“কি অয় এই সনদ দিয়া? সনদ দিয়া কি পেট ভরে??”

কুরবানির ঈদ বিধায় গরু কাটার কাজ শেষ করেই ছুটতে হয়েছে মাংস বিলির কাজে। সারা পাড়া মাংস দিয়ে আসছিলাম, তখন ট্রেতে অনেক মাংস বাকিই ছিল। অনেকেই নিজের ভাগটাও দিয়ে পাঠিয়েছেন। তো বাসায় আসার পথেই হাতের বামে মসজিদ পরে। ঐ মসজিদেই জুম্মা ও অন্যান্য নামাজ আদায় করি আমাদের পাড়ার সবাই। সেই মসজিদের সিঁড়িতে দেখি একজন বৃদ্ধ বসে আছেন ছেঁড়া একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পড়া। পাশে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। ভাবলাম হয়ত ছন্নছাড়া মানুষ কুরবানির মাংস সংগ্রহ করতে এসে এখানে ক্লান্ত হয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। আমার দিকে কেমন জানি একটা দৃষ্টি মেলে ছিল, ভাবলাম হয়ত মাংস চাইছে। তো আমি ট্রে থেকে কয়েক টুকরা মাংস নিয়ে তাকে দিতেই, সে আমার হাত থেকে কেড়ে নিলো টুকরাগুলো তারপর কাঁচাই চিবাতে শুরু করল। আমি যারপণাই বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। আরে এ কি করে। তো আমি তাকে বললাম, “এভাবে কাঁচা চিবাচ্ছেন কেন? বাড়ি নিয়ে রান্না করে খান?” আমার কোথায় জানি না কি ছিল সে হা হা করে হাসতে লাগলো। তারপর আমাকে প্রশ্ন করলো, “তোমার নাম কি?” আমি নাম বলার পর বলল, “শুনো বাজান আমার বাড়িঘর নাই। গত চারদিন কিছু খাই নাই। তাই এভাবেই খাচ্ছি। নাইলে মইরে যাব।” আমার কৌতূহল আটকাতে পারলাম না, প্রশ্ন করে বসলাম, “বাড়িঘর নাই থাকেন কই?” সে একটু খানি মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করল, “রাস্তায় রাস্তায়। ৭১রে যুদ্ধে গেছিলাম বৌ ছাওয়াল থুয়ে। যুদ্ধ শেষ হইলে আমিও দ্যাশে ফিরলাম কিন্তু আমার ভিটা বাড়ি কিচ্ছু নাই। সব লোকজনে দখল কইরা নিছে।”

