এর আগের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ ক্ষণিকের দেখা, এ মায়াময় ভুবনে -২
২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারী, আমরা দুই বন্ধু মিলে সস্ত্রীক ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার (সম্ভবতঃ) পদ্মা তীরবর্তী মৈনট ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যদিও এটাকে অনেকে ঢাকার ‘মিনি কক্সবাজার’ বলে থাকেন, আমার কাছে তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। তবে যাওয়ার পথে থেমে থেমে এটা ওটা করে বেশ আনন্দ করেছিলাম, যেমন সরিষা ক্ষেতে নেমে সোঁদা গন্ধের মাটিতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা, পথ পাশের চা-দোকানে নেমে চা-টা খাওয়া, আর উপস্থিত মানুষজনের সাথে আলাপচারিতা, ইত্যাদি। এসব করতে করতে প্রায় দুপুর বেলায় সেখানে পৌঁছেছিলাম। মটর বোটে সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে যখন ঘাটে ফিরে আসলাম, তখন বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। ফেরার সময় এক আচমকা বাতাসে আমার মাথার হ্যাটটি উড়ে গিয়ে পদ্মার অতল বুকে সলিল সমাধি লাভ করেছিল। এ নিয়ে অবশ্য আমি একটি পোস্টও লিখেছিলামঃ
https://www.somewhereinblog.net/blog/KA13/30225563
যাহোক, ওখানকার কয়েকটি হোটেলের মধ্যে যেটিকে আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন মনে হয়েছিল, সেটাকে বাছাই করে আমরা ভর্তা-ভাজি-মাছ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। সেদিন ওয়ার্কিং ডে ছিল বিধায় কাস্টমারের বেশি ভিড় ছিল না, তাই খাওয়া দাওয়া শেষে সীট ছেড়ে দেবার কোন তাড়াও ছিল না। তাই আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করে সেখানে বসেই গাল গল্প চালিয়ে যেতে থাকলাম। সূর্য খানিকটা ঢলে পড়লে আমরা ওখানে বসেই ঘন দুধের চা খেয়ে ফেরত আসার জন্য উঠতে উদ্যত হ’লাম। হোটেলওয়ালা বললো, ‘মৈনট ঘাটে বেড়াতে এসেছেন, পদ্মার মাছ না নিয়েই ফিরে যাবেন’? আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাজার কখন বসবে’? সে বললো, ‘একটু পরে বাজার জমবে, তবে এখনই কিছু কিছু মাছ আসা শুরু হয়েছে’। আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরতি পথের অচেনা অংশটুকু পাড়ি দিতে চাচ্ছিলাম, তাই আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না। যাহোক তবুও একটু এগিয়ে দেখি এক মাছওয়ালা ছোট/ মাঝারি সাইজের পাঁচটি (রুই, কাতল আর চিতল) মাছ নিয়ে বসে আছে। আমাদেরকে একটু নিমরাজি দেখে সে বেচারা অনেক সাধাসাধি করে, এবং মনে হয় একটু সাশ্রয়ী মূল্যেই আমাদেরকে মাছগুলো দিয়ে বললো, ‘স্যার মৈনট ঘাটের মাছ, একবার খেলে আবার আসবেন’। আমরা দু’জন ভাগাভাগি করে মাছগুলো কিনেছিলাম। মাছ খেয়ে লোকটাকে সত্যিই স্মরণ করেছিলাম, বিশেষ করে চিতলমাছ খাবার পর। চিতল মাছ দেখলেই ক্ষণিকের দেখা সেই সহজ সরল মাছওয়ালার কথা এখনো মনে পড়ে।
০৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, বাংলা বাজার জুবিলী হাই স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত ‘ঝিঙেফুল’ প্রকাশনীতে যেতে হবে। আমার চতুর্থ বই এর প্রকাশক জনাব গিয়াস উদ্দিন খসরু সাহেব টেলিফোনে ঠিকানা জানিয়েছেন এবং সেখানে যাবার পথ বাৎলে দিয়েছেন। আমি কাছাকাছি গিয়ে রাস্তার বাঁকের একটি চা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ‘ঝিঙেফুল প্রকাশনী’র কথা জিজ্ঞেস করলাম। ব্যস্ত চা ওয়ালা জবাব দেবার আগেই পাশে বসা এক চর্মকার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আয়া পড়ছেন তো, আবার জিগায়’! আমি বললাম, ‘কই আয়া পড়ছি’? তিনি আঙুল তুলে একটা বিল্ডিং এর দিকে দেখালেন, সেখানে বড় করে লেখা আছে ‘বাংলা বাজার জুবিলী হাই স্কুল’। ঐ স্কুলটার ঠিক অপর পার্শ্বেই ছিল ‘ঝিঙেফুল প্রকাশনী’র অফিস-কাম-স্টোর। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে তিনি আমার পাদুকার দিকে ইশারা করে মৃদু হেসে বললেন, ‘কাম করাইবেন না’? আমি বললাম, ‘কামের তো দরকার নাই’। সে একজোড়া স্যান্ডেল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘খাড়ায়া খাড়ায়া এক কাপ চা খান। জোতার মুখটা আন্ধার হইয়া রইছে। চা শেষ কইরা দেখবেন মুখ চমকাইতাছে’- বলে আবার সেই মৃদু হাসি। আমি অগত্যা আমার ফিতেহীন জুতো জোড়া খুলে দিয়ে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। বলা বাহুল্য, তিনি ছিলেন পুরাতন ঢাকার কুট্টি সম্প্রদায়ের একজন লোক। কুট্টিরা স্বভাবগতভাবে দারুণ কৌতুকপ্রিয় হয়ে থাকে। সচরাচর তাদের মুখে হাসি লেগেই থাকে, কখনো তা প্রাণখোলা, কখনো ক্রুর।
১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, এলাকাবাসীদের সংগঠন কর্তৃক একটা আউটিং (পিকনিক) এর আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকার অদূরে বেরিবাঁধের পার্শ্বে অবস্থিত ‘তামান্না গার্ডেন’ এ। সবাই যখন খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা, ফটো সেশন আর হৈচৈ এ ব্যস্ত, তখন আমার দৃষ্টি পড়েছিল তারকাঁটার ওপারে জীবন সংগ্রামের এই বয়স্কা যোদ্ধার প্রতি, যিনি চুপি চুপি তারকাঁটার নীচ দিয়ে প্রবেশ করে সংগ্রহ করছিলেন, না, কোন খাবার বা ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট নয়, কিছু খালি পানির এবং হাল্কা পানীয়ের প্লাস্টিক বোতল। দিনশেষে তার এ সংগৃহীত সম্ভার ভাঙারির দোকানে বিক্রয় করে হয়তো তার দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হবে। তারকাঁটার এপারের ওপারের বৈপরীত্য সেদিন মনে রেখাপাত করেছিল।
০৮ এপ্রিল ২০১৯, এই ছোট্ট মেয়েটি কেমাল আতাতুর্ক এভিনিউ এর বিভিন্ন পয়েন্টে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বেলী ফুলের মালা বিক্রয় করে তার যৎসামান্য জীবিকা নির্বাহ করে। তার নিজের জীবনে কোন সুবাস না থাকলেও সে হাসিমুখে পথে থেমে থাকা গাড়ীর চালক/আরোহীদের কাছে সুগন্ধি বেলী ফুলের মালা প্রতি পিস মাত্র দশ টাকায় বিক্রয় করে। দিন খারাপ গেলে পাঁচ টাকায়ও করে। তার এ ছবিটি আমি তুলি কাকলি ক্রসিং পয়েন্টে, গত ০৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে রাত ১০-২৭ মিনিটে। আমি এবং আমার সহযাত্রী মিলে তার দিনের অবশিষ্ট এ চারটি মালাই সেদিন কিনে নেই। সে হাসিমুখে বাড়ী ফিরে যায়, সে হাসির কাছে ফুলের সৌরভ ও সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়।
