ইয়াঙ্কি মুলুকে পহেলা বৈশাখ

ডেট্রয়েট এ বাংলাদেশীদের  রমরমা দিন। খুব বেশি আগের কথা নয়। এই কিছুদিন আগেও এখানে একটা মাত্র বাংলাদেশী মাছের দোকান ছিলো। সেখানে রো শ্যাড মাছ ইলিশ বলে বিক্রি করা হতো। ইলিশ শ্যাড এর গোত্রভুক্ত আর দেখতেও প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু মাটি আর পানির তফাতের কারনে এর কাঁটা অনেক নরম আর স্বাদও অনেক পানসে। এ নিয়ে দোকানিকে প্রশ্ন করা হলে সে তেড়েমেরে আসতো,
-ইতা কিতা মাত মাতরে বা,ইগু বাংলাদেশ থাকি আইসে,
বুজচনি খতদুর থাকি আইসে,ইগু নরম অইব নাতো কি তুমার মাতাহ নরম অইব।

কচিত কদাচিৎ সেখানে বাংলাদেশী সবজি পাওয়া যেত।তখন বাংলাদেশীদের সব্জির গোল্ডেন স্ট্যান্ডার্ড ছিল কচুর লতি। কোন শহরে কচুর লতি পাওয়া গেলে বোঝা যেত সেখানে অনেক বাংলাদেশী আছে।আর সবাই সেটা খুব রসিয়ে রসিয়ে গল্পও করত – ও মা, সে কি , তোমরা বাংলাদেশী মাছ পাও না, আমাদের এখানে তো সব পাওয়া যায়, টেংরা মাছ, ইস্পাহানি চা, টোস্ট বিস্কুট এমনকি কচুর লতিও। সুপার মার্কেট এর প্যাকেট করা ভেড়ার মাংস প্যাকেট খুলে হয়ে যেত হালাল খাসির মাংস। সেই মাংসের একটু ভিন্ন গন্ধ নিয়ে কেও প্রশ্ন করলে সেই আবার বিশাল ধমক-
মিয়া খাসির মাংস থাইক্কা কিতা আগরবাত্তির গন্ধ ফাইতানি, খাসিরই তো গন্ধ ফাইতা।

বেশীদিন আগের কথা না, দোকানীরা মেয়াদউত্তীর্ণ মসলার প্যাকেট এ নতুন মেয়াদ ছাপিয়ে পুরনো মেয়াদের উপরে সেটে দিতেন।আর যারা দিতে ভুলে যেতেন তাদের এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতেন –
ইগু প্রিন্ট মিস্টেক অইছে।ইগু ২০০০ অইব, ১৯৯৫ না।
এই বাংলাদেশীদের বেশিরভাগই থাকতো হ্যামট্রামাকে যারা মুলত এখানাকার গাড়ির কোম্পানীগুলোতে কাজ করার জন্য আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে ভিড় জমায় আশির দশকের শুরুর দিকে ।আর ডেট্রয়েটের আশে পাশের যে শতাধিক ছোটো ছোটো শহর  আছে সেগুলোতে  ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল হাতে গোনা কিছু বাংলাদেশী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র।

এখানে তখন উৎসব বলতে পাকিস্তানি বা আরব মসজিদ এ ইদের নামাজ আর পরিচিত কারো বাড়িতে ভুঁড়িভোজ, পরচর্চা আর স্বদেশের রাজনীতি। খুব বেশি হলে  কীবোর্ড বা হারমোনিয়াম এ দুই একটা বাংলা গান। (এখানে (এবং আমেরিকার প্রায় বাকি সবখানেই) গান গাওয়ার গায়ক/গায়িকা ছিলো অনেক, হারমোনিয়াম বাজানোর শিল্পীও খুঁজে পাওয়া যেত, কিন্ত কোন এক অদ্ভুত কারনে এই অতি সম্প্রতি ছাড়া আমি এখানে কোন তবলচি দেখিনি কখনো। কে জানে তবলচি দের তখন হয়ত national security র জন্য বিপদজনক গন্য করা হতো বিধায় ভিসা দেওয়া হতোনা 🙂 🙂 🙂

