মোঃ মতিউর রহমান সরকার আমার পিতা। তিনি ২য় মহাযুদ্ধের সময় সৃষ্ট বঙ্গীয় গৃহ রক্ষী দল ( The Bengal Home Guard) – এ যোগ দেন ১৯৪৩ সালে। ১৯৪৮ সালে আনসার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন আনসার মূলত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল। ১৯৫৩ সালে সহকারী এডজুটেন্ট পদে চাকুরী পান। তখন আকার অনুসারে দুইটি বা একটি থানা নিয়ে গঠিত ইউনিট প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন সহকারী এডজুটেন্ট। যথেষ্ট সম্মানের, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি চাকুরীতে যোগ দান করেননি। ১৯৬৫ সালে তিনি আনসারের প্লাটুন কমাণ্ডার হন। উত্তর বঙ্গ চিনি কল (গোপালপুর চিনিকল) এর অধীন বেশ কয়েকটি খামার রয়েছে। এগুলোর একটি মুলাডুলিতে ওভারশিয়ার পদে চাকুরী পেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা রিয়াছত উল্লাহর অসুস্থ্যতার জন্য চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসেন।
মতিউর রহমান তার পিতার প্রতি যথেষ্ট অনুরক্ত হলেও বিষয়টা এক তরফা ছিল। ছেলের ভালমন্দের প্রতি রিয়াছত উল্লাহ বেশ উদাসীন ছিলেন। অনেক গুলো বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বেশ কষ্টেই চলতে হত মতিকে। প্রথম পুত্র ফজলুর রহমান একবার স্কুলে যাবার সময় দেখল জামা ছেঁড়া। কাউকে কিছু না বলে সে নিজেই সুচ সুতা দিয়ে সেলাই করতে গেল। সেলাই এর পরে দেখা গেল ভুলে দুইপাশ একসাথে সেলাই হয়ে গেছে , সেটি পরা তখন অসম্ভব। সেলাই খুলতে গিয়ে জামাটাই ছিড়েঁ গেল। বহুব্যবহারের ফলে তালিমেরে চালানো সম্ভব নয়। জামা ছিঁড়ার অপরাধবোধে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ফজলু। মতি বাকরুদ্ধ। লাখপতির মেয়ে আশানারা কি করবে। ছেলের পড়ার খরচ যোগাতে গয়নাগুলো বিক্রি বা বন্ধকে গেছে। সরকারের ব্যাটা নিজেই নিজের জমি চষে। তবু সব সময় ভাত পাওয়া যায় না। মসুর সিদ্ধ করে বা মসুরের রুটি খেয়ে ক্ষুধা চাপা দিয়ে রাখতে হয়। এই অবস্থায় উদ্ধারে এগিয়ে আসেন জফর সরকারের ছেলে জামাল সরকার। ইনি মতির না পাওয়া ভালোবাসা রাবেয়ার ভাই। জামাল সরকার দুইটা জামা বানিয়ে দেয় ফজলুর জন্য।বন্ধুর মেধাবী ছেলের জন্য সানন্দে তিনি এটা করেন। করিমপুর হাইস্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় তাকে মানবিক বিভাগেই পড়তে হয়। মেট্রিক পাশ করার পর সে রাজশাহী কলেজে সাইন্সে পড়ে। তখন লেখাপড়া ইংরেজী মাধ্যমে চলতো। রাজশাহী যেতে বাড়ি থেকে ৪ মাইল দূরে আব্দুলপুর রেল স্টেশনে ট্রেনে চড়তে হত। ছেলের টিনের বাক্সখানা নিজেই মাথায় করে নিয়ে যেতেন মতি। বাক্সের তলায় খুজলে এখনো দুই একটা চুল পাওয়া যাবে।
১৯৭০ সালে বাঙালির প্রাণের দাবি ৬ দফা নির্বাচনের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক নির্বাচনে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ভোট দিয়ে আসেন মতিউর রহমান। ভোট দিয়ে আসার কয়েক ঘন্টা পর রাত্রে জন্ম লাভ করে তাদের ৪র্থ পুত্র। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম নেতা যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোশেফ ব্রোজ টিটোর নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বড় দুই ছেলে মোঃ ফজলুর রহমান এবং মোঃ আজিজুর রহমান সরকার ভারতে পালিয়ে যায়। ফজলুর রহমান বাংলাদেশ এর প্রথম যুদ্ধকমিশনে সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট হন। ত্রিপুরা অবস্থান করে কুমিল্লায় যুদ্ধ করেন। তিনি পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিলেন। ফজলুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। সাবসিডিয়ারী পাশ করে আর্মিতে চলে যাওয়ায় অনার্স বা মাস্টার্স করা হয়নি। আজিজুর রহমান শেখ পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পেট প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তিনি বর্তমানে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা।
