একলক্ষ বছর অপেক্ষার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কিনা?
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে
চলো খেয়ে আসি।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মত উড়ছে
-দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানি দেখি!
সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীণ শরীরে
আমারা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি
জলস্রোত ক্রমশ তীব্র…………………কনকনে।
(এখন ওসব কথা থাক- মণীন্দ্র গুপ্ত)
কবিতাটা পড়ে ঠাস করে বইটা বন্ধ করলো আরেফিন।
শিলা পিঠে গুঁতো দিয়ে বলল – “কিরে , কি হলো? পড় শুনি”।
আরেফিন বলল – “নাহ! মুডটাই খারাপ হয়ে গেল”।
শিলা – “কেন? কি হইলো আবার? হুদাই ঢং করিস না তো। জানিস তো তোর কবিতা না শুনলে রাতে ঘুম পড়া কিচ্ছু হবেনা, এখন পড় শুনবো ”।
সংসদ ভবনের সিঁড়িতে বসে আরেফিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল – “তুই শুনবি? আমার লেখা কবিতা?”
শিলা হেসে বলল – “তুই আবার কবিতা লেখিস নাকি?? আগে তো বলিস নি কখনো?’’
আরেফিন – ‘‘নাহ! লেখিনা, তবে যে কবিতাটা পড়লাম ওটাকেই একটু modify করে পড়বো । শুনবি?’’
হাসতে হাসতেই বলল, ‘‘পড় শুনি।’’
আরেফিন-
“একলক্ষ শতাব্দী সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুই আমার কিনা, শিলা?
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চল, মিরপুরের ক্যাফেতে, নতুন কি এক টাইপের কফি এসেছে
চল খেয়ে আসি।
হালকা বাদামী চুল,
করুণ বিকেলের গোধূলিতে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে
-দেখি দেখি তোর তামাটে মুখখানি দেখি!
সন্ধ্যে হলো, এখনি সূর্য পাটে নামবে, ধীর পায়ে উঠে
তোর সাথে সামনের ব্যস্ত ঢাকার যানজটে এগিয়ে চলেছি
যানজট ধীরে ধীরে যেন ক্রমশ…………………..অসহ্য।”
পড়া শেষেই শিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আরেফিন। শিলা বিব্রত বোধ করছে, সে জানে আরেফিন এখন কি বলবে? কেন সে মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাটি আজ ইচ্ছে করেই change করে এনেছে। আচ্ছা আজকের তারিখ কত, ২৬ অক্টোবর,২০১৩।
হুম! বুঝতে পারছে এখনি ঐ প্রসঙ্গটা আবার তুলবে আরেফিন। কিন্তু কি জবাব দেবে শিলা? শিলার এই হারিয়ে যাওয়া মুখ দেখে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে আরেফিন বলল – “কিরে জবাব দে?”
শিলা- “দেখ ভালো লাগছে না, আর কি? কিসের জবাব? কবিতা? ভালো হয়েছে কিন্তু আসলটাই বেশী সুন্দর ”।
– “আমি তো এই জবাব চাইনি। আমি যা বলছি তা তুই ঠিকই বুঝতে পারছিস। তবে কেন কথা ঘুরাচ্ছিস? আজ কতদিন হলো খেয়াল আছে তোর?”
– “হ্যাঁ আছে। ছয় বছর ঠিক ঠিক রাত ৯টা ০৫ মিনিটে পূর্ণ হবে। আর কিছু বলতে চাস?”
– “তোর কি এখনো মনে কোন সন্দেহ আছে তোকে আদৌ ভালোবাসি কিনা?”
– “দেখ আমার পড়া শেষ হোক তারপর তোকে উত্তর দিব, জবাব দিব কৈফিয়ৎ যা চাস সব দিব But please leave the topic for now… এখন আর কিচ্ছু বলবি না, please! ”
তারপরও কিছু বলতে চাইছিলো আরেফিন, শিলা থামিয়ে বলে – “ওঠ দেরি হয়ে যাবে, পরে তোর কবিতার মতোই অসহ্য যানজটে আটকা পরতে হবে ”। বলেই হাটা ধরে, কিন্তু আরেফিন ঠায় বসে থাকে, চুপচাপ, কিছুদূর এগিয়ে আবার ফিরে এলো শিলা, আরেফিনের হাত ধরে বলল – “আচ্ছা আমি তো আর মরে যাচ্ছিনা নাকি? এখন চল তো”।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরেফিন বলল – “ফালতু কথা বলবি না, তোর যেতে হয় যা আমি এখানেই বসে থাকবো, তোর যদি আমাকে বা আমার কথা ভালো না লাগে উঠে চলে যা, তোকে বেধে তো আর রাখিনি”।
– “ওলে, আমাল বাবুটা লাগ করেছো? রাগ করেনা সোনা। আচ্ছা বল কি বলবি? আর তোর কথা ভুল তোর কথা আর তুই দু’টাই আমার সবচেয়ে favorite। তাই তো দুনিয়ায় এতো আবাল আতেল থাকতে তোর সাথে ঘুরি। তুই আমার শ্রেষ্ঠ আবাল, আবাল The Great.”
– “তোকে ঘুরতে বলছে কে? আর ন্যাকামি করিস না মেজাজ গরম হয়। যাচ্ছিলি যা। বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় আরেফিন। শিলা ওর পাশে ব্যাগটা ধপাস করে ফেলে বসে পরে, ওর কনুইটা ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল – আচ্ছা তুই কেন সব সময় এমন করিস? আমি তো আর কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিনা। এখনো গোটা জীবনটাই পরে আছে। আমাকে পড়াটা শেষ করতে দে। নিজের একটা পরিচয় বানাই, তখন বাসায় তোর কথা বলব। আর তোর চিন্তা কি আগে তো বড় আপু আছে নাকি? তারপর আমি । বলেই আরেফিনের মুখের দিকে তাকালো support এর আশায়, কিন্তু আরেফিন কথা না বলে, সংসদ ভবনের সামনে পড়ে থাকা ঘাসের মাদুরে চিকমিক করা গোধূলির আলোখেলার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। এই দেখে শিলা ধাক্কা দিয়ে বলল – কিরে কথা বলছিস না ক্যান? যা মন চায় বল, বকা দিতে চাইলে বকা দে। কিন্তু আজ আর বলবো না যে মন চাইলে থাপ্পড় মার, সেদিনের মতো যদি মেরে দিস, তোর হাত যা শক্ত। কিরে কি হলো? দেখ ছেলেদের এতো রাগ থাকা ভালোনা। বলেই ওর মুখটা নিজ হাতে ঘুরিয়ে নিজের দিকে করলো শিলা। মুখটা ঘুরতেই চোখে পড়লো শিলার মায়াবী কালো চোখ দু’টি, আর ওর তামাটে বর্ণের মুখের ওপর, যেখানে এখন গোধূলির আলো পড়ে আরো আরো অনেক অনেক বেশী সুন্দর করে তুলেছে ঐ মুখটা। এতো সুন্দর একটা মেয়ে , তার মতো আবাল, আতেল মার্কা একটা ছেলের কাঁধে মাথা রেখে আছে, কেমন বেমানান লাগছে দেখতে? সবাই কি ভাববে, এতো সুন্দর একটা মেয়ের boyfriend এই রকম আতেল মার্কা। ধুর! কে কি ভাবলো তাতে তার কি? আর তাছাড়া ওরা তো boyfriend আর girlfriend না। শিলার ভাষ্যমতে ওরা just friend, শুধুই ভালো বন্ধু। সে যাক গে, শিলার মুখের দিকে তাকালে সব রাগ বরফের মতো পানি হয়ে গলে যায়। এখনো তাই হলো, শিলা ওর কাঁধে পরম নির্ভরতায় মাথা রেখে বসে আছে, যেন এই পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কেউ নেই তার। একটা ছোট্ট শিশু যেমন নতুন জায়গায় গেলে তার সাথে থাকা মানুষটিকে জাপটে ধরে রাখে, তেমনি করে তাকেও ধরে রেখেছে শিলা। আলতো করে শিলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল – চল, দেরী হয়ে যাচ্ছে। তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। রাত হয়ে গেছে একা একা যাওয়া ঠিক হবে না। চল। বলেই ওর হাতটা ধরে উঠে এলো। শিলাকে বাসায় নামিয়ে দিতে গিয়ে