অন্তর্নিহিতা

টিএসসির গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। কলাভবনের কাজটা শেষ করে সারিনি মাহিরের সামনে পড়লাম। আর তার কোথা রাখতে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকা। শালা মানুষ হলো না। সেই কলেজ লাইফ থেকে শুরু করেছে। তার যেন কোন অন্ত নাই, নাই বিরক্তি। ছোটবেলা থেকে খাতার পাতায় অযথাই আঁকিবুঁকি করার একটা বদ অভ্যাস ছিল। আর আলপনাও মোটামুটি আঁকতে পারতাম। তাই যখন আমার টেনেটুনে করে পরীক্ষার পাশে কোথাও চান্স পেলাম না, তখন আমার শেষ আশ্রয় হয় ঢাকা আর্টস কলেজে। কিছুদিন যাবার পর পেটের টানে আশা এই রাস্তাটাকেই আপন মনে হতে লাগলো। আর এখন তো আর আর্ট আমার পেশা নেই নেশাই হয়ে গেছে। ওহ! এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারন জনাব ডেটিং মারবেন। তাই আমাকে বসিয়ে দিয়ে গেছেন কি এক রবীন্দ্র সরোবর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। তার নতুন যে প্রেমিকা সে নাকি গান গায়। আর আজ এখানে নাকি তিনি গান গাইবেন। আর আমাকেও তা হজম করতে হবে, উফ কি জ্বালা!! ছোটবেলা থেকে একা একা বড় হয়েছি। দাদার একমাত্র সন্তান বাবা আর আমি নিজেও তাই। একসময়ের জমিদার দাদার বিশাল প্রাসাদসম বাড়িতে তাই একলাই কেটেছে আমার শৈশবের বিকশিত হওয়ার দিনগুলি। তাই কোন রকম গান বাজনা, হৈ হুলোড় চেয়ে নীরবতাই আমার বেশি প্রিয়। আরও ভালো হয় যদি সাথে থাকে নিঃসঙ্গতা ও আমার স্কেচবুকটা, ব্যস।

এইসব ভেবে সময় কাটাচ্ছি তখনই মাহির এসে বলল, “দোস্ত তোর ভাবি এখন গান গাইবে। তারপর তুই তোর যেখানে মন চায় যেতে পারবি, কোন সমস্যা নেই।” কথাটা বলেই আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেল আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।  ওহ! বলাই হয়নি হাতে আছে একটা পেইন্টিং। গত সপ্তাহে আঁকা। হটাৎ করেই আঁকা। আঁধ খাওয়া চাঁদের জ্যোৎস্ন্যা পড়েছে দীঘির কালো জলে, আর তাতে অর্ধ শরীর ডুবিয়ে আছে একটি মেয়ে। তার চুলগুলো এলোমেলো রাতের হাওয়ায় উড়ছে পিঠের উপর , আর এক কোণা থেকে দেখা যাচ্ছে তার টানাটানা চোখ দু’টোর একটি আর তার সরু নাকের বাঁকটা। যেন দীঘির জলে পড়া চাঁদের বিম্বটাকে সে সন্তর্পনে ধরতে চাইছে, আপন করার অভিপ্রায় নিয়ে। তেল রঙে অনেক সময় নিয়ে যা শেষ পর্যন্ত দাড়িয়েছে তাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলতে আমাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবেনা। তবে আমাদের এই বাংলাদেশে প্রশংসা করার লোকের অভাব নেই, নেই পরামর্শদাতারও। কিন্তু কোন কিছুর ন্যায্য মূল্য পরিশোধের লোকের খুবই অভাব। আর তাই আজ ওরিয়েন্টাল আর্ট গ্যালারিতে নিয়ে যাচ্ছি, যদি একটা বিহিত করা যায়। কারন হাতের অবস্থা খুব একটা ভালো না। দাদা ধনী ছিলেন, ছিল অনেক জমিজমা। কিন্তু কথায় আছে , “বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায়।” আর আমার উড়নচণ্ডী বাবা এই কথাটার স্বার্থকতা আবারো প্রমাণ করে ছেড়েছেন। কোন মতে গ্রামে থাকা কয়েক বিঘে জমি ছাড়া বাকি সবই আমার বাবার করা কর্জের টাকা শোধাতেই বিক্রি করতে হয়েছে। এখন যা আছে তা ইজারা দিয়ে আর আঁকা ছবির হদিস করে  কোন মতে এখন আমার সংসার চলে। তাই ছবিটা বিক্রির জন্য এতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছি। পকেটের টান না থাকলে ছবিটি রেখে দিতাম আমার কাছে। কেন জানি না আমার মনে হয়েছে, এই ছবির চোখধারী নারী শুধুই ছবি নয়। এই চোখ শুধুই তুলিতে আঁকা কোন চোখ নয়। এই চোখ যেন জ্যান্ত, জীবিত। আর এই চোখধারী নারীই হবে আমার জীবনের সাথী। এই চোখই হলো এই হৃদয়ে থাকা অন্তর্নিহিতার চোখ। এই চোখ ধরেই আমার অন্তর্নিহিতাকে আমার বহির্জগতে প্রত্যাবর্তন করতে দেখবো। এইসব আউলা ঝাউলা চিন্তা করছি, তখন মাহির এলো, পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল, “দোস্ত চরম গাইলো না। গলা তো না যেন মাখন মামা, পুরাই মাখন।” যদিও আমি কিছুই শুনিনি, আমার ধ্যান ছিল অন্য কোথাও বললাম, “হুম। ” তারপর ও বলল, “তুই এক মিনিট আর একটু কষ্ট কর। আমি ওকে ডেকে আনি তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।” বললাম, “কি দরকার? আজ নিয়ে তো পঞ্চাশজনের বেশীজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলি। কয়েকদিন পরেই একান্ন হবে। যেদিন সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসবি সেদিন পরিচয় করিয়ে দিস। আজ উঠি আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।” ও হেসে বলল, “আরে দোস্ত, ঐতার খজেই তো আছি। পাচ্ছি না দেখেই তো অন টেস্ট। আসলটা পেলে কি আর এমন করি। খালি একবার পাই না কেন, সিধা ঝুওল্যা পড়মু কসম মামা। তুই খাড়া এক মিনিট আমি আসতেছি।” বলেই ছুট। একা একা বসে আছি চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। কিছু দূরে দেখি আমার আর্ট কলেজের বান্ধবী অন্তি তার প্রেমিকের সাথে হেটে আসছে। সোজা আমার দিকে এসে বলল, “আরে, নিলয়, তুই এখানে কি করিস? তোর যে গান ভালো লাগে তা তো আগে জানতাম না?” হেসে বললাম, “ আরে ধুর! মাহিরের কাজ। আমি এসেছিলাম কলাভবনে একটা কাজে, তারপর যাব গ্যালারিতে ছবিটার বিহিত করতে। পথে মাহিরের সাথে দেখা আর আমাকে বসিয়ে দিয়ে সে গেছে তার প্রেমিকাকে আনতে। তাই বসে আছি।” তখন অন্তি তার প্রেমিক নাহিদকে বলল, “জানো ও না অনেক সুন্দর একটা ছবি এঁকেছে, দেখবে নির্ঘাৎ ভাল লাগবে।” বলেই আমাকে বলল, “দোস্ত একটু কষ্ট করে বের করনা। আরেকবার দেখি ।” তবে অন্তির মাঝে যতটা উৎসাহ ছিল তার গণিতের কঠিন সমীকরণ আর রসহীন রসায়ন বা অপদার্থ নিয়ে কাজ করা পদার্থ পড়া, তথা বুয়েট পড়ুয়া প্রেমিকের মাঝে কোন উৎসাহই দেখতে পেলাম না। তবুও বের করতে হল। আর দেখে জনাব কেবল একটা কথাই বললেন, “নাইস ওয়ার্ক অর্থাৎ সুন্দর কর্ম।” তারপর অন্তি বলল, “দোস্ত আজ আসি কাল কলেজ আসলে দেখ হবে। আল্লাহ হাফেয।”

