– এই ছেলে এই……………………।
কিছুটা অবাক রাত ২টা বাজে এমন সময় এইভাবে কোন মেয়েলী স্বরের ডাক নিশ্চয়ই কেউ আশা করবে না। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম হলুদ কামিজ আর সবুজ সালোয়ার পরিহিতা আমাকে তার কাছে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করছেন না ঠিক আদেশ দিচ্ছেন। কিছুটা ভয় পাওয়া স্বাভাবিক একে রাত তার উপর কমলাপুর রেলস্টেশন আশে পাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। তবে যে ধারণাটা মনে আসছিল তা সত্যি হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তার পোশাক আশাকে আর যাই হোক সে রকম কিছু মনে হবেনা । তো এগিয়ে গেলাম
– জী আমাকে বলছেন?
সে একটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝামটি দিয়ে বলল
– আর কেউ কি আছে এই প্লাটফর্মে, আমি তো কাউকে দেখছিনা আপনি দেখেছেন কি?
আজিব মেয়ে তো একে ডেকেছে হুকুম করে আবার ঝাড়ি মেরে কথা, কিছুটা অবাক হলেও ধৈর্য্য ধরে বললাম – জী বলুন কি সাহায্য করতে পারি?
– হুম!!! আমাকে এই ঠিকানায়ে একটু পৌঁছে দিতে হবে? আমি ঢাকা ঠিক মত চিনিনা এর আগে একা একা ঢাকা আসিনি।
ব্যস এইবার একটু শোধ নিতে হয়, – ওহ! তা আপনি বুঝলেন কি করে আমি সাহায্যকারী, খারাপ কেউ না? আমি তো আপনার ক্ষতিও করতে পারি তাইনা?
– হুহ! আইসেন একবারে হিল দিয়ে পিটাইয়া পিঠের চামড়া উঠায় দিবনা কিছু করতে আসলে।
অবাকের উপর অবাক যাকে বোধ হয় বলে হতবাক। হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি বলে কি এই মেয়ে, তার কথা শুনে হেসে ফেললাম, বললাম – হুম, মোহাম্মদপুর। কিন্তু এখন তো কোন বাস পাবেন না, রাত ২টা পেরিয়ে গেছে অপেক্ষা করুন ওয়েটিং রুমে কাল সকালে বাসে উঠায় দিবো চলে যাবেন।
সে গোঁ ধরে বসল, নাহ তার এখনি যেতে হবে যে করেই হোক, নিজের কপালকে নিজে দুষলাম আচ্ছা মুছিবতে পড়া গেলো তো রে বাবা। তো তাকে নিয়ে বাইরে বেরুলাম, কিন্তু চারিদিক ফাঁকা কিচ্ছু নেই কোথাও অবশেষে একটা সিএনজি পেলেও সে মোহাম্মদপুর যাবেনা। অগত্যা ১ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এইবার ভদ্র মেয়ের মত এসে বসে পড়লো। আমি বসে ফেইসবুকে গুঁতোগুঁতি করছি হটাৎ দেখি সে ঢুলছে, জিজ্ঞাসা করলাম – ঘুম পাচ্ছে? পেলে ঘুমিয়ে পড়তে বললাম। কিন্তু সে নারাজ সে ঘুমাবেনা, যাই হোক তো তাকে বললাম, চা খাবেন? খেলে নিয়ে আসি, একটু বসেন এইবার সে রাজি হলো।
দু’কাপ চা এনে দেখি সে তার কাঁধের ব্যাগটার উপর মাথা রেখে কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ওয়েটিং রুমের মৃদু আলো আর বাইরের প্লাটফর্মে জ্বলা টিউব লাইটগুলোর আবছা আগমন ঘরটাতে তার মুখের উপর পড়ছে, হালকা শ্যামলা রঙ, টানা টানা চোখ, দেখতে একবারে মন্দ না। চুলগুলো তার মুখের উপর ছড়িয়ে আছে, আর নিশ্বাসের সাথে একটু একটু করে নড়ছে। সেপ্টেম্বর মাস। শেষ রাতের দিকে শীতের প্রকোপ কিছুটা বোঝা যায়। একবার ভাবলাম ডেকে তুলে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দেই। কিন্তু কাছে যেতেই ঘুমের ঘোরে সে বিড় বিড় করে বলা শুরু করলো – “শান্ত তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, প্লিজ আমাকে এভাবে কষ্ট দিওনা। আমি থাকতে পারবোনা। প্লিজ, শান্ত।”
আমাকে দেয়া ঠিকানার কাগজটা দেখলাম, সাব্বির হোসাইন শান্ত, বাসা নং ৪৬/৩, ২ নং কাজী নজরুল ইসলাম রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। বুঝলাম ঘর ছাড়া পাখি নতুন নীড়ের আশায় উড়াল দিয়েছে, যদিও জানেনা সে পাখি কি তার গন্তব্য কি হবে তার মঞ্জিল?