দরজায় বৃষ্টি আপুর সাথে দেখা হলে, সেখানে কিছুক্ষণ কথা বলে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে চলে এলো আরেফিন। বাসায় কেউ নেই। মা বাবা পাবনা গেছে। এতো বড় বাসায় এখন কি করবে একা একা? ল্যাপটপ নিয়ে ফেইসবুকে লগইন করলো কিন্তু বেশীক্ষণ থাকতে পারলো না, আসলে ভালো লাগছে না। অবশেষে ২মাস আগে কিনা বেনসনের প্যাকেটটা বের করে ড্রয়ার খুলে সাথে লাইটারটা, তারপর একটার পর একটা চলতে থাকে। অনেকদিন পর আবার সিগারেট ধরালো, শিলা না করার পর আজ এই প্রথম। অনেকদিন হয়ে যাওয়ায় মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। ভালো লাগছিলো না কিছুই, একটা প্রশ্ন মনের ভিতরটা ভেঙ্গে চুড়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। কেন? কেন এই মেয়েটা এমন করে? ছয়টা বছর ধরে মেয়েটাকে ভালোবেসে আসছে সে। প্রথম দেখা কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। গলাটা অসম্ভব সুন্দর ওর, এখনো আছে। শিফট সাবজেক্ট সব আলাদা তাই তারপর আর ওর সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই কথা নেই এমনকি দেখাও নেই। আসলে কিছুটা আরেফিনের খামখেয়ালীর কারণেই। তারপরও কথায় আছে চোখের আড়াল তো মনের আড়াল, কিন্তু কেন জানিনা সব সমীকরণের গলায় দড়ি পরিয়ে দিব্যি নিজের অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে সে আরেফিনের মনে। সব তত্ত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। গোটা এক বছর পর আবার দেখা। সেই নবীন বরন অনুষ্ঠানে। ওর নিজের এক বোকামির জন্য কি কান্নাটাই করেছিলো শিলা। যদিও আরেফিন জানত না যে এভাবে কিছু একটা হয়ে যাবে। আরেফিন যে শিলাকে পছন্দ করে তা ওর সব বন্ধুরাই জানত, শুধু আরেফিন নিজেই কিছু বলত না, কারণ সে চেয়েছিল আগে নিজেকে ওর যোগ্য করে গড়ে তুলবে তারপর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে তো বন্ধুরা বালি ছিটিয়েই দিলো। শিলার গানের পর সবাই চিৎকার করে আরেফিনের নাম জানিয়ে দিলো, ব্যস আর কি এই মেয়েও সোজা গিয়ে হাউমাউ করে কান্না। ভাগ্যিস তখন আরেফিন সামনে পিছে ছিল না থাকলে নির্ঘাত একটা চপেটাঘাত হজম করতে হত শিলার হাতে। তারপর কত চেষ্টা শুধু একটিবার sorry বলবার জন্য। কিন্তু কোন পথই ছিলোনা। ইন্টার পড়ুয়া একটা মেয়ের কাছে ২০০৭ সালে কোন মোবাইল ছিলোনা, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তবুও এটাই ছিলো চরম সত্য। কত কষ্ট করে এক বান্ধবীকে দিয়ে বৃষ্টি আপুর নংটা জোগাড় করল। তারপর ওর বান্ধবী মৌকে দিয়ে ফোন দিয়ে ওর হয়ে sorry বলালো। আর তার কিছুদিন পর ঐ নংটাও অফ হয়ে গেলো…। হায়রে কপাল!!!! আর কি এভাবেই ইন্টার পাশ করে ভর্তি যুদ্ধ। এর মাঝে তার ফুটো কপালের বদৌলতে অথবা কোন এক অজানা ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবেই কিনা friendship day তে ওর নংয়ে একটা মিসকল এলো, নং না চিনলেও ভাবল কোন বন্ধু হয়তো নতুন নং নিছে। ছোটখাটো একটা কবিতা লিখে ঐ নংয়ে friendship day তে wish করল-
কিছু কিছু মুহূর্ত ফেলে আসা
কিছু হাসি, কিছু কান্না
কত শত না বলা কথা
কখনো কানে কানে, কখনোবা
হাসির দমকে ফাটিয়ে গলা।
কখনোবা কথা বিনা নিস্পলক
চোখের তারায় তাকিয়ে থাকা।
একি নয় ভালোবাসা?
বন্ধুর প্রতি হাত বাড়িয়ে
একি শুধুই মিছে প্রত্যাশা?
আরে নাহ! ধুর! এসবই
বন্ধুত্ব আর ভালোলাগা
একসাথে হেসে খেলে বাঁচা
Happy Friendship Day Dstwww….:)
পরদিন ঐ নং থেকে ফোন আসলো, দুঃখিত আপনি মেসেজ দিয়েছেন, কিন্তু আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। ভুলে কাল আপনার নংয়ে কল করে ফেলেছিলাম, সরি। আরেফিন সাধারণভাবেই কথা বলল , কথা বলে জানতে পারলো এটা বৃষ্টি আপুর নং। শিলার বড় বোন। ব্যস, আর কি লাগে, ২দিন পর ফোন দিয়ে আপুর সাথে খাতির তারপর শিলার সাথে বন্ধুত্ব। অনেক কষ্ট করেছে, কত গল্প লিখে ফেইসবুকে পোস্ট করেছে। শিলার সব বান্ধবীদের হাতে কত বকাই না খেয়েছে, এক সময় নিজেকে আধুনিক দেবদাসই মনে হচ্ছিলো। বন্ধুরা সবাই সান্ত্বনা দিত। কেমন যেন ছিলো দিনগুলো একটু এলোমেলো তবে অনেক সুন্দর। শিলাকে নিয়ে অনেক গল্প কবিতা লিখেছে সেগুলো এখনো ওকে দেয়া হয়নি। দিবে যেদিন শিলা ওকে হ্যাঁ বলবে, যেদিন বলবে, আরেফিন আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি, সেইদিন। কিন্তু আদৌ সেই দিন আসবে কিনা? সেইখানেই যত সংশয়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে শিলার নং। ফোন ধরেই বলল – Surprise. প্রতিবার তুই ফোন দিস আজ আমি দিলাম। কিছুটা অবাক হয় আরেফিন মানে কি? বিরক্তিটা যায়নি, সেটা নিয়েই বলে – মানে কি? বুঝতে পারলাম না। শিলার উৎসাহটা কমে গেল, গলাটা নামিয়ে বলল – ঘড়ি দেখ। বলেই ফোনটা রেখে দিলো। এদিকে ঘড়ির দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো আরেফিন, ডিজিটাল ঘড়ির ডিসপ্লেতে তখন বড় বড় লাল অক্ষরে লেখা
09:05:35 pm, 26th October, 2013
Oh! shit…….কি করে ভুলে গেলো? আহ! আর এই মেয়েটাই বা চায় কি? সে তার কথায় এক আর কাজে আরেক। কল ব্যাক করলো কিন্তু নং বন্ধ। তারপর ফোনটা রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো, ফ্রিজ খুলে রাতের খাবারটুকু ওভেনে গরম করে নিয়ে খাওয়ার পর্বটা সারলো। এরমাঝে ৩/৪ বার ফোন দিলো কিন্তু নং অফ তো অফ। কিচেনের ডিশগুলো ধুয়ে মুছে রাখলো যদিও সকালে বুয়া আসবে তাও এখন সময় কাটানোর জন্যে তো কিছু করা চাই। সবশেষে যখন একবারে ঝাড়া হাত-পা তখন বাজে ১০.৩০।
আবার ফোন দিলো এবার রিং হলেও ফোন ধরলো না। এভাবে ৪বার ফোন দেয়ার পরও যখন ধরলোনা ওর মেজাজটা গরম খুব খারাপ হতে লাগলো, ফোনটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরাতে না ধরাতেই ফোন এলো। ফোন ধরে কোন কথা না বলে চুপচাপ সিগারেটে টান দিতে থাকলো আরেফিন। ওদিকে শিলাও চুপ। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে শিলাই বলল – “ওই কথা বলছিস না কেন? চুপ করে থাকার জন্য ফোন দিছি, হাঁদারাম?”
– “কি বলবো? তুই ফোন দিছিস তুই বল”।
– “আমার ঠ্যাকা, বয়ে গেছে তোর সাথে কথা বলতে”।
– “তাহলে ফোন দিছিস কেন?”
– “বারে নিজে ৪টা মিসকল দিছিস……………..”.
– “মিসকল না কল। ওর কথার মাঝেই বলে উঠে”।
– “ঐ তো আব্বু ছিলো তাই ধরতে পারিনি, কি করবো বল?”
– “এখন আব্বু নাই? চলে গেল কেন? থাকলেই পারতো”।
– “ঐ তুই এভাবে কথা বলতাছিস কেন?”
