জীবন থেইকা মাধুর্য উইড়া গেছে

বৃহঃস্পতিবার আসলে আগে একটা ফিল পাইতাম। এই ফিল প্রথম আসে স্কুল-কলেজে থাকতে। যেইখানে পড়তাম ওইখানে শুক্কুরবার সকালে পিটি-প্যারেড করতে নামা লাগতো না। আর বৃহঃস্পতিবার রাতে আমাগো ভালো-মন্দ খাইতে দিত। ওইটারে আমরা বলতাম— স্পেশাল ডায়েট। জেলখানার কয়েদিদের যেমন বিশেষ দিবস আসলে এইরকম খাবার খাইতে দেয়। আর বৃহঃস্পতিবার রাতে মুভি শো হইতো৷ দল বাইন্ধা আমরা বিদেশি সিনেমা দেখতাম৷ যদিও ইলেভেন-টুয়েলভে সিনেমা না দেইখা, মোবাইলে তৎকালীন প্রেমিকার লগে কথা কইতাম বা পছন্দের জুনিয়র ডাইকা গান শুনতাম, গল্প করতাম, ডায়েরি লিখতাম। বৃহঃস্পতিবার আইলে মনের মইধ্যে একটা সুখ সুখ ভাব হইতো৷ মনে হইতো কালকে ঈদ। সকালে একটু ঘুমাইতে পারবো। কিন্তু শুক্কুরবার সকালে স্বভাবসুলভ ঘুম ভাইঙা যাইতো আর ঘুম আসতো না।

ভার্সিটি লাইফে বৃহঃস্পতিবার রাত কাটতো এসএম হলের ছাদে কিংবা ক্যান্টিনের ছাদে। সেইখানে বইসা আমরা ক্যানাবিস কেন্দ্রিক ডিসকোর্স নিয়া আলোচনা করতাম আর কাউরে কাউরে গাজাকার বা গাজাউলিয়া বা গাজ্জালি উপাধি দিতাম। রাতে খাইতে যাইতাম চাংখারপুল বা পুরান ঢাকায়৷ একটা থ্রিল আছিল লাইফে তখন। ভার্সিটির শেষ দিকে বিটিভির একটা প্রোগ্রামে কাজ করতে গিয়া শুক্কুরবার খুব সকালে ওঠা লাগতো৷ টেকা পয়সা মোটামুটি যা পাইতাম তা দিয়া চইলা যাইতো দেইখা শুক্কুরবার সকালে বেলা করে ঘুমানোরে বিসর্জন দিতাম ভাবতাম এইভাবে মরার মত ঘুমানোর চাইতে টাকা কামানো ভালো৷ সেই থেইকা বৃহঃস্পতিবার রাত আইলে পরদিন ঘুম থেইকা ওঠার একটা তাড়া ফিল করি।

কর্মজীবনে ঢুইকা দেখি আসলে সবার মইধ্যে একটা ঈদ ঈদ ভাব চইলা আসে। এইটারে আমি উপভোগ করি। রিসেন্টলি রাইটার শাহাদুজ্জামানের একটা গল্প খুব টানছে সেইটার নাম ‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহঃস্পতিবার’। যেইখানে দেখানো হইছে লাইফের পৌনঃপুনিকতাকে, শিস দিয়া বাড়ি ফেরা এক যুবকের বয়ানে। আমিও আমার বহু কলিগেরে বৃহঃস্পতিবার আসলে এইরকম শিস দিতে দেখি৷ কিন্তু সেই শিস কানে না আসলেও অন্তত মনের মইধ্যে বাজে৷ আমি জন্মাইছে বৃহঃস্পতিবার৷ ফলে এইদিন আসলে আম্মা আমারে নিয়া ভয়ে থাকে৷ সে আমারে জানায় আমি বিশ্যুদবাইররা পোলা। বিশ্যুদ বাইরা পোলাগো অনেক নিয়ম মাইনা চলতে হয়। যেমন এইদিন নখ কাটা যাবে না। ঝাড়ুর শলা গায়ে লাগানো যাবে না। আরও অনেক কিছু যা আর মনে পড়তেছে না। তো, এইসব নিষেধাজ্ঞার মইধ্যে বড় হইয়া এই বয়সে বৃহস্পতিবার আসলে আমার মধ্যে কেমন একটা সেল্ফ সেন্সরশিপ কাজ করে। যে কথা বলতে চাই, বলা হয় না৷ যে কাজটা করতে চাই করা হয় না।

তরিকাপন্থী মানুষদের কাছে বৃহস্পতিবার গুরুবার। এই দিনে তারা আগরবাতি মোমবাতি জ্বালায়া রিচুয়াল পালন করে৷ আমিও কিছুদিন বৃহস্পতিবার অনুরূপ রিচুয়াল পালন কইরা আসছি। দেখছি, ওই সময়টা আসলে সপ্তাহের অন্য ছয়দিনের ক্লান্তি ভুলাইয়া দেয়৷ মাথার জাংক চইলা যায়। বহুদিন বৃহস্পতিবার ওই রকম গোল হইয়া বসিনা। আল্লাবিল্লা করিনা, দয়াল-মুর্শিদরে স্মরণ করি না৷ জীবন থেইকা মনে হয় মাধুর্য উইড়া গ্যাছে৷ ভাবতেছি আগামি সপ্তাহ থেইকা আবার গুরুবার পালন করবো৷ আমাদের প্রচুর পালন করা দরকার।