অন্তিরা চলে গেলে ছবিটা আবার প্যাক করছি তখন একজন মেয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো। জর্জেটের কালো শাড়ি, তার উপর কালো চুমকির কাজ। গোধূলির মলিন আলোয় হালকা ঝিকমিক করছে। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর হাত ভরা কালো কাঁচের চুড়ি, ডানহাতে বাদামী রঙের একটা চেইন ঘড়ি। যেন কালোর দেশের রাজকন্যা তার রাজ্যের সকল কালোর সমাহারে নেমে এসেছে এই মিশ্র রঙের পৃথিবীতে, তার কালোর আলোকে দূত্যিময় করে ছড়িয়ে দিতে। বলল, “এক্সকিউজ মি, আমি কি ছবিটা দেখতে একটু দেখতে পারি।” অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম, “ঠিক আছে।” সে ছবিটা দেখে বলল, “অসাধারণ সংগ্রহ, তা কত দিয়ে কিনলেন?” আমি বললাম, “দুঃখিত! এটা কেনা না। আমার আঁকা।” সে অবাক হবার ভঙ্গিমায় বলল, “ আপনাকে দেখে তো মনে হয়না আপনি একজন আর্টিষ্ট? যাই হোক অসাধারণ, গ্রেট ওয়ার্ক।” আমি বললাম, “ ঠিক আছে। এটা আসলে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা একরকম হয়েই গেছে যে আর্টিষ্ট মানেই একটু এলোমেলো, অগোছালো টাইপের মানুষ। যারা দুনিয়ার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নয়। সুন্দর সুন্দর রঙের সমারোহে অসাধারণ ছবি আঁকলেও নিজের পোষাকের রঙ নির্ণয়ে বরাবরই ভুলো মনা। অবশ্য এটা আপনাদের দোষ না। আমাদের মিডিয়া এভাবেই যে উপস্থাপন করে। কিন্তু কথায় আছে না, জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়তায় ভরা। তাই সব সময় নাটক, সিনেমা বা গল্পের চরিত্রের সাথে মিল খুঁজে পাবেন না। ” কথাগুলো বলে সারিনি পিছন থেকে মাহির ডাক দিলো – “আরে সায়ন্তী তুমি এখানে? আমি তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।” ও আচ্ছা যাক তোমাদের দেখা হয়েছে। তাও পরিচয় করিয়ে দেই, সায়ন্তী এ হলো নিলয়। আমার বাল্যকালের বন্ধু, আর্টস কলেজে পড়ে। আর নিলয় এ হলো সায়ন্তী, তোকে যার কথা বলেছিলাম আর কি!

আমি বললাম, “হুম! একান্ন।” সাথে সাথেই সায়ন্তী প্রশ্ন করলো, “একান্ন কি?” মাহিরও চট জলদি উত্তর দিলো, “না মানে ওর যে ছবিটা দেখলে এ পর্যন্ত আমি তোমাকে দিয়ে একান্ন জনকে দেখিয়েছি। আমি একাই। তাই এই কথা বলল। আসলে ও কিছু আঁকলে কাউকে দেখাতে চায়না তো। বড়ই ইনট্রোভার্ট। কিন্তু আমি জোর করে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াই। তাইনা দোস্ত……………” বলেই সম্মতির আশায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আমি শুধু ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, “হুম!”

তারপর বলল, “দোস্ত আজ আসি, পরে সময় করে একদিন ওকে তোর ছবিগুলো দেখিয়ে আনবো।” আমিও ছাড়া পেলে বাঁচি আর তাই মাহিরের কথায় তাড়াতাড়ি করে বললাম, “হুম, যা। আমিও যাই। আল্লাহ হাফেয ।” তখন সায়ন্তী বলল, “ আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালোই হল। এমন প্রতিভাবান পরিচিত কেউ থাকলে খারাপ না। আপনার বন্ধু হতে চাই? রাজি আছেন?” আমি বললাম, “সেটা আপনার ইচ্ছে। আমার কোন কিছুতেই কোন আপত্তি নেই। তবে আমার বন্ধু হওয়া আর পুতুলের বন্ধু হওয়া এক সমান। কেননা বেশীরভাগ সময় আমি চুপচাপ থাকি এবং তা এতোটাই যে আমার উপস্থিতিটুকুই কেবল থাকে কিন্তু কোন অংশগ্রহণ থাকেনা।” সে হেসে বলল, “তাতেই চলবে। আমি আপনার আঁকা দেখবো চুপচাপ, কোন কথা বলবো না, বিরক্তও করবোনা। আপনার ঠিকানাটা দিবেন?” আমি বললাম, “মাহিরকে নিয়ে একদিন চলে আসুন। বেশী দূর না, এই ওয়ারীতেই আমার বাসা।” তারপর বিদায় জানিয়ে রিক্সায় উঠলাম। যে যার গন্ত্যবের দিকে ছুটে চলা।

 