হটাৎ চোখ পড়লো তার হাতের উপর সেপ্টম্বরের হালকা হিমেল বাতাসের দাপটে তার রোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। বুঝলাম শীতে কষ্ট পাচ্ছে, তাই ব্যাগ থেকে আমার বার্মিজ চাদরটা বের করে তার গায়ের উপর দিয়ে দিলাম। আরো একবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো মেয়েটা খুবই সুন্দর এমন মেয়েই আমি আমার নিজের জন্য খুঁজেছিলাম তবে ভাগ্য অন্যভাবেই তাকে আমার সামনে এনে ধরা দিলো। উঠে এলাম আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো তার প্রেমে পড়ে যেতাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে অবাক হলো আমার চাদর তার গায়ে দেখে, জিজ্ঞাসা করলো আমিই দিয়েছি কিনা? বললাম, – আশে পাশে আমি ছাড়া তো কেউ ছিলোনা, তাই মনে হয় আমিই দিয়েছি। সে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ দিলো। তারপর বললাম – চলুন তবে যাওয়া যাক। সকালের নাস্তা স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনের এক হোটেলে সেরে সিএনজি নিলাম সেই ঠিকানায়। জ্যাম আর লাগেজের মাঝে সিএনজিতে বসে থাকা সস্তা কথা না। যাই হোক বেলা ১১টার দিকে সেই বাসা খুঁজে পেয়ে তাকে যেতে বলে উল্টো পথে হাটা ধরলাম, কেন জানিনা ফিরে আসতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে, সবার জীবন সব স্বপ্ন পূরণ হয়না। রিকসা ঠিক করতে যেই না হাত কে যেন পিছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো। আমি পিছে ফিরে তাকাতেই দেখি সে তার চোখ দুটোতে অশ্রু জিজ্ঞাসা করলাম – কি ব্যাপার কি হলো? সে উত্তর দিলো, – এ বাসায় শান্ত নামে কেউ থাকেনা, আমাকে অভিযোগ করলো আমি নাকি তাকে ভুল ঠিকানায় এনেছি।
মহা ঝামেলারে তো বাবা, তার সাথে ফিরে গেলাম, গিয়ে বাড়িওয়ালাকে প্রশ্ন করলাম – “ভাই এটাই তো বাসা নং ৪৬/৩, ২নং কাজী নজরুল ইসলাম রোড, মোহাম্মদপুর। সে বলল – জী ভাই এটাই। তা এখানে শান্ত নামে কেউ একজন এই ঠিকানা দিয়েছেন, এই মেয়েটাকে সে অনেক দূর থেকে আসছে। আপনি কি কোন সাহায্য করতে পারবেন?” সে তো মহা খ্যাপা আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বের করে দিলেন বললেন, এইসব নিয়ে যেন আর তাকে বিরক্ত না করি।
উফ!! বিশাল ঝামেলায় পড়লাম, এদিকে আমাকে ২টার ভিতরে অফিসে যেতে হবে, ফিরে এসে তাকে বললাম – আপনার কাছে ফোন নং নেই, থাকলে ফোন করুন তিনি জানেন তো আপনি আজ আসছেন? সে বলল- সে জানে আর নং আছে কিন্তু ফোন নেই । নিজের ফোন দিয়ে বললাম, – ফোন করুন। সে ফোন করলো কিছুক্ষণ পর হতাশ মুখে ফিরে এসে বলল – ফোন বন্ধ। আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছেই অনবরত। কি করবো এদিকে ১২টা বেজে গেছে। তাকে বললাম – আসুন আমার সাথে। আপনাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসি। আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই ফিরে যান।
তখন সে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো আর বলল -“তার পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব না। সে তার বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে শুধুমাত্র তার ভালোবাসার জন্য। এখন বাড়ি ফিরে গেলে তার বাবা-মা তাকে বের করে দিবে আর তার ভাইরা তাকে মেরে ফেলবে। কারণ সে এক হিন্দু পরিবারের মেয়ে এই ছেলেটাকে ভালোবেসে সে ইসলাম গ্রহণ করছে আর এটা জানার পরই তার পরিবার তাকে ত্যাজ্য করেছে। তার এখন যাওয়ার কোন যায়গা নেই।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে শেষ করে আমাকে বলল – আমাকে একদিনের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? আমি কাল চলে যাবো আমার এক বন্ধু আছে তার কাছে।