– “কিভাবে কথা বলতেছি? ভালো না লাগলে কথা বলিস না। তোকে কি জোর করে কথা বলাচ্ছি”।
– “কি আজব। আচ্ছা বাবা sorry.. আর তোকে তো বললামই আমার একটু টাইম লাগবে। I need some more time.”
– “হুম!!”
– “হুম? হুম কি রে? আচ্ছা আমার একটু সমস্যা থাকতে পারেনা?”
– “হুম! সেটাই তো বললাম, তো সমস্যা থাকতেই পারে। Actually, থাকতে পারে কি always থাকে। বিগত ছয় বছর ধরে তোর তোকে বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি সহ স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, আরবি, চাইনিজ ও টার্কিশ এই দশটা ভাষায় দশ হাজারবার বলেছি , “1. আমি তোকে ভালোবাসি, 2. I love you, 3. Main Tujhse Pyar karata hoon (Hindi), 4. Te amo (Spanish) 5. Ti amo (Italian) 6. Je t’aime (French) 7. Ya Tebyo Lyublyu (Russian) 8. Ahabbaki (Arabic) 9. Wo ai ni (Chinese : Simplified) 10. Seni Seviyonum (Turkish) । আমার কোন সমস্যা হইনি, Absolutely এখনো হয়না, আর কখনো হবেওনা। টানা ছয় ছয়টা বছর তোর পিছে পাগলের মতো ঘুরছি। পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া সব ভুলে ছুটছি। যেন ২০০৫ সালের BTCL এর ডায়াল আপ ইন্টারনেট সংযোগ, শালার Loading……. Loading……. Loading……. Loading……. Loading…….। চলছে তো চলছেই তাও loading শেষ হয়না। তবুও ছুটছি, আমার কোন সমস্যা নেই, আমার কোন সমস্যা হয়না। অথচ তুই? তোর যত সমস্যা। ফোনে ঠিকমত কথা না বললে রাগ করিস। আমার মন খারাপ থাকলে তা ভালো করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিস। এমনভাবে রাগ ভাঙাস যা একজন স্ত্রীও তার স্বামীর জন্য করেনা। অন্য মেয়ের সাথে হেসে কথা বলতে দেখলে মন খারাপ করিস, যেন তুই আমার প্রেমিকা। এগুলো কি? এসব আমি কি ধরে নেবো? তুই just friend or more than a friend? তুই মুখে বলিস এক কথা, আর কাজে কর্মে আরেক। আমার গোটা লাইফ তোর জন্য ব্যয় করতেছি। Smoke করলে এমনভাবে শাসন করিস আমি নিজেই তোর কথা আর কাজের ফারাক দেখে দ্বিধায় পরে যাই। আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস কিন্তু কেন মুখে স্বীকার করিস না ? Please, শিলা সত্যি করে বল। সামনে এক সপ্তাহ পরে আমার মিশন, সোমালিয়ায়। আমি সেখানে যাওয়ার আগে তোর কাছ থেকে জানতে চাই। please, let me know. ঐখানের অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। আর এই মিশনে যদি আমার মৃত্যু হয় তাহলে যেন আমার আক্ষেপ না থাকে যে তুই আমাকে ভালোবাসিস এই কথাটা আমি জানিনা। আর না বাসলে অন্য ব্যাপার। অবশ্য মরলে তো তোরই ভালোই হয় আর কেউ কোনদিন সমস্যা করবেনা, তোরও কোন সমস্যা থাকবেনা। So, please pray for that.” কথাগুলো বলে এক অজানা উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে আরেফিন।
ওপাশে শিলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে – “আরেফিন, আমি বুঝতে পারছি তোর কেমন লাগতেছে। আর এও জানি তুই যেভাবে পাগলের মতো আমাকে ভালোবাসিস আর কেউ কোনদিন আমাকে সেভাবে ভালবাসতে পারবেনা। কিন্তু তুই আমার পরিবারের কথা ভালোমতোই জানিস আলাদা করে তোর কাছে নিশ্চয়ই কিছু আমাকে বলতে হবেনা। আমার বাবা কেমন মানুষ? তিনি কোনদিন মেনে নিবেন না যে তার মেয়ে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করবে। আর তারপরও আমি তোর সাথে আসতে পারি কিন্তু মা বাবার দোয়া ছাড়া কেউ সুখী হতে পারে বল? আর ভালোবাসার কথা বলছিস? তারা যে ২১টা বছর ধরে ভালোবেসে আমাকে বড় করেছে। তুই নিজেই তাদের সামনে তোকে তুলনা কর উত্তর পেয়ে যাবি। তাই আমি পারবোনা তাদের কষ্ট দিতে। তাছাড়াও বৃষ্টি আপুর বিয়ে হবে তারপর না আমার প্রশ্ন। আগ বাড়িয়ে নিজের কথা কি করে বলব? তাই তো বলছি একটু সময় দে। আর আমি কেন তোর সাথে নিজেকে জড়াচ্ছি না? কারণ নিয়তির কথা কেউ বলতে পারেনা রে। আজ আমরা একসাথে আছি, কাল যে নিয়তি তোকে বা আমাকে অন্য কোথাও অন্য কারো সাথে জুড়বেনা তারই বা নিশ্চয়তা কই? তাই যদি নিয়তি আলাদা পথেই নিয়ে যায় তাহলে তা দুজনের জন্যই খারাপ হবে। So, please try to understand। আর ব্যবহারের কথা বলছিস, তুই যে খুব Special একজন সেটা তো তোকে বলে দিতে হবেনা নিশ্চয়ই? আর তোর কিচ্ছু হবেনা, ভালোমতো মিশনটা শেষ করে আয়, তারপর আমিই একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। চিন্তা করিস না এর মাঝে আপুরও একটা গতি হয়ে যাবে তারপরই তো আমি নাকি। ওকে, মন খারাপ করিস না”।
কি বলবে? কিছু বলার সুযোগই তো রাখেনি। ফোন ধরে নিজেকে শান্ত করে বলল – “ঠিক আছে কিন্তু মিশন শেষে আসার পরই বাবাকে তোদের বাসায় পাঠাবো? তখন না করতে পারবিনা। এর আগের বার না করছিস?”
– “ ওকে, বাবা পাঠাইস, যা খুশি। আগে মিশনতো শেষ করে আয়। এর মাঝে কি হয় বলা যায় ? জীবন মরণের কি কিছু ঠিক আছে নাকি?”
– “মানে? কি বলতাছিস? হইছেটা কি?”
– “ আরে কি হবে? তুই বললি নাহ তাই বললাম।”
ব্যস এভাবেই কথা চলছে তো চলছেই। রাত ৩টা বাজলে আরেফিন বলল – “ ঐ যাহ ঘুমা কাল আবার তোর ভার্সিটিতে ক্লাস আছে না?”
– “ হুম! আছে। ঘুমাবো আগে একটা কবিতা শুনা, তোর কবিতা শুনলেই ঘুমাই পড়বো।”
– “তা হবার নয়, আগে আমার গান কই? গত তিনদিন হইলো তুই আমারে গান শুনাস না। আজ আগে গান তারপর কবিতা”।
– “ আগে কবিতা। গান শুনলে নিজে নাক ডাকা শুরু করে, তাই আগে কবিতা”।
– “ ঐ নাক আবার কবে ডাকলাম,হ্যাঁ? আমার নাক ডাকেনা। হুহ!!”
– “আরে শেষ যেদিন গান গাইছি ঐদিনই তুই নাক ডাকছিস আর আমার কবিতাটা মাইরা দিছিস। তাই আজকে আগে কবিতা তারপর গান”।
– “ আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমার গান যদি আজ না শুনতে পাই তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে” তাইলে কাল থেকে কবিতা বন্ধ, আর কোন কবিতা হবেনা”।
– “ আয় হায় কয় কি? তাহলে তো না ঘুমাইয়া মইরা যামু”।
– “ যা গা তাতে আমার কি?”
– “ তাই না?????”
