর’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বাবা ফুটবলার ছিলেন। ছেলের শুরুটাও হয়েছিল বাবার ক্লাব কিসপেস্টে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে। সেখান থেকে হাঙ্গেরির জাতীয় দল পর্যন্ত আসতে পুসকাসের সময় লেগেছে মাত্র দুই বছর। এর কিছুদিন পরই সামরিক শাসন জারি হলো হাঙ্গেরিতে। কিসপেস্টকে নিজেদের অফিশিয়াল দল বানিয়ে নিল হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনী। নতুন নাম হনভেড। প্রথম মৌসুমে একাই ৫০ গোল করে হনভেডকে হাঙ্গেরিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জেতান পুসকাস। এটা ১৯৪৯-৫০ মৌসুমের কথা। তার পরও আরো চারবার হনভেডকে এই শিরোপা এনে দিয়েছেন তিনি। হাঙ্গেরিয়ান লিগের সবচেয়ে সফল এই ক্লাবের হয়ে ১৬৪ ম্যাচে ১৬৫ গোল করা পুসকাস সত্যিই হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবের প্রাণপুরুষ।
প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি রিয়াল মাদ্রিদেরও। ১৯৫৬ সালের সেই ‘হাঙ্গেরিয়ান বিপ্লব’-এর পর দেশ ছেড়ে স্পেনে পাড়ি জমান পুসকাস। অতিথি ফুটবলার হিসেবে কিছুদিন খেলেন এনপানিওলের হয়ে। কিন্তু পুসকাসের মতো ফুটবলারকে কি আর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে পছন্দ করবে কেউ! ১৯৫৭-তেই তাঁকে নিজেদের দলে নিয়ে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। পুসকাসের বয়স তখন ৩১। কিন্তু বয়সকে হার মানাতে জানতেন বলেই না তিনি ইতিহাসের সেরা ফুটবলারদের একজন হতে পেরেছেন। বাঁ পায়ে গোলার মতো শট নিতে পারতেন বলে অল্পদিনের মধ্যেই রিয়াল সমর্থকদের কাছে তাঁর পরিচিতি হয়ে গেল ‘দ্য বুমিং ক্যানন’ হিসেবে। আলফ্রেডো ডি স্টেফানো আর ফ্রান্সিসকো জেন্তোর সঙ্গে মিলে রিয়াল মাদ্রিদকে করেছিলেন টানা পাঁচ মৌসুমের লা লিগা চ্যাম্পিয়ন। সঙ্গে ইউরোপিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন তিনবার, দুইবার রানার্স-আপ!
এ সব কিছুই তাঁর ক্লাবের হয়ে অর্জন। কিন্তু দেশের হয়ে পুসকাস উজ্জ্বল তার চেয়েও অনেক বেশি। পঞ্চাশের দশকে তাঁর হাঙ্গেরিকে এখনো ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দল বলে মানেন সবাই। মানতে হবে। ‘ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্স’রা আসলেই মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিলেন প্রতিপক্ষের জন্য। আর সে কারণেই ১৯৫৪ সালে যখন সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে খেলতে যান, যেন আগে থেকেই পুসকাস, ককসিস, হিদেকুটিদের শিরোপাটা দিয়ে দিতে রাজি ছিলেন অনেকে। নক আউট পর্ব শুরু হওয়ার আগের ম্যাচগুলোর দিকে তাকালে অন্তত তা-ই মনে হবে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ এবং তার পরের ম্যাচে জার্মানিকে ৮-৩ ব্যবধানে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে তারা। দুই ম্যাচে পুসকাস নিজে করেছেন ৩ গোল। শেষ আটের লড়াইয়ে ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে, একই ব্যবধানে উরুগুয়েকেও সেমিফাইনালে হারায় হাঙ্গেরি। যদিও এই দুই ম্যাচে ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি পুসকাস। বার্ন স্টেডিয়ামের ফাইনালেও জার্মানির বিপক্ষে পরিষ্কার ফেভারিট হাঙ্গেরি। তার ওপর আবার ইনজুরি কাটিয়ে ফিরেছিলেন অধিনায়ক পুসকাস। যদিও অনেকেই বলছিলেন, পুসকাসের ফেরায় ছন্দ নষ্ট হতে পারে ককসিস, হিদেকুটি ও জিবোরকে নিয়ে গড়া হাঙ্গেরিয়ান আক্রমণভাগের। সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে ষষ্ঠ মিনিটেই হাঙ্গেরিকে এগিয়ে নেন তিনি। দুই মিনিট পর জিবোরের গোলে ব্যবধান দ্বিগুণ হলে হাঙ্গেরির চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সময়ের অপেক্ষা ধরে নিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু তাহলে আর এই ম্যাচের নাম ‘মিরাকল অব বার্ন’ হবে কেন! দশম মিনিটে ১ গোল ফিরিয়ে ম্যাচে প্রাণ ফেরান মরলক। আট মিনিট পর সমতা ফেরান রান! বার্ন তখন উত্তেজনায় ফুটছে। বিরতির পর জার্মান ডিফেন্সে পুসকাস, ককসিসরা আক্রমণের ঢেউ বইয়েও গোল আদায় করতে পারছিলেন না। টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েও ককসিসের ফাইনালে গোলশূন্য থাকাটাও অবশ্য ট্র্যাজেডির। হাঙ্গেরির আক্রমণের ফাঁকেই পাল্টা আক্রমণ থেকে ৮৪ মিনিটে গোল করে জার্মানিকে এগিয়ে দেন রান। ৮৭ মিনিটে পুসকাস গোল করলেও রেফারি সেটা বাতিল করেন অফসাইডের অজুহাতে। অথচ ম্যাচ শেষে জার্মানের অনেক খেলোয়াড়ই বলেছেন, কোনোভাবেই অফসাইডে ছিলেন না পুসকাস। গোল বাতিল হওয়ায় সবাইকে অবাক করে ৩-২ ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় জার্মানরা।