তার কথা শুনে আমি কিছুটা হতবাক বললেও বোঝানো যাবেনা, আমি পুরো পুরি shocked। তার কাছে এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে ফোন করলাম অর্পাকে আমার পরিচিত কলেজের ছোট বোন ওর বাসাও মোহাম্মদপুরে। ওকে আসতে বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম, সংসদ ভবনের সামনে। লাগেজ নিয়ে সংসদের সামনে বসে আছি সবাই আড়চোখে দেখছে। কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। তো আধঘণ্টার ভিতর অর্পা এলে ওকে সব বুঝিয়ে বললাম, একদিন যেভাবে হোক ম্যানেজ করে নিতে। সেও কোন রকম রাজি হয়ে গেলো, কারণ সে ভেবেছে এই মেয়ে আমার কেউ, মানে আমার পছন্দের মানুষ। কোন রকম তাকে অর্পার হাতে তুলে দিয়ে আমি অফিসের দিকে পা বাড়ালাম।
সন্ধ্যার দিকে একবার ফোন করে খোঁজ নিলাম। কেন জানিনা তারপর সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। কাল সকালে অফিস আছে, তাকে পৌঁছেও দিতে হবে কেন জানিনা তাকে ছাড়তে মন চাইছিলো না। সারারাত ধরে একটা কথাই চিন্তা করলাম, তাকে আমার ভালোই লাগে, কি এমন ক্ষতি হবে সে যদি আমার জীবনে আসে। আমার আপন বলতেও কেউ নেই এক মামা ছিলেন কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন তিনিও এক বছর হলো গত হয়েছেন, একা মানুষ আমি, একটাই আমার জগৎ। কি এমন আসবে যাবে যদি তাকে এই রাজ্যের রানী করি। তারপরেই মনে হলো সম্ভব না সে ভাববে আমি তাকে করুণা করছি। এটা কি ঠিক হবে? এই সব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত কেটে ভোর হলো টেরই পেলাম না।
সকাল সকাল বের হলাম, আজিমপুর থেকে মোহাম্মদপুরে গিয়ে তাকে পিক আপ করে সিএনজি করে কমলাপুর পৌছুলাম ১০টার দিকে। কোথাকার টিকেট নিবে প্রশ্ন করতেই বলল – এক জায়গা হলেই হয়।
-মানে? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
-কিছুনা, আচ্ছা চট্টগ্রামের টিকেট করুন।
তার জন্যে টিকেট কেটে এনে দিলাম ট্রেন ১০.৩০ মিনিটে। আর তখন ১০.১৫ বাজে, বেঞ্চে বসে আছি পাশাপাশি একবার মনে হচ্ছে বলেই ফেলি, আবার মনে হচ্ছে ঠিক হবেনা, এই অবস্থায় যখন দুলছি তখনই সে উঠে পড়লো, বলল – “আসি, অনেক উপকার করছেন। আজকের দিনে এতো ভালো মানুষ পাওয়া যায়না। আমার ভাগ্য সব সময় খারাপ হলেও এই একটা ব্যাপারে ভালো ছিলো। আসি ভালো থাকবেন।”
আমি তাকে বললাম – আচ্ছা, ঠিক আছে যাচ্ছেন যান, তা ফোন নংটা রেখে দিন। যদি কোন সাহায্য লাগে আর ঢাকা এলে জানাবেন। আশা করি আপনার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। তা আপনার নাম কিন্তু বলেননি, যাবার আগে নামটা তো অন্তত বলে যান।
সে হেসে বলল – আমার নাম অরুণিমা, অরুণিমা সেন অরণী। নাহ, আর আপনাকে জ্বালাতে চাইনা, ভাগ্য একবারই আপনার কাছ থেকে যা নিতে বাধ্য করছে তাই কখনো শোধ করতে পারবোনা। তাই আর আপনার ঝামেলা হতে চাইনা। আসি, দোয়া করবেন।
কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ট্রেনে উঠে বসলো। আমিও উল্টো ঘুরে বাহিরের দিকে পা বাড়ালাম, হুইসেলের শব্দ কেন জানি মনে হচ্ছে ভুল করছি, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে? তারপর পিছে ফিরে দৌড়াতে লাগলাম, ছুটে গিয়ে উঠলাম ট্রেনে, তার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, দেখি সে কাঁদছে। শাহাদাত অঙ্গুলিতে তার চোখের জলটুকু মুছে দিতেই সে পাশ ফিরে চেয়ে অবাক হয়ে বলল – আপনি?
কিছু না বলে শুধু বললাম – মিসেস উপাধি নিতে আপত্তি আছে?
সে শুধুই অবাক দৃষ্টি মেলে চেয়েছিলো। পরের স্টেশনে নেমে পড়লাম দুজনে আজ থেকে এই পথচলা দুজনের । আমার হাতে তার হাত কোমল কায়া, আমার কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার জীবনে আজ নতুন দিনের সূচনা, নতুন পৃথিবী কেবল তার আর আমার।
ভালো লেগেছে। এগিয়ে যাও। শব্দ চয়ন আরেকটু ভেবে করো দারুণ হবে।
ব্জলে উঠুক বারুদ
ধন্যবাদ ভাইয়া ইন শাল্লাহ সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে ।
বারে বারে অবাক হই, আর দেখি ফিরে ফিরে
কতটা বদলে গেছি এই আমি প্রতিটি পদে পদে.....................