বন্ধু তোমায় সালাম

৪ জানুয়ারী, ২০০৪ তারিখে রয়েল মিলিটারী একাডেমি, স্যান্ডহার্টস এ যোগদানের পর দুইটা সমস্যা আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছে। একটি হল ঠান্ডা আর অপরটি ভাষা। যোগদানের প্রথম ২-৩ দিন সত্যিকার অর্থেই আমি কারো কোন কথাই বুঝতে পারিনি। আমার প্লাটুনের অন্যদের দেখাদেখি সব কাজ করে গিয়েছি না বুঝেই। প্রথম কয়েকদিনের কার্যক্রমের একটা বিরাট অংশ ছিল ইউনিফর্ম, বুট, অন্যান্য পোষাক, বার্গেইন, অন্যান্য সামগ্রী ও সরঞ্জামাদি ইস্যু করা। বিদেশি ক্যাডেট হিসাবে আমার জন্য ছিল অতিরিক্ত কিছু আইটেম যা অন্যদের ছিল না। ভাষা বুঝতে না পারার কারনে আমি সব কিছু গুবলেট করে ফেললাম। মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম যে, আমাকে দিয়ে মনে হয় হবে না। ২য় দিন ডিনার টাইমে খুব মন খারাপ করে বসে ছিলাম আর এমন সময়ে আমার প্লাটুনের এক সদস্য আমার পাশে এসে আমাকে বললো, “তুমি এত মন খারাপ করে আছ কেন? আমি মনে হয় তোমার সমস্যা বুঝতে পেরেছি। দেখ, এখানে যে সব স্টাফদের দেখছ তারা অধিকাংশই ওয়েলস কিম্বা স্কটিশ। ওদের ইংরেজি আমরাও ঠিক মত বুঝতে পারি না। এটা নিয়ে মন খারাপ কর না কয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।” আসলেই দুই-এক সপ্তাহের মাঝে অনেক ভাল অবস্থায় চলে আসলাম আমি। আমার এই বন্ধুটির নাম “ড্যান রীড”। রীড শুধু আমার প্লাটূনেরই না, আমরা ছিলাম একই সেকশনে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতই ছিল। আমাকে মানসিক ভাবে সবসময় অনেক সাপোর্ট দিয়েছে আমার এই বন্ধুটি।

স্যান্ডহার্টস এর প্রশিক্ষনে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে আমাদের বহিরাঙ্গন অনুশীলনে। মাসের মধ্যে কমপক্ষে ১০-১৫ দিন থাকতে হত বাইরে। আর এই অনুশীলন গুলোর অধিকাংশ হতো ওয়েলস এর উত্তরাংশ এবং স্কটল্যান্ডের দিকে যেখানে সবসময় বৃষ্টি হয় আর তাপমাত্রা থাকতো -৫ থেকে -১৫ এর মধ্যে। অনুশীলনে যেয়ে আমার লক্ষ্য ছিল শীতের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা। আমার প্লাটূন তথা সেকশনের সকল সদস্য আমাকে সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে। এমনও হয়েছে যে রেষ্ট টাইমে কয়েকজন প্লাটূনমেট মিলে আমাকে তিনদিক থেকে চেপে ধরে রাখতো যাতে করে আমার ঠান্ডা কম লাগে। পরের দিকে আমার সবকিছু সহ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম কিছুদিনের বিভিষিকাময় সময়গুলো যে কিভাবে কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমার প্লাটুনের বন্ধুরা বিশেষ করে রীড, বোয়ানী যাদের কথা আমার বিশেষ করে মনে পড়ে। আমার কষ্টের সময় যেমন তাদের পাশে পেয়েছি তেমনি আনন্দ-উল্লাসের সময়েও একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ করেছি। যেসব কথা থাক। আজ আমি স্যান্ডহার্টসের গল্প লিখতে বসিনি, আমি আমার অতি প্রিয় বন্ধু ড্যান রীড সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলবো। একজন মানুষ যে এত সৎ হতে পারে তা রীডকে কাছে থেকে না দেখলে বোঝা যায় না। বিএমএ তে ট্রেনিং এর সময় দেখেছি যে প্লাটুন কমান্ডার বা স্টাফ না থাকলে আমরা সবকাজের মধ্যেই ফাকি দেওয়া শুরু করি। শুধু তাই না আমি মনে করি এটা আমাদের জাতিগত সমস্যা। কিন্তু আমি রীডকে দেখেছি তার কর্তব্যে অচল থাকতে। ট্রেনিং এর কষ্টকর সময়েও তাকে দেখিনি ফাকি দেওয়ার চেষ্টা করতে। আমাকে ও সবসময় বলতো, মেহেদী, তুমি যদি মনে কর এখন কেউ দেখছে না আমি একটু রেষ্ট নিয়ে নিই তাহলে তুমি সারাজীবন এমনি করে যাবে এবং কখনই উন্নতি করতে পারবে না। ১২ নং প্লাটুন, মার্ন কোম্পানীতে আমাদের একটি বছর কেটেছে। রীডের সাথে আমার অনেক অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