এবার কিছুটা খারাপ লাগতে লাগলো একজন মুক্তিযোদ্ধা, এই স্বাধীন বাংলা নামক যে রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্র গড়ার এক শ্রমিক কোথায় তার সম্মানের সাথে বাঁচার কথা, সেই তিনি আজ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমি জানিনা কেন তার পাশে আপনা থেকেই বসে পড়লাম অজু করার যে উঁচু স্থান থাকে তার উপর। বসে তাকে বললাম, “আপনি মুক্তিযোদ্ধা আপনার তো সনদ থাকার কথা? সনদ নাই? সনদ দিয়ে তো আপনি কিছুটা হলেও অনুদান নিতে পারেন সরকারের কাছ থেকে?” সে করুণ একটা চাহনি দিয়ে বলল, “আছে বাবারে, সনদ তো আছে, কিন্তু এই সনদ কি পাইরবে আমার বৌরে আমার কাছে ফিরায় আনতে, পাইরবে আমার ছাওয়ালটারে এই বুকে দিয়ে যাইতে। কি অয় তোমাগো ঐ সনদ দিয়া। যে ট্যাহাটা দেয় হেইটা তো শালা ঐ যত চোরগুলার পেটেই ধরে না আমরা কই থেইক্যা পামু? সনদ ধুইয়্যা খাইলে পেট ভরে না রে বাজান, পেট ভরে না। ” তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, “কাজ কাম নাই এই হানে বইয়া আছ কেন?” আমি কি উত্তর করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, বললাম, “ না , আপনি মুক্তিযোদ্ধা, আমার দাদাও যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাই আপনাদের মত মানুষ দেখলে কথা বলতে ইচ্ছে করে, সেইজন্যই এখানে বসলাম, আপনার কথা শুনবো বলে।” এইবার সে একটু স্ফীত হেসে বললেন, “ হা! আমার কথা, কি শুনবা বল?? আমারে জিগাও আমি কইতেছি?” আমি সুযোগ পেয়ে তাকে তার বাড়ি ঘর বৌ বাচ্চার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তার বাড়ি পাবনারই মালঞ্চী তে। তাঁতের কাজ করতেন আর বিঘে দুয়েক জমি ছিল চাষ করেই সংসার চালাতেন। ১৯৭১ তার বয়স ছিল সবে ২২। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তিনিও দেশের জন্য যুদ্ধে নামেন।
পাবনা থেকে নৌকা কইরা তিনদিন তিন রাইত খাওয়া কইতে মুয়ামুড়ি গেলাম রাজশাহী। ঐহান থেকে মুর্শিদাবাদ হইয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে। ২মাসের ট্রেনিং লইয়া জয়পুরহাটের হিলি দিয়া ঢুইকা গেলাম দ্যাশের ভিতর। আমার কাজ ছিল গ্রেনেড ছুড়া। এমনেই যুদ্ধ করলাম কত জাগাত, আস্তে আস্তে মানুষ মরলো আর আসলো। কিন্তু আমার কিছুই হইল না। আমি আর আমার এক দোস্ত মিলা আইছিলাম, হেয় তো কবেই আমারে ছাইড়্যা গেলোগা। তয় ওর দোষ নাই। হারামি পাকের একটা গুল্লি সিধা ওর খুপড়ির ভিতর দিয়া গেছিল। মরার আগে কলমাও পড়ার সুযোগ পাইল না। তহন মে মাস। এদিকে আমরা জয়পুরহাটের কাম অন্য একদলের হাতে ছাইড়্যা আস্তে আস্তে বগুড়া হইয়া সিরাজগঞ্জ দিয়া পাবনার দিকে আগায় আইলাম। শাহজাদপুরে একখান যুদ্ধ লাগছিলো, ওইবার আমাগো পনের জনের দলের মাত্র ৬জন জান নিয়া ফিরলাম। দেখলাম এমনে ওগো লগে এইহানে পারমু না। তাছাড়া এই বেড়া সাথিয়া জুইড়া তখন শান্তিবাহিনী, রাজাকার আর আল বদর দিয়া ভইরা ছিল।তাই যেদিন ওগো নতুন সেনা আসার দিন হইলো আমরা ঠিক করলাম ঐদিন বড়াল নদীর উপর যেই ব্রিজ ঐটা উড়ায় দিমু। তারপর সপ্তাখানেক বাদে ঐ মিশনটা শেষ কইরা আমরা আইয়া ঢুকলাম পাবনা শহরে।

জুনের শেষ দিকে একবারের লাইগা বৌ ছাওয়ালগুলারে দেখবার আইলাম, কিন্তু ওমা কই আমার ভিটা বাড়ি কই আমার গেরাম। সব তো কালা কয়লা হয়া আছে। চেনা একজনরে পাইলাম হেই কইলো ভাই তড়া কইরা এইখান থেইকা যাও। পুরাটা দিয়ে শান্তিবাহিনীর লোক ছায়া গেছে। তোমার হদিস করছিল। তুমি ভাই এই জাগাত থেইকে এখুনি যাও। বৌ বাচ্চার কথা জিগাইতেই কইল বেটি ছাওয়াল আর পোলাপাইনগুলারে অন্য গেরামে পাঠায় দেয়া হইছে। আমরা কয়েকজন খালি এইখানে আছি যে মুক্তিভাইদের কোন সাহাইয্য যদি লাগে এর লাইগ্যা। ভাই তুমি আর দেরি কইরো না। তড়া কইরা যাও এহান থেইকা। ফিরা আইলাম গেরাম থেইকা ভাবলাম হয়ত সব ভালোই আছে। হেরপর গয়েশপুরের একটা মিশনে গিয়া গুলি লাইগলো পায়ে। আমারে পাঠায় দিলো বাজিতপুরে একটা ছোট কুড়ে ঘরে। সেইখানে এক বইনের সেবায় সুস্থ হইলাম, ততদিনে পাবনা স্বাধীন হয়া গেছে। ফিরা গেলাম গেরামে, দেইখাই পাশের বাড়ির আমেনা বু আমারে জড়াইয়া কান্দন ধরলো। আমি কিছু বুঝিনা কি কয় সে কান্দনের দমকে কোন কথাই বুঝার জো নাই। সুফিয়া বু পাশ থেইকা কইল,……………………………যা কইলো কইতে পারমু না বাজান। বুক ফাইটা যায়। আমার বাচ্চা পুলাটারে নাকি পাক সেনারা বুট দিয়া পারাইয়া মারছে।