– “অয়ে অফ যা, কবিতা শোন……
– “বল”
– “অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই এই গাঢ় রাত্রে চুপিচুপি শুয়ে
বলি শোন
সৌরতারা ছাওয়া বিছানায়
সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন
আলাদা নিঃশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়াছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দুজনে-দুজনা-
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না
দেখি তুমি নেই।
(রাত্রি – অমিয় চক্রবর্তী)
আরেফিন বলল – “শিলা, ঐ শিলা???” ওপাশের সাড়া না পেয়ে আরেফিন আবারো বলল – “ কাল কপালে দুঃখ আছে তোর ।”তারপরও কোন শব্দ না পেয়ে – “ধুর!!” বলে ফোনটা কেটে দিলো।
ওদিকে শিলা? শিলা আলতো করে চোখের জল মুছলো। যখন টের পেল আরেফিন ফোন কেটে দিয়েছে, তখন সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে ফোঁপানোর বেগটা বাড়তে থাকে। কারণ শিলা জানে সে নিজেও কতটা ভালোবাসে তাকে। কষ্ট তো ওর নিজেরও হয়, ভালোবাসার মানুষটিকে বারবার রিক্ত হাতে ফিরিয়ে দিতে, অথচ ঐ হাতটিই তো আজীবনের জন্য ধরতে চেয়েছিলো। কিন্তু কি করবে সে? কি করার আছে তার? সে যে নিয়তির কাছে অসহায়। সে কি করে ভুলে যাবে সে একটা পচনধরা মাংসপিণ্ড বৈ আর কিছুই না। তার পুরো শরীরটা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, পচে যাচ্ছে। সে যে বিষাক্ত । সময়ের অবগাহনে তার এই বিষাক্ততা শুধুই বাড়বে। তার শরীর মাংসগুলো পচে গলে খসে যাবে। তার বা তার ভালোবাসার সাধ্য নেই এই পচনরোধ করবে। কারো অতটুকু সামর্থ্য নেই। আর তাই যদি তাকে পচে যেতেই হয়, যদি তাকে গলে মিশে যেতে হয় ঢাকার এই দূষিত বিষাক্ত বাতাসের কণাগুলোর সাথে, তবে তার কি অধিকার আছে আরেফিনের জীবনটায় এই বিষ ঢেলে বিষাক্ত করার, কি অধিকার আছে ওর জীবনটাকে নষ্ট করার। কেন সে তার বাস্তবতা ওর কাছে তুলে ধরে তার করুণার পাত্র হয়ে থাকবে? সে জানে তার কথা জানলে, ও আরো পাগল হয়ে যাবে। আরো বেশী ভালোবাসবে তাকে, কিন্তু সেই ভালোবাসাটুকুর ঋণ শোধ করার সামর্থ্যটাই যে সৃষ্টিকর্তা তাকে দেননি। কেন তার সাথেই এমন হলো? কথাগুলো ভাবতে থাকে আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শিলা। মাথায় হাতের ছোঁয়া পেতেই উঠে বসে। দেখে বৃষ্টি আপু বসে আছে। কখন এলো টেরই পায়নি। আপুকে দেখে আর চুপ করে থাকতে পারেনা, জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে শিলা আর কান্না জড়ানো গলায় কি বলল তার কিছুই বৃষ্টি বুঝলোনা। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো শিলাকে। কারণ সে জানে তার এই বোনটা বড় অসহায়, বড্ড দুখী। কোনরকমে চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে বলল – “ কি হয়েছে রে বোকারাম কাঁদছিস কেন?” কান্না ভেজা কণ্ঠে শিলা সব কথা বললে, বৃষ্টি বলল – “ দেখ শিলা আমার মনে হয়, ওকে তোর সব খুলে বলা উচিত। আর কেনইবা বলবি না, জীবন তো ছোট; সে তোকে যতটুকু ভালোবেসেছে কিছুতো ওকে ভালোবাসবি? আর সব জেনে যদি ও তোর সাথেই থাকে সেটাই তো মনে হয় তোর জন্য সবচেয়ে ভালো হবে”।
শিলা বলল – “নাহ, আপু আমি পারবোনা। ও এই কথা জানার পর কতোটা কষ্ট পাবে তুমি জানোনা, সেই কষ্টটুকু আমি দেখতে পারবোনা”।
– “ আচ্ছা ঠিক আছে। না বললে নাই। এখন ঘুমা, ভোর ৪টা বাজে, কাল আবার ক্লাস আছে না? তাই এখন ঘুমা”।
বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া শুরু করলো আর একটা হাত শিলা দু’হাতে জড়িয়ে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে, যেখানে স্বপ্নে তাকে কবিতা শোনাচ্ছে আরেফিন –
“ অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি,……………….”
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর গতরাতের স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো শিলার, ভাবলো, অতন্দ্রিলা মানে কি?? জিজ্ঞাসা করতে হবে আরেফিনকে। ঘুমটা ভালোই হচ্ছিলো তাই উঠতে মন সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু না উঠেও উপায় নেই ক্লাসে যেতে হবে। একবার ভাবল ধুর! যাবেনা, এর চেয়ে ওয়ার্কশপের সামনে বা নৌ জা মহসিনের অফিসে আছে ওর জানপাখিটা, ওখানে গিয়ে তাকে চমকে দেয়া যায়। কোথায় যাবে তা নিয়ে কিছুটা দোমনা করার পর ঠিক করলো ক্লাসটা করে তারপর ওর অফিসে গিয়ে Surprise দিবে। এদিকে সকাল বেলা বৃষ্টি ফোন করে আরেফিনকে, বলে – “ তোর সাথে কথা আছে? আজ দেখা করতে হবে?
– “ ঠিক আছে কখন, কোথায় বলেন বান্দা আপনার খেদমতে হাজির থাকবে…।”
– “ দেখ ফাজলামি করবিনা, Serious ব্যাপার”।
– “ ওকে, করবনা, কিন্তু কোথায় আসবো, কখন আসবো সেটা তো বলবেন, নাকি?”
– “ এখন পারবি?”
– “ একটু দাঁড়ান আমি Appointment গুলো Check করে বলছি। হুম………………… পারবো, কোথায় বলেন আসতেছি”।
– “ ফুডকোর্ট, বসুন্ধরা।
– ওকে, কিন্তু সমস্যা আমি কিন্তু ইউনিফর্মে আছি।
– তাতে আমার কি? আমি কি তোর সাথে ডেটিং মারতে যাচ্ছি নাকি?
– নাহ, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, মানে C.C.C. তা হবে কেন? আপনি আমার হবু বউয়ের বড় বোন আপনার সাথে কি করে ডেটিং মারি, ছোট হলে অবশ্য ভেবে দেখতাম…|সে যাক আপনার আবার নেভির পোষাকে অ্যালার্জি ছিল কিনা তাই বললাম।
– আরে ধুর বাকওয়াস বান্ধ; সোজা চলে আয়, আমার পৌছাতে ২০ মিনিট মতো লাগবে।
– ওকে আপু আমি আসতেছি।
হাতের কাজটা শেষ করেই বসুন্ধরা সিটির পথে পা বাড়ালো। অফিসের গাড়ি নিয়েই বের হয়েছে। বাইক নিতে মন চাইলো না। মাঝ রাস্তায় পৌঁছানোর পর ফোন এলো – কই তুই?
– আরে জ্যাম আসতেছি, আর মিনিট ১০ লাগবে, তুমি অর্ডার দাও, সকালে কিছুই খাইনি, খুব খিদা লাগছে। bye. আরো মিনিট পনেরো পর পৌঁছে গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিলো। সোজা উপরতলায় উঠে ফোন দিলো – কই তুমি?
– পান মশলার সামনে আয়।
ওদিকে হাটা ধরলো। বৃষ্টিকে সামনে দেখতেই স্যালুট করে বলল – “ অফিসার হাজির ম্যাম”
– ফাজলামি করতে নিষেধ করেছি। চোখ রাঙায় বৃষ্টি।
– ওকে সরি, বলো কি বলবে?
– চল ওদিকটায় , বস আগে খা, তারপর বলছি।
– খাওয়ানোর জন্য আনছ? কাহিনী কি মাহিন ভাই কি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইছে নাকি বাসায়? তাড়াতাড়ি তোমরা কাজটা শেষ করলে আমারটাও হয়ে যায়। হুদাই ঝুলায় রাখছো।
– বেশী কথা বলবিনা, চুপচাপ খা, সকালে নাকি খাসনি। খা তারপর কথা বলতেছি।
– ওকে। বলেই খাওয়াটা সেরে নেয়। তারপর বলে – এখন বল কি বলবা?
বৃষ্টি আমতা আমতা করতে করতে বলে – একটা কথা লুকাবিনা, আমার কাছে তুই কি সত্যি সত্যি শিলাকে ভালোবাসিস?
হেসে বলে – তাইলে কি হুদাই ছয় বছর ধরে ঘুরতেছি? But my bad luck.
