ছবির ফ্রেম

পুরনো ডায়রিটা খুলে হঠাত্‍ করেই তিথির মন খারাপ হয়ে গেল। ডায়রির মাঝে রুদ্রের একটা ছবি। বাতাস লেগে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।রুদ্রের স্মৃতি বলতে তিথির কাছে এটুকুই। পনের বছর আগের ছবি।অনেক কষ্টে তিথি ডায়রিতে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ দেখে ফেললে বিপদ। বিবাহিতা স্ত্রীর কাছে স্বামী ছাড়া অন্য যে কারো ছবি থাকাটা গুরুতর অপরাধ। তিথি জানে। তারপরেও রুদ্র বলে কথা। একটা সময় ছিল যখন তিথির প্রতিটি নিশ্বাস জুড়ে ছিল রুদ্র। অনেকটা পথ হাতে হাত রেখে ওরা পাড়ি দিয়েছিল। তারপরেও নিয়তি নামের এক অদৃশ্য বস্তু আমাদের জীবনটাকে নিয়ন্ত্রন করে। আর তাই হয়তো জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অনিশ্চিত।

তিথির জীবনে রুদ্র ছিল অতিথির মত। খুব ভালো গান গাইত বলে তিথি ছিল ক্যাম্পাসের সবার প্রিয় মুখ। ভার্সিটির কোন এক বর্ষবরনে তিথির সাথে রুদ্রের পরিচয়। বরাবর ই কিছুটা ভাবুক প্রকৃতির ছিল রুদ্র।নিজে স্বপ্ন দেখতো। আর সব স্বপ্ন জুড়েই থাকতো তিথি। রুদ্র বলতো ‘তিথি,একদিন তুমি অনেক বড় গায়িকা হবে। সাড়া দেশের মানুষ তোমাকে একনামে চিনবে।সাথে আমাকেও। আমি তোমার গীতিকার তো তাই. . .কথাটা বলেই রুদ্র হো হো করে হাসি শুরু করতো। রুদ্রর অনেকগুলো বাজে অভ্যাসের মধ্যে এটি একটি। সব কথার শেষে হাসি। তিথি রুদ্রকে থামিয়ে দিয়ে বলতো ‘আচ্ছা রুদ্র,যদি কোনদিন আমি হারিয়ে যাই তোমার কাছ থেকে। দূরে অনেক দূরে।সেদিন ও কি তুমি এমনি করে হাসবে?ঠিক আজকের মত। কথাটা শুনে রুদ্রর হাসির বেগ আরো বেড়ে যেত।তিথির কাঁধে হাত রেখে বলতো ‘গান ছেড়ে ইদানিং দর্শন চর্চা হচ্ছে বুঝি? দাঁড়াও কাল ই আমি প্লানচেট করে প্লেটোকে আনবো। বলবো ‘স্যার,তিথি নামের এই মায়াবতী মেয়েটি আপনার কাছে পড়তে চায়। আপনি ওকে একটু পড়াবেন? হা হা হা।রুদ্রর হাসি শুনে তিথির গা জ্বলত।কিছু কিছু মেয়ে আছে রাগলে আরো সুন্দর লাগে। তিথিও সে রকম। আর তাই রুদ্র মাঝেমাঝেই এমন করত। তিথিকে রাগিয়ে ওর লাবন্যময় মুখটা দেখতো। আর ভাবতো কোন এক ভুল জন্মের স্মৃতিস্মারক তিথি। তিথি বলতো ‘দর্শন পড়তে প্লেটোর কাছে কেন যাবো? আপনি কি তবে ঘাস কাটবেন? আমি আপনার কাছে পড়বো।কি পড়াবেন না? তিথির কথা শুনে রুদ্র বলতো ‘তোমার মত ছাত্রী পাওয়া তো আমার সাত জন্মের ভাগ্য।ভাগ্যিস শরত্‍চন্দ্রের সময়ে জন্মাও নি।তাহলে দেবদাসের নায়িকা পার্বতী না হয়ে তুমি হতে। তিথি বলতো ‘তাই আর তুমি বুঝি দেবদাস হয়ে ঢাকার রাস্তায় তিথি তিথি করতে? রুদ্র বলতো ‘আমি দেবদাস হবো কেন?ও তো ব্যর্থ প্রেমিক। আমি হতাম প্যারিস।তোমাকে হেলেন বানিয়ে পুরো ঢাকা শহরে ট্রয় নগরীর মত আরো একটি উপাখ্যান রচনা করতাম। চে গুয়েভারার মত বিদ্রোহী প্রেমিক হয়ে তোমাকে পাওয়ার জন্য ভালোবাসার মিছিল দিতাম। এবার তিথি হাসল।বলতো ‘থাক,ঢাকা শহর ঢাকা শহরের মতই থাক।শুধু শুধু আমার জন্যে ঢাকা শহরের এক কোটি মানুষ গৃহহীন হবে কেন? তোমাকে কিছুই করতে হবেনা।আমাকে পেতে হলে অল্প একটু ভালোবাসা দিও এতেই চলবে. . .