ঐ ঘটনার পর তিন চার সপ্তাহ পার হয়ে গেছে ওদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই, এতোদিনে হয়তো মাহিরের নতুন কোন একটা জোগাঢ় হয়ে গেছে। তবে দুঃখের কথা এই তিন চার সপ্তাহেও ছবির কোন হদিস করতে না পেরে যথারীতি তা আমার আঁকার ঘরে পরে আছে, প্যাক করা অবস্থায়। হলুদ প্যাকেটের উপর ধুলোর আস্তরণ জমেছে। ওয়ারীর এই বাড়িতে মানুষ বলতে আমারা দু’জন। আমি আর আমার দুঃসম্পর্কের আত্নীয় আলীম কাকা। আলীম কাকা বাড়ির দেখভাল করেন, আর রান্নার কাজ করেন। আমি প্রথমেই বলেছি আমার বাবা উড়নচণ্ডী মানুষ তার কোন ঠিকানা ছিলনা। তিনি বাড়ি থেকে বের হতেন তারপর কয়েক মাস কোন খোঁজ থাকত না হটাৎ একদিন হাজির হতেন। এভাবে চলার জন্য দাদাজানের কাছে গালমন্দ যে কম শুনেছেন তা নয় তবে কোন কিছুই তার স্বভাবে পরিবর্তন আনতে পারেনি। তাই বুদ্ধি করে বাবার বিয়ে দেওয়া হয়, তবে সে বুদ্ধিও কাজে আসেনি। বাবা বিয়ের মাস তিনেকের মাথায় উধাও কোন খোঁজ খবর নাই। আমি নাকি তখন মায়ের মাঝে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছি।  তার ছয় মাস পর হাজির হলেন। ব্যস সবকিছু ঠিক মতই চলছিল। প্রায় বছর দুয়েক হল কোন সমস্যা নেই। তারপর আবার আচানক লাপাত্তা হয়ে গেলেন। সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না। এর মধ্যে পৃথিবীর আলো দেখলেও তার মাঝে বাবাকে আলাদা করার ক্ষমতাটা আমার হয়ে উঠেনি। তাই তার মুখ দেখা সত্ত্বেও তা স্মরণ করার মত স্মৃতি আমার মস্তিস্ক জমাতে পারিনি। বাবার পথা চেয়ে থাকতে থাকতে পাঁচ বছরের মাথায় মাও মারা গেলেন। আমার বয়স তখন সাত বছর হতে চলল।  তারপর থেকে দাদাজানের হাতে মানুষ। তবে এস.এস.সি পরীক্ষায় পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হবার আগেই দাদাজানও না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। সেই থেকে শুরু হলো একা একা পথচলা। আর তাই নিঃসঙ্গতাই আমার প্রধান সাথী হয়ে উঠেছে। তবে আলীম কাকা আজও অপেক্ষায় আছেন বলা যায় না কবে আমার উড়োনচণ্ডী বাপ ঊড়ে এসে হাজির হন ওয়ারীর ২নং লেনের এই প্রাচীন বাড়িটিতে। জানালার ফাঁকে চেয়ে চেয়ে এইসব কথা ভাবছিলাম, বাড়ির সামনে থাকা এক চিলতে জায়গায় করা বাগান, বাগানে সুন্দর অপরাজিতা ফুল ফুটেছে। অপরাজিতা আমার খুব পছন্দের বিধায় আলীম কাকা এই গাছগুলো আমার আঁকার ঘরের সামনে লাগিয়েছেন। আমি অবাক হয়ে দেখছিলা, ফুটে থাকা অপরাজিতায় উপর দিয়ে একজোড়া কালো ভ্রমর গুন গুন করতে করতে ঘুরে বেড়াছে। আচ্ছা এটাকে দিয়ে একটা ছবি আঁকা যায়না। যেই ভাবা সেই কাজ, ইজেলটা বসিয়ে তাড়াতাড়ি পেন্সিল দিয়ে গঠনটা এঁকে নিলাম। একটি মেয়ে বাগানের অপরাজিতার উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর ভ্রমরের দল তার পিছে পিছে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা গড়বড় হচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারছিনা। ছবির মেয়েটার মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্চে? কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর মনে হলো আরে এতো মাহিরের প্রেমিকা, কি যেন নাম সায়ন্তী। সায়ন্তীর মুখ। কিন্তু পৃথিবীর তলাট্টে এতো মুখ এতো নারীর সমারোহ থাকা সত্ত্বেও আমার অবেচেতন মন আর মস্তিষ্ক এই মেয়ের বিম্ব কেন তৈরী করলো?? ভাবলাম মুখটা পরিবর্তন করতে হবে, ইরেজার দিয়ে মুছে আঁকতে গেলাম, কিন্তু কেন জানিনা আমার আর কোন মুখের ইমেজ তৈরী হচ্ছেনা। ঘুরে ফিরে যা দাঁড়াচ্ছে ঐ একি মুখ একি চোখ, একি নাক সর্বোপরি একি মুখমণ্ডলে রূপান্তরিত হচ্ছে। বুঝলাম না ঠিক গোলমালটা কোথায়? চতুর্থবার যখন পারলাম না তো মুখের অংশটা মুছে ওভাবেই ফেলে রেখে উঠে আসলাম। আলীম কাকাকে বললাম, চা দিতে। চা নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠলাম, আকাশ দেখবো বলে। অনেকদিন খোলা আকাশ দেখা হয়না। গ্যালারিতে ঘুরতে ঘুরতে তেমন অবসরই পাইনি। আর যান্ত্রিক ঢাকার যান্ত্রিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কার সাধ্য আছে আকাশের পানে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচবে?  ছাদে উঠতে না উঠতেই চারিদিক থেকে আজানের স্বর ধ্বনিত হলো। মানে এইমাত্র বিকেল হলো । ছাদে পৌছে সারিনি আলীম কাকাএসে বললেন, “তোমার এক বন্ধু আর বান্ধবী এসেছে নিচে”। কিছুটা অবাক হলাম বন্ধু আসার মত অনেকেই আছে, কিন্তু বান্ধবী?  যাই হোক ভাবতে ভাবতে নিচে এসে দেখি ড্রয়ং রুমে মাহির আর সায়ন্তী বসে আছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম এই ভেবে এক মাস হতে চলল, আজো মাহিরের সম্পর্কটা টিকে আছে? সত্যি অবাক করা কাণ্ড। ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আর কি খবর ? হটাৎ কি মনে করে?” মাহির বলল, “এই যে উনি তোর ছবি আঁকা দেখবে বলে পাগল হয়ে উঠেছেন। তাই নিয়ে এলাম, তোর আঁকিবুঁকি দেখাতে”। বললাম, “ভালোই করেছিস। একটা ছবি শুরু করেছি। পেন্সিলে আঁকা শেষ এখন আঙ্গুলে রঙ করবো। সায়ন্তী বাচ্চা মেয়ের মত লাফিয়ে উঠে বলল, “ চলুন, দেখবো কি আঁকলেন?” “চলুন” বলে ওদের আঁকার ঘরে নিয়ে এলাম। চারিদিকে রঙ, থিনারে মাখামাখি। পায়ের তলায় চিকন ১/২ ইঞ্চির তুলি থেকে শুরু করে দেয়ালে রঙ করার বড় ব্রাশ তুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে। মাহির ইজেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ দোস্ত এটাও তো জোশ রে।” সায়ন্তী বলল, “ কি আঁকছেন? বুঝিয়ে বলবেন না?” বললাম, “ কিছুই না। একটা মেয়ে শখের বসে বাগানে ফোটা নীল অপরাজিতাকে ভালোবেসে তাদের উপর দিয়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে আর মেয়েটাকে দেখে একদল ভ্রমর আর প্রজাপতি মেয়েটার পিছু নিয়েছে।” সে ঠিক কি বুঝলো জানিনা মুখে বলল, “ ওহ!” তারপরই পাল্টা প্রশ্ন, “টা মুখ আঁকেননি কেন?” মেয়েটা প্রশ্ন করে খুব ঝামেলার ব্যাপার। বললাম, “কেন জানি না যেই মুখই আঁকি না কেন ঠিক মানাচ্ছেনা। বেমানান ঠেকছে। তাই পুরোটা শেষ না করেই উঠে গিয়েছিলাম ছাদে।” আবারও বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করে বসলো, “কেন? পছন্দ না হওয়ার কি আছে?” ক বলব, বুঝতে না পেরে বললাম, “ আ……এক কাজ করি। আপনি বসুন আপনার মুখটাই আঁকি। দেখি মানায় কিনা?” হটাৎ পাওয়া এই প্রস্তাবে কিছুটা ইতস্তবোধ করছে, মাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে কি বলবে বা করবে ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছেনা। তখন মাহির নিজেই ওর জন্য টুলটা এনে বসিয়ে দিয়ে সায়ন্তীকে বলল, “আরে ভালোই হবে। তুমি চুপচাপ বস। এক নজরে তাকিয়ে থাকবে”।