– ধুর! সেটা তো বলিনি। ধর যদি এমন হয়, মানে আল্লাহ্ না করুন, শিলার যদি কোন রোগ থাকে। যেটা কখনো ভালো হবার নয় এবং যদি এমন হয় সে আর বেশীদিন বাঁচবে না। তাহলে? তাহলে তুই কি করবি??
মুখের হাসিটা উবে যায় কর্পূরের মতো। ওর মুখ দেখে বৃষ্টি আবার বলে – ধর, it’s just suppose..Okay?? Serious হওয়ার কিছুই নাই। আমার বোনটাকে তুই কতটা ভালোবাসিস তা যাচাই করতে হবেনা, যাচাই না করেই কি তোর হাতে বোনকে তুলে দেবো নাকি?? বুঝতে পারে কিছু একটা ঝামেলা আছে। তারপরও বৃষ্টির চোখে চোখ রেখে বলে – দেখো আপু, আমি শিলাকে ভালোবাসি , সে কেমন কোথা থেকে এসেছে, আর কয়দিন ছিল বা থাকবে, I just don’t care anything. যদি এমন হয় যেটা তুমি বললে, তাহলে ওকে যে কয়দিন পাবো আরো বেশী ভালোবাসবো, এতো বেশী যে যেন ওর কাছে শুনতে পাই “ তুই আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ করে তুলেছিস।” এতো বেশী যেন কখনো আমাকে আক্ষেপ করতে না হয় ইশ! আর একটু যদি ওকে ভালবাসতে পারতাম, আর একটু করলেই হয়তো ওর মুখে আরো একটু হাসি ফুটতো। জানি ওকে যত ভালোবাসবো আরো বেশী ভালবাসতে মন চাইবে। তবুও এতোটা ভালোবাসার চেষ্টা করবো যেন ওর শেষ সময়টাতেও ওর চোখে মুখে হাসির ঝলক দেখতে পাই। আর এজন্য যা করতে হয় আমি করবো। এখন তুমি আমাকে সত্যি করে বলতো হয়েছেটা কি??
– না। কি হবে কিছুনা..এমনি বললাম। আমতা আমতা করে বৃষ্টি বলে – হ্যাঁ ঠিক আছে সব ঠিক আছে। চিন্তা করিস না।
– উহু! কিছু একটা ঠিক নেই। কি হয়েছে ওর বল আপু? আর কয়দিন বাঁচবে ও?? জেরা করে, গলা দিয়ে অনেক কষ্টে শব্দটা বের করে আরেফিন ।
আস্তে করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে বৃষ্টির চোখ থেকে, বলে – আরেফিন, শোন, শিলা ব্রেইন ক্যান্সারের রোগী। রোগটা অনেকদিন হল ধরা পড়েছে। আর ওর ব্রেইনের এমন একটা অংশে সমস্যা হয়েছে যেটা ঠিক করা যাবেনা। আর ওর হাতে সময় আছে আর মাত্র ৩ কি ৪ মাস। ওর মাইগ্রেনের সমস্যা ছিল সেটাতো তুই জানিস। প্রথম প্রথম মাথা ব্যথা করত ভেবেছিলো পুরাতন সমস্যা পরে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যায়, তারপর হাসপাতালে নিলে ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পরে। আর ও তোকে অনেক ভালোবাসেরে, just ও চায়না তুই সারাজীবন একা একা কষ্ট পাস, তাই কখনোই স্বীকার করেনা। বাবার দোহাই, পড়াশুনার কথা সবই শুধু তোকে ওর থেকে সরিয়ে রাখার জন্য, ওর যা সময় আছে তুই মিশন শেষে দেশে ফিরলে আর ওকে দেখতে পেতি না। তাই ও এই কাজ করতেছে। এভাবে চলতে থাকলে ওর মৃত্যুর পর তোর অন্য কাউকে বিয়ে করতে সমস্যা হবেনা কষ্ট হলেও বা ওকে ঘৃণা করে হলেও, সেই কথা ভেবেই এই পথ ও বেছে নিয়েছে।
কি বলবে আরেফিন বুঝতে পারছেনা, আজ অনেকদিন পর দু’চোখ ফেটে কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদা যাবেনা, কোন রকমে বলল – ও কোথায়?
– ভার্সিটিতে, ক্লাসে আছে।
– আচ্ছা আপু আমি উঠি, আমার একটু কাজ আছে অফিসে, অল্প সময় চেয়ে বের হয়েছিলাম।
– ভাই তুই যাই করিস ওকে জানাসনে যে আমি তোকে বলেছি, আর পারলে ওর ভুল ভাঙ্গা।
– চিন্তা করোনা, কাজ হয়ে যাবে, তোমার একটু সাহায্য লাগবে, সময় আসুক বলবো, তুমি সাহায্য করলেই চলবে।
– অবশ্যই, তুই খালি সময়মত আমাকে বলিস।
– হুম বলব, ওকে bye. আপুকে উঠিয়ে দিয়ে CNG নিলো অফিসের ঠিকানায়। CNG থেকে নেমে সোজা গেল ওর অফিসার কমোডোর মুহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলামের সাথে কথা বলতে। তাকে বলে মিশন থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিলো। তিনি কেন জিজ্ঞাসা করতে বলল- “ স্যার, মিশন আমার জীবনে আবার আসবে, আরো অনেকগুলো আসবে, কিন্তু যা আমি এখন হারাতে যাচ্ছি তা আর কখনোই ফিরে পাবোনা স্যার। বলে সব কথা তাকে খুলে বলল। শুনে তিনি বললেন – “Good decision my boy, you must stay beside her now and don’t worry for next squad your name will be in the front. Almighty bless you.” পরিকল্পনা মোতাবেক একটা কাজ তো ভালোয় ভালোয় হলো আর একটা হলেই হয়। রুমে গিয়ে সে তার বাবাকে ফোন করে – বাবা, তোমাকে শিলার কথা বলেছিলাম না? তো তোমরা যদি আজ বিকালেই আসতে পারো তাহলে কাল ওদের বাসায় যাবো তোমাদের সাথে করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
ওর বাবা হেসে বললেন – এতো উতলা হলি কেন? তোর মিশনটা শেষ করে আয়, আর মাত্র কয়দিন আছে মিশনের। তারপর না হয় ধুমধাম করে বাকি কাজটাও সেরে ফেলবো, আমার বড় ছেলে তুই, আর তোর বিয়ে একটু ভালো মতো করবনা তা কি করে হয়।
আস্তে করে বলল – বাবা আমি মিশনে যাচ্ছিনা, আমার নাম কাটিয়ে নিয়েছি।
ওর বাবা অবাক হওয়ার সুরে বললেন- কেন? এই মিশন তো তোমার Dream ছিল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল – বাবা সবার সব স্বপ্ন একসাথে পূরণ হয়না, আগে পিছে করতে হয়। একটার ত্যাগ স্বীকার করতেই হয়, না হলে অন্যটাকে চিরদিনের জন্য হারাতে হয়।
– আরে তোর কণ্ঠ এতো Depressed শোনাচ্ছে কেন? কি হয়েছে সেটা বলবি তো নাকি? ওর বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করেছে না কি হয়েছে সেটা বল।
– না, বাবা। তা নয়, আসলে………………” এবার আর কান্না ধরে রাখতে পারলোনা, কাঁদতে কাঁদতেই সব কথা বলল। তারপর ওর সব কথা শুনে ওর বাবা বললেন – দেখো বাবা, যে মেয়ে মাত্র ৩ মাস বাঁচবে, তাকে বিয়ে করবে? তোমার গোটা জীবন পরে আছে। চিন্তা করে দেখো যদি মনে কর যা ভেবেছ তাই করবে তাহলে আমাকে বোলো আমি আর তোমার মা আজ রাতেই চলে আসব।
– বাবা, আমি জানি আমি কিছুই করতে পারবোনা। কিন্তু আমি ওকে কথা দিয়েছি বাবা আমি ওর শেষ মুহূর্তটা পর্যন্ত ওর পাশে থাকতে চাই বাবা এবং আমাকে থাকতেই হবে। ওকে না বিয়ে করলে জীবনে আর কাউকে কখনো বিয়ে করতে পারবোনা। তখন এই ৩ মাসের জন্য পাওয়া ছেলের বউটাও পাবেনা। Please, আমার আর কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেই, সব নেওয়া হয়ে গেছে, শুধু তুমি অমত করোনা।
– ঠিক আছে, তুই নাহিয়ানকে খবর দে, বিকালের ট্রেনেই যেন রউনা দেয়। আমি আর তোর মা আসছি। ঠিক আছে, রাখি, আল্লাহ্ হাফেয।
– হুম, আল্লাহ্ হাফেয।
কথা বলা শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে রুমে আসতেই দেখে শিলা বসে আছে। ও রুমে ঢুকতেই বলল – কি খবর, লেফট্যানেন্ট আরেফিন কবির, BN কেমন আছেন?