রুদ্র ছিল অনেটা আকাশের মত। তিথির অভিমান গুলো সেখানে মেঘ হয়ে জমত। কখনো বিষাদ শ্রাবনে তিথির মেঘ গুলো যখন আরো ঘনীভূত হত তখন ই তা বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ত রুদ্রর চোখ থেকে। তিথির মনে পরে কোন এক জন্মদিনে রুদ্র তিথিকে একটা শাড়ী উপহার দিয়েছিল। আকাশী রঙ তিথির খুব পছন্দ। অনেক খুঁজে তাই তিথির জন্য এই শাড়ীটা কিনেছিল রুদ্র। রুদ্রের অনেক কষ্টের উপার্জনের টাকা। তিথি জানতো ‘হয়তো এই শাড়ী কেনার জন্যে গত কয়েক মাস ধরে রুদ্র টাকা জমিয়েছে।হয়তো বন্ধুরা ফাস্টফুড খেতে রুদ্রকে ডাকলে ও বলেছে ‘দোস্ত পেটটা কয়েকদিন ধরে ভালোনারে।তোরা খা। আমি দেখি।. . .কিংবা এও হতে পারে গত কয়েকমাসে রুদ্র তার সিগারেট খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দিনে একটা বা দুইটা।কোনদিন হয়তো তাও না। তিথির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।একটা মানুষ তাকে এত ভালোবাসে কেন? একটু কম ভালোবাসলে কি হয়। শাড়ী হাতে পেয়ে তিথির খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। কিছু কান্না আছে আনন্দের। হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা অজস্র ভালোবাসার একফোঁটা নিরেট অশ্রুবিন্দু। তিথি কখনো শাড়ী পরেনি।রুদ্রের কথা মত একদিন এই শাড়ী পরে এসেছিল। সেদিন রুদ্র তিথিকে বলেছিল ‘পৃথীবিটা কি জানে,তার চেয়েও সুন্দর আকাশ আমার আছে. . . .

তিথির যখনি মন খারাপ থাকতো তখনি সে এই শাড়ী পরত।মনেহত রুদ্র ওর সমস্ত শরীরে জড়িয়ে আছে। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো যে এত তীব্র এত প্রখর তা তিথি বুঝিছিল রুদ্রর কাছ থেকেই। একবার তিথি রুদ্রকে একটি ছবির ফ্রেম উপহার দিয়েছিল। রুদ্র ছিল শখের ফটোগ্রাফার। ফ্রেম দেয়ার পর তিথি বলেছিল ‘খুব সুন্দর একটি ছবি তুলে ফ্রেমে বাঁধাই করবে। এরপর আমাকে দেখাবে,মন থাকবে? রুদ্র বলেছিল ‘দেখ,আমার মেমোরী গোল্ড ফিশের মত না। তোমার কোন কথা কি আমি ভুলে গেছি? তিথি বলল ‘তা যাও নি। তবে কে জানে। ভুলে যেতেও পারো। একসময় আমাকেও। রুদ্র তিথির চুল ধরে টান মারলো। বললো ‘এরপর এধরনের কথা বলবেনা। আমার অনেক কষ্ট হয়…
পরদিন রুদ্র ফ্রেম নিয়ে এল। দু জনের একটা ছবি খুব সুন্দর করে বাঁধালো। তিথি যতটা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে। মুচকি হেসে তিথি বললো ‘এটা তোমার কাছে রেখে দাও। স্মৃতি হিসেবে থাকুক। এই প্রথম রুদ্রের চোখে পানি এলো। তিথি শুধু বললো ‘এত অল্পতেই চোখ ভিজে গেল? তুমি যে সারাক্ষন এইসব কথা বলল। তিথির কাজল কালো চোখ ভিজে যাওয়ার আগে রুদ্র তার সেই চিরচেনা হাসি দিয়ে বলল ‘চল বৃষ্টিতে ভিজি। এখানে বসে কাঁদলে লোকজন তো আমাদের পাগল বলবে। তাও ভালো বৃষ্টির মাঝে কেউ তোমার ভেজা চোখ খেয়াল করবেনা। তিথি কোন ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো ‘পাগল একটা,চলো. . . ….ঝুম বৃষ্টির ঢাকা শহর সেদিন তাকিয়ে দেখলো একজোড়া কপোত কপোতির পাগলামি।. . . . .

