ঐ উড়াল বলাকায়- ((প্রভাতী পর্ব))

দুই ঘাড়ের উপর বসে মোনকার-নাকীর এমন জোরে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করল যে রিজভীর ঘুম ভেঙে গেল। রাত তিনটার সময় ঘুম ঘুম চোখ মেলে- মশারির ফুটো দিয়ে ঘরের অন্ধকার দেখল সে কিছুক্ষণ। বারান্দায় আলো জ্বলছিল। আর এদিকে বিছানার পাশের জানালা দিয়ে বাইরের ফ্লাড-লাইটের আলোকে কিছুটা হলেও ঢেকে দিয়েছে আড়াই তলার সমান উঁচু যুবতী জামরুল গাছ।

প্রসাব করতে বাইরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে এখন! সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সময় লাগছে। দরজা খুলেই হয়তো দেখা যাবে করিডোরের মাথায় আজরাইল সদৃশ কোন বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে। কিংবা টয়লেটের দিকে কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর হয়তো হঠাৎ করে পেছন থেকে এক জান্তব হুংকার আসবে- হোল্ড অন!

তাহলেই হয়েছে। প্রসাব করে যে আরাম পাওয়া যেত তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশী যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। পানিশমেন্ট খেতে হবে বাকিটা রাতভর অথবা কালকের সারাটা দিন। রাস্তার পাশের ওই চুনকাম করা শাপলা-বক আর পানির ফোয়ারার পাশে সাত-সকালে মুরগী হয়ে বসে থাকতে হবে। দুই পায়ের হাঁটুর নিচ দিয়ে হাত পেঁচিয়ে এনে কানের লতি ধরে- পাছাটা উচু করে আর মাথাটা নিচু করে- মুরগীর মতো হয়ে থাকতে হবে। নাহ! ঊষার শান্ত সকালে এই জঘন্য শাস্তির কথা আর ভাবতে পারল না রিজভী।

নির্জন রাতের মাত্র ছয় ঘন্টা সময় নিজের জন্য পাওয়া যায় এখানে। একান্ত নিজের এই সময়ে বড় ভাইদের অশরীরী অস্তিত্ব কোনভাবেই মেনে নিতে পারলনা সে। তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে জানালার গ্রীলের সাথে গা ঘেষে দাড়িয়ে গেল রিজভী। জামরুল গাছের পাতা ভিজিয়ে ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে দুই তলার জানালা দিয়ে হিস্যু করতে শুরু করল মনের সুখে।
নিচতলার রুমের কোন রসিক বাসিন্দা চিৎকার করে উঠল একটু পরেই- ‘কোন বাইনচুদ মোতে রে’। থতমত খেয়ে গেল রিজভী। মেজাজটা একটু খিঁচড়ে গেল। একগাল নিঃশব্দ হাসি দিয়ে অর্ধপ্রসাবের বাকিটুকুও ছেড়ে দিল সে ভয়ে ভয়ে। তারপর লকার খুলে চকলেটের কৌটা থেকে একটা চকলেট মুখে পুরে দিয়ে সাদা বিছানায় শুয়ে পড়ল সুখ সুখ মনে।

রাতের অন্ধকার আর টিউব লাইটের আলোয় যে সাদাভ-আঁধার রঙের খেলা হয়- সেখানে চোখ মেলে রাখলেও জীবনকে স্বপ্নছায়ায় মতো মনে হয়। কখনো তীব্র-আশার তীক্ষ-আলো আবার কখনো অন্ধকার-ভেজা ছলাত ছলাত চোখের জল। ভেজা মন ফিরে যায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দৌড়ঝাঁপে- বর্ষা কিংবা রৌদ্র পুকুরের ঝাঁপাঝাঁপিতে। অদূর সামনেই শোনা যায় মুখরিত করতালির কলতান আর সফলতার কী অভিজাত সংবর্ধণা। স্বপ্ন ভেঁজা চোখের তীব্র দীপ্ততায় এসবই হয় তখন টিকে থাকার অনুপ্রেরণা।