পুরোপুরি অপ্রতিভ হয়ে – আরে তুই? একটা ফোন দিবিনা, ফোন দিয়ে আসতি।
– ধুর! ফোন দিয়ে আসলে কি আর Surprise দেওয়া যেত। তাই Surprise দিতে চলে এলাম, তোর এখন কোন কাজ আছে?
– নাহ, আজ তেমন কোন কাজ নেই।
– কি ব্যাপার চোখ লাল লাগছে কেন? কি হয়েছে?
– কি হবে আবার ? কিছু হয়নি তো।
– আমার কাছে মিথ্যে বলছিস জানিস পারিস না খামোখা কষ্ট করে চেষ্টা করছিস। ঝেড়ে কাশ তো হয়েছেটা কি?
– মিশনে যাচ্ছিনা।
– কেন? অবাক হয়ে বলল।
– গ্রামে দাদি অসুস্থ সমস্যায় পড়েছি, সে এখন তোকে দেখতে চায়।
– অ্যা? আমাকে? আমাকে কেন? আমি কি করলাম আবার?
– আরে হ্যাঁ তোকেই, মানে নাতবৌ দেখার শখ হইছে তার, আর তাই আমাকে মিশন থেকে নাম কাটিয়ে নিতে হলো। আর তোকেও বলতাম তোর আব্বুকে বলতে। আর তুই তো এখানেই এসে গেলি। আমাকে আর কষ্ট করে তোদের ওখানে যেতে হবেনা। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো শিলা – ওহ ! আচ্ছা এখন কি করবি তাহলে?
– কি করবো কি? আজ তুই তোর বাবাকে বলবি কাল আমার পরিবার ধইরা তোরে দেখতে আসবে, আচ্ছা তুই না আমি বৃষ্টি আপুকে দিয়ে বলাই সেটাই ভালো হবে। তাহলে আর তোর আব্বু তোকে কিছুই বলতে পারবেনা। ঐটাই করতে হব।
– আরে, এটা কি করে হবে ? মানে আপুর আগে? আর আমি তো তোর কাছে কিছু সময় চেয়েছিলাম নাকি?
– আরে বাবা আমার কি করার আছে? বাবা ফোন দিয়ে খবর দিলো, বলল আজকে রাতে আসছে কাল তোদের বাসায় যাবে কথা ঠিক থাকলে কালকেই কাজ সমাধা করে পরশু তোকে নিয়ে গ্রামে যাবে আমি কি বলব? আমার হাতে কি কিছু আছে এখন?
– দেখ , হবেনা, সমস্যা আছে?
– আচ্ছা তুই এমন করছিস কেন? আমি কি মেনে নিয়েছিলাম না।।এখন যদি আমার পরিবারে সমস্যা হয় আমি কি করতে পারি? আমার অসুস্থ দাদি তার নাত বউ দেখবে বাবা বললেন আমিও বলেছি তোকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবোনা। ব্যস। এখন তুই আমার সমস্যাটা দেখবিনা? আমি যে এতদিন ধরে তোর সমস্যাগুলো দেখে আসতেছি, কি সমস্যা তাও কখনো জিজ্ঞাসা করিনি, তুই যে সমাধান দিয়েছিস তাই মেনে নিয়েছি কাজ করেছি আমি কখনো তোকে না করেছি? তাহলে আজ কেন তুই এমন করছিস? তোর মনে কি আছে খুলে বল তো?
– নাহ মনে কি থাকবে? মানে আপুর আগে আমার বিয়ে কেমন দেখাবেনা?? আব্বু মনে হয় না রাজি হবে।
– Come on its 2016. এখন কি এইসব কোন ব্যাপার, আর তোর আব্বুর সাথে আমি কথা বলব চল।
– নাহ, সে কেমনে হবে? থাক বাদ দে, বড়দের ব্যাপার স্যাপার তারা যা করে তাই ঠিক, ওকে। আর নাক গলানোর দরকার নাই, এমনিতেই চশমার ভারে আমার নাকটা অনেকখানি দেবে গেছে। আর নাক খোয়াতে চাইনা। বলে হেসে পরিবেশটা হালকা করলো।
আরেফিন বলল- চল শেষবারের মতো বন্ধু হয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসি। যাবি?
– হুম, এতো Sure হচ্ছিস কি করে?
– আমার মন বলছে। সে যাক যাবি কিনা সেইটা বল?
– ওকে…চল কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হবে।
– ঠিক আছে চল।
– এভাবে? ইউনিফর্মে?
– আরে, পথে বাসায় ১০ মিনিট hold করবো। তুইও ফ্রেশ হয়ে নিস আমিও change করে নিবো।
– No way man. তোর বাড়িতে গেলে একেবারে বউ হয়েই তার আগে না। তুই এখন বাসায় যাবি ঠিক ঠিক এক ঘণ্টা পর আমাকে বাসা থেকে পিক আপ করবি। ওকে, আমি উঠি, Bye, আল্লাহ্ হাফেয।
শিলা বেরিয়ে যেতেই বৃষ্টিকে ফোন করল আরেফিন, সব কথা বলে বলল – আপু, বাসার দিকটা তুমি ম্যানেজ কর। আমি এদিকটা দেখতেছি। ও যেন বাসায় কোন সমস্যা না করে।
– আচ্ছা আমি দেখতেছি। আর তুই আসলেই অনেক ভালোরে, আমার বোনটা অনেক লাকি। ইশ! আমাকে যদি কেউ এভাবে ভালোবাসতো??
– হয়েছে রাখো রাখো। মাহিন ভাইয়াও কম যায়না, সে যাক পরে তোমারে সাইজ করবো, আপাতত যা বললাম ঐটা ঠিক থাকে যেন, ওকে bye.
এই প্রথম শিলাকে কোন মিথ্যে বলল আরেফিন। অথচ এছাড়া ওর আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না।
মনে মনে বলল- Sorry; Sheela, It’s only for you………………
শিলা বাসায় গিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। ওখানে মাথায় শাওয়ারের পানি ঢালছে আর চিন্তা করছে কি করবে? আজ তো আর কোন পথই খোলা রাখেনি আরেফিন। এখন সে কি করবে? কাল ওর মা-বাবা এসে যদি সত্যিটা জানতে পারে তাহলে তো ব্যাপারটা আরো খারাপ হবে। তারচেয়ে আজই ওর বলতে হবে। যে করেই হোক। যত কষ্টই সে পাক আজ তাকে জানাতেই হবে। মনে মনে সব ঠিক করে ফেললো শিলা। আজ সে সাজবে ওর জন্য। শুধুই তার জন্য যদি সে সব জানার পরও তাকে আগলে নেয় তো নিবে না হয় জীবনের জন্যে সে সাঁজা ছেড়ে দিবে। গোসল শেষে আরেফিনের প্রিয় আকাশী নীল শাড়িটা বের করলো শিলা। তার সাথে ম্যাচিং করা নীল পাথরের মালা আর কানের দুল এবং আকাশী নীল কাঁচের চুড়ি। যেদিন প্রথম জেনেছিল আরেফিনের প্রিয় রঙ আকাশী নীল সেদিনই সে এই পুরো সেটটা কিনেছিল, শুধু আজকের এই দিনটির আশায়। হয়তো আরো আগেই আসতো দিনটি যদি না এই জীবাণুটা ওর শরীরে বাসা বাঁধতো। থাক আজ আর কষ্টের কিছু মনে করবেনা সে আজ তার আনন্দের দিন। এদিকে শিলাকে সাঁজতে দেখে বৃষ্টি খোঁচা দিয়ে বলল- কিরে পালিয়ে যাচ্ছিস নাকি?? আমাদের ছেড়েছুড়ে? আরেফিনও ফোন দিয়ে কি সব যেন বলল……… – আরে ধুর! কি যে বলনা। এমনি বাইরে যাব কখনো সাঁজা হয় না, ভাবলাম আজ একটু সাজি। তাই শাড়িটা পড়লাম। দেখতো আপা কেমন লাগছে?
– কি বলব কিছুই বলার নেই।
– কেন? ভালো লাগছেনা??