তারপর আমাকে বলল, “ আঁক দোস্ত। আমি বসে বসে আঁকা দেখি ।” আমি ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়েই আঁকতে শুরু করলাম। এই প্রথমবার এই একটি বারের দেখাতেই কেন জানিনা মেয়েটাকে বড় আলাদা লাগছে। জানলার পাশেই টুলটা বসানো, দক্ষিণা বাতাস ঝিরি ঝিরি করে জানালা দিয়ে রুমে প্রবেশ করছে। আর তাতে ওর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে আর একটু পর পর সে সেগুলো হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে। কালো চোখদুটো অসম্ভব সুন্দর লাগছে। দীঘির কালো জলের মত স্বচ্ছ টলটলে। নাক্টা বেশী উচুও না আবার বোঁচাও না, মাঝামাঝি। ঠোটটা হালকা বাদামী। যেন ক্যাডবেরির ডেইরী মিল্ক চকোলেটের মত। চকোলেটের মতই সিক্ত আর নেশা জড়ানো ওষ্ঠাধর। আমার চোখ আর তার মুখমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রইলো না। সে সীমা অতিক্রম করে পৌছে গেল তার গোলাপী সাদা গাত্রবর্ণের গলার কাছে। একে তো গ্রীষ্মকাল, তারপরে আবার ফ্যান বন্ধ, রঙ শুকিয়ে যাওয়ার ভয় আছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ওর গলার ভাজে। এক বিন্দু ঘাম গড়িয়ে আসছে তার বুকের খাঁজে। কমলা রঙের শিফনের শাড়ির সাথে ম্যাচ করে ফিটিং ব্লাউজের কারণে ওর সুউচ্চ বুক্টা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। গরমে অনেক কষ্টে বসে ছিলো, দেখলাম আমি কিছুই আঁকি নি। উলটো বাকি অংশটায় উলটাপালটা আঁচড় টেনে ছবিটাই নষ্ট করে ফেলেছি। যখন ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকালাম ঠিক তখনি সে একটা নিঃশ্বাস ছড়লো, ওর বুকটা দু’ইঞ্চি বেড়ে আবার নেমে গেলো। এই উঠানামায় সৃষ্ট কম্পনে গলার খাঁজ বেয়ে নামা ঘামের বিন্দুটির আলতো করে চুইয়ে লুকালো ঐ স্ফীত স্তনের আড়ালে।

এতোক্ষণে আমার হুশ ফিরলো, এ আমি কি করছি? ওফ! আল্লাহ। ছি! সে আমার বন্ধুর প্রেমিকা। আর আমি তাকে কি নজরে দেখছিলাম? ইশ! না জানি মাহির টের পেলে কি ভাববে? আর মেয়েটাই বা কি ভাববে? আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ঐ সৌন্দর্য্যখানি হতে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। বললাম, “দুঃখিত, আপনাকে অনেকক্ষণ কষ্ট করে বসিয়ে রাখলাম, কিন্তু দেখুন কিছুই আঁকতে পারলাম না। আসলে আজ কেন জানি না হচ্ছে না। দয়া করে মাফ করে দিবেন। অনেক কষ্ট দিলাম।”  সে কিছুটা আশাহত হলো। তখন মাহির বলল, “ আরে এটা এমন কি! বাদ দে তুই মন খারাপ করিস না। সব দিনে সব কিছু হয় না। আজ হয়নি তো কি হয়েছে অন্য আর একদিন হবে।” সায়ন্তী বলল, “ আসলে আপনার দোষ না। আমার চেহারা তো তেমন ভালো না আর কপাল তো আরও খারাপ তাই শিল্পীর পেন্সিলও এই মুখের ছবি আঁকতে চায় না।” বুঝলাম মন খারাপ করেছে, তাই বললাম, “আপনার কথা ভুল প্রমাণিত করে দেবো যদি অন্য আরেকদিন একটু কষ্ট করে সময় দেন তো। আর আসলে আমার অভ্যাস একবসায় ছবি শেষ করা। এর হেরফের হওয়াতেই বুঝি আজ এমন হচ্ছে। আপনি মন খারাপ করবেন না।” মাহির বলল, “ দোস্ত তোকে পারতেই হবে। সায়ন্তী আজই সময় ঠিক করে নাও কখন আসবে?” সে বলল, “ আচ্ছা আপনার ফোন নংটা দিন। আমি কথা বলে নিবো।” আমি মাহিরকে নং দিতে বলে বললাম, “এক কাজ করলেই তো হয় তোরা সকালে এলি সারাদিন থাকলি। আমারও একটা দিন একা একা কম থাকতে হল। সাথে সাথে ওর ছবিও আঁকা হলো।” সায়ন্তী বলল, “আচ্ছা যান, আসব।”

মেঘে তখন বিধাতা গোধূলির লালচে আবির ছড়িয়ে দিয়েছেন। সূর্যটাও ধীরে ধীরে হারাতে বসেছে আঁধারের অসীম বুকের মাঝে। পাখিরা ডানা ঝাপটিয়ে ফিরে যাচ্ছে আপন নিরালায়। সায়ন্তী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “মাহির, অনেক দেরী হয়ে গেলো। আজ উঠি অন্য একদিন আসব।” আমি বললাম, “অবশ্যই, অপেক্ষায় থাকবো।” মাহির আর সায়ন্তী বিদায় নিয়ে চলে গেলে আমি আবার আঁকার ঘরে ইজেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি জানিনা কি করছিলাম? তাই এখন ঠাণ্ডা মাথায় সব আবার ভাবতে হবে। কিন্তু ছবিটার সামনে গিয়ে আবার সব এলোমেলো হয়ে গেলো। পুরো ছবি পেন্সিলের আঁচড়ে নষ্ট হলেও শুধু একটা চোখ পরিপূর্ণতা নিয়ে আছে। কিন্তু চোখটা কেন জানিনা আমার আগের ছবির চোখটার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তবে কি আমার ঐ মেয়ে আছে বলেই এমন হচ্ছে নাকি বাস্তবেই এমন। তবে কি সায়ন্তীই সেই অন্তর্নিহিতা? না, আর ভাবতে পারছিনা। বিশ্রাম প্রয়োজন, রুমে গিয়ে রবীন্দ্র সংগীত ছাড়লাম,

সহেনা যাতনা , দিবস গণিয়া গণিয়া বিরলে

নিশিদিনও বসে আছি শুধু পথপানে চেয়ে।

কিসের জন্য অপেক্ষা? কিসের জন্য পথ চাওয়া? ঠিক বুঝতে পারছিনা? কেনই বা এই গানটি পছন্দ করলাম? এলোমেলো ভাবনাগুলোর যাতনায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুম ভাঙল পরদিন সকালে। সায়ন্তীর ফোনে।

