রজনীগন্ধার ঘ্রাণ
রজনীগন্ধা নিয়ে মাতম ছিলো একদা। আমাদের কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে বাগানের দু’ধারে ফুটে থাকতো সারিসারি রজনীগন্ধা। বাজারি রজনীগন্ধার সাথে এই রজনীগন্ধার তফাত ছিলো বেশ। মূলত এর গন্ধ আচ্ছন্ন করে রাখতো আমাকে। আধাসামরিক আবাসিক বিদ্যাপিঠে বিবিধ নিয়মের ভেতরে ছিল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা। একটু সিনিয়র হবার পর প্রায়ই রাতের ডিনার শেষে রজনীগন্ধার গন্ধযুক্ত হাসপাতালের পথে হাঁটতাম। শরতের রাতে আকাশে যখন ঝুলে থাকতো শারদীয় জোছনা, আর হৃদয়ে ভর করতো প্রেমের দিন, রজনীগন্ধার দু’একটা ডাল তুলে এনে হাতে করে নিয়ে যেতাম ক্লাসরুমে। প্রায়ই এমন হতো, হাতের উষ্ণতায় রজনীগন্ধা নেতিয়ে পড়তো, ফেলে দেয়ার পর দেখতাম হাত থেকে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ আসছে। সেই গন্ধ কখনো কখনো মুছে না ফেলে ফিরে যেতাম ডরমেটরিতে। আরেকটু সিনিয়র হবার পর রজনীগন্ধার সাথে সৃষ্টি হলো অদ্ভুত বন্ধুত্ব। এস এস সি পরীক্ষার সময়কে আমরা বলতাম ‘ক্যান্ডিটেট টাইম’। পি,টি প্যারেড আর কলেজের নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে তখন একটু অবসর মিলতো তখন। প্রায়ই হাউসের বাগানে ঢুকে রজনীগন্ধা এনে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতাম মগে। মগই তখন অস্থায়ী ফুলদানি। দেখতাম, পুরো রুম কেমন আচ্ছন্ন করে রেখেছে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ। তিন চারদিন সে গন্ধ থাকতো। একসময় পানি সবুজ বর্ণ হয়ে যেত, নেতিয়ে পড়তো রজনী গন্ধার শাদা পাপড়ি।
তখন চিঠিই ছিল বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কাঠিন্যের মাঝে পিতামাতা ছাড়াও মানসিক মুক্তির জন্য এক তরুণীর সাথে চিঠির আদানপ্রদান হতো আমার। খামে নাম পালটে তাকে পাঠাতাম অপরিপক্ক হাতে লেখা চিঠি। সে চিঠির মাঝে হয়তো রজনীগন্ধার কিছু পাপড়িও থাকতো। সে সময়ে পারফিউমের প্রতি ঝোঁক ছিলো বেশ। প্রতি টার্মে কলেজের আবাসিক হাউসে সাথে করে নিয়ে যেতাম নতুন নতুন বডি স্প্রে। মনে পড়ে, চিঠিগুলোতে প্রায়ই সে পারফিউম মেখে দিতাম। যেন চিঠির প্রাপক পড়ার সময় স্মৃতির ঘ্রাণকেও অনুভব করতে পারে। তবে রজনীগন্ধার পাপড়ি পাঠাবার সময় আর কোন পারফিউম দিতাম না। এভাবে, আধাসামরিক অঙ্গনের রজনীগন্ধা ডাকবিভাগের দুই টাকার খামে করে পৌঁছে যেত বরিশাল শহরের এক নিরিবিলি গৃহে।
উপহার দিতে ভালোবাসতাম। ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লেখা থাকতো বন্ধুদের জন্মদিনের তারিখ। প্রতিবার ছুটির শেষে কলেজে ফেরার সময়ে বরিশালের বুকভিলা লাইব্রেরি থেকে কিনতাম বই। সবাইকে হয়তো দেয়া হতো না। যারা কাছের বন্ধু তাদের জন্মদিনে বই দিতে ভালো লাগতো। তখন হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া খুব কম লেখককেই চিনতাম। বইয়ের সাথে কিনতাম চকমকি গিফট পেপার। যখন প্রিয় কারো জন্মদিন থাকতো, সেই গিফট পেপারে নিজ হাতে কস্টেপ দিয়ে বইটি মোড়াতাম। এরপর হাউজ গার্ডেন থেকে রজনীগন্ধা, গোলাপ, হলিহক্স কিংবা বিদেশি কোন ফুল এনে কস্টেপ দিয়ে লাগাতাম। সেখানে চিরকুটে লেখা থাকতো প্রিয় বন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা সম্বলিত কোন কবিতার লাইন। রাত বারোটার পর হয়তো নীরবেই ওর রুমে রেখে আসতাম উপহার, কখনো সামনাসামনি দিতাম। উপহারের মোড়ক উন্মোচনের এক মায়াবী প্রেক্ষাপটে তখন নিজেকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। কলেজ থেকে চলে আসার শেষদিকে অনেক কিছু মিস করার সাথে মিস করছিলাম কলেজের বাগানকে। সারাবছর যেখানে ফোটে গোলাপ, রজনীগন্ধা সহ দেশিবিদেশী অনেক ফুল। মনে হতো, এই চত্বর থেকে চলে গেলে হয়তো এতো তাজা ফুল আর কোথাও পাবো না। এই শহরের জমাটবাধা নিঃসঙ্গতায় খুব মনে পড়ে রজনীগন্ধা তোলার সেই দিনগুলোর কথা। কি নির্ভার জীবন ছিলো তখন। এর অনেকদিন পর রজনীগন্ধার ঘ্রাণ ছেড়ে আসা জীবনের পাল্টানো প্রেক্ষাপটে সিটিলাইফের এক কর্মক্লেদান্ত রাতে অচেনা ফেসবুক আইডি থেকে রজনীগন্ধা ফুলের শুভেচ্ছা আসে। জানি না ঠিক কি কারণে কোন রকম দিবস ছাড়া এই আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা বার্তা আমাকে পাঠায় এক অপরিচিতা। তবে, অনেককাল পর এই বার্তা পেয়ে আমার মন ফিরে যায় সেইসব রাতের কাছে। যে রাত গুলোতে আমি রজনীগন্ধা কুড়াতাম আর তার ঘ্রাণ লেগে থাকতো স্মৃতির বুক পকেটে।
আয়না
ভাবা যাক অনেকদিন আয়না না দেখা এক যুবককে কোন এক তরুণী এক আশ্চর্য আয়না উপহার দিলো। আয়নার সাথে জুড়ে দিলো এক রহস্যময় চিরকুট। তরুণী লিখলো, আয়না ও যৌনক্রিয়া ঘৃণ্য বিষয়, কেননা উভয়ই মানুষের সংখ্যাকে বহুগুণিত করে। লিখলো, বোহের্সের এই উক্তি আসলে সর্বদা প্রযোজ্য নয়। মূলত চলমান মূহূর্তে মানুষ আয়নার দাসত্বকে বরণ করে নিয়েছে বলেই এতো বিভ্রান্তি। আয়না মাঝেমধ্যে মানুষের সংখ্যাকে গুনীতক করে না, বরং মানুষ আয়নার সামনে দাঁড়ালে আরো একা অনুভব করে। তখন সে ভাবে, আয়নার মাঝে যে মানুষটিকে দেখা যাচ্ছে তাঁর অস্তিত্ব থাকলে পৃথিবীর বিপুল বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি মিলতো। সে জানালো, আয়না আবিষ্কারের অনেক পূর্বে যখন জলে মানুষের ছায়া পড়তো, ক্লান্ত-ক্লেদান্ত মানুষ তখন নিজেকে দেখে বিভ্রান্ত হতো।
মানুষ মূলত নিজেকে দেখতে ভালোবাসে, তাই তাঁর আয়না প্রিয়। তখন আমাদের মনে পড়বে গ্রিসের সেই রূপস যুবকের কথা, স্বচ্ছ জলে যে তার মুখাবয়ব দেখে মুগ্ধ নয়নে নিজের প্রেমে পড়েছিল। মূহুর্তের পর মুহূর্ত নিজের দিকে তাকিয়ে সে পরিণত হয়েছিল একটা ফুলে। আত্মপ্রেমের এ যুগে, এইসব মায়াবী রূপকথা প্রাসঙ্গিক হলেও নিজের দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকার সময় নেই কারো। যে যার মতো ছুটে চলা এ নিদারুণ ব্যস্ততার শহরে নিজেকে দেখার মতো ঝুঁকি মানুষ নেয় না। নিজেকে দেখলেই চোখে পড়বে, অনেক আগে যে শিশুর সারল্য লেপ্টে ছিলো মানুষের মানচিত্রে, সে সারল্য ক্রমশ এসে ঢেকে দিচ্ছে নাগরিক কমপ্লেক্সিটি।
বিভ্রান্তের এ শহরে সদ্য প্রেমে পরা কোন যুবক মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলেনা, আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন,
কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে….
বকুল শাখে যে ফুল ফোটে, নাগরিক ভ্রমর তাঁর খবর রাখে না বলে এমন অনেক নিঁখুত বিউটিস্পট প্রেমিকের চোখে আড়াল রয়ে যায়। কিংবা এই পাল্টানো সময়ের ঘেরাটোপে মানুষ হয়তো ভুলে গ্যাছে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা। কিংবা হয়তো জানেই না, গভীর দুঃখে দুঃখী হয়ে, মুখোমুখি বসে অবসরে দুটি আইস্ক্রিমের বরফজল হবার মর্মান্তিক পরিণতির দৃশ্য দেখার নামই প্রেম।
তারপরও হৃদয়ে প্রেমের দিন আসে। যেসব অভিমানের কোন নিকনেইম নেই, যেসব অনুভূতিকে কিনশিপ টার্ম দিয়ে ডিফাইন্ড করা যায় না, মানব-মানবীর নিবিড় রহস্যময় মনোজগতের মাঝে জাগরূক দ্বীপের মতো তেমনই কিছু সম্পর্ক সুগন্ধ ছড়ায়। হৃদয়ের সমতল পৃষ্ঠে যে মলিন মুখ, যেসব মুখ আমরা লালন করি যত্নে, সেসব মুখের কাছে আমাদের মুখোশ খুলে ফেলে নিজেকে অপর্ণ করি সর্বান্তকরণে, সে সব আপন প্রতিবিম্বের কাছে মানুষ মূলত পরাজিত আলোকরশ্নি। তবুও হৃদয়ের সমকক্ষ কোন আয়না নেই। আয়না ভেঙে গেলে যেমন অজস্র আয়নার জন্ম হয়, তেমনই মানুষ ভেঙে গেলেও অজস্র মানুষের জন্ম হয়। তখন মনের মাঝে চক্রাকারে তাড়া করে ফেরে,
‘প্রতিবার প্রেমে নতুন জনম, জীবন কি করে একটাই?’
মা এবং মায়া
মায়ের তরুণী বয়সের একটা দুর্লভ আলোকচিত্র খুঁজে পাই পুরনো অ্যালবামের মাঝে। নিতান্তই সাদাসিধে একটা শাড়ি পরে, অনাড়ম্বর সাজগোজহীন মলিন মায়াবী মুখে তাকিয়ে থাকেন সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া অষ্টাদশী আমার মা। সম্ভবত যে বছর আমার পিতা প্রথম জেদ্দা থেকে ফিরেছিলেন, আশির দশকের মাঝামাঝি কোন এক নির্জন দুপুরে বিদেশ থেকে আনা ক্যানন ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন স্ত্রীর ছবি। সন্তানহীন যে স্ত্রীকে তিনি রেখে গিয়েছিলেন গ্রামীণ শ্বাপদসংকুল অরণ্যের সমাজে, যেখানে সন্তানহীন নারীদের প্রতিশব্দ বন্ধ্যা কিংবা বাজা।
বরাবরই নিশ্চুপ প্রতিবাদহীন কর্মঠ সহজ সরল আমার মা। তরুণী বয়সে কবিতা লিখতেন, ডায়েরি লিখতেন, সুদূর সে গ্রামে বসে পড়তেন বেগম পত্রিকা। আর প্রচন্ড অভিমানে দূরদেশে থাকা স্বামীর কাছে পাঠাতেন দীর্ঘ চিঠি। সেসব চিঠির কিছু পড়ার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার। রবীন্দ্রনাথের বালিকা বধু কমলা এবং আশালতা উভয় চরিত্রের ছায়া পাই মায়ের মাঝে।
বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে যখন তার কোল জুড়ে আমার জন্ম, তখন পৃথিবীর অনেক কিছুই পালটে যাচ্ছিল। মায়ের রেখা নামের সাথে মিল রেখে তিনি আমার নাম রেখেছিলেন রাব্বী। মায়ের সাথে আমার ঘনিষ্টতা যখন বেড়ে যাচ্ছিল, যখন একটু একটু করে বুঝতে শিখি মায়ের আদর, ঠিক তখন এক যুগ এক বছর আগে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাই পড়ালেখার কারণে। জানি না মায়ের মনে আমার এ নিরুদ্দেশ যাত্রা কি প্রভাব পড়েছিল, তবে গভীর রাতে যখন দু’একটা কুকুরের ডাক শোনা ক্যাডেট কলেজের সে-ই কঠিন পরিবেশে, একা থাকার বিছানায় মা মা বলে চিৎকার করে উঠতাম। আজন্ম চাপা স্বভাবের আমার মা-ও কি কাঁদতেন? বিছানার বালিশে জমে থাকতো তাঁর কান্নার জল?
কৈশোরে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত, মাও বঞ্চিত সন্তানের ভালোবাসা থেকে। কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়িতে গেলে অনুভব করলাম মা আর আমি আসলে পৃথক পৃথিবীতে বাস করি। তাঁর অতিথিসুলভ আচরণের মাঝে কোথায় যেন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম রেখে যাওয়া আমার গ্রামীণ মাকে। গোসল করার পর যার নারকেল তেল দেয়া চুল আমি আচরে দিতাম, যে মাকে আমি আচার বানাতে তেঁতুল আর আমের খোসা ছাড়িয়ে দিতাম, যে মায়ের জন্য আমি মধ্য দুপুরে নলকূপ থেকে পানি এনে দিতাম, বন বাদাড়ে ঘুরে মায়ের জন্য সংগ্রহ করতাম জ্বালানি কাঠ। কখনো মা পিঠা বানাবেন বলে নারকেল ছুলে দিতাম, সুপারির পেকে যাওয়া হলুদ পাতা কুড়িয়ে এনে আউলিতে বানিয়ে দিতাম। কখনো দেখতাম আমাদের নিজস্ব পুকুরে নেমে ধুতে গিয়ে টুপ করে ডুবে যাওয়া কোনো চামচ কিংবা বাটি খুঁজছেন মা। সংসারের সবকিছুর প্রতি ছিল তাঁর নিপুণ যত্ন। কোন কিছুই হারিয়ে যেতে দিতেন না। প্রতিবার খাবারের পর যা বেঁচে যেত দেখতাম তা তিনি তুলে রাখছেন তাঁকে কাজকর্মে সহযোগীতা করা শাহআলম কিংবা হযরত আলীর বৌ কিংবা সোহরাবের জন্য। যারা শুধু গৃহকর্মী নন ছিলেন মায়ের একান্ত আপন আত্মীয়।
যৌবনে এসে মায়ের সাথে দূরত্ব যেন বেড়েই চললো। কবিতা লেখা আমার মা, এখন আর কোন বইই মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারেন না। শাপের মতো তার কোকড়ানো চুল আমি অজস্র দিন আচরে দেবার দুঃসাহসও করি না। পৃষ্ঠা পাল্টানো অধ্যায়ের মতো মতো কি আশ্চর্য পালটে গেলেন আমার মা!
এই শহুরে জীবনে, একা থাকার এই নিঃসঙ্গ জনপদে,দীর্ঘ তেরো বছর ধরে মাকে মনে পড়া সতত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাওয়া এ সময়ে আলাদা ভাবে মনে করতে পারি না আদৌ মাকে কখন মনে পড়ে। তবু রোজ কথা হয়, অনুভব করি মায়ের কন্ঠে কোন ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই, অনুযোগ নেই। শুধু শুনতে পাই একটাই কথা,
কবে আসবি? কবে ছুটি?
মুঠোফোনের এপাশে ভেসে আসে মায়ের কন্ঠ। পৃথক পৃথিবীতে যে যার মতো, আমি ও মা ঢেকে রাখি আমাদের পুরনো ক্ষত।
রাতের রূপরেখা
কৈশোর কাটানো রাতগুলোয় আমাদের বাতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যেও ছিল আইন-কানুন। এমনিতেই আমরা নিয়ন্ত্রিত হতাম প্রতিটি পদক্ষেপে। চলার সময় আমাদের হাত কতটুকু সম্প্রসারিত করতে হবে, প্যারেডে প্রতিটি পদক্ষেপ কতটুকু সময় অন্তর নেব, কার কতোটুকু নিকটে যেতে পারবো, সূর্য গলে যাওয়া তপ্ত বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ফল-ইনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকার মুহূর্তে ঘাড় বেয়ে নেমে আসা ঘামের চিকন স্রোত মুছে ফেলতে পারবো কি না, এমনকি চায়ের সাথে বিস্কিট ভিজিয়ে খাওয়ার মতো অকিঞ্চিৎকর অধিকার পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হত। নিরবধি নিয়ন্ত্রণের ভেতর যারা বসবাসিত হয়, একটু স্বাধীনতা পেলেই তাঁরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মাঝেমাঝে ভাবি, ক্যাডেট কলেজের নিয়মতান্ত্রিক ঘেরাটোপে কৈশোরের সেই নিয়ন্ত্রিত রাতগুলোর সাথে এই লাল-নীল-সবুজ-হলুদ দীপাবলির ঢাকা শহরের বেসামরিক রাতগুলোর কি দারুণ বৈপরীত্য!
এখানে বাতি নেভানোর জন্য কোন নিয়ম অনিয়ম নাই, নাই কোন বাধ্যবাধকতা। নগরীর নিষ্প্রাণ দালানকোঠায় কখনো একযোগে নেমে আসে না নয়নাভিরাম অন্ধকার। সব রং মুছে গেলেও আয়োজন করার মত কোন পান্ডুলিপি থাকে না তাই শহরের ফ্ল্যাটগুলো একেকটি অসমাপ্ত উপন্যাস। যে উপন্যাসের অধ্যায়ে-অধ্যায়ে অপ্রেম-অস্নেহ-বিরহ-বেদনা আর সম্পর্ক ভাঙা কিংবা জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার একঘেয়ে কাহিনী। অবিশ্বস্ততা আর বিশ্বাসহীনতার পটভূমি।
ভাবি, খাকি চত্বরের রাতগুলোর মত যদি একবার এ শহরে নেমে আসতো নিয়ন্ত্রিত রাত। কোথাও একযোগে অদৃশ্য কমান্ড হচ্ছে, লাইটস আউট। লাইটস আউট। আকাশ থেকে ভেসে আসা কোন ঘোষণা সংকেত কিংবা যুদ্ধের ময়দানে অলৌকিক আদেশবাণীর মত কিছুটা বাস্তব, কিছুটা অপার্থিব। অতিলৌকিক কোন কন্ঠস্বর, যা মানুষের কন্ঠ, কিন্তু ঠিক যেন মানুষের নয়। এক ধরণের ব্যতিব্যস্ততা নেমে আসতো শহুরে জীবনে। ক্রমশ বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে। কোথাও ধীরলয়ে, কোথাও দ্রুত। কোন কোন অঞ্চলে যখন আঁধার নেমে এসেছে, কোন কোন অঞ্চলে তখনো মায়াবী আলো। সেই মায়াবী আলোর রশ্মি অন্ধকার অঞ্চলে এসে আবছায়া অবয়ব তৈরী করছে। সে এক মেলোড্রামাটিক দৃশ্য।
মনে পড়ে, ঘড়ির কাঁটা যখন ১০ টা ৪৫ ছুঁইছুঁই তার কিছু আগে মাঝেমধ্যে চলে যেতাম বাস্কেট বল গ্রাউন্ডে। এক যোগে বিভিন্ন রুমের বাতি নেভার দৃশ্য দেখার জন্য। ব্রিটিশ নিয়মে চালিত এ আবাসিক অঙ্গনের নিয়ম ছিলো বেশ কড়া। পৌনে এগারোটার মধ্যেই নিভিয়ে ফেলতে হবে সকল বাতি। ঘুম না এলেও, ঘুমের ভাণ করে শুয়ে থাকতে হবে নিঃসঙ্গ শাদা বিছানায়। সারাদিনের ক্লান্তি ঘনিয়ে এলে, প্রাত্যহিক জীবনের লেনদেন শেষের চিহ্ন হিসেবে অল্পকিছু পরেই বাঁশি বাজতো। তিন হাউসের দায়িত্বরত তিন ডিউটিক্যাডেট বাঁশি বাজিয়ে জানান দিতো কর্মব্যস্ত একটি দিনের সমাপ্তি। তিনটি আলাদা তরঙ্গে, অল্পবিস্তর সময়ের ব্যাবধানে বেজে ওঠা বাঁশির আওয়াজ ভেঙে দিতো কিশোরদের ঘুমপূর্ব খেলাঘর। সে খেলাঘরে থাকতো, ক্যারামবোর্ডে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসমাপ্ত কোন দানের গুটি, টেবিল টেনিসের বল, কমনরুমে হিন্দী চ্যানেলের কোন যৌনাকর্ষক গান কিংবা হলিউডের কোন সিনেমার শেষ দৃশ্য, পরের দিনের প্যারেডের জুতা পলিশ, জুনিয়র রুমে চলতে থাকা কোন খোশ গল্প, বেসিনে শেইভের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ততা, হাউস মস্কে চলমান এশার নামাজ, কিংবা হাউস অফিসের বিবিধ কর্মকান্ড। মূহুর্তে, প্রিফেক্টদের ভারি ভারি কন্ঠস্বর থেকে আওয়াজ আসতো, বয়েজ লাইটস অফ। লাইটস অফ বয়েজ।
বালকেরা বাতি নেভাও। বাতি নেভাও বালকেরা।
যেন বাতি নেভাতে পারলেই বালকদের চোখে ঘুম এসে ভর করবে । ঘুমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে স্বপ্ন কে। ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি এসে ভর করবে কতিপয় বালকের ক্লান্ত চোখে। ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি আসার আগেই এই আদেশ বার্তা মুহূর্তে ছড়িয়ে যেত ৫১ একরে। দেখতাম, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বিভিন্ন ডরমেটরিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাতি গুলো একে একে আলো থেকে অবসর নিচ্ছে। একসময় সব বাতি নিভে গেলে অথৈ সমুদ্রের বাতিঘরের মতো হাউস বিল্ডিং এর উপরে জেগে থাকতো আলোয়গর্ভবতী তিনটি মাত্র ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটার ‘বিসিসি’। যা ভাঙালে পাওয়া যেত অঙ্গনের পুরো নাম। বাতি নেভানো অন্ধকার রুমগুলোর শাদা বিছানাকে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মনে হতো মেঘের পালঙ্ক। সেই পালঙ্কে শুয়ে শুনতাম শহর থেকে সাতমাইল দূরে পাড়া গায়ের ভেতর গড়ে ওঠা এই অঙ্গনে দূর থেকে ভেসে আসা কোন আহত ঝিঁঝিঁদের হারমোনিয়াম। সে সুর যেন শতাব্দী প্রাচীন কলের গানের মত মেলাংকোলিক আবহময়।
অধিকাংশ সময়েই ঘুম আসতো না। মনে পড়তো, শৈশবে ঘুম না এলে বালিশের পাশে বসে মা যে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে পান খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাতেন, তাঁকে বসতে দেয়ার মতো কোন খাট পালঙ্ক না থাকার একটা করুণ আর্তি ফুটে উঠতো। মাথার নিচে বিব্রতকর একটা বালিশ চেপে প্রায়ই খোকা ঘুমিয়ে যাওয়া কোন পাড়া জুড়ানো জনপদে খাজনা দিতে না পারা অসহায় এক কৃষকপরিবারের কথা ভাবতাম। মনে হতো, বর্গীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত্র, বুলবুলিতে ধান খেয়ে ফেলা নির্ঘুম এক কৃষক হয়তো জেগে আছেন জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। ক্ষুধা পেটে ঘুমিয়ে যাওয়া তাঁর সন্তানের পাশে বসে কৃষকবউ হয়তো তাঁকে ঘুম পাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় কোন এক কালে রচনা করেছিলেন এই ঘুমপাড়ানি গান।
মনে পড়ে, কলেজে এগারোটার ঘন্টা বাজানোর এক অদ্ভুত রেওয়াজ চালু ছিল। প্রতিরাত এগারোটার সময় রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে কোন এক নৈঃশপ্রহরীর শক্ত হাতে বাজানো এগারোটি ঢং ঢং শব্দ কানে বেজে আসতো। ঘুম না আসা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে প্রায়ই আঙুলের কড়ে গুনতাম ঘণ্টার সংখ্যা। মাঝেমাঝে মনে হতো, কোন একদিন ভুল করে হয়তো চকিদার বারোটি ঘন্টা বাজিয়ে ফেলবে। কিন্তু তেমন কখনো হয়নি। শুধু শেষ ঘন্টা বাজার পর ধাতুর রিনরিন মিহি ধ্বনি হাওয়াই মিঠের মতো মিলিয়ে যেত রাতের বাতাসে। এসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো পাথর তলিয়ে যাবার মতো অতল ঘুমে তলিয়ে যেতাম ঘুমের সমুদ্রে।
আর এখন ঘুম না আসা এইসব মেট্রোপলিটন রাতে বসে ভাবি, জীবনের বিবিধ অস্থিরতা নিয়ে বহুরাত নির্ঘুম কাটানো কোন স্বামীকে কি তাঁর স্ত্রী এখন ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়? কিংবা ইনসোমনিয়া আক্রান্ত কোন স্ত্রীকে তাঁর স্বামী কপালে হাত রেখে ঘুম পাড়ানোর সংগ্রাম চালায়? নাকি ভিন্ন মুখী হয়ে অভিন্ন বিছানায় মেসেঞ্জারে দু’জন ঘুম না আসার গল্প শোনায় দূরের দেশের কোন মানুষদের? কেবলই দূরের তারাদের নক্ষত্র মনে হয়। পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলা দু’জন নর-নারী তবুও টেনে নিয়ে যায় যে জীবন, সমাজ তাকে সংসার নাম দেয়। মন খারাপের রাতে কেউ কাউকে চোখের ঘুম হয়ে যাবার অনুরোধের মতো বিষয় থাকে না সেখানে।
ভাবি, যদি একদিন এই অনিয়ন্ত্রিত বিশৃঙ্খল এলোমেলো শহর জুড়ে নেমে আসতো কৈশোরের মতো কোন নিয়ন্ত্রিত রাত। লাল সবুজ হলুদ বাতিগুলো একযোগে নিভে যেত। নিভে যেত শ্রেণী ব্যবধান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের উঁচু নিচু সকল দালানের আলো। সমস্ত শহর ডুবে যেত ছিমছাম অন্ধকারে। আর কোন পান্ডুলিপি অসমাপ্ত রয়ে যেত না তবে। বিউগল বেজে যেত অবিরাম, শহরের সকল মানুষ ঘুমিয়ে যেত পরম প্রশান্তির বিছানায়।
থাকতো শুধু অন্ধকার,
মুখোমুখি বসিবার আমাদের নিজস্ব বনলতা সেন।