– আরে পাগলি, তোর মতো অত সুন্দর হইতে পারলাম কই? আর এতো ভালো একটা জামাই বা পাইলাম কই।
– হইছে আর বলা লাগবে না। হুদাই ফালতু কথা।
– ফালতু কথা না…হুম আমি বুঝি জানিনা………
দুই বোন মনের সুখে ঝগড়া শুরু করে দিলো। এর কিছুক্ষণ পর বাইরে হর্ন বাজায় আরেফিন। আজ সাদের গাড়িটা নিয়ে এসেছে। বাইকে ফেরার সময় রাত হয়ে যাবে, তখন সমস্যা হতে পারে তাই গাড়িই ভালো। আরো দুই তিনটা হর্ন দেওয়ার পর বের হলো শিলা, হালকা নীল শাড়ি, নীল পাথরের মালা আর কানের দুল, হাত ভর্তি হালকা নীল কাঁচের চুড়ি। ওকে দেখেই তো আরেফিনের চোখ ছানাবড়া। হা করে তাকিয়ে আছে দেখে শিলা এগিয়ে এসে ওর মাথায় টোকা মেরে বলল – মুখ বন্ধ কর, মশা ঢুকবে। আর কি শিখছিস লাইফে, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে কি করে গাড়িতে তুলতে হয় জানিস না? হাঁদারাম, যাহ তোকে বিয়েই করবোনা। আরেফিনের বিশ্বাস হচ্ছে না। এই মাত্র ও কি বলল, – ঐ কি বললি? আর একবার বলনা? শিলা হেসে উঠলো, লজ্জায় আস্তে আস্তে ওর তামাটে মুখটা লাল হয়ে গেলো, তারপর বলল – যাহা শুনেছেন ঠিকই শুনেছেন। আব্বু রাজি হলেও আপনাকে বিয়ে করবোনা। আরেফিনের চোখ তখন কপালে বলে কি এই মেয়ে, চোখটা টিপ দিয়ে বলল –
Wah! kia bat hai. Teri charo taraf neel hi neel hai (বাহ সে কি কথা! চারিদিক শুধু নীল দিয়ে ভরা )
Sajni kia keh rahe ho, kia samjhu tri signal green hai??(সজনী কি সে লুকনো কথা? তবে কি আজ সংকেত সবুজ করে দিলা)
আবারো হেসে বলল – চুপ, দরজা খোল।
– Wait a minute my Princess.
গাড়ি থেকে নামলো আরেফিন পিছে একটা লাল গোলাপের তোড়া, মোট ৭৭ টা লাল গোলাপ, ৭২ টা এই ৬ বছরের ৭২টা মাসের জন্য, ৪টা ওর গাওয়া গানগুলোর জন্য। আর শেষ একটি শুধুই শিলার জন্য। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে ফিল্মি কায়দায় বসলো, এক হাতে গোলাপের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে আর এক হাতে এগিয়ে দিলো ডায়মন্ড হাউস থেকে কেনা রিংটা। তারপর বলল – শিলা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। Will you marry me please??
লজ্জায় লাল হয়ে বলল – হইছে আর ঢং করা লাগবে না, করবো করবো। কোন সুযোগ রাখছ না করার। মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে আরেফিন বলল – আসলে ছয় বছর পর ছিপে মাছ আটকেছে, কি করে সেই ছাড় দেই বোলো? তারপর ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো, উঠে বলল – কই যাবে? সাভার না উত্তরা?
– জানিনা, যেখানে ইচ্ছে হয় যা, আর দেখ আমি এই তুমি তুমি করতে পারবোনা। তুই শুধুই আমার তুই। তুই ছাড়া বলতে পারবোনা, আর তুই ও তুই ছাড়া বলতে পারবিনা।
– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, খুশী, তো?
– হুম……।
গাড়ি নিয়ে ছুটলো দুজনা সাভারে। সাভারের স্মৃতিসৌধের সামনে গাঢ় সবুজ ঘাসের চাঁদরে বসে আছে শিলা আর ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আরেফিন। শিলার উদাসী মুখ দেখে আরেফিন বলল – কিরে কি হলো? মুখটা পেঁচার মতো করে রাখছিস কেন?
– নাহ! কিছু নাহ। আচ্ছা আরেফিন যদি এমন হয় কখনো যে আমি মারা যাই । তাহলে তুই আরেকটা বিয়ে করতে পারবিনা, তোর সুন্দর একটা পরিবার থাকবে, একটা ছোট্ট ছেলে থাকবে একদম তোর মতো। তোকে আব্বু আব্বু বলে ডাকবে। পারবিনা? কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা আঁটকে আসে শিলার অনেক কষ্টে কান্না চেপে কথাগুলো বলে সে।
– তুই মরবি কেন? কি বলিস? আরে এইজন্যই তো তোকে বিয়ে করতেছি। আমার আর তোর বাচ্চা হবে একটা ছেলে একটা মেয়ে। মেয়েটা ঠিক তোর মতো শান্ত, ভদ্র, cute, sweet আর তোর মতো রূপবতী। আর ছেলেটা হবে আমার মতো একটু দুষ্টু, একটু পাগল, একটু আঁতেল টাইপের, একটু হাঁদারাম আর বাউণ্ডুলে। তোর আর আমার Perfect Production হবে। বুঝতে পারছিস, হুম?? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিলা বলল – দেখ, আরেফিন সেটা সম্ভব না। কারণ আমি ব্রেইন ক্যান্সারের রোগী, আমি আর বড়োজোর ৩ মাস বাঁচবো। আর এইজন্যই কখনো তোর কোথায় রাজি হইনি।
– আমি জানি আর এটা কিছু হইলো আজকাল ক্যান্সারেরও চিকিৎসা হচ্ছে, তোরটাও করা যাবে আগেই Feed up হয়ে গেছিস কেন? আর আমি জানি তোর কি সমস্যা ছিলো। আমি সব জানতাম আগে থেকেই।
অবাক হয় শিলা – কবে থেকে?
– অনেক আগে থেকেই(আর একটি মিথ্যা বলে) তাইতো তোকে বিয়ে করার জন্য এতো উতলা হয়েছি। আর তুই কিনা……………………কিরে কাঁদছিস কেন???
চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না শিলা বলে – তুই একটা কুত্তা, তুই হারামি……কেন? কেন? কেন এতো ভালোবাসিস? কি করে পারিস?