  • শুভ সকাল। কি খবর? কেমন আছেন?
  • সকাল? এখন তো সবে আমার ভোর হলো? তাও আপনার ফোনের জন্য, নাইলে তো মাঝরাত থাকতো। আর তাই ভোরবেলায় কি কারো কোণ খবর থাকে? আর যেহুতু খবর নেই তাই বলতেও পারছিনা কেমন আছি?
  • মানে কি? আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝিনা। এতো পেচিয়ে কথা বলেন কেন? পেচিয়ে কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে খুব মজা পান না???
  • কিছু না। এইমাত্র আপনার ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙলো। টা আপনার খবর বলুন। আর আমার স্বভাবই এইভাবে কথা বলা, কাউকে নিজ ইচ্ছা থেকে বিব্রত করার জন্য বলিনা।
  • ওহ! আমার খবর ভালো। আচ্ছা, একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?
  • করে ফেলুন, উত্তর জানা থাকলে অবশ্যই দেবো।
  • আপনি কি আমাকে বন্ধু মনে করেন না? আপনার কাছে ঠিকানা , ফোন নং চাইলে মাহিরকে কেন বলেন? নিজে দিতে পারেন না?
  • সন্দেহ অমূলক। চাইনা কোন নতুন জাল বুনতে প্রাচীন দেওয়াল ধ্বসে যাক।
  • দুঃখিত, এইবারও বুঝলাম না। পরিষ্কার করে বলবেন দয়া করে।
  • শুনুন, বিদেশী প্রবাদে আছে, “তরী , ঘোড়া আর নারী, যে চড়িবে তারই।” আর তাছাড়া এই পৃথিবীতে নারী আর মানি মানে টাকা, এই দুই জিনিস নিয়ে সব সময় ফ্যারকা বাঁধে। আর তাই আমি এই দুই জিনিস থেকে সব সময় সন্তর্পণে সাবধানে গা বাঁচিয়ে চলি। আপনি আমার বাড়িতে আসা দ্বিতীয় নারী। এর আগে আমার জন্মদিনে আমার এক সহপাঠী ছাড়া আর কেউ এই বাড়ির ঠিকানা জানেনা।
  • মানে আপনি কি বলতে চান? আমাকে নিয়ে বা আমার জন্য আপনার সমস্যা হতে পারে?” কথাতে বিরক্তির ভাবটা স্পষ্টতই বোঝা গেল,
  • হুম! হতে তো পারেই, বলা যায় না। কেন আপনি কি নারী গোত্রের অন্তর্গত নন?
  • তাহলে ফোনে কথা বলছেন যে, সমস্যা হবে না?
  • হুম! তাও হতে পারে। এক কাজ করুন। কথা বলা বাদ দিন। ফোনটা কেটে দিন।
  • আরে দাঁড়ান। ফোন আমি করেছি রাখলে আমি রাখবো। আপনার কি? আপনি বলার কে?

এই ধরণের দাপুটে কথার সাথে আমি অভ্যস্ত নই। তাই আমার নিজেরও মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো। যে ঝামেলা থেকে বাচতে চাই তা আরো কাঁধে চেপে বসছে এবং আমি তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ের হাত থেকে ছাড়া পেতে হবে। তাই বললাম

  • আমি কেউ না তো আপনার ইচ্ছে হলে ফোনটা রেখে দিবেন আমার কথা বলতে মন চাইছে না।

ফোন বালিশের পাশে স্পিকার অন করে ছুড়ে দিলাম। সে কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো , আরে আজিব কথা বলছেন না কেন? বলে ফোন কেটে দিলো। কাটার আগে ধুৎ বলে একটা শব্দ  করলো। শব্দটা শুনে হাসি পেলো, এই ভেবে যে হৈমন্তী গল্পে পড়েছিলাম, বয়স ষোল তবে তা স্বভাবের ষোল নয়।” এতো দেখি সেই কথার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। বিছানা থেকে উঠে হাত্মুখ ধুয়ে নাস্তা করে গেলাম ছবি আঁকার ঘরে। কয়েকদিন হল কলেজ যাওয়া নেই, এই নিয়ে আমাদের কলেজের শিক্ষকদের কোন মাথাব্যথাও আছে বলে মনে হয় না। আঁকার ঘরে কি করবো? ত্থিক করতে না পেরে স্কেচবুকটা নিলাম, একটা ২বি পেন্সিল নিয়ে অবলীলায় সয়ন্তীর মুখটা স্কেচ করতে থাকলাম। সাধারণত কারো মুখ স্কেচ করতে তাকে সামনে দরকার হয়, কিন্তু এবেলায় সব নিয়ম যেন উপর শিকোয় তুলে রাখা হয়েছে। এরকম হবার কারণ কি? তবে কি আমি তার প্রেমে পড়েছি? তবে কি সেই আমার অন্তর্নিহিতা?  যার জন্যই আমার অবচেতন মন আমার সৃষ্টির মাঝে তাকে বার বার ফিরিয়ে এনে এ কথাই কি প্রমাণ করতে চাচ্ছে? কি মনে করে জানিনা আগের ছবিটা পরে থাকতে দেখে কভার খুলে বের করলাম। ছবিটার দিকে তাকালাম আর বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া কিছুই বাকি ছিলো না আমার জন্য। কাল যখন সায়ন্তীর ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলার ওর ঐ শান্ত চোখ দু’টোকে খুব চেনা চেনা লাগছিলো, মনে হচ্ছিল এমন চোখ আমি হর হামেশাই দেখে আসছি। ছবির মেয়েটির চোখের দিকে স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম, কিন্তু এ কি করে সম্ভব? তবে কি আমার সব সৃষ্টি এক? নাকি অদৃষ্টের কোন খেলা? নাকি শুধুই কাকতালীয় একটা ব্যাপার। আমার সব আঁকার খাতাগুলো বের করলাম উল্টিয়ে দেখতে থাকলাম, নাহ! অন্য কোনটাই তো এমন না। তবে এটা এমন কেন হচ্ছে? মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিলাম, সবুজ বোতামে চাপ্তেই দেখলাম সায়ন্তীর নং টা জ্বলজ্বল করছে। ফোন করতে গিয়েও করা হলো না। ওয়াশরুমে গিয়ে কাধ অবধি থাকা চুলগুলো ভিজিয়ে নিলাম। রুমে ফিরে ফোন নিয়ে ফোন দিলাম, রিং হচ্ছে কিন্তু ধরলো না। আবার ফোন দিতেই এবার ফোন ধরলো। ধরতেই বললাম,

  • শান্তা, বিশাল সমস্যা। আমাকে বাঁচা। পারলে তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।
  • আচ্ছা। কি হয়েছে সেটা তো বলবি নাকি?
  • অনেক কিছু হয়েছে? এতো কিছু ফোনে বলা সম্ভব না। কিন্তু যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না।
  • কি হচ্ছে? কি ঠিক হচ্ছে না? সেটা না বলে কি আবোল তাবোল বকছিস।
  • তুই বাসায় আয় নিজে না দেখলে বুঝবি না।
  • এখনি আসতে হবে? আমি একটু বাইরে যাচ্ছিলাম। তাও তুই যদি বলিস।
  • কই যাবি? শপিংয়ে তো? আমার এখান হয়ে যা।
  • আচ্ছা তাই করি। তুই একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি।

শান্তা আসলে সব গুছিয়ে বলতে হবে। আগে সব ছবি আর স্কেচবুকগুলো এক জায়গায় করতে হবে। আঁকার  ঘরে গিয়ে সব জিনিশ এক জায়গা করে রাখছি এমন সময় ডোর বেল বাজলো। এতো দ্রুত তো আসার কথা না। গলা চড়িয়ে বললাম, “কাকা, দেখুন তো কে?” আমি আমার কাজ করতে লাগলাম। পিছন ফিরে দেখি সায়ন্তী দাঁড়িয়ে আছে, চোখটা ফোলা লাল হয়ে আছে,যেন এইমাত্র কান্নাকাটি করেছে। কান্না জড়ানো কন্ঠেই বলল, “আপনি এভাবে আমাকে অপমান করার সাহস কই থেকে পেলেন? আমি আপনার কোন ক্ষতি করেছি? তাহলে কেন আপনি আমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করলেন? আমি জীবনে কারো কাছ থেকে এতো খারাপ ব্যবহার পাইনি? আর আপনি? নিজেকে কি মনে করেন?”