আমি মাঝে মাঝে আমার ছবির এ্যালবামগুলো দেখি আর সেইদিনগুলোর স্মৃতিচারন করি। এই স্মৃতিচারন নিয়ে অন্য আরেকদিন বিস্তারিত লিখবো। আজ শুধু দুটো ছবি দিব।

এন্ডুরেন্স রেস জয়ের পর আমাদের ১২ প্লাটুন, আমাকে উপরে তুলে ধরা হয়েছে

এন্ডুরেন্স রেস জয়ের পর আমাদের ১২ প্লাটুন, আমাকে উপরে তুলে ধরা হয়েছে

ড্যান রীড

ড্যান রীড

আমার এই কোর্সমেট, প্লাটূনমেট, সেকশনমেট ড্যান রীড গত ১১ জানুয়ারী ২০১০ সোমবার আফগানিস্থানের নর্দান হ্যালম্যান্ডের মুসাকালা নামক স্থানে একটি বিস্ফোরনে নিহত হয়েছে। খবরটা শোনার পর থেকে আমি মানসিক ভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়েছি, একসাথে জীবনের কষ্টকর একটি বছর পার করেছিলাম। তাই এটা সবার সাথে শেয়ার না করে পারলাম না।

বিবিসি নিউজে ছবি সহ খবরটি প্রকাশিত হয়েছে।

২,৭৮৪ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “বন্ধু তোমায় সালাম”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আর কতজন ড্যান রীড মারা গেলে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সারাবিশ্বজুড়ে যুদ্ধ বন্ধ হবে জানি না... :no:
    রীড পরিবার এবং তার শুভাকাংখীদের জন্য রইল সমবেদনা...


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    এই দেশপ্রেমিক যোদ্ধাদের দেশপ্রেমের আফিম খাইয়ে আফগানিস্তান-ইরাকে যুদ্ধ করতে পাঠায় বুশ-ব্লেয়ার-চেনিরা,নিজের ছেলেমেয়েদেরকে সজতনে সব বিপদ থেকে দূরে রেখে।আমাদের দেশেও তাই-গুলি খেয়ে মরে আমাদের আর্মি-পুলিশ-আনসারেরা আর নেতা নেত্রীদের পকেট ফুলে ফেঁপে পাহাড়ের মথয়ে উথতে থাকে।

    সে আমেন টু হিপোক্রেসি!

    সেই সাথে নিজ দেশের জন্যে জীবন দানকারী এই যোদ্ধাকে সেলাম!

    জবাব দিন
  3. আন্দালিব (৯৬-০২)

    আমি ভাবতেছিলাম স্মৃতিচারণ পোস্ট। তোর ঐ সময়ের গল্প শোনা হয় নাই, তাই পড়তে ভালো লাগছিলো। শেষে এসে এইটা কি শোনাইলি! 🙁

    ড্যান রীডের ছবিটা দেখে খুব খুব মন খারাপ হলো... পৃথিবী থেকে এই ভালো মানুষগুলো কেনো এতো তাড়াতাড়ি চলে যায়?

    যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে কথা বলারও আগ্রহ পাইতেছি না। ড্যান কি আমাদের বয়সী ছিলো?

    জবাব দিন
  4. রবিন (৯৪-০০/ককক)

    ধুর তোর ব্যান চাই। সকালে অফিসে এসে সিসিবি খুলেই এই খবরটা পড়লাম। মন্টাই খারাপ হয়ে গেলো।
    আসলেই আর কতো জন মারা গেলে যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝবে নেতারা?

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ফেসবুকে তোমার লিংক দেখেই বুঝেছিলাম। তাই প্রস্তুতি নিয়েই পড়তে শুরু করি। শেষ করার পর যন্ত্রণাটা এতোটুকুও কমে না। তোমার বন্ধুর জন্য ভালোবাসা।

    ..................................................................
    হিংসায় উম্মত্ত পৃথ্বী......... তবু ভালোবাসার কথা বলে যাবো আমৃত্যু


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

    Sorry to hear about the loss of your great friend, Capt Daniel Read. I have also come across many people here in the USA, who have lost their sons, daughters, mother or father in these senseless wars.

    Wars have never solved any issues in the world. It is high time we all stand against 'any wars' - just or unjust.

    Stop the war machine

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।