স্বপ্নমায়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল রিজভী। কোন গভীর টানের তলদেশ থেকে জোর করে তুলে আনল তাকে একটি বিদ্রুপ মাখা কন্ঠস্বর।
-কি রে !
পাশের বিছানা থেকে মাথাটা রিজভীর দিকে এগিয়ে দিল শরীফ। তার মনের সব রস কন্ঠে মেখে বলে উঠল- কি রে! তুইও জানালা দিয়ে মেরে দিলি!
রিজভীর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বন্ধুদের মধ্যে ছোটকা-টোটকা নেতা হিসেবে খাতির পায় বলে একটু ভাব নিয়েই চলত সে। কিন্তু জানালা দিয়ে প্রসাব করার ব্যাপারটা এরা জেনে গেলে প্রেস্টিজ আর থাকে কই!
কোন উত্তর না পেয়ে শরীফ আবার বলল, কাল তো নিচতলা থেকে বিচার দেবে ওরা । নিচে থেকে তো চ্যাঁচাল শুনলাম।
হুম- বলেই দাঁত চিবোতে লাগল রিজভী।
তিনতলা থেকে যখন উপরওয়ালারা রাত দুপুরে বিষ্টি নামায় তখন কি হয়! আর আমরা করলেই দোষ! নিচতলার ওরাও তো এই কাজই করে। আমরা করি জামরুল গাছের পাতায় আর ওরা করে জামরুল গাছের গোড়ায়। গাছের জন্য ওদের কাজটাই বেশী ক্ষতিকর। বুঝলি।
অবাক হয়ে রিজভীর কথা শুনে যাচ্ছে শরীফ। আসলেই তো এভাবে চিন্তা করে নাই সে কখনো। এজন্যেই রিজভীকে মাঝে মাঝে জিনিয়াস মনে হয় শরীফের।
শোন। এখনো শেষ হয় নাই আমার কথা। বিষ্টি হলে কি ওরা থামাতে পারে! পারে না। তখনো তো শব্দ হয়। তখন ওরা ঘুমায় ক্যামনে! অযথা এগলা নিয়া চিন্তা করে লাভ নাই। তুই ঘুমাÑ বলেই শরীফের দিকে তাকালো রিজভী।

অন্ধকার-আলোতে শরীফকে দেখে বেশ খুশি খুশি মনে হল। ধীরে ধীরে মশারী ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো জানালা ঘেষে। পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল একবার। নাহ, রিজভী আর তাকাচ্ছে না । এবার বাইরে তাকিয়ে ওজন কমালো শরীফ মনের সুখে।

ক্যাডেট কলেজের এই নির্মম বন্দীশালায় কেউ কারো বন্ধু নয়। নিজেকেও বিশ্বাস করা যায় না মাঝে মাঝে। বিশেষ করে জুনিয়র সময়টাতে। সময় গড়ানোর সাথে সাথে কিছু অন্তরঙ্গতা বাড়ে। ঘটনায় ঘটনায় কিছু সম্পর্ক ঝুলে যায় একই সূতোয় বারবার। রাত এগারটার পরের নিষিদ্ধ রাতে বারান্দার অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে বিষাদ বিলাস কথন কিংবা রুমে শুয়ে শুয়ে রাত্রির শেষ যাম পর্যন্ত নষ্টালজিয়া ভাগাভাগি করা সম্পর্কগুলো সব কিছুকে ছাপিয়ে আজীবন বদ্ধনে জড়িয়ে যায় কখনো কখনো।