কথাটা বলেই নীরবে অশ্রু ঝরাতে লাগলেন। আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম, যদিও জানতাম না তার উত্তর কি হবে? যদি জানা থাকতো কখনো এই প্রশ্নটি করতাম না। আমি তাকে বললাম, “ আপনার স্ত্রীর কি হয়েছিল?” সে আমার দিকে নিথর পাথুরে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল কোন কোথা না বলে হটাৎ করেই ধ্বক করে জ্বলে উঠলো ঐ পাথুরে চোখ সাথে তপ্ত অশ্রুজল, চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ আমারে ময়নারে হারামজাদাগুলা বেইশ্যা বানাইছে। আমার ময়নারে নিয়া কুত্তার বাচ্চাগুলা আমোদ করছে। আমার সোনার বৌটারে কুত্তাগুলা খাবলাইয়া খাবলাইয়া খাইছে। আর সেই লজ্জায় আমার ময়না গলাত দড়ি দিছে, আমার ময়না ……………………। ” কথা শেষ না করেই কাঁদতে শুরু করলেন। আর আমি হতবিহবলের মত ঠায় তাকিয়ে আছি। আমি জানি এটাই সত্যি তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কেন জানি না আমি মানতে পারছিলাম না।

আমি সব কিছু ভুলে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ধ্যান ভাঙ্গলো আজান শুনে। যোহরের নামাজ পড়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। পুরোটা দুপুর কিভাবে কেটে গেছে টেরই পাইনি। আমি তাকে বললাম, “চলুন আমার সাথে, বাসায় গিয়ে কিছু খিচুড়ি আর মাংস খেয়ে নিবেন, আসুন।” আস্তে আস্তে তাকে ধরে নিয়ে বাসায় আনলাম আমার ঘরে বসতে দিয়ে মাকে বললাম, খাবার দিতে। নার আমি এই ফাকে আছরের নামাজটা পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে উঠে দেখি তিনি তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। নিজেকে অনেক ছোট মনে হলো। মনে হলো আমরা আসলেই নরকের কীটের চেয়ে অধম। যে মানুষগুলোর জন্য আজ এই স্বাধীন দেশে বাস করছি সেই মানুষগুলোর কোন খেয়ালই আমরা রাখিনা। আদৌ আমরা মানুষ কিনা ভাবতে লজ্জা লাগছিলো। বাকী দিন কেমন জানি বিষণ্ণ ভাবটা রয়েই গেলো। তারপর দিন তাকে খুঁজতে গিয়ে আর মানুষটার আর কোন খোঁজ পাইনি। আমাদের পাড়া থেকে চলে গেছেন। কিন্তু গত পরশু এক বেওয়ারিশ লাশের জানাজা পড়লাম। বলাই বাহুল্য তিনি আর কেউ নন সেই মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম আমার জানা হয়নি। কিভাবে মারা গেছেন তাও কেউ জানেনা, সকালে মসজিদের হুজুর তার লাশ দেখতে পান পুকুরে।
কেউ জানেনা তার আসল পরিচয় কেউ জানেনা তিনি কত বড় সম্মানের প্রাপ্য, কিন্তু বিনা সম্মানে তিনি আজ শায়িত আছেন। আমি কোন লেখক না। যে সুন্দর করে কোন গল্প ফাঁদবো। আমার সেই যোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা দেননি। কিন্তু আজ না লিখে পারিনি বিবেকের তাড়নায়। আজ আমি যদি না লিখি তবে চাপা পরে যাবে এক মহান মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর দেশের জন্য দেয়া কুরবানির কথা। আমরা বর্তমান সমাজের মানুষরা প্রাণী কুরবানি করে ঈদের মজা নিচ্ছি। অথচ কিছু