তারপর আশির দশকের শেষ আর নব্বই এর শুরুতে  এসে অবস্থা বদলাতে শুরু করে। গাড়ীর কোম্পানিগুলোতে কাজের সহজলভ্যতা, পারিবারিক অভিবাসন, জীবনযাত্রার কম খরচ, বহুজাতিক সংস্কৃতি, অভিবাসীদের প্রতি বন্ধুসুলভ সামাজিক/রাজনৈতিক ব্যাবস্থার কারনে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট থেকে (বিশেষ করে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া) প্রচুর বাংলাদেশী মিশিগানে চলে আসেন। যারা আসেন তাদের বেশির ভাগ ই আস্তানা গাড়েন হ্যামট্রামাকে। হ্যামট্রামাক একটা অদ্ভুত শহর – সব মানে এবং মুল্যে। গোটা পৃথিবীতে এরকম আরেকটা শহর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয়না। এই শহরের গল্প আরেকদিনের জন্য উঠানো থাক। শুধু এই টুকুই আজকের জন্য যথেষ্ট যে এই শহরে যে কয়টা নাইট ক্লাব আছে প্রায় ঠিক সেই কয়টাই মসজিদ আছে এবং সংখ্যাটা নগন্য না।

ডেট্রয়েট/হ্যামট্রামাক এর সাথে সাথে এর পাশের উপশহর গুলোতেও বাড়তে থাকে বাংলাদেশীরা,বাড়তে থাকে বাংলাদেশীদের হাঁকডাক। পাঁচফোড়ন আর মাছের ঝোলের গন্ধ কিচেন থেকে ছড়িয়ে পড়ে মিশিগানের রাস্তায়। একটার জায়গায় দুইটা, দুইটার জায়গায় চারটা এই করে করে বাড়তে থাকে মাছের দোকান, মিস্টির দোকান, শাড়ির দোকান, গয়নার দোকান। এখন সব পাওয়া যায় ডেট্রয়েট এ – এমন কি কচুর লতিও। এখন আর শ্যাড ইলিশ বলে খেতে হয়না। এখন চাইলে সামনেই খাসি জবাই করে নিয়ে রেজালা রান্না করতে পারেন নির্দ্বিধায়।

সব মিলিয়ে এখানে এখন  প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী বাস করে। হ্যামট্রামাক এর স্কুলে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শেখানো হয়, মসজিদে মাইকে এ আজান দেওয়া আইনত সিদ্ধ, রাস্তায় হাটলে চোখে পড়বে প্রচুর বাংলা সাইন বোর্ড। শুধু তাই না – এই একটি মাত্র আমেরিকান শহর, গুগুল ম্যাপ এ যার পরিচয় ‘বাংলা টাউন’ হিসাবে।আর একি সাথে বদলে যায় এখানকার পালাপার্বণ, উৎসব আর উদযাপনের চিত্রও। ধর্মীয় উৎসব তো বটেই, বাঙালীর শত বৎসরের শাশ্বত সামাজিক উৎসব গুলোও এখানকার বাংলাদেশীরা অনেক হাঁকডাক করে পালন করা শুরু করে। এখন ডেট্রয়েটেও ফাগুনের আগুন লাগে, বৈশাখে ঝড় ওঠে, শীতের পিঠা, শ্রাবণের পার্বণ কিছুই বাদ যায় না। তাছাড়া বিভিন্ন ছুতোছাতায় গান বাজনা লেগেই থাকে সামার এর প্রায় পুরো সময়টা জুড়েই।

২০০৮ গোটা আমেরিকার এবং বিশেষ করে মিশিগানের অর্থনীতিতে একটা বিশাল ধ্বস নামে। গাড়ীর কোম্পানি গুলো তখন মৃত্যু শয্যায়। এই বিদঘুটে সময়ের আঁচ থেকে বাংলাদেশিরাও রক্ষা পায়নি। সে সময় প্রচুর বাংলাদেশি চলে যায় মিশিগান ছেঁড়ে। কিন্তু অর্থনীতির সুত্র মতোই সেই খারাপ সময় টা বেশিদিন টেকেনি। ২০১২ এর শেষের দিকে এসে আমেরিকা এবং মিশিগান আবার ঘুরে দাঁড়ায় নিজের পায়ে।

এই মন্দার পরের বছরগুলোতে দুটো নতুন কনসেপ্ট ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আমেরিকায়। এক – তেল ছাড়া গাড়ী চালানো (electric vehicle) দুই – ড্রাইভার ছাড়া গাড়ী চালানো। (Autonomous vehicle). প্রযুক্তির সব রথি মহারথীরা ঝাপিয়ে পড়ে এই প্রযুক্তি আয়ত্তে আনতে। টেসলা, গুগুল, অ্যাপেল, ইনটেল সবাই হাজার হাজার কোটি ডলার নিয়ে বাজারে আসে। পিছিয়ে ছিলনা জেনারেল মটরস, ফোরড আর ক্রাইস্লার ও। এই দ্বৈরথে কে জিতবে বুঝা মুশকিল ছিল। সব পণ্ডিতরা লেখালেখি শুরু করেছিলেন যে নতুন শতাব্দীর গাড়ির রাজধানী হবে ক্যালিফোর্নিয়া, মিশিগান না। কিন্তু সব নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে মিশিগান সেই যুদ্ধে বিজয়ি হয়েছে, এই রথী মহারথিদের কেউ কেউ থলি গুটিয়ে বিদায় নিয়েছেন, কেউ মিশিগানের গাড়ীর কোম্পানীগুলোর সাথে মিলে মিশে কাজ করা শুধু করেছেন। এই তথ্যটা এখানে এই কারনে প্রাসঙ্গিক যে, এই দুটো নতুন টেকনোলজির কারনে এখানে যে বিশাল চাকরির বাজার তৈরি হয়েছে, তার সুত্র ধরে প্রচুর বাংলাদেশী তরুন তরুনী, সদ্য পাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা যারা আগে নিউইয়র্ক, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়া কিছুই ভাবতনা তারাও মিশিগানে চলে আসছে চাকরি নিয়ে।

আর এই তরুন তরুনীরা মিশিগানের বাংলাদেশীদের পুরো চালচিত্রটাকেই প্রায় আমুলে বদলে দিচ্ছে। এখানে আগে যে অনুষ্ঠানগুলো হত, তার একটা মোটামুটি কমন থিম ছিলো যে ঢাকা বা নিউইয়র্ক বা টরোন্টো থেকে কোন সেলেব্রেটি আসতেন গান গাইতে, সাথে দুই এক জন স্থানীয় শিল্পিরা গাইত, নাচত। শাড়ী, গয়নার বাজার বসত অনুষ্ঠান ঘিরে সাথে বাঙ্গালীর স্ট্রিট ফুড – মুড়ি, চানাচুর, সিঙ্গারা, চা, বিরিয়ানী। আমি কোনক্রমেই এই অনুষ্ঠান গুলোকে ছোটো করে দেখছিনা। আমরা অনেক আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে এইসব অনুষ্ঠানে যাই। আর অনেক ভালোলাগা আর ভালোবাসা নিয়ে ঘরে ফিরি।  কিন্তু এর বাইরেও যে কিছু করা যেতে পারে তা আমরা কখনই ভেবে দেখিনি, এই তরুন, তরুনীরা সেটাই এবার করে দেখালো এই পহেলা বৈশাখে।

বৈশাখের প্রথম দিনে লরেন্স টেক ইউনিভার্সিটির সায়েন্স হলে  এরা আয়োজন করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। সেখানে কোন রুনা লায়লা বা বাপ্পা মজুমদের গান করেনি, সেখানে কোনো শামিমা আরা নিপা নাচেনি, কোন জুয়েল আইচ জাদু দেখায়নি। এখানকার স্থানীয় শিল্পীরাই গেয়েছে, নেচেছে, কবিতা আবৃতি করেছে, অভিনয় করেছে আর হল ভর্তি বাংলাদেশীরা তার প্রত্যেকটি মুহূর্ত উপভোগ করেছে।  সেই উদ্যোগে প্রত্যয় ছিলো, প্রান ছিলো, প্রেম ছিলো। সেই উদ্যোগে সম্পৃক্ততা ছিলো, আনন্দ ছিলো, ছিলো সম্প্রীতি।

যে একঝাক নতুন আনকোরা তরুন তরুনি মিশিগানে এসেছে তারা শুধু তাদের স্বপ্ন, সংকল্প আর সৃজনশীলতাই সাথে করে আনেনি, তারা বুকে বয়ে এনেছে তাদের বাঙালীয়ানাকেও। এরা শুধু রাঁধে আর চুলি বাঁধে না, এরা নাচেও। এরা শুধু পড়ে আর পড়ায় ই না, এরাও কবিতাও আবৃত্তি করে। এরা শুধু মেশিন আর ম্যাথ নিয়ে দিন কাটায় না, এরা গানো গায়। এরা শুধু ইঞ্জিন আর ট্রান্সমিশন নিয়ে চিন্তিত না,  এরা অভিনয়ো করে । দেশ থেকে যোজন ক্রোশ দূরে অনাবিল স্বপ্নময়তায় এরা আরেকটা বাংলাদেশ তৈরি করে করে ফেলেছে অবলীলায়। দেশ শুধু তো একটা ভৌগোলিক বিভক্তি নয়, দেশ একটি সাংস্কৃতিক আর সামাজিক স্বকীয়তার স্মারকও বটে। এরা প্রত্যেকে সেই স্মারকের সন্নিগ্ধ রুপ, উল্লসিত সংস্করন আর উৎকৃষ্ট উদহারন।

যে লক্ষ কোটি বাংলাদেশী বাংলা মায়ের উদর ছেঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে, যারা বৃষ্টির সন্ধ্যায় আজো আনমনা হয়ে উঠে, যারা কব্জি ডুবিয়ে মাছের ঝোলে  ভাত খাওয়াকে এখনো তাদের পরিচয়ের অংশ মনে করে, যারা এখনো রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গণ্ডী থেকে খুব বেশিদুর এগুতে পারেনি, তাদের কাছে এই স্মারকের মুল্য অনেক। তারা আজ যে বিশ্বজনীন বাস্তবতার অংশ, যে আন্তর্জাতিক আবহের অন্তর্গত, যে স্রোতে প্রিতিনিয়ত একটু একটু করে বিলিন হচ্ছে তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা তার বিপরীতে এগুল শুধু ‘গুড ওল্ড কান্ট্রি’ নয়, এগুলো তাদের নিজেকে ধরে রাখবার একটা প্রানপন চেষ্টা। এই প্রয়াসে যত নতুনত্ত থাকবে, যত দৃঢতা থাকবে, যত স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে ততই তার ভবিতব্যের ভিত্তি মজবুত হবে।

[এই পোস্টের মূল লেখক মোঃ গোলাম সাকলায়েন, ক্যাডেট নম্বর ১০৭৫, ব্যাচ ২০, কাসিম হাউস, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। তার সম্পর্কে জানতে পড়ুন বঙ্কিম ও ব্যকরণ। ছবিসহ সাকলায়েনের ফেসবুক পোস্টের লিঙ্ক ]

৫,২৯০ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ইয়াঙ্কি মুলুকে পহেলা বৈশাখ”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।