এর আগের পর্বটি পড়তে পারবেন এখানেঃ ক্ষণিকের দেখা এ মায়াময় ভুবনে-১
আজকের এ পর্বে ক্ষণিকের দেখা তিনটি চরিত্রের কথা বলবো, ঘটনার দিন-তারিখ উল্লেখসহঃ
০১ জনুয়ারী ২০২১, সকাল দশটা। গত চারদিন ধরে আম্মা রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল হাসপাতালের সন্নিকটস্থ ‘ডক্টর্স ক্লিনিক’ এ চিকিৎসাধীন আছেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে বিধায় চিকিৎসক জানিয়েছেন যে আজ কালের মধ্যে ওনাকে ছেড়ে দিবেন। আমরা চাচ্ছি যে হাসপাতাল থেকে বাড়ী নিয়ে আসার আগে তাঁকে আমাদের প্রস্তাবিত (কল করা) আরেকজন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা করে দেখুক। তাই আরো দুই একদিন দেরি হলে আমাদের তরফ থেকে কোন অসুবিধা নেই। গতকাল রাতে আম্মার পাশে রাত প্রায় একটা পর্যন্ত ছিলাম। আজ সকালে গোসল-নাস্তা সেরে আবার বের হচ্ছি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। এ কয়েকদিনে রিক্সায় যাতায়াত করে মোটামুটি এলাকার অলিগলি ও রাস্তা চিনে ফেলেছি এবং রিক্সাভাড়াও জানি। তবুও আমি অভ্যাসবশতঃ রওনা হবার আগে ভাড়া ঠিক করে নেই। অদূরে এক রিক্সাওয়ালাকে দেখতে পেয়ে তাকে ইশারায় ডাকলাম। কাছে এলে দেখি সে মধ্যবয়স্ক, মুখে হাল্কা চাপ দাড়ি, প্যান্ট শার্ট পরিহিত, স্মার্ট। তাকে গন্তব্যের কথা জানিয়ে ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম। সে এক গাল হেসে বললো, ‘স্যার আমি কখনো ভাড়া চেয়ে নেই না। আপনি যা দিবেন, সেটাই আমার জন্য সঠিক ভাড়া’। তার এই দার্শনিক মন্তব্যে আমি একটু অবাকই হ’লাম। আমিও তাকে হেসেই বললাম, ‘তুমি যেমন যাত্রীর কাছে কোন ভাড়া চেয়ে নাও না, আমিও তেমন কোন চালকের বাহনে ভাড়া ঠিক না করে উঠি না’। সে আবার হেসে বললো, ‘আমার কাছে কোন ক্যাচাল পাবেন না স্যার, যা দিবেন তাতেই আমি খুশি’। অগত্যা আমি উঠে পড়লাম।
রিক্সাওয়ালাকে স্বভাবে তার বয়সের তুলনায় একটু বেশিই চঞ্চল বলে মনে হলো। সারাটা পথ হয