মতিউর রহমান হয় মার্চ/এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ৩০ মার্চ ময়নার যুদ্ধ ৩১ মার্চ আড়ানীর গোচর এবং ২ এপ্রিল ভিতরভাগ যুদ্ধ করেন। এরপরে পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে আর যুদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। পরিবার পরিজন নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ান। পালানর সময় তখনকার কোলের বাচ্চা টিটো একবার হারিয়ে গিয়েছিল। তাকে কোন এক সহৃদয় মানুষ লুঙ্গির ত্যানায় জড়িয়ে যত্নে জড়িয়ে রেখেছিলো বলে জানা যায়। অক্টোবর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা মাড়িয়ার কাছে অ্যান্টিট্যাংক মাইন দিয়ে রেল লাইন উড়িয়ে দেয়। এর শোধ নিতে পাক বাহিনী মাড়িয়া গ্রামের অনেক গুলো বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মতির বাড়িতে গোটা দুই অর্ধদগ্ধ চৌকি ঊনিশ শত নব্বই সাল পর্যন্ত বেঁচেছিল। মাইনটির অংশ বিশেষ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। মোট তিন টুকরার মধ্যে একটি মুক্তিযোদ্ধা আজাদ আলীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঐ অপারেশনে তার হাত উড়ে যায়। তিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক খেতাব পান। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কয়েক জন পাকিস্তানী সৈনিক জনতার ধোলাইয়ে জাহান্নাম লাভ করে। মতিউর রহমান ছিলেন ঐ গণধোলাইয়ের অন্যতম নেতা। নিহত পাকি সৈনিকদের গোটা দুই রাইফেল বেশ কিছুদিন তার দায়িত্বে ছিল। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সে অস্ত্র জমা দিয়ে দেন তিনি।তার নিজস্ব একটা দোনলা বন্দুক ছিল, অস্ট্রিয়ান। ভারতে না গেলে মুক্তিযোদ্ধাত্ব পোক্ত হয় না বিধায় মতিউর রহমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। মতিউর রহমানের শিকারের নেশা ছিল। অনেক গুলো বাঘ শিকার করেছেন। মানুষ খেকো বাঘ মেরে নাটোর এর এসডিওর কাছ থেকে চান্দির মেডেল পেয়েছিলেন। পানের মত মেডেলের উপরে ছিল চান-তারা।উনার আর একটা শখ ছিল রেডিওতে গান শোনা।
খুব চমৎকার করে লেখা এ আত্মজীবনী পড়ে মুগ্ধ হ'লাম।
বড়ভাই ব্রিঃ জেঃ ফজলুর রহমান এখন কোথায় আছেন?
পড়বার জন্য ধন্যবাদ ভাই। বড় ভাই আমেরিকা প্রবাসী।
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
টিটো, অনেক ভালো হচ্ছে। শুধু তোমরা নও, সমজা সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, সবই উঠে আসছে। পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকলাম
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
সাইদুল ভাই অনেক ধন্যবাদ 🙂
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
বেশ কিছুদিন পর এ পর্বটা পেলাম। দুর্দান্ত লিখেছেন।
হারিয়ে যাবার কাহিনীটা আরেকটু বিশদে বলে একদিন।
হারিয়ে যাবার কাহিনীটা বলতে সময় লাগবে। 😕
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
চমৎকার বললে কম বলা হবে!
আরো একটু সময় নিয়ে আরো কিছুটা তথ্য জড়িয়ে লেখা যেতে পারে। বোঝা যাচ্ছে একটানে লিখে ফেলা, অল্প সময়ে। তারপরও অসাধারন!
অনেক ধন্যবাদ ভাই্ হ.ইসলাম। আপনি ঠিকই ধরেছেন, একটানে লেখা। পরে আরও তথ্য যোগ করব 🙂
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
শেষ করে দিচ্ছেন কি? অসাধারণ একটা সিরিজ। :boss:
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
ধন্যবাদ মোকা। আর দুই একটা পর্ব হবে 🙂
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
চমৎকার! আবারো বসলাম তাহলে! 🙂
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\