ভালোবাসাবাসির মুহূর্ত গুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। প্রিয় মানুষ গুলোর কাছাকাছি থাকার সময় গুলো কখনো কখনো ছবির ফ্রেমের মত। জীবন্ত অথচ নির্জীব নিষ্প্রান।যে মানুষ গুলো একসময় আমাদের চারপাশ জুড়ে থাকতো তারা হয়ে যায় স্মৃতি।তিথির আকাশে রুদ্রের উপস্থিতিটা অনেকটা এমন ই।সম্পর্কের একটা পর্যাযে রুদ্রের ধরা পরে কোলন ক্যান্সার।প্রথম প্রথম তিথিকে রুদ্র বুঝতে দিতনা।এড়িয়ে যেত।রুদ্রের হঠাত্‍ পরিবর্তন তিথি মানতেও পারেনি।তবে তিথি বুঝতে পারতো রুদ্রের কঠিন কিছু হয়েছে।সেই হাসিমুখটা অনেকটাই বিমর্ষ।উদাসীন।একদিন হুট করে তিথির হাতে একটা বক্স ধরিয়ে রুদ্র বলে ‘আগামী কাল ভোর পাঁচটার ফ্লাইটে আমেরিকা যাচ্ছি।প্লিজ জানতে চেওনা কেন।বাসায় গিয়ে বক্সটা খুলবে।আমি আসি।ভালোথেকো…
তিথিকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত রুদ্র দেয়নি।শুধু তাকিয়ে ছিল রুদ্র চলে যাওয়ার পথের দিকে অবাক দৃষ্টিতে।

আজ থেকে পনের বছর আগে কোন এক বিষন্ন সন্ধ্যে বেলা। তিথি নামের একুশ বছরের একটি মেয়ে কাঁদছে। রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে। পাশেই খোলা রুদ্রর চিঠি। একটু পর পর তাকাচ্ছে রুদ্রর ফেরত দেয়া ফ্রেমটির দিকে। যেখানে শুধু রুদ্রের ছবি। তিথির অংশটুকু রুদ্র ছিঁড়ে রেখে দিয়েছে। রুদ্র কিছু ভয়ংকর কথা লিখেছে চিঠিতে

”তিথি,
প্রথমেই বলে নিচ্ছি কাঁদবেনা। হাতের লেখা যেন সুন্দর হয় এজন্য জেল পেন দিয়ে স্কেল টেনে টেনে লিখেছি। তোমার চোখের পানিতে আবার যেন মুছে না যায়। তাহলে ছোট্ট এই পৃথীবির বুকে বাঁচার যে শেষ ইচ্ছেটুকু আছে তাও কিন্তু বিলীন হয়ে যাবে। মনে পরে? আকাশে মেঘ দেখলে তুমি বলতে দেখ রুদ্র আকাশে দুটো মেঘ। একটা ছেলে আরেক টা মেয়ে। এরা দু জন দু জনকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু যখন অভিমান হয় তখন একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে।তখন এদের কষ্টগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরে।ঠিক তোমার আর আমার মত। তোমার কথা শুনে দেখতাম আকাশে মেঘের বিন্দু মাত্র চিহ্ন নেই অথচ তোমার দু চোখ ছলছল করছে,তুমি নিশ্চই অবাক হচ্ছো তোমার দেয়া ফ্রেম কেন ফিরিয়ে দিয়েছি। আমাদের ছবিটা কেন দুই ভাগ করা। শোন,ক্যান্সার নামের এক ভয়াবহ কাঁচি ছবিটাকে দু ভাগ করতে বাধ্য করেছে। তোমার ভাগ আমার কাছে থাকুক আর আমারটা তোমার কাছে। আসলে জীবনটা ছবির ফ্রেমের মত।স্মৃতি বদলের সাথে সাথে ছবির ও পরিবর্তন হয়।কিছু জীবন আছে একটি স্মৃতিই ধরে রাখে। একসময় ফ্রেম পুরনো হয়ে যায়। ছবির মানুষটি ঝাপসা থেকে ঝাপসা তর হয়। জীবন চলে তার নিজস্ব নিয়মে।
স্মৃতি বদলের মত ছবি ও বদলায়। তোমার জীবনে আমি ছিলাম স্মৃতি। একসময় তোমার জীবনে অন্য কেউ আসবে। তাকে নিয়ে জোছনা বিলাস করবে। আমি না হয় তারা হয়ে তোমাদের দেখবো। আচ্ছা মানুষ মরে গেলে নাকি তারা হয়ে যায়।তুমিতো দর্শন ভালোবাসো। আমাকে একটু জানিওতো।
তুমি নিশ্চই কাঁদছো। শোন জীবনের চরম বাস্তবতা এমনই। তোমার জীবনটা নষ্ট হোক তাও চাইনা। তোমার জীবনে নতুন কেউ আসবে। যাকে নিয়ে সুখের সংসার করবে। প্রথম প্রথম মন মানবেনা। কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে। আমার জন্যে। অনেক কষ্টে আমেরিকা যাওয়ার টাকা জোগাড় হয়েছে।ও তোমাকে তো বলাই হয়নি। আমি একটা এন জি ও তে কাজ করতাম। অনেকটা অফিসিয়াল কাজ। পোস্ট টা ছোট বলে তোমাকে কখনো বলিনি। ওরাই আমাকে আমেরিকায় আসার খরচ দিয়েছে। আমার বেঁচে থাকার খুব ইচ্ছে। যদি দেশে ফিরে আসি তবে তোমার জন্যে একটা নীল শাড়ী নিয়ে আসবো।অই শাড়ীটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে তাইনা।ভালো থাকার চেষ্টা করো. . . . . . . . . . .

রুদ্র

তিথির বিয়ের সময় অনেক জিনিসের সাথে ছবির ফ্রেমটাও তিথি সাথে করে শশুড় বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। তিথির শাশুড়ী একবার ঘর গোছাতে গিয়ে ফ্রেমটা দেখে বললো ‘তিথি মা,ফ্রেমটা ফাঁকা কেন? আজ ই তোমার আর আশরাফের যে যুগল ছবিটা আছে তা দেয়ালে টানিয়ে দাও। বাচ্চা মেয়ে,এটুকুও বলে দিতে হয়। মাঝমাঝে তিথির খুব ইচ্ছে হয় তিথির ছবির পাশে রুদ্রর ছবিটা লাগাতে। মাঝেমাঝে ডায়রিটা খুলে রুদ্রর ছবি বের করে। হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে আবার রেখে দেয়। তিথির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। একসময় চোখের কোন ঘেঁষে ঝড়ে পরে অজস্র বেদনার এক ফোঁটা লোনা অশ্রুবিন্দু. . . . . . . . . . .

…………………………………………………………………………………..

৩,০৭৯ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “ছবির ফ্রেম”

  1. আসাদুজ্জামান (১৯৯৬-২০০২)

    কিরে ভাই, তোমার সমস্যাটা কি???? ছ্যাঁকা ট্যাকা খাইছো নাকি?? 😉 এইসব বিরহগাথা দিয়া জাতিরে আর কাঁন্দাইও না। :(( ট্র্যাজেডি মানুষে বেশি খায়। বেশি খাওয়াইতে যাইয়া আর দুঃখ দিও না। :no:

    আশা দাও, ভরসা দাও, স্বপ্ন দেখাও।

    লেখা ভালো ছিল।

    অফটপিকঃ শরৎ, রবীন্দ্র, সমরেশ, হুমায়ুন সবাই নারীকে অতিরিক্ত ভালোবাসতো বলেই কিনা বহু লেখায় মহান করছে। পোলারা যতটা ঐগুলা পড়ছে (এবং পইড়া নারীর আরো প্রেমে পড়ছে), মাইয়ারা মনে হয় অতটা পড়ে নাই(কারন পড়লে আরো মহান হওয়ার চেষ্টা চালাইতো) আর পড়লেও হয়তো ভাবে যে আমরা তো এমনই (হউক বা না হউক)। তাই তাদের ভাব আরো বেড়ে যায়। :khekz: (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।