ক্যাডেট কলেজ আইন অনুসারে রাত এগারোটার সময় সব রুমের আলো নেভাতে হয়। এ নিয়মের সামান্য ত্রুটি হলে পরের দিন শাস্তি হিসেবে হয়ে যেতে পারে একটা নির্দয় একস্ট্রা ড্রিল। শেষ দুপুরের পড়ন্ত রোদে বাধ্যতামূলক একঘন্টা খেলার সময়ে সেদিন আর খেলাই হয়ে ওঠে না। বুট, আর্মি বেল্ট, ক্যাপ আর খাকি ইউনিফর্ম পড়ে দেখা করতে হয় আর্মির স্টাফদের সাথে। তারপর ষ্টোররুম থেকে বহন করে এনে- আধামণ ওজনের একটা বালুর বস্তা চাপাতে হয় পিঠের উপর। কিছুক্ষণ গাধার মত দৌড়াতে হয়। তারপর বাস্কেটবল গ্রাউন্ডের পাশে আলাদা একটা সরু মাঠে শুরু হয় শারীরিক শাস্তি।
কখনো কখনো বালুর ব্যাগ পিঠ থেকে নামিয়ে সিমেন্ট-রডের তৈরী সেল তুলে দেয়া হয় ঘাড়ের উপর। তারপর হাঁটু দিয়ে হাঁটতে হয় অমসৃণ পিচঢালা রাস্তায় অথবা বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে। কখনো কখনো উপুড় হয়ে শুয়ে হাতের কনুইয়ের উপর ভর করে পঞ্চাশ কিংবা একশ মিটার রাস্তা ক্রলিং করে করে এসে মাথা নিচে আর পা উপরে দিয়ে ‘লং-আপ হয়ে’ থাকতে হয়- দুম করে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।
আবার কখনো ড্রেনের নোংরা পানি অথবা বালুতে মাখামাখি হয়ে চামড়া ফাটানো শব্দে শরীরের উপর পড়- শপাং শপাং, চাবুকের মত লাগে দেবদারু গাছের সরু ডালের আঘাত। একঘন্টা সময় ধরে শাস্তি হিসেবে এমন একটা অসহ্য ‘একস্ট্রা ড্রিল’ সহ্য করে অনেকেই বমি করে দেয়। অথবা প্রচন্ডভাবে ঘেমে মাথা ঘুরে পড়ে যায় ঠাস করে। তারপর বন্ধুরা তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে অথবা বাথরুমের শাওয়ারের নিচে।

আর্মির স্টাফদের কাছে নিচতলার শফিউর বিচার না দিলে লঘু পাপে এমন কড়া শাস্তি ওদের হতো না কখনো। জানালা দিয়ে প্রসাব করার অপরাধে রিজভী আর শরীফ টানা তিনদিন এক্সট্রা ড্রিল ভোগ করে একদম চুপ হয়ে গেছে। একেবারে একদম চুপ। টুঁ শব্দটিও বের হয়না আর মুখ থেকে। শরীরের প্রত্যেকটা বাঁকে বাঁকে ব্যথা। একবিন্দু নড়াচড়া বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণাকাতর সময়গুলো।

শুক্রবার সকালটা আর নষ্ট করতে চাইল না শরীফ। রিজভীর দিকে তাকিয়ে বলল- চল দুপুর পর্যন্ত বাস্কেটবল খেলে আসি।
আশেপাশের রুমের বাসিন্দারাও খেলতে যেতে চাইছে। সাদা হাফ প্যান্ট-শার্ট আর কেডস পড়ে সাদায় সাদায় সাদাবাবু সেজে রুম থেকে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে তারা। অনেকেই বলছে- চল, কিছুক্ষণ খেলে আসি। তাহলে শরীরের ব্যথাটা নড়ে যাবে। চুপচাপ শুয়ে থাকলে ব্যথা বাড়তেই থাকবে।
সবাই একসাথে খেলতে যাবার জন্য রেডি হয়ে বারান্দায় বেরোতেই দেখল- চোখের সামনে মূর্তিমান আতঙ্ক মিষ্টার মোন্তাজুর রহমান। ছেলেরা তাকে মাস্তান, মোস্তান, মালু এসব বিভিন্ন নামে ডেকে থাকে আড়ালে আবডালে। মদ খেয়ে হরদম মাতলামি করার কারণেই ‘মালু’ নামেই বেশী ডাকে তাকে।
সবাইকে একসাথে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন মালু স্যার। সবাই রুমে রুমে চলে যা। কেউ খেলতে যাবি না। টেবিল চেয়ারে গিয়ে পড়তে বস। রুমের বাইরে কাউকে দেখলে চামড়া তুলে নেব সবগুলার।
ব্যাস আর কি লাগে! মালু স্যারের চেহারাটাও মধ্যবয়স্ক বাঘের মতোই অভিজাত আর ভয়ংকর। হুংকার শেষ হবার আগেই ডানে-বামে ধাক্কা খেয়ে ধুম-ধাম, বুম-বাম, দুম-দাম করে বিচ্ছুর দল ঢুকে গেল নিজ নিজ রুমে।

কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজায় উঁকি দিয়ে মাথা বের করল সবাই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইটভাটার মতো লালচে আগুন চোখে মালু স্যার তাকিয়ে আছেন সবার দিকে।
এক সেকেন্ড মাত্র সময়। সবাই সবার চোখের ভাষা পড়ে নিল শুধু। তারপর হুড়মুড় করে একসাথে সবগুলো রুম থেকে বের হয়ে মালু স্যারের সামনে দিয়েই হৈ হৈ করতে করতে ছেলেরা এক ছুট দিল। একেবারে ভোঁদৌড়। এক দৌড়ে মাঠ। খেলতে আসার আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে গেল। অনেকে আবার খেলা বাদ দিয়ে ছায়ায় বসে বাতাসে শিষ কেটে কেটে দুষ্টামি শুরু করল।

ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান মোন্তাজুর রহমান স্যার। হলুদ হাউসের হাউস মাষ্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মতো ক্যাডেট কলেজের হলগুলোকে বলে ‘হাউস’। রক ক্যাডেটে তিনটি হাউস আছে। হাউস হলো ছেলেদের থাকার জন্য আবাসিক জায়গা। সেরকম তিনটি হাউসের একটি হলো হলুদ হাউস। আর সেই হাউসের সর্বময় কর্তা হলেন মোন্তাজুর রহমান ওরফে মালু স্যার। বাকি দুটো নীল হাউস আর সবুজ হাউস। ইংরেজীতে অভিজাতরকম দক্ষতার কারণে কলেজের বড় বড় যমদূতরাও বদ মেজাজী মালু স্যারকে সামলে চলেন সবসময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভোষ্টদের চাইতেও অনেক বেশী দাপটে থাকেন ক্যাডেট কলেজের হাউজ মাস্টাররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রভোষ্ট, ক্যাডেট কলেজের হাউজ মাস্টার, আর ছেলে বা মেয়েদের থাকার জন্য বিভিন্ন ইশকুল-কলেজের আবাসিক হোষ্টেলের সুপারভাইজার একই রকম পদ এগুলো, একই রকম দায়িত্ব।

ক্লাস এইটের ছেলেদেরকে দশটার সময় অফিসের সামনে কান ধরে নিল ডাউন হয়ে থাকার আদেশও দিয়ে গেলেন গোমেদ আলীর কাছে।

একবার রেগে গেলে ইংরেজীতে খিস্তি মেরে লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে দিতে বেশী সময় লাগে না তার। আর কোন ক্যাডেটকে সুযোগমতো পেলে তো কথাই নেই। বুকে-মুখে কোথাও বেত চালাতে দ্বিধা করেন না বিন্দুমাত্র। এই অর্ধপাগল মালু স্যার ক্লাস এইটের একদল পুঁচকে ছেলের কাছে এভাবে পরাাজিত হয়ে- তীব্র রাগে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে চলে গেলেন অফিসের দিকে। আর অফিসের বেয়ারা গোমেদ আলীকে বলে গেলেন- রাতের বেলা একডজন ভালো বেত রেডি রাখবি। ওদেরেকে বলবি- কান ধরে হাঁটুর উপর বসে থাকতে। ঘোড়া রোগ হয়েছে এদের। এর ঔষধ আমার জানা আছে। রাতে এসে চিকিৎসা করব। আর শোন, বেত যদি পছন্দ না হয় তাহলে তোর কিন্তু চাকরি যাবে। ভালো করে বেত বানাবি। বুঝেছিস তো।

কার্তিকের কড়া রোদে টানা দুই ঘন্টা খেলা শেষে- মাঠ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলো সবাই। শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই বেরসিক গোমেদ আলী এসে জানিয়ে দিল মালু স্যারের ফরমান। আনন্দ, উত্তেজনা আর অসাধ্য সাধনের বিজয়রেশ কাটেনি এখনো। বন্দী জীবনে বুনো স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে এই ভয়ংকর খবরটাতেও মলিন হলো না কেউ। ধমক দিয়ে বিদায় করে দিল গোমেদ আলীকে। তারপর কোরাস গানের মতোই অট্টস্বরে হাসতে হাসতে দোলাদুলি খেতে লাগল।

রাত দশটার একটু আগেই রেডি হলো সবাই। শার্ট-প্যান্ট-টাই পড়ে ঘুরতে থাকল রুমে বারান্দায়। অনেকে আবার জুতোটাও পলিশ করে নিল ভালো করে। প্রথম শ্রেণীর চাকুরেদের মতো করে স্যুটেড-বুটেড হয়ে দশটায় চলে গেল সবাই মালু স্যারের অফিসের সামনে। তারপর চোরা হাসি আড় করে শেষবার একে ওকে দেখে নিয়ে মুখ গুমোট করে কান ধরে হাঁটুর উপর বসে গেল সবাই।