শুধু শিরোপাটাই জিততে পারেনি! কিন্তু ফুটবল মাঠে যা করা যায়, ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে তার সবই করে দেখিয়েছে হাঙ্গেরি। ১১ গোল করে ‘গোল্ডেন শু’ জিতে নিয়েছেন স্যান্ডর ককসিস, ‘গোল্ডেন বল’ পেয়েছেন ফেরেংক পুসকাস। কিন্তু ওই যে বিশ্বকাপ না জিততে পারার আফসোস, সেটা তো পুসকাসের থেকে গিয়েছিল আজীবন।
থাকবেই। বিশ্বকাপ বলে কথা। তবে দেশের হয়ে ৮৫ ম্যাচে ৮৪ গোল করা এই হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি অপ্রাপ্তির বেদনাটাও হয়তো কিছুটা ভুলে যেতেন ২০০৯ সালে তাঁর নামে সুন্দরতম গোলের জন্য ফিফার প্রবর্তন করা পুসকাস অ্যাওয়ার্ডের কথা জেনে যেতে পারলে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০০৬ সালে ওপারের দেশে চলে যাওয়ার আগে অবশ্য একটা কথা জেনে গিয়েছিলেন এই ফুটবল গ্রেট। যখনই কোনো হাঙ্গেরিয়ান বিদেশে যায়, তারা নিজেদের পরিচয় দেয় এভাবে_’ইয়েস, আই অ্যাম এ হাঙ্গেরিয়ান, ম্যান ফ্রম পুসকাস কান্ট্রি।’
কতজন ফুটবলারের ভাগ্যে এই সম্মান জোটে?
পুসকাসের নাম শুনেছি অনেকবারই। বিশ্বকাপের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলেই হাঙ্গেরি আর পুসকাস বার বার উঠে আসেন! লেখাটা দারুণ জমাটি হৈছে, কামরুল ভাই!
অসাধারন লিখেছো কামরুল :boss: :boss: :boss: ।
আমি পরের লিজেন্ড নিয়া গবেষনা শুরু করে অফ ট্র্যাক হয়ে গেসি।
দুর্ভাগ্য- পুসকাসের খেলা দেখা হলো না! 🙁
লেখা চমৎকার, একেবারে ক্রীড়া সাংবাদিকদের মত। 😉
:boss: :boss: :boss: :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:
অসাধারন হয়েছে :hatsoff:
দারুন লেখা... :thumbup: আমাদের যাদের পুসকাসের খেলা দেখার সৌভাগ্য হয় নাই তাদের জন্য...
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ভাই রে ভাই! এ তো দেখি পুরাই গোল মেশিন, তাও বাম্পায়ের মেশিন!! 😮 😮 😮
পুসকাস কিন্তু পরবর্তীতে স্পেনের জাতীয়তা গ্রহন করে স্পেনের হয়ে খেলেছিল। ১৯৬২ তে স্পেনের হয়েই বিশ্বকাপ খেলে পুসকাস তবে সেবার কোন গোলই (৩ ম্যাচে) করতে পারেনি সে।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ব্যাপার না 😀
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
প্রথম আলো তে একবার পুসকাস কে নিয়ে একটা লেখা পড়ছিলাম।এই লেখাটা ঐ টার চেয়ে বেশি মানবিক ।
লেখাটা পড়া পড়া মনে হইতেছে, কই যেন পড়ছি 😀
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
এইখানে নাকি দেখেন তো 😉
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
দারুণ লিখছেন কামরুল ভাই :clap:
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
:hatsoff: :hatsoff: :hatsoff: :boss: :boss: :boss:
:clap: :clap: :clap:
তুই তো বাংলাতে ও দারুন লিখিস রে! হ্যাটস অফ ফর ক্যাডেটস
:boss: :boss: :boss:
ভুল লেখায় কমেন্ট করে দেন নাই তো ! 😕
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
আরে যা বলসে বলসেই । চোখ বুজে গ্রহণ করে ফেলেন প্রশংসা 😀
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
চ্রম পোষ্ট :clap:
সবার কাছেই প্রিয় কিংবদন্তীর ফুটবলারদের নিয়ে পোষ্টের দাবী জানিয়ে গেলাম।
অফটপিকঃ কামরুল ভাই, আপনি দেখি বাংলাতেও দারুন লেখেন :grr: :grr: ।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
তুই কি আমার জাপানিজ ভাষায় লেখাগুলোও পড়ছিস? :grr:
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
জ্বি ভাইয়া, কামরুল তপু ভাই ঐগুলাকে বাংলায় ভাষান্তর করে লিঙ্ক দিয়েছিলেন আমাকে। আপনি যা নাইচ লেখেন না 😛
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
বহুভাষাবিদ কাম্রুল ভাইয়ের এই পোস্টটাও বরাবরের মতই ভাল পেলুম
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
এই জন্যেই জার্মানীরে দেখতারিনা... x-(
সুন্দর ফূটবলের হন্তারক...'৫৪...'৭৪... 😡
কামরুল ভাই, আপনি তো বাংলাতেও চ্রম লেখেন দেখি... ;))
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আমি এইটা বুঝিনা মানুষ জার্মানি কে কেন সাপোর্ট করে ?
তুই ইংরেজী পত্রিকাতে কি করছিস?
You cannot hangout with negative people and expect a positive life.