মানুষ আছেন আজো আমাদের দেশে সমাজে যারা তাদের সব কিছু কুরবানি করেছিলেন এই দেশটার জন্য। আমাদের সরকার বিদেশী বন্ধুদের যারা মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন তাদের স্বীকৃতি দিলেন এইতো সেদিন, কিন্তু আমাদের দেশের মাঝে থাকা অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের কি তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পেরেছে? প্রশ্ন রইলো জাতির সব কর্ণধারদের কাছে। কি দিয়েছি আমরা এই মুক্তিযোদ্ধাদের একখানা সনদ, আর সামান্য নামে মাত্র কিছু অনুদান। এই কি সব? কিন্তু দেশের জন্য তারা যা দিয়েছেন তার হিসেব কি আদৌ করা সম্ভব ? আমি জানিনা হয়ত কথাগুলো আবেগের বশে লিখছি, কিন্তু কথাগুলো হৃদয়ের মাঝ থেকেই বের হয়ে আসছে। বারংবার একটা প্রশ্নই আসছে মনে ঘুরে ফিরে একটা কথাই মনে পড়ছে, “কি অয় এই সনদ দিয়া? সনদ দিয়া কি পেট ভরে??” আসলেই তো কি হয় এই সনদ দিয়ে, সনদ দিয়ে যদি পেট ভরতো তাহলে তো রফিক আজাদ লিখতেন না “ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।”
আর কথা বাড়াবো না। এতো গল্প নয় এতক্ষণ কষ্ট করে পরেছেন এর জন্যই ধন্যবাদ। অনেকদিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম। পিলখানার ঐ মর্মান্তিক ঘটনার পর। ক্যাডেট কলেজে পড়ি বিধায় লেখাটি আমাদের কলেজ প্রকাশনায় স্থানও পায়। সেদিন লিখেছিলাম শুধুই লিখতে হবে বলে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি কয়েক বছর আগে লেখা ঐ কবিতাটা শুধুই কবিতা ছিলো না, তা আজো আমাদের সত্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিলো-

হায়! আজ বর লজ্জা হয় সেই কথার স্মরণে
আজ এই শির আমার হয় অবনমিত।
কেননা আমি আজও এক বাঙালি।
আমার জন্ম এই বাংলায়।
না, কোন না পাওয়ার বেদনা থেকে নয়,
বরং যখন দেখি স্মৃতির পরতে আঁচড়ে লেখা
বীর বাঙ্গালির সেই রক্তঝরা বায়ান্ন, ঊনসত্তর
আর একাত্তরের বীরত্বগাথা , আমার হৃদয় গর্বে ভরে যায়।

ক্ষণিকের মাঝেই সেই অহমিকা ধূলি কণার মাঝে
পদপিষ্ট হয়, যখনই মনে হয় বীভৎস সে
পঁচাত্তর, আশি, ঊননব্বই আর পঁচিশে ফেব্রুয়ারি ২০০৮
কোথায় লুকাবো আমি আমার সেই লাঞ্ছনা?
অপবাদ? আর ধিক্কার ধ্বনির ব্যঞ্জনা?
তবে আমাদের আজ সবই অতীত? সবই কেবল স্মৃতিগাথা?
তবে কি আজ আমরা শুধুই সেই বীর
বাঙ্গালিদের বিবর্জিত বিবর্তিত এক নিকৃষ্ট স্বত্বা ?

১,১৩৬ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : ““কি অয় এই সনদ দিয়া? সনদ দিয়া কি পেট ভরে??””

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ১ম।

    ভালো লাগে নাই।

    পরে হয়তো বিস্তারিত বলার সুযোগ করে নিবো।

    :teacup:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তিনিও দেশের জন্য যুদ্ধে নামেন।

    কোন ভাষণ? ৭ই মার্চ?
    ২৬ শে মার্চের ভাষণ অল্প লোকই শুনেছিলো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।