বললাম, “শান্ত হও। এ এমন কিছু না। আর আমি প্রথম দিনই বলেছি আমি আমার খেয়ালখুশি মতো চলি তাতে কার ভালো লাগলো কার খারাপ তা চিন্তা করি না।” সে বলল, “তাই বলে এমন বাজে ব্যবহার? আপনি ফোনটা ভদ্রভাবে রাখতে পারতেন।” বলেই কলাপাতা রঙের শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো।

আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, কি অসাধারণ তার রূপ। সদ্য কান্না থামানোতে দমকে দমকে ঊঠা নিঃশ্বাসে তার সারা শরীর কেপে কেপে উঠছে। গোল ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে গেছে। এখনো মাথা নামিয়ে ফোঁপাচ্ছে। কি করব আমি? আমি যে অধমেরও অধম নইলে কি আর পারতাম এতো সুন্দর নিস্পাপ একজনকে কাঁদাতে? কি করে তার ঐ আখিজল আজ মুদবো আমি আমার অধম হাতের ছোঁয়ায়? না সে সাহস আমার নেই। এক কদম এগিয়ে গিয়ে হাতটা ধরতেই যেন ওর সারা শরীরে বিদ্যুতের ঝলক লাগলো আর সে তাতে কেপে উঠলো। তার হাত ধরে বললাম, “ হায় রে, বাচ্চা মেয়ে। এতো অল্প কথাতেই যদি কাঁদো তাহলে আর কি করে হবে? হুম?? কান্না থামাও।” বলেই ওর তপ্ত আঁখি জল আমার তর্জনীর ডগায় তুলে নিলাম। মনে পড়লো নজরুলের  সেই গান-

নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি জল। মলিন হয়েছে ঘুমে

চোখের কাজল। এ নয় আঁখি জল।

যদিও এ বেলায় ঘুম নয়, চোখের কাজল মলিন হয়েছে আঁখি জলেই। কেন জানি না মনে হলো এই নারী আমার। এই অশ্রুজল আমার। এতে শুধু আমারই অধিকার আর কারো নয়। এই আমার অন্তর্নিহিতাকে আর আজ এই সময় হলো তাকে নিজের করার। কখন তাকে বাহু বাঁধনে বেধেছি খেয়ালই করিনি। বুঝতে পারলাম যখন সে ছোটার জন্য চেষ্টা করলো। তারপর ছেড়ে দিতেই একহাত দূরে গিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল, “আপনি এ কি করছেন?” ওড় চোখে মুখে ছিলো বিহ্বল হওয়ার ছাপ। বললাম, “সরি! সরি! আসলে কিছু কথা তোমাকে জানানো উচিত। একটু বসো। প্লিজ রাগ করো না, আমার কথাগুলো শুনো তারপর যা মন চায় বলো আমি বাঁধা দিবো না। ” বলেই তাকে আর সুযোগ না দিয়ে ছুটে গেলাম ছবিগুলোর কাছে একেকটা ছবি আনলাম তার সামনে তারপর আনলাম আয়না। ছবিগুলো ইজেলের উপর রেখে বললাম, “দেখো এই ছবিটা, ঐ চোখটা? দেখো এখন আয়নায় তোমার চোখ। কি দেখছো? একই চোখ তাই না? এবার এই ছবিটা দেখো ঐ নাকের ভাঁজটা দেখো, এখন দেখো আয়নায়। কি হুবহু নয়? একই চোখ, একই না নাকের ভাজ। চোখের চাহনি, হুবহু এক। দেখো আয়নায়। বিশ্বাস হয়  না? কিছু বুঝতে পারছো?”

সে হতভম্বের মত একবার আমার দিকে আর একবার  ছবি ও আয়নায় তাকাচ্ছে। তারপর বলল, “এটা কি করে সম্ভব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।” বললাম, “বুঝতে পারছনা? আমার সৃষ্টির মাঝে তোমার অনুপ্রবেশ। কিন্তু কেন? এতো এমন নয় যে তোমাকে দেখার পর থেকে এমন হচ্ছে। অনেক আগে থেকে। তোমাকে চেনার আগে থেকেই। কিন্তু কেন? কি অভিপ্রায়ে? আমি জানিনা। এতোদিন তাও ঠিক ছিলো। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আমি যাই আঁকি না কেন , যাকেই আঁকি না কেন তার মাঝে তুমি আসো। আমি অন্য কারো ছবি আঁকতে গেলেও তোমাকে আঁকি। আর সেদিনের ঐ ছবিটাও শেষ না করে উঠে গেলাম কারণ তুমি। তোমাকেই এঁকেছিলাম। কিন্তু মাহিরের কথা ভেবে আমি মুখটা মুছে দিয়েছি। পরে তোমাকে সামনে পেয়ে আঁকার কথা বললাম, যেন মাহির ভুল না বুঝে কিন্তু আক্তেই পারলাম না। আমি এটাই জানতে চাই। কি আছে তোমার মাঝে? কেন তোমাকে নিয়ে আমার অবচেতন মন আমার সাথে খেলছে? কেন? সায়ন্তী কেন?” তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কপালের ভ্রু কুঁচকে কথা শুনছে, কি বলবে  যেন ভেবে পাচ্ছে না। আমতা আমতা করতে দেখে আবার বললাম, “তাই তোমার কাছ থেকে দূড়ে সরতে চেয়েছি। তোমাকে এড়িয়ে চলেছি। কিন্তুই যতই এড়াতে চেয়েছি ততই তুমি আর তোমার স্মৃতিরা আমাকে ঘিরে ধরেছে, টেনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমাকে আমার আগের স্থানে। বল ের হাত থেকে মুক্তির উপায় বল? জানা আছে?” দুজনেই চুপ করে ছিলাম, আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ছবিগুলো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম, তুলি আর ব্রাশগুলো ছুড়ে ফেললাম এদিক ওদিক। সায়ন্তী উঠে এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, “দয়া করে থামুন। আপনি চাইলে আমি আর কোনদিন আপনার সাথে যোগাযোগ করবো না। তাও এভাবে নিজেকে কষ্ট দিবেন না। মাফ করে দিন আমাকে। আমি চলে যাচ্ছি।” কথা শেষ করে আঁচলের কোণায় আর একবার চোখের জল মুছলো, তারপর ত্রস্তপদে বেড়িয়ে গেলো। এমন সময় শান্তা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। বলল, “আরে একি অবস্থা করেছিস?” কথা শেষ করার আগেই আমার চোখে পানি দেখে বলল, “আরে দোস্ত হয়েছেটা কি?” আমার বুকের সাথে তখনো ধরা সেই স্কেচবুকটা, ওটা হাতে নিয়ে বলল, “এ তো ঐ মেয়েটা যে এই মাত্র বেড়িয়ে গেলো।” বললাম, “ওটাই তো সমস্যা।” তখন শান্তা বলল, “তুই আয় তো এখান থেকে। বসার ঘরে চল। তারপর ঠাণ্ডা হয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে বল হয়েছেটা কি।” শান্তার কথা মত হাত মুখ ধুয়ে এসে ছাদে এসে ইজিচেয়ারে বসলাম দুজন। তারপর সব খুলে বললাম। সে বলল ,