১৩ এপ্রিল ২০১৯, বহু শতাব্দী ধরে গ্রাম বাঙলায় চৈত্র মাসের শেষ দিনটিতে “চৈত্র সংক্রান্তি মেলা” অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সাধারণতঃ কোন খোলা জায়গায়, বৃ্দ্ধ বিটপীর ছায়াতলে কিংবা খেলার মাঠে এসব মেলা বসে থাকে। এই মুরুব্বী গত ১৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে, চৈত্র সংক্রান্তির দিনে তার বানানো হাতপাখার সম্ভার নিয়ে এসেছিলেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত “চৈত্র সংক্রান্তি” মেলায়। অতি সামান্য পুঁজি-নির্ভর তার ব্যবসা। তালপাতা দিয়ে হাতপাখা বানান তিনি। কিছু রেখেছেন স্রেফ তালপাতা আর বাঁশের কঞ্চির বুনটে বাঁধানো হাতপাখা হিসেবেই, এগুলোর ক্রেতা নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা, যারা আসন্ন গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে বাঁচতে এ পাখাগুলোকেই হাতে তুলে নেবেন, রাতে বিছানায় শিওরের পাশে রাখবেন। আর কিছু পাখা তিনি আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রঙিন ঝালর লাগিয়ে অনুপম সাজে সাজিয়েছেন, বোধকরি আরেকটু অবস্থাপন্ন গেরস্তদের জন্য, আর পাখার ঠিক মাঝখানে একটি অত্যন্ত সুন্দর কথা লিখে দিয়েছেন- “মনের মানুষ”।
জানিনা, সৌন্দর্য বর্ধনের এ কাজটি তিনি নিজে করেছেন, নাকি অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছেন। বোধকরি, এমন নান্দনিক কাজটি হয়তো কোন পুরুষের করা নয়, এ কাজে হয়তো তিনি তার স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধু বা অন্য কোন মহিলার সাহায্য নিয়েছেন। তাপদগ্ধ কারো দেহে এবং মনে যখন এ রঙিন ঝালর লাগানো পাখাটি শীতলতার পরশ বুলিয়ে যাবে, তখন হয়তো মনে মনে তিনি তার “মনের মানুষ” এর কথাই ভাববেন, তাকে নিয়ে পাখার রঙের মত অনেক রঙিন স্বপ্ন বুনে যাবেন! ঝালর লাগানো তালপাখা, বালিশের কভার, রুমাল এবং আগেকার দিনের মা/খালা/নানী/দাদীদের হাতে বোনা উলের সুয়্যেটার, মাফলার, হাতমোজা, নক্সীকাঁথা, ইত্যাদিতে সূচকার্যে লিখা কিছু কিছু কথা লিখা থাকতো। সেসব কথায় অনেক মায়া মমতা ও ভালবাসা জড়িয়ে থাকতো।
ছবিটি ময়মনসিংহ নিবাসী মনোয়ার হোসেন এর সৌজন্যে পাওয়া। তার অনুমতিক্রমে ছবিটি আমি আমার এই পোস্টে একটু ক্রপ করে সংযোজন করলাম। ছবিটি শেয়ার করার অনুমতি দেয়ার জন্য তাকে অশেষ ধন্যবাদ।
১৪ অগাস্ট ২০১৯, দুপুর দুই টা। এক বয়স্ক বাদাম বিক্রেতাকে দেখেছিলাম যমুনার উপর বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে থেমে থাকা ট্রেনের কামরায় কামরায় ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রী করতে। ট্রেনে উঠতে নামতেও তার কষ্ট হচ্ছিল। অতি সামান্য পুঁজি, অতি সামান্য লাভ- তাই দিয়েই নিরানন্দ জীবন যাপন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও এদের অবস্থার ইতর বিশেষ হয়নি।
২৫ অগাস্ট ২০১৯, দুপুর ১২-১৭। প্রখর রৌদ্রতাপে পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের আইল্যান্ডে বসে এই মহিলা তার সংগৃহীত পরিত্যাক্ত পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিক বোতল বিছিয়ে গোছাচ্ছিলেন। তার কপালে জমে ওঠা দু’ফোঁটা ঘাম বলে দিচ্ছে বাইরে তখন কতটা গরম! যানজটে আটকে থাকা আমার গাড়ীর দু’পাশে ভিখারি-ভিখারিণীর হাত পাতা ছিল, কিন্তু আমার দৃষ্টি ছিল একটু দূরের এই নারীর উপর, যিনি স্বাধীনভাবে জীবিকার্জনের জন্য এই কষ্টকেই গর্বের সাথে বেছে নিয়েছেন। শ্রমজীবি এ নারীর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা!
