নিথর, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে মানুষটা। নাকে দু’টো আতর লাগানো তুলো গোঁজা। তার দিকেই অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে তার ছোটো নাতনী হৃদিতা।
– ভাইয়া, দাদার নাক থেকে ওটা খুলে দাও না, দাদা তো নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
অর্ক তাকে কিভাবে বলবে যে দাদা আর কখনো শ্বাস নেবেন না। সেও তো এ বিদায় মেনে নিতে পারছে না; মনে মনে অনেকবার ভেবেছে দাদা এখনই জেগে উঠবে; আবারও সৈয়দ সাহেব হয়ে বলে উঠবে, “ ওডা, নাকের মদ্যে ইয়ান কি দি রাকসস? আঁ’র চেয়ারখান দে। হুইতে আর ভাললাগেনা, এ’ন বমু”। যদিও সে জানে এ ভাবনা ভাবনাই থেকে যাবে তবুও অর্ক ভাবতেই থাকে; একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দাদার দিকে। এদিকে অনেকক্ষণ জবাব না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হৃদিতা নিজেই তুলোগুলো তুলে দিতে যায়।
– এই মেয়ে কি কর? কর কি?
– আহা! দাদা তো নিশ্বাস নিতে পারবে না।
– মা, যাও উপরে যাও।
সবার ওপর রাগ করে দোতলায় চলে যায় হৃদিতা। কেউ বোঝে না কেন দাদা যে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। বাবা বলেছেন মানুষ দুই মিনিট শ্বাস না নিতে পারলেই মারা যায়। বাবাও তো ওখানে আছেন, বাবা কিছু বলে না কেন কাওকে। না বলুক, দাদার কিছু হলে শিক্ষা হবে। সবসময় বাবা তাকে বকে আজ সে বাবাকে আচ্ছা করা বকে দেবে।
দোতালায় সবাই কাঁদছে। মানুষটার নাতি-নাতনী, ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, আত্মীয়-স্বজন সবাই। কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, তার পাশেই তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা না পেয়ে নিজেই হার মেনে কাঁদছে কেউ। সবার সামনেই সবাই কাঁদছে আজ, যেন মানুষটা কান্নার লাইসেন্স দিয়ে গেছে আজ সবাইকে। কিন্তু তারপরও বারান্দার কোণায়, স্টোররুমে, রান্নাঘরে কিংবা ড্রইংরুমের পর্দার পেছনে লুকিয়ে অনেকে চোখের পানি মুছছে; আজো তাদের কাঁদতে মানা।
অর্পিতা এ দলেরই একজন। ছাদে রেলিঙয়ের ওপর বসে আছে ও। পুরো বাসায় তার সবচাইতে প্রিয় যায়গা এটি। এখান থেকে কেউ তাকে দেখতে পায় না অন্যদিকে সে সবাইকে দেখতে পায়। প্রচণ্ড মন খারাপ হলে সে এখানে চলে আসে, হেডফোন দুটো যখন গান শোনায় তখন মনে হয় সারা পৃথিবী গান গাচ্ছে। কিন্তু আজ অর্পি’র কাছে মন ভালো করার মতো কোনও গান নেই। নিচে সবার মায়াকান্না দেখতেও ভালো লাগছে না, তাই সে এখানেই আছে। কিছুক্ষণ পরই এদিক ওদিক ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল অর্পি “খুব মজা লাগে না তোর? দুনিয়ায় পাঠাবি, রঙচঙ দেখাবি, মানুষকে ভালবাসবি, আবার একদিন নিয়েও যাবি, এত সস্তা কেন সব? এত আনন্দ কেন পাস তুই মানুষকে কষ্ট দিতে? ও তুই তো আবার খোদা, তোর তো হাসি-কান্না কিচ্ছু নাই ”। নিচের দিকে এক নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অর্পিতা। হঠাৎই সে ফিক করে হেসে দেয়। “বেচারা ঈশ্বর, সর্বশক্তিমান, তুই কি জানোস তোর সবচেয়ে বড় দুঃখ তোর আবেগ নাই। সবসময় ওখানে বইয়াই থাকবি; দুঃখ বুঝবি না ঠিক আছে কিন্তু তোর কপালে তো সুখ ও নাই রে। তোরে নিয়ে আমার দুঃখ হয় ……… বেচারা”
জল ছলছল চোখে অর্পি’র এসব বিলাপ দেখে উপরে বসে হয়তো কেউ হাসছে। কিন্তু তাতে আজ অর্পি’র কিই বা আসে যায়। এমনকি যে মানুষটার জন্য এসব বিলাপ হয়তো তারও কি আজ এসব বোঝার ক্ষমতাটুকু আছে?