  • “আরে গাধা, তুই ঐ মেয়েটার প্রেমে পড়েছিস, ব্যস সোজা কথা। এই মেয়েই তোর ড্রিমগার্ল। এখন যা সব খুলে বল।”
  • কিন্তু কি করে? মাহির জীবনের প্রথম কোন মেয়ের সাথে এতদিন সম্পর্ক রেখেছে মানে সে আসলেই তাকে পছন্দ করে। তাছাড়া সায়ন্তীও মাহিরকে ভালোবাসে আমাকে না।
  • তাই তুই বলবি না? নিজে নিজে কষ্ট পাবি? এটা কি করে হয়?
  • কিছুই করার নেই রে শান্তা শুধুই কষ্ট পাওয়া ছাড়া।
  • তো এখন কি করবি?
  • ভাবছি দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। অনেকদিন যাওয়া হয়না। তাছাড়া জায়গা পরিবর্তন করলে হয়ত কোন উপকার আসলেও আসতে পারে।
  • দেখ যা ভালো বুঝিস কর। কিন্তু যোগাযোগ রাখিস। বেলা তো অনেক হল। তোর ক্ষিধা লাগেনি। চল, খাবি আয়।

তারপর দুপুরের খাওয়া শেষে আরেক দফা বুঝ দিয়ে শান্তা চলে গেল। আমি শোবার ঘরে গিয়ে আমার ব্যাগ গুছানো শুরু করলাম। সব কাজ শেষ করে যখন বের হলাম তখন সূর্য পাটে নেমেছে, আস্তে আস্তে অন্তিম পরিণতি আঁধারে বিলীন হতে যাচ্ছে। প্রদীপের আলো নিভে যাবার আগে একবারের জন্য যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠে তেমনি সূর্য ডুবে যাবার আগে তার লালিমার রক্তিম আভা চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে চাইছে। আর আমি আর একবারের জন্য পিছন ফিরে দেখে নিলাম বাড়িটা, তারপর সামনে দেখি গন্ত্যব অজানা, শুধুই গাঢ় অন্ধকারকে জয় করার অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। পথচলা শুরু হলো আমার অন্তহীন পথে, গন্ত্যবহীন গন্ত্যবের খোঁজে রাত্রির আঁধারকে সাথী করে।

এরপর ৬মাস কেটে গেছে আজ এখানে তো কাল ওখানে করে ঘুরতে ঘুরতে। বাড়ি ফিরে এসে প্রথমেই চোখ পড়লো বিছানার পাশে ফেলে যাওয়া মোবাইলটার দিকে। পার্থক্য কেবল এই যন্ত্রটি এখন মৃত। মাস ছয়েক চার্জ না থাকায় ব্যাটারি অফ হয়ে গেছে। আমার মনের মতই। এ মনও আজ মৃত। ফোনটা চার্জে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনার চেষ্টায় নিবৃত হলাম। চেনা যাচ্ছেনা, মাথার চুল আর দাড়ি গোফ তার দৈর্ঘ্যের নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সেলুনে গেলাম সভ্য জগতের বাসিন্দা হওয়ার বাসনায়। তারপর ফিরে এসে গোসল করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি ৫০টার বেশী মিসকল আর মেসেজ। এর পরে আর ফোন ধ্বকল সহ্য করতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু অন করার সাথে সাথেই আরো ১০/১১ টা মেসেজ এলো। কিন্তু কোনটাই দেখতে মন চাইলো না বিধায় সব একবারে মার্ক করে রিড করে দিলাম। আজ থেকে নতুন সূচনা করবো। গ্রামের জমির দাম বেড়েছে, এক বিঘা কি দু বিঘের দামেই একটা আর্টশপ খোলা যাবে। তা না হলে অন্য কোন ব্যবসা, এমনি এমনি বসে থেকে কি আর দিন যাবে। যাক সে চিন্ত করা যাবে পরে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি মাহিরের ফোন।  ধরতেই মাহির বলল,

  • আরে শালা, গাধার বাচ্চা গাধা। কই ছিলি এতদিন ? একটা কোন খোঁজ খবর নাই? বেঁচে আছিস না মরছিস তারও তো কোন হদিস নাই।
  • এইতো গ্রামে ছিলাম। আর দেশ ঘুরলাম। আর মরলে সে খবর এমনিতেই পেতি। কারন খারাপ খবর বাতাসের আগেই পৌছে যায়। যেহুতু পৌউছেনি তার মানে এখনো বেঁচে আছি। তোর কথা বল।
  • ভালো বলেছিস। আর আমি? আমি তো মাম্মা ফাইস্যা গেছি। এক্কেবারে ক্লীন বোল্ড।  বলেই হাস্তে লাগলো।
  • মানে কিরে? কিসে ফাঁসলি আবার?
  • বুঝলিনা শালা, আসলটা পাইছি। তাই বিয়া কইরা ফেলাইছি।

কথাটা বুকের উপর ধপাস করে একটা পাথর পরার মত ব্যথার উদ্রেক করলো। যে সায়ন্তীকে ভোলার জন্য এতো কিছু সেই তাকে দিয়েই শুরু হলো দিন? ম্লান গলায় বললাম, – ভালো তো। তোর বউয়ের তো বিয়ের আগেই শখ ছিলো ছবি আঁকানোর। তখন তো হল না। একদিন সময় করে বেড়াতে আয় এঁকে দিবো। বিয়ের আগে হয়নি তো কি বিয়ের পরেই হোক।

অবাক হয়ে বলল , “তুই কার কথা বলছিস? নীতুর সাথে তোর আবার দেখা হলো কবে? তুই তো ওকে দেখিসইনি।” আমি মাহিরের চেয়েও অবাক হয়ে বললাম, “মানে কি? সায়ন্তীর কি হলো?” অনেক কষ্টে নামটা উচ্চারণ করলাম। আর সে একগাল হেসে জবাব দিলো, “আরে শালা, ঐটা তো নং ৫১. আর এইটা ৬০. মাঝখানে ০৯জন খালি আসছে আর গেছে। দেশী ব্যাটসম্যান উইকেটে থাকতে পারেনি। কিন্তু মামা এইটা এক্কেবারে সাকিব আল হাসান। আউট হওয়ার নামই নাই। তাই বিয়ে কইরা ফেললাম। কিন্তু মেয়েটা ভালো ছিলো। তোর ওখান থেকে আসার ২দিন পর বলল, সরি আমি তোমার সাথে সম্পর্ক্টা আর রাখতে পারবো না। আমাকে মাফ করে দিও। আর তুমি অনেক ভালো কিন্তু আমি আসলে । আমার দ্বারা আর সম্পর্কটা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। সরি।” হ্যান ত্যান । গলায় মেয়েলি স্বর এনে বলল। তারপর বলল, “মামা আমি তো কই, আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমার রাস্তা পরিষ্কার করলা। তাও কইলাম, ঠিক আছে। ব্যাপার না। এটা হওয়া অসম্ভব কিছুনা। তয় মামা, শুনলাম মেয়ে নাকি অসুস্থ। কি জানি হইছে? শমরিতা হাসপাতালে।” আমার চিন্তায় তখন টান পড়লো, বললাম, “কি হয়েছে? শমরিতা? কোনটায়? জানিস নাকি?” মাহির বলল, “কেন? দেখতে যাবি? তোর খোঁজ করছিল মাস দুয়েক আগে। আমি তো জানিনা। যা দেখা কইরা আস। মিরপুর শমরিতায়। আমার কি আসতে হবে নাকি তুই একাই যাবি?”