আরেফিন ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে যেন কেউ ওকে কেড়ে নিয়ে যাবে ওর কাছ থেকে, তারপর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে – ধুর পাগলী ! পারলাম কই? কিছুই তো করতে দিলিনা। কাঁদিস না তো, তোর চোখে কান্না মানায় নারে, একটা কবিতা শুনবি………
চোখ মুছতে মুছতে বলে – হুম…। বল।
– এই যে এতো কাণ্ড জানো
সব কিছুই তোমার জন্য
এই যে মিছিল ট্রাফিক জ্যাম
বা বিধান সভায় ধন্য ধন্য
সবই তোমার জন্য।
সেই তুমি যে লুকিয়ে রইলে
দুঃখী মেয়ের চোখের পাতায়
কিংবা আঁকিবুঁকির মধ্যে
নবীন কবির চটি খাতায়।
এখন না হয় বাইরে এলে
জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে
দেখো নিচে গোলাপ হাতে
সেই যুবাটি ঠায় দাঁড়িয়ে।
ছুটলে মানুষ অফিস ফেরৎ
রণক্ষেত্র থেকে সৈন্য
বালকদের ঐ প্রভাতফেরি
সব কিছুই তোমার জন্য।
(তোমার জন্য – বাসুদেব দেব)
সন্ধ্যা হয়ে এলো চল উঠি বলে শিলাকে সাথে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আরেফিন। শিলা ওর কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে আর আরেফিন এক হাতে ওকে জড়িয়ে রেখেছে। ওখান থেকে রেডিসনে ডিনার করে শিলাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজ নিরালার পথে এগিয়ে চলে আরেফিন। মাথায় ঘুরপাক খায় সারাদিনের চিন্তাগুলি , তারপর হাঁফ ছেড়ে নিজেকে নিজেই বলে উফ!!!! কি দিন গেলো একটা। কপাল ভালো সব ভালোয় ভালোয় ঠিক করতে পেরেছে। খালি কালকের কাজটা হলেই হয়। বাসায় বাবা – মা অপেক্ষা করছে আর কাল সকালে ছোট ভাই নাহিয়ানও এসে পৌঁছে যাবে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঢাকা – চট্টগ্রামের ট্রেনে উঠে গেছে।
পরদিন বিকালে পুরো পরিবার নিয়ে শিলাদের বাসায় গেলো ওরা। শিলার বাবা কিছু বলতে না পেরে কেঁদে ফেললেন। তারপর আরেফিনকে ডেকে বলেন – “বাবা, আমি ভেবেছিলাম আমার এই মেয়েটা সবচেয়ে অভাগা। কিন্তু না। আমি ভুল ছিলাম, যে মেয়ে তোমার মতো ছেলের ভালোবাসা পেয়েছে সে অভাগা হতে পারেনা বাবা। আমার মেয়ের জীবনের শেষ কয়টা দিন ওকে হাসিখুশি রেখো বাবা, তোমার কাছে এর বেশি আর কিছুই চাইনা।”
সন্ধ্যে বেলায় শিলাকে বউয়ের সাজে সাজানো হয়। লাল বেনারসি শাড়ি, গলায় সোনার হার, কানে ঝুমকো দুল, আর হাতে কাঁকন। দুপুরেই বৃষ্টি ওর হাতে মেহেদি করে দিয়েছে। মেহেদির লাল রঙ যেন ওর ফর্শা হাতটাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কাজি আসেন সাড়ে আটটায়। তারপর ওদের বিয়ে পড়ানো হয়, ঠিক ঠিক ৯.০৫ মিনিটে। তারিখটি ছিল ২৮ অক্টোবর,২০১৬। ঠিক ঠিক ৬ বছর ০২ দিন পর।
তারপর আর কি? শেষ পরিণতি তো সবারই জানা। তবুও মাঝে মাঝে শিলার কষ্ট দেখে খুব কাঁদত আরেফিন, অবশ্যই আড়ালে। শিলা যখন কাঁদত তখন ওর পাশে বসে কবিতা শোনাতো আরেফিন, কখনো রফিক আজাদের “যদি ভালোবাসা পাই”, কখনো সানাউল হকের “অষ্টপ্রহরিকা”, কখনো সৈয়দ রেজাউর রহমানের “আমার ঠিকানা”, কখনো মহাদেব সাহার “চিঠি দিও”, অথবা জীবনানন্দ দাশের “আকাশলীনা” নয়তো বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের “ চোখ” রবীন্দ্রনাথের “নিদ্রিতা” আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “ রাখো তোমার উদ্যত পা”।
আর শেষ যেদিন সে শিলার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে চুমো খেয়েছিল, অঝোরে কেঁদেছিল দুজনাই। আরেফিন বুঝিয়েছিল ওকে আর নিজেকে। ওর মৃত্যুর পরও নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে। যদিও মন মানেনি সে কথাগুলি-
যখনই হৃদয় আকাশে ঘটেছে,আঁধার কালো মেঘের ঘনঘটা,
যখনই এই মন দরিয়ায় এসেছে , দুঃখ নামক উন্মাদ ভাটা
যখনই এই আঁখি হতে ঝরেছে, তপ্ত অশ্রুজল দু’ফোটা,
যখনই একাকীত্বের বিষাক্ত ছোবল, এই হৃদয় করেছে ফাটা ফাটা।
মনকে বলেছি- শোনরে মন, কেন কাঁদিস তুই একা একা?
দুনিয়ার এই বিচিত্র রঙ্গশালায়, সবার সাথেই এমনটা হয়।
এই যে সকল কষ্ট আর বেদনা, সময় সবাইকে দিয়েছে করুণ ছোঁয়া।
কিছুটা মেঘের অমানিশা, কিছুটা আলেয়ার খেলা, এইতো জীবনের বেচাকেনা।
আষাঢ়-শ্রাবণে কি আর বর্ষা হতো, যদি সব ঋতুতেই ঢল নামতো?
তবে কেন কাঁদিস রে মন তুই একা একা? একবার যে চলে যায় সে আর ফিরে আসেনা,
তবুতো জীবন থেমে রবেনা, মুছে যাবেনা, তারে দেয়া যত প্রতিশ্রুতি আর সব কথা,
তাই কাঁদিস না মন, কাঁদিস না, হাস প্রাণ খুলে, কাঁদিস না আর একা একা, এ নিরালা।
সময়ের ব্যস্ততায় জীবন বদলে যায়। কারো জন্য কোন কিছু থেমে থাকেনা। শুধু কিছু রাত জাগা রজনী, আর তার স্মৃতি স্মরণে চোখ বেয়ে ঝরে আঁখিজল। এর বেশী কি আদৌ কিছু হয়? আমার জানা নেই। হয়তো হয়না। কারণ সবাই বদলে যায়, সব বদলে যায়। আর তাইতো মনীর চৌধুরী লিখেছিলেন, “ মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়।” আরেফিন নিজেও এই সমীকরণের বাইরের কেউ নয়। অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে ওর জীবনেও, কিছুটা নিজের ইচ্ছায়, কিছুটা সমাজ আর পরিবারের চাপে। যদিও তাতে তার কোনই হাত ছিল না। শিলার মৃত্যুর আট বছরের মাথায় দুই পরিবারের চাপে আবার বিয়ে করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিয়ের আগেই তন্বীকে সব কথা খুলে বলে সে। প্রথম প্রথম খুব আপসেট থাকলেও পরে মেনে নেয় তন্বী। অবাক হয় সে, কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা ঈর্ষান্বিত। সর্বোপরি আস্তে আস্তে সেও মানুষটাকে ভালবাসতে শুরু করে। এই আশায় হয়তো শিলার মতো নয় অন্তত তার এক সিকিভাগ ও যদি ওর কপালে জুটে, ভেজালের দুনিয়ায় ঐটুকু খাঁটি ভালোবাসা, ওটাই ওর অনেক পাওয়া হবে। আজও প্রতি ২৬ অক্টোবর রাতে গান উৎসর্গ করে সে শিলার নংয়ে। বন্ধ নংয়ে এখনো ফোন করে সে মাঝে মাঝে, ভয়েস এসএমএস পাঠায়, কত শত কবিতা। আজ আর কোন কবির কবিতা নয়, তার নিজের লেখা কবিতাগুলো। এখনো উদাস বিকালে একলা চলে যায় সাভারে, স্মৃতিসৌধের সামনে ঐ জায়গাটাতে গিয়ে শুয়ে থাকে, আকাশে চোখ মেলে খোঁজে। কি খোঁজে সে জানেনা। হাদিসে নাকি বলা আছে, “ যে যাকে ভালোবাসবে তার সাথেই তার রোজ কেয়ামতে হাশর হবে।” অপেক্ষায় থাকে সে। আর রাত কাটায় বাসার বেলকনিতে বসে, কবিতা পড়ে আনমনে, তন্বী পিছে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ নীরবতায়, ওর কষ্টে বাঁধ মানেনা তন্বীর চোখের জলে। তারপর রাতের গভীরতা যখন চরমে পৌছায়, আস্তে করে ডেকে নিয়ে ঘুমোতে যায় দুজন। কিন্তু চারপাশে ধ্বনিত হতে থাকে আরেফিনের কবিতার শব্দ গুচ্ছেরা –
সমর ঘুড়ির লাটাই হাতে দাঁড়িয়ে একা তেপান্তরের মাঠে,
স্বপ্ন নিয়ে আজ ছাড়ছি সুতো, শুধু তোমার পথে সাথী হবো।
যখন সব নিরবতা ভেঙ্গে, রাত্রি পটে বারি ঝরে,
মাঝরাতের সেই কোলাহলে, তোমার সুরে এ মন গেয়ে ওঠে,
বন্ধু তুমি হারালে কোথায়? খুঁজি তোমায় আমি নীল অজানায়,
হারালে কোন অস্পৃশ্য সীমায়? বসত গড়ে ঐ মেঘের ভেলায়………।
চেক করে দেখো লেখাটা আবার।
অনাবশ্যক স্পেস আছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
অনেক দিন আগে লেখা , চেক করেছিলাম তাও কিছু রয়েই গেছে 🙁
বারে বারে অবাক হই, আর দেখি ফিরে ফিরে
কতটা বদলে গেছি এই আমি প্রতিটি পদে পদে.....................
রাজীব আসলে বলতে চাইছিলো কবিতায় লাইনের মধ্যের স্পেসগুলোর কথা, চোখে লাগছে।
এতো কবিতার সমাবেশ গল্পের রসাস্বাদনে বাধা দিচ্ছে, যদিও কবিতার কালেকশন হিসেবে ভালোই লাগছে।
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ওহ! আসলে আমার কাছে যে বইটা ছিলো সেটাতে এভাবেই স্পেস দেয়া 🙁
বারে বারে অবাক হই, আর দেখি ফিরে ফিরে
কতটা বদলে গেছি এই আমি প্রতিটি পদে পদে.....................