গতবছর (২০১৯) রোহিঙ্গা শিবিরে গবেষণা কাজে গিয়ে দু’টো কম্বল কিনছিলাম ওদের লোকাল মার্কেট থেকে। ত্রান পাওয়া তেল, নূন, সাবানসহ বহু জিনিস রোহিঙ্গারা বেঁইচা দেয় ফলে ওইখানে একধরণের মার্কেট ইকোনমি গইড়া উঠছে। আমার ইচ্ছা ছিল ওদের মার্কেট ইকোনমিতে পার্টিসিপেট করা আর স্বল্প মূল্যে দুইটা কম্বল পাওয়া। UNHCR -এর ছাপ্পা সম্বলিত সিলভার কালারের কম্বল দু’টির দাম পরেছিল ৩৫০ টাকা। সেই কুতুপালং থেকে হোটেল নিসর্গ হয়ে বিমানযোগে বহু কায়দা করে টেনে নিয়ে এসেছিলাম কম্বলদ্বয়কে। গত বছর তীব্র শীতে কম্বল দুটি ভালোই সাপোর্ট দিয়েছিল। এবং প্রথম যে রাতে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম, স্বপ্নে দেখলাম বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে আমি শরণার্থী হয়ে রাত কাটাচ্ছি। কেন এমন স্বপ্ন দেখলাম বুঝে উঠতে পারলাম না।

রিলিফের কম্বল গায়ে দেই বলে আমার নিকটজনদের কেউ কেউ জানায়, তাদের বংশের মধ্যে আমিই প্রথম রিলিফের কম্বল গায়ে দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছি। রিলিফের কম্বল গায়ে দেয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম না। আমি যে স্কুল কলেজে পড়ছি ওইখানে শীতের সিজনে আমাদের রিলিফের কম্বলই দিত। একটা কালো কুচকুইচ্চা কম্বল, গায়ে দিলেই গা কুটকুট করতো কারণ ওইগুলা বছরের বাকি দশ মাস স্টোর রুমে পড়ে থাকতো। আর একটু সিনিয়র হইলে রঙ্গিন কম্বল পাইতাম, একটা বেটার কোয়ালিটির। ক্লাস সেভেনে বইসা আমি ক্লাস টুয়েলভে উঠতে চাইছিলাম ওই রকম কম্বলে ঘুমানোর জন্য। এমন না যে এর চেয়ে বেটার কোয়ালিটির কম্বলে আমি ঘুমাই নাই। আমার পিতা সেই আশির দশকে জেদ্দা থেইকা দুইটা কম্বল আনছিল যেগুলা ভেড়ার পশম দিয়া তৈরি। ওই সময়ে আমি শীতকালের অপেক্ষা করতাম শুধুমাত্র ওই কম্বলে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু ওই কম্বলের উল্টা দিক আর বাইল দিক আমি আউলাইয়া ফালাইতাম। ফলে খসখসা পার্ট গায়ে দিয়া ঘুমাইয়া গেলে আব্বা রাতে আইসা উলটা পার্ট কম্বল গায়ে দিয়া ঘুমাইছি বলে রাগ করত। এবং সে কম্বল উঠায়া ঠিক সাইড গায়ে দিয়া দিলে ওই স্বল্পদৈর্ঘ্য বিরতিতে আমার রানে ঠান্ডা লাইগা যাইত। মনে মনে বিরক্ত হইয়া কম্বলের অপর সাইড আবার ওম দিতে থাকতাম। এরপর শীত গেলে আম্মারে দেখতাম রোদ দিয়া কম্বল দুইটারে আবার তিন তালায় (কাঠের ঘরের) উঠায়া রাখতো। উঠায়া রাখার সময় বলত, বড় কম্বলট তোর। যখন বিয়া করবি তখন তোরে এইটা উপহার দেব।

আবার মনে পড়ে গেল, হল লাইফে আমি আরেকটা রিলিফের কম্বল গায়ে দিতাম যেইটা সম্ভবত সিডরের সময় পাইছিলাম। (বাড়ি বাড়ি আইসা দিয়া গেছিল। কারণ, সেবার মানুষের তুলনায় ত্রান আসছিল বেশি। ফলে, রুরাল কনটেক্সটে মার্জিনাল না হইয়াও এইরকম বহু জিনিস পাইছিলাম।) রিলিফের কম্বল গায়ে দিতে আমার আরামই লাগে। বিশেষ করে শীতের দিনে বাড়ি গেলে আমার আব্বার আনা ওই দামি কম্বলে ঘুম না আসলে আমি রিলিফের কম্বল গায়ে দিয়া ঘুমাইলে আম্মা আমারে বলতো আমার অধঃপতন হইছে।

এইবার ঢাকায় শীত ভালোই। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এমন লাগাতার শীত আর পরে নাই। খুব শীত পরলে আমি খুশি হই দুইটা কারণে, প্রথমত এক বন্ধুর দেয়া একটা ওভার কোট যেইটা তীব্র শীত না পরলে পরা যায় না, দুই রিলিফের কম্বল গায়ে দিতে পারার সুখ। কারণ, রোহিঙ্গা শিবিরের ওই কম্বলের ভেতর অলটাইম ২৪-২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বিরাজ থাকে। আরেকটা সুবিধা, এই কম্বল অটো গরম হইয়া থাকে। তো আমার স্ত্রী আমার বাসায় আইসা যখন দেখলো আমি রিলিফের কম্বল গায়ে দেই তখন সে তার দামি একটা কম্বল আমারে দিতে চাইলো। আমি তারে জানাইলাম, আমার রিলিফের কম্বল গায়ে না দিলে ঘুম আসে না। আজকে ঢাকায় কত তাপমাত্রা জানি না। রিলিফের কম্বল গায়ে দিয়া এই লেখা লিখতে লিখতে দেখি এখন আর ঘুম আসতেছে না। কম্বল সরাইয়া রাখলাম, কোন শীত নাই। শীত কি তাইলে প্রতারণা করা শুরু করলো?

৮২ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।