পিছনে বিশাল বাগান। হেমন্তের আলতো বাতাস আর ফুলের সুবাস কোনটাই কোন আমেজ আনতে পারছে না শরীফের মনে। অন্যদিন হলে শরীফ হয়তো তুলিকে ভেবে ভেবে বুকভরে রজনীগন্ধার সুবাস নিয়ে নিত মনের সুখে। অথবা নিচে গিয়ে পপি ফুলের সবুজ কুঁড়িতে জোড়ে ফুঁ দিয়ে ফুটিয়ে দিত কয়েকটি লালচে পপি। এখন মনে কোন প্রেম নেই, কোন বিষাদ বিলাসও নেই। অজানা আতঙ্ক অপেক্ষা করছে সামনে। মালু স্যারের জন্য অপেক্ষা।

দশটা বেজে গেছে। এই বুঝি স্যার চলে আসে। দূরে কারো পায়ের আওয়াজ হলেই মেরুদন্ড সোজা হয়ে যাচ্ছে সবার। সময়ের ছোট ছোট সেকেন্ডগুলো কত দীর্ঘ- হাঁড়েহাঁড়ে তা অনুভব করছে ওরা।

সাড়ে দশটার দিকে স্যার এলেন।
কিররে- তোরা সব এসেছিস তাহলে! গলায় ঘড়ঘড় শব্দ করে বাম ভ্রু টা আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে ডান দিকের চুলগুলো একবার ঝাঁকিয়ে অবহেলার ছন্দে টেনেটেনে বললেন স্যার। বলেই রুমে ঢুকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন তিনি। গোমেদ আলীকে ডেকে বেতগুলো সব দিয়ে যেতে বললেন টেবিলের উপর। এক একটা বাঁশকে চার ফালি করে কেটে ভালো করে পলিশ করে বেশ সুন্দর কিছু বেত বানিয়ে এনেছে শালার বেয়ারা। বেতগুলো দেখে রিজভীর সব রাগ গিয়ে পড়ল গোমেদ আলীর উপর। যেন গোমেদ আলীর জন্যই আজ ওদেরকে মার খেতে হচ্ছে!
-আয় সব ভিতরে আয়। চোখ বন্ধ করে, চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে- সবাইকে ভিতরে এসে দাঁড়াতে বললেন মালু স্যার।
সবাই ভয়ে ভয়ে কাঁচুমাচু করে এসে দাড়ালো মালু স্যারের অফিস রুমে। বাঘের সামনে একপাল হরিণ শাবকের মতোই নিশ্চিত পরিণতি মেনে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই।
-দ্যাখ। তোরা আমাকে মাস্তান বলিস। মালু বলিস। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি মদ খাই না, মাতলামিও করি না। মদের জগতে সারারাত পরে থাকার জন্য তোরা আমাকে মদস্তানের নাগরিক মালু বানিয়ে ফেলেছিস। জীবনে কোনদিন মদ ছুঁয়েও দেখিনি আমি। আমি একজন পাক্কা মুসলমান। শেষরাতে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। মালু স্যারের মুখে এসব ভন্ডামি কথা শুনে চাপা হাসিটা অনেক কষ্টে আটকে রাখল ছেলেরা।
-আমাকে মদ খেতে দেখেছিস তোরা কেউ! আমি মাতলামি করেছি কোথাও! মাস্তানি করেছি! তবে আমাকে তোরা মাস্তান বলিস কেন! মালু ডাকিস কেন! বল। চিৎকার করে উঠলেন মালু স্যার। আর ভকভক করে বিদেশী মদের গন্ধ বের হতে থাকল তার মুখ থেকে। চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। বেশ টেনেটেনে কথা বলছে সে।

একবার রিজভীর ইচ্ছে হল যে স্যারকে কিছু একটা বলে। কিন্তু সামনে অতগুলো বেত দেখে আর সাহস হলো না। এই সেদিনওতো ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দেখানোর পর যে তিনজন সবচেয়ে বেশী পেয়েছে তাদেরকে কানধরে ওঠাবসা করালো পঞ্চাশবার। কী অভূতপূর্ব বিচার!

টিভি রুম থেকে একটা হিন্দী গানের মিউজিক ভেসে আসছে। সিনেমার আইটেম গান। সিনিয়র ক্যাডেটরা সাউন্ড বাড়িয়ে উদ্দাম ভিডিও গান দেখে পা দুলিয়ে দুলিয়ে মজা নিচ্ছে। রিজভী একটু নড়ে উঠল। ঠোঁট বাঁকা করে নিঃশব্দে হাসলেন মালু স্যার।
ছেলেরা তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু স্যার ঠিকই বুঝে গেছে যে গানটার নায়িকা মাধুরী। হা হা। তারপর ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো তো মুততে শিখিসনি তোরা। আবার মাধুরীর গান শুনে নাচতে চাস। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন স্যার। যাহ। আজ তোদেরকে কিছু বলবো না। বলেই বেয়ারাকে বললেন, টিভি রুমে কারা আছে ডেকে নিয়ে আয় ওদেরকে। ওদেরকে একটু নাচাই আজ। পড়ালেখা বাদ দিয়ে বদমাশগুলো সারাদিন টিভি রুমে বসে বসে মৌজ করতেছে। আজ ওদেরকে আমি আমার রুমে দলাইমলাই করবো। গোমেদ আলীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন মালু স্যার- যাহ.. ডেকে নিয়ে ওদেরকে।

কোন শব্দ না করে সাবধানে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে যাচ্ছে সবাই। পেছন থেকে রিজভীর নাম ধরে ডাকল স্যার। শান্ত গলায় বলল এই রিজভী, তুই দাঁড়া।
মনে মনে ভয় পেয়ে গেল ও। কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না। জিজ্ঞাসু চোখে স্যারের দিকে তাকালো সে।
স্যার ঠোঁট বাঁকা করে বললেন- আজ ছেড়ে দিলাম জন্য মনে করিস না বেঁচে গেলি। বেশী খুশি হোস না। তোদেরকে পরে ধরব আমি। আজ তোদের বড়গুলোকে একটু সাইজ করি।
তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠে- যা ভাগ, বলেই হাত দিয়ে সিনেমার গডফাদারদের মতো ইশারা করলেন মালু স্যার। সেকেন্ড দেরী না করে দ্রুত কেটে পড়ল রিজভী। রুমে ঢুকে লাইটের সুইচটা খটাশ করে চেপে আলো নিভিয়ে দিল সে। শরীফ ইশারায় জানালাটা খুলে দিতে বলল ওকে। জানালাটা খুলে বিছানায় শুয়ে কান খাড়া করল ওরা।

হ্যাঁ। শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঠাস ঠাস শব্দ আসছে অবিরত। সাথে আহ! উহ! আরো কতো আহাজারি! শরীফ আর রিজভী দু’জনের মুখেই তৃপ্তির হাসি। মার দ্যানেওয়ালারা আজ মার খাচ্ছে। হা হা হা।

ক্যাডেট কলেজের সিনিয়রদের অত্যাচারে অতিষ্ট জুনিয়রদের জন্য এটাই মনে হয় সবচেয়ে আনন্দের দিন। নিজেরা তো আর সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলতে পারে না। কিন্তু সিনিয়ররা কোন কারণে স্যারের কাছে ধরা খেয়ে পানিশমেন্ট পেলে মনে মনে নেচে ওঠে জুনিয়ররা। ময়ূরের মতো নেচে উঠছে শরীফ আর রিজভীর মন। ঠিক যেন দেয়া ডাকা ময়ূরী। আকাশে মেঘের ডাক শুনে কেকা ডাকিনি যেমন পেখম মেলে ধরে, তেমনি ওদের মনেও খুশির রং ছড়িয়ে যাচ্ছে। স্যারের বেতানোর শব্দ ও সিনিয়রদের আর্ত চিৎকারের সাথে সাথে ওদের রক্তেও নাচন উঠেছে। শরীফ আর রিজভীর মতো হয়তো অন্যদের রুমেও নিরব চলছে অনন্দ উৎসব।

১,৮২৪ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “ঐ উড়াল বলাকায়- ((প্রভাতী পর্ব))”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।