– “অর্পিতা, মা নিচে আয়। গ্রামে যাবি না?” রহমত সাহেব তার মেয়েকে ডাকলেন।
– “বাবা আর দুই মিনিট”
– “ঠিক আছে মা, তাড়াতাড়ি আয়”
দাদার মৃত্যুতে তার মেয়েটি একেবারেই ভেঙে পড়েছে। নিচে অনেকক্ষণ কান্না করার পর এখন ছাদে বসে নিজে নিজে কিসব জানি বকছে। কিন্তু তিনিই বা কি বলে সান্ত্বনা দেবেন। বাবার মৃত্যুতে তিনি নিজেই তো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। বড় নেককার মানুষ ছিলেন তার বাবা, কখনো কাওকে এতটুকু কষ্ট দেননি। এমনকি ইন্তেকালের সময়ও এমন এক শময় গেলেন যখন সবার ছুটি। এই যে গত দেড় বছর হাসপাতালে, বাড়ির বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন; আমাদের কত ভুলে কত কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু কখনো উঃ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। ভেবেই নিঃশব্দে আবারো চোখের পানি মুছলেন তিনি। বড় অদ্ভুত একজোড়া চোখ হয়েছে তার; চোখের পানি যেন আজ শেষই হবে না।
নিচে অর্ক দাদাকে আলতো করে ছুঁয়ে দেখল। শুনেছে মৃত্যুর পর মানুষ নাকি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আজ সে অনুভব করলো। অন্যরকম এক রূঢ়, নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা। ফ্রিজের বরফ বা শীতকালের লোহার মত ঠাণ্ডা নয় এটি, এ ঠাণ্ডার মাঝে কেমন যেন একটি ফাঁকা ফাঁকা ভাব আছে। ক্লাস এইটে থাকতে একবার দাদা একদিন মারা যাবেন ভেবেই অর্ক জায়নামাজে অপর বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল। কিন্তু আজ অর্কর কেন কান্না পাচ্ছে না ও বুঝে পারছে না। হয়তো এতদিন পর এ মৃত্যুকে ও স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছে। না, তা যে সে পারেনি এটা বোঝার জন্য কোনও সাইকোলজিস্ট লাগবে না। তবে সে কাঁদছে না কেন? অর্ক জানে না; আজ জানার দরকারও নেই। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে তার দাদার দিকে। বড় বড় পাথরের চাঁই দিয়ে ব্যায়াম করতেন দাদা, তার দুই হাতে অর্ক-অর্পিতা কত ঝুলে থেকেছে। আর আজ সে মানুষটার মাথা মাটিতে ঠুকে গেছে, মাথা তোলার শক্তি নেই আজ। মানুষ মারা গেলে কি আসলেই ‘নাই’ হয়ে যায়? হয়তো তাই, তা না হলে সবাই দাদাকে ‘লাশ’ বলে সম্বোধন করছে কেন? তার তো অনেক নাম ছিল, একেকজনের কাছে একেক নাম। কিন্তু আজ সবাই মিলে দাদাকে লাশ বানিয়ে দিল। এসব ভাবছিল অর্ক হঠাৎ ওপর থেকে হৃদিতার ডাক
– “ভাইয়া, ওটা সরানোর দরকার নেই। বাবা বলেছেন দাদা ওটার ভেতর দিয়েই নিঃশ্বাস নিতে পারবে”
যাক, অন্তত একজনের কাছে হলেও তো মানুষটা এখনো মানুষ আছে।
অদ্ভুত লেখা, মন ভীষন খারাপ করে দিলে ভাই।
মন খারাপ করেই লেখাটি লেখা, তাহলে হয়তো মনটাকে একটু স্পর্শ করতে পেরেছি .........
অনেক বেশী মন খারাপ হয়ে গেল। ম্রিত্তু খুবই ভয়ঙ্কর।
মন খারাপ করে দেয়া একটা লেখা................
একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার
অনেক সুন্দর হইসে রে লেখাটা ।অনেকই সুন্দর ।
আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই,এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।
ধন্যবাদ দোস্ত
দোস্ত আমার দাদা দাদি দুই জন এ মারা গেছে ...... একজনের মারা যাওয়ার দিন ও আমি কাঁদতে পারি নি ...... কেন এখন জানি না......
লেখাটা সুন্দর, যদিও জানিনা এই লেখার জন্য সুন্দর বিশেষণটা ঠিক কিনা, একদম একটানে পড়ে ফেললাম...
ধন্যবাদ আপু
বড় বেশি সত্য দোস্ত ......... বড় বেশিই সত্য