১০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখ দুপুর ২টা ৩৫ মিনিট। রাশ মেলা শুরু হবার আগের দিনে দিনাজপুরের কান্তজা মন্দির প্রাঙ্গণে বসা এক ঢোল বিক্রেতা অনেক উৎসাহ নিয়ে আমাকে কান্তজা মন্দির নিয়ে অনেক মজার গল্প শুনিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে রাশ পূর্ণিমা নিয়েও অনেক তথ্য জানা হয়েছিল।
ঢাকা
১৪ জানুয়ারী ২০২১
মৈনট ঘাটের সেই মাছ বিক্রেতা….
ছবি তোলার সময়ঃ ১১ জানুয়ারী ২০১৮, বিকেল ৪ঃ২০
বাংলাবাজারের জুবিলী রোডের সেই কুট্টি চর্মকার….
ছবি তোলার সময়ঃ ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯, বিকেল ৩;৫২
ঢাকার বেড়ী বাঁধ সংলগ্ন “তামান্না গার্ডেন” এর পিকনিক স্পটের তারকাঁটার ওপাশের সেই বয়স্কা জীবন-সংগ্রামী যোদ্ধা নারী…..
ছবিটি তোলা হয়েছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ তারিখ সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে।
কাকলি ক্রসিং পয়েন্টের সেই ছোট্ট মেয়েটি…..
ছবি তোলার সময়ঃ ০৮ এপ্রিল ২০১৯, রাত ১০ঃ২৭
গত ১৩ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে, ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত “চৈত্র সংক্রান্তি” মেলায় “মনের মানুষ” এর পসরা সাজিয়ে বসে থাকা সেই শীতল পরশ বিক্রেতা….
ছবিটি ময়মনসিংহ নিবাসী মনোয়ার হোসেন এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
যমুনার উপর বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তে থেমে থাকা ট্রেনের কামরায় কামরায় ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রী করা সেই বয়স্ক বিক্রেতা….
ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৪ অগাস্ট ২০১৯, দুপুর দুইটায়।
তার কপালে জমে ওঠা দু’ফোঁটা ঘাম বলে দিচ্ছে বাইরে তখন কতটা গরম!
ছবি তোলার সময়ঃ ২৫ অগাস্ট ২০১৯ দুপুর ১২ঃ১৭
২৫ অগাস্ট ২০১৯, দুপুর ১২ঃ১৭ এর সময় প্রখর রৌদ্রতাপে পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডের আইল্যান্ডে বসে এই মহিলা তার সংগৃহীত পরিত্যাক্ত পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিক বোতল বিছিয়ে গোছাচ্ছিলেন।
রাশ মেলা শুরু হবার আগের দিনে দিনাজপুরের কান্তজা মন্দির প্রাঙ্গণে বসা সেই ঢোল বিক্রেতা….
চিত্রগ্রহণঃ ১০ নভেম্বর ২০১৯ তারিখ দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে।