বিশ্বকাপ নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে দেখি আহসান স্মৃতির বিশ্বকাপ নিয়ে একটা সিরিজ শুরু করে দিয়েছে। ঠিক করেছি আমার লেখাটা ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওর লেখাতে কমেন্ট হিসেবে দিয়ে দেবো। ফুটবল নিয়ে কি লেখা যায় চিন্তা করতে করতে মাথায় এলো, ফুটবলারদের নিয়ে লেখি। “ফুটবলার” বললেই সবার মনে প্রথমে ভেসে আসে পেলে বা ম্যারাডোনার নাম। কিন্তু এরা ছাড়াও আরোও যারা ফুটবল শিল্পী ছিলেন বা আছেন তাদের নিয়ে একটা “দশে মিলে করি সিরিজ” শুরু করা যায়। আশা করি ব্লগে আরোও যারা ফুটবল ফ্যান আছেন, তারাও তাদের পছন্দের খেলোয়াড় নিয়ে লিখে এই সিরিজ চালু রাখবেন।
২০০৪ ইউরো উপলক্ষ্যে আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ইমরান ভাই কিভাবে কিভাবে জানি একটা ডিশের কানেকশন ম্যানেজ করে ফেলেছিলেন। তাই আমরা ঠিক করেছিলাম এইবার ইউরো রশীদ হলের ৫০২ নম্বর রুমেই দেখা হবে। ইংল্যান্ড আর পর্তুগালের মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনাল দেখছি। দুর্দান্ত খেলা চলছে, ইংল্যান্ড প্রথমেই মাইকেল ওয়েনের গোলে এগিয়ে যাবার পরে পোস্তিগার গোলে পর্তুগাল সমতা আনলো। অতিরিক্ত সময়ে রুই কস্তার গোলে এবার পর্তুগাল এগিয়ে গেলে ল্যাম্পার্ডের গোলে ইংল্যান্ড সমতায় ফিরে এলো এবং শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুট আউট। দুই দল যখন শুট আউটের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন দেখলাম বর্ষীয়ান এক ভদ্রলোক এসে বেশ ভাবের সাথে পর্তুগালের খেলোয়ারদের পিঠ চাপড়ে দেয়া, সাহস যোগানো ইত্যাদি কাজ করে যাচ্ছেন। এমনকি ফিগো বা রুই কস্তা ওই লোকের পাশে হেডমাস্টারের কাছে ধরা খাওয়া স্কুলবালকের মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান ভাইয়ের কাছে “এই লোক কে??” জিজ্ঞেস করায় ইমরান ভাই মাথার পেছনে একটা বই দিয়ে বাড়ি দিয়ে (ভাগ্যিস বইটা চিকন ছিলো) জবাব দিলেন পর্তুগীজ ফুটবলের বাপ। গতকাল মালেয়শিয়ার একটা লোকাল চ্যানেলে “ফুটবল গ্রেটেস্ট — ইউসেবিও” নামে একটা শো দেখতে গিয়ে এই সব পুরোনো কথা মনে পড়ে গেলো।
ইউসেবিও বা ইউসেবিও ডা সিলভা ফেরেইরা জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে মোজাম্বিকের পর্তুগীজ অধ্যুষিত মাপুতোতে। কিশোর বয়েসে তিনি পর্তুগালে পাকাপাকিভাবে চলে যান। তার প্রথম ক্লাব ছিলো স্পোর্টিং ক্লাব অফ লরেঙ্কু মারকুয়েস। এখানে তিনি প্রাক্তন ব্রাজিলীয়ান ফুটবলার হোসে কার্লোস বোয়েরের নজর কাড়তে সক্ষম হন এবং বোয়ের তাকে নিয়ে যান বেনিফিকার কোচ বিলা গাটম্যানের কাছে। গতকালে অনুষ্ঠান থেকে জানলাম, লরেঙ্কু মারকুয়েস আসলে তাকে বিক্রি করতে চেয়েছিলো স্পোর্টিং ক্লাব ডি পর্তুগালের কাছে। কিন্তু ক্লাব ডি পর্তুগাল তাকে ট্রায়াল রাউন্ডে অংশ নিতে বলায় তিনি মনক্ষুন্ন হয়ে সেখানে যোগ দিতে রাজি হননি। ১৯৬১ সালে ৭৫০০ পাউন্ড ট্রান্সফার ফীতে ইউসেবিও বেনিফিকাতে যোগদান করেন। এরপরে শুরু হয় পর্তুগীজ ফুটবলে বেনিফিকার আধিপত্য। তিনি বেনিফিকাকে ১১ টি লীগ চ্যাম্পিয়নশীপ জিততে সাহায্য করেন (১৯৬১, ১৯৬৩-৬৫, ১৯৬৭-৬৯, ১৯৭১-৭৩, ১৯৭৫)। এর মধ্যে সাত বার তিনি লীগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার গৌরব অর্জন করেন।
ক্ষ্রিপ্ততা, ড্রিবলিং আর কৌশনের অনন্য ইউসেবিওকে সতীর্থরা ব্ল্যাক পার্ল বলে ডাকতেন আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা ডাকতো ব্ল্যাক প্যান্থার নামে। ১৯৬৫ সালে তিনি ইউরোপিয়ান ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার খেতাব লাভ করেন এবং ১৯৬৮ আর ১৯৭৩ সালে ইউরোপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে গোল্ডেন বুট অর্জন করেন। তার সময়ে বেনিফিকা মোট পাঁচ বার ইউরোপিয়ান ক্লাবের কাপের (এখন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ) ফাইনাল খেলতে সক্ষম হয়। তার মধ্যে ১৯৬১ আর ১৯৬২ সালে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলেও ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৮ সালে তাকে রানার আপ ট্রফি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বেনিফিকার জার্সি গায়ে তিনি ৭১৫ ম্যাচ খেলে ৭২৭ টি গোল করেন। এর পরে ইঞ্জুরী আক্রান্ত হয়ে পড়ার কারনে ১৯৭৬ সাল থেকে ইউসেবিও বেনিফিকা ছেড়ে কিছু ছোট ছোট দলে খেলেন। অবশেষে ১৯৭৮ সালে তিনি অবসর নিতে বাধ্য হন।
পর্তুগালের পক্ষে তিনি ৬৪ ম্যাচে ৪১টি গোল করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পর্তুগালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন (২০০৫ সালে পলেতা তাকে অতিক্রম করে যায়)। ১৯৬১ সালে লুক্সেমবার্গের বিপক্ষে তার জাতীয় দলে অভিষেক হয়, কিন্তু অভিষেক ম্যাচেই তার দল ৪-২ গোলে হেরে যায়। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে পর্তুগাল কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৬৪ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপে বুলগেরিয়ার কাছে হেরে প্রাথমিক পর্বেই বাদ পড়ে যায় পর্তুগাল। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে তারা নিজেদের গ্রুপে পায় বুলগেরিয়া, ব্রাজিল আর হাঙ্গেরীকে। তবে এইবার ইউসেবিওর দল গ্রুপের তিন দলকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায়। গ্রুপ পর্বে তারা পেলে, গ্যারিঞ্চা, জর্জিনহোদের নিয়ে গড়া ব্রাজিলকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয়। ইউসেবিও এই খেলাতে দুইটি গোল করেন। কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার সাথে ম্যাচের প্রথমেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়লেও ইউসেবিওর চার গোলের সুবাদে ৩-৫ গোলে জিতে যায় পর্তুগাল। এর পরে সেমি ফাইনালে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ডের। গতকালের অনুষ্ঠানটিতে ইউসেবিওর কিছু টিমমেটেরও সাক্ষাতকার ছিলো, যাতে একজন এই সেমিফাইনাল সম্পর্কে বলেছিলেন, প্রথমে সেমিফাইনালের ভেন্যু ছিলো লিভারপুলে এবং তিনি নিশ্চিত লিভারপুলে খেলা হলে পর্তুগালই জিততো। কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে ভেন্যু নির্ধারন করা হয় ওয়েম্বলীতে। ভ্রমনক্লান্ত পর্তুগাল যথেষ্ট বিশ্রাম ছাড়াই মুখোমুখি হয় ববি মুর, চার্লটন, জিওফ হার্স্টদের ইংল্যান্ডের। ববি চার্লটনের দুই গোলের জবাবে ইউসেবিও পেনাল্টি থেকে একটা গোল করতে পেরেছিলেন কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। ইউসেবিও নিজেও তার সাক্ষাতকারে বলেছিলেন ওই ম্যাচে তিনি ফিট ছিলেন না। যদি ফিট থাকতেন তাহলে ওই ম্যাচে তার নেয়া বেশ কিছু শট বারে না লেগে অবশ্যই গোল হতো। কথাগুলো বেশ উদ্ধত শোনালেও ইউটিউবে খুজে পাওয়া তার খেলার কিছু ভিডিও দেখলে বোঝা যাবে তিনি খুব একটা বাড়িয়ে বলেননি। ফাইনাল খেলতে না পারলেও ইউসেবিও তার করা ৯ গোলের কারনে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার মর্যাদা লাভ করেন। এরপরে ১৯৭০ আর ১৯৭৪ সালের কোয়ালিফাইং রাউন্ডেই পর্তুগাল বাদ পড়ে গেলে তার বিশ্বকাপ স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
পর্তুগালের হয়ে বড় কোনো শিরোপা না জিততে পারলেও ইউসেবিও পর্তুগালকে ইউরোপের সাধারন কোনো দল থেকে ইউরোপের ফুটবল শক্তিতে রুপান্তরিত করেছিলেন। পর্তুগালের সোনালী প্রজন্ম, যারা পর পর দুবার ফিফা যুব বিশ্বকাপ জিতে পর্তুগালকে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলো আসল বিশ্বকাপ জেতার, সেই লুইস ফিগো, রুই কস্তা বা নুনো গোমেজের একেবারে নিজস্ব হিরো এই ইউসেবিও। কে জানে, একটা বিশ্বকাপ জিততে পারলে হয়তো পেলে বা ম্যারাডোনার মতন তিনিও আমাদের এক চেনা মানুষ হয়ে থাকতেন।
🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
🙂
দারুন একটা পোস্ট... সিরিজ হিসেবে চলতে থাকলে খুব ভাল হয়। পেলে, ম্যারাদোনা বাদেও যে অনেক লিজেন্ডারি ফুটবলার আছে যাদের সাথে আমাদের পরিচয় নেই বললেই চলে... ইউসোবিও সম্পর্কে প্রথম কবে জেনেছিলাম মনে নেই, তবে সে একাই যেভাবে পর্তুগালকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে এনেছিল তার জন্য এর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ প্রথম থেকেই ছিল, যেমন্টা আছে পুসকাসের উপর।
(আমি সিরিজ শুরু করে বিপদে পড়ে গেলাম দেখছি, কবে যে পরের পর্ব নামাতে পারব ~x( )
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
একটু সময় দিয়ে নামায়ে ফেলো। বিশ্বকাপ শুরু হবার আগেই তোমাকে ২০০৬ পর্যন্ত আসতে হবে।
ইউসেবিও- এর কথা মুখে মুখে অনেক শুনেছি। তাঁকে পর্তুগীজ ফুটবলের শিল্পী বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।
দারুণ সিরিজটা শুরু করার অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আশা করবো, সবাই মিলে সিরিজটা আগিয়ে নিয়ে যাবে। :thumbup: :thumbup:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
তুমিও তোমার পছন্দসই কোনো ফুটবলারকে নিয়ে লিখে ফেলো ......
ফুটবলার না পেলে পছন্দের সই কে নিয়ে লিখলেও চলবে।
পরেরবার পুস্কাসকে নিয়ে জানতে চাই ।
তারপর ডি স্টেফানো , জর্জ বেস্ট , গ্যারিঞ্চা।
চাকুরীজনিত সামান্য দৌড়ের ওপরে আছি। তবে শীঘ্রই পরেরটা লিখবো।
চালিয়ে যান ভাই,অনেক তথ্য জানলাম,নিজে ঘেটে বের করার চেয়ে অন্যের তৈরি করা সুন্দর লেখা পড়া অনেক মজার 😀 :boss:
ধন্যবাদ আছিব।
আছিব ভাইয়ের সাথে একমত B-) দারুন একটা পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই 🙂
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
🙂 🙂
দারুন একটা পোস্টের জন্য ধন্যবাদ :hatsoff:
ধন্যবাদ মেহেদী ...
:hatsoff: :hatsoff: :boss: :boss:
🙂 🙂 🙂
দারুন একটা পোস্ট… সিরিজ হিসেবে চলতে থাকলে খুব ভাল হয়... :thumbup:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
দারুন একটা পোস্ট। পড়ে খুব ভাল লাগল ভাইয়া :hatsoff: :thumbup: :thumbup:
আমাদের দুর্ভাগ্য যে ইউসেবিওর খেলা সরাসরি (টিভিতে) দেখার সৌভাগ্য হয়নি। 🙁
মিডিয়ার কল্যাণে এখন খেলোয়াড়দের চেনা কত সহজ! আশা করি এরকম আরও কিছু প্রায় বিস্মৃত খেলোয়াড়ের কথা আপনার সামনের লেখাগুলোয় আসবে।
বিশ্বকাপ তো শুরু হয়ে যাচ্ছে মাগার next এপিসোডতো আসে না । 🙁 🙁