  • না থাক তোর কষ্ট করা লাগবেনা। আমি খুঁজে নিবো। আচ্ছা রাখি পরে একদিন কথা হবে।
  • শোন বাসায় আসিস। তোর ভাবির রান্নার হাত অসম্ভব সুন্দর, একবেলা খেয়ে যাস। আঙুল চাটতে থাকবি, চ্যালেঞ্জ।
  • আছা আসব এক দিন। আজ রাখি। আল্লাহ হাফেয।

ফোনটা রেখে ইনবক্স খুললাম, যা ভেবেছি তাই, সব গুলো সায়ন্তীর মেসেজ। সর্বশেষটা আজ থেকে দেড় মাস আগের। ওটাতে লেখা-

“ আপনি এতো খারাপ কেন? হ্যাঁ? এখন তো আমি বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি। তাও কেন উত্তর দিচ্ছেন না? কেন ফোন বন্ধ করে রেখেছেন? আমাকে কাঁদাতে আপনার খুব ভালো লাগে বুঝি নাহ??? ”

আমি নিজেই নিজেকে বললাম, নাহ আর কোন কষ্ট করবো  না। আর আমি তোমাকে কাঁদাবো না সায়ন্তী। বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজি নিয়ে গেলাম সোজা মিরপুর শমরিতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। খোঁজ নিয়ে জানলাম ৭৭ নং কেবিনে আছে। দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিন তলাতে দরজাটা আলতো করে খুলতেই দেখি সায়ন্তী শুয়ে আছে। হাসপাতালের সবুজ গাউনে। হয়তো ঘুমিয়ে আছে নয়তো অজ্ঞান অবস্থায়। হাতের শিরায় প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। গোটা শরীরটা শুকিয়ে জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেছে। সুন্দর সেই টলটলে চোখের নিচটায় অমানিশার আঁধারের কালো রেখা দেখা দিয়েছে। সেই ক্যাডবেরি আজ শুকিয়ে কাষ্ঠল রূপ ধারণ করেছে। গোলাপী সাদা মুখমণ্ডল আজ খাতার সাদা পাতার মত ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। কেবলই পাশে বসে ওর মলিন হাতটা হাতের মাঝে নিতেই কেউ একজন রুমে প্রবেশ করলেন, বয়স্কা মহিলা। তাকে দেখে দাড়াতেই বললেন, “তুমি নিলয় না? আমার মেয়ের মুখে এতবার তোমার কথা শুনেছি যে এক দেখাতেই চিনে ফেললাম। তুমি বস বাবা, ওর কাছে। ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখলে অনেক খুশি হবে। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে খাওয়া দাওয়া ঠিক মত না করতে করতে আজ ওর এই দশা। এখন তুমি ফিরে এসেছ, ও আবার সুস্থ হয়ে উঠবে।” বলেই আমার দিকে এগিয়ে এসে হাতটা ধরে বললেন, “বাবা, তোমার দোহাই লাগে তুমি ওকে ছেড়ে যেওনা। আমার এই একটি মাত্র সম্বল। বাপ মরা মেয়ে। দয়া কর এই বয়স্কা মহিলার উপর। তুমি না থাকলে ও এভাবেই কাঁদতে কাঁদতে মরে যাবে।” কথাগুলো শেষ করার আগেই ডুকরে কেদে উঠলেন। আমি তাকে ধরে বললাম, “আপনি কাদবেন না। আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি ওর পাশেই আছি। ও সুস্থ হয়ে উঠবে।”  বলে দুজন ওর পাহসে বস্তেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। আমাকে দেখেই কিছু বলতে চাইলো, আমি আমার আঙুল ওর ঠোঁটের উপর রেখে না করাতেই চুপ হয়ে গেল। কিন্তু ওর চোখে মুখে খুশির এক ঝলক ফুটে উঠলো।

সাতদিন পর ওকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। মাঝের দিনগুলি ছিলো অন্যরকম। সারাদিন সারারাত ওর পাশে থাকা। সকালের দিকে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার ছুটে যাওয়া। সারাদিন গল্প বলা, ওর মুখে গান শোনা। খুবই মিহি স্বরে, আলতো করে, কানে কানে। আবার ওকে আবৃত্তি করে শোনানো। আমি পড়া শেষ করলেই বলত, “তুমি আবৃত্তি করেলেই তো পারো।” আমি হেসে বলতাম, “জ্বি না। এই কবিতায় হক কেবল তোমার আর কারো নয়।” কখনো নিজে লিখে শোনাতাম, ও হাসত বলত, “তুমি আসলে চুপারুস্তম।” মানে জানতে চাইলে বলত, “যে অনেক প্রতিভাবান, কিন্তু কাউকে সেই প্রতিভার কথা জানতে দেয় না” একদিন পড়ে শুনালাম-

হে দেবী,

একবার শুধুই একবার

এসে নিরালায় ছুঁয়ে যাও আমায়,

তোমার মৃদু কোমল তনু ছোঁয়ায়।

আমি যবন,

ব্যতিব্যস্ত তোমার পূজার্চনায়

একাকী যজ্ঞে মত্ত এই দূর নিরালায়।

শুধু একবার, ছুঁয়ে যাও, না হয় সত্যি করে নয়।

তবুও একবার শুধু মিছে ভালোবাসায়

তোমার ঐ বাহু ডোরে বেধে নাও আমায়।

হে মম দেবী, সার্থক হবে জন্ম তব আমার

সার্থক হবে এই অর্চনা তোমায় ভালোবাসার।

কবিতা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল অনেকক্ষণ। ওর চুলের গন্ধে আমি তখন আত্মহারা। এমনই দিন কেটেছে। তারপর একদিন সে প্রশ্ন করল, “ভালো তো বাসতেই তবুও এতো কাঁদালে কেন?” আমি জানি না কি দিবো এর উত্তর, শুধু তাকে বুকের মাঝে বেধে রেখে বলেছিলাম, “অন্তর্নিহিতা আজীবন এই হৃদয়ের মাঝেই অন্তর্নিহিত রয়ে যাবে এটাই তো সত্যি। কিন্তু কি করে যে এই হৃদয় মন্দিরের দেবী, আমার অন্তরের অন্তর্নিহিতা আমার হবে তা যদি তখন জানা থাকতো তাহলে কি আর তাকে অন্তর মাঝেই বেধে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম?” সে মুচকি হেসে বেধে রেখেছিলো আপন ডোরে, আর বলেছিলো, “কি যে বলো ছাতামাথা কিছুই বুঝিনা। এতো কঠিন করে কথা বলবে না, বললে আমাকে ভেঙে ভেঙে বুঝিয়ে দিতে হবে। আমি খুব কম বুঝি।” কিছুই বলতে হয়নি হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের যে বন্ধন তৈরী হয়েছিল তাই সব বুঝিয়ে দিয়েছে। আর কয়েকদিন পর আমাদের বিয়ে। আমার অন্তর্নিহিতা আমার অবচেতন মনের বাঁধা পেরিয়ে চেতন মনের রাজপ্রাসাদে আগমণ করছেন। দোয়া করবেন তার আর আমার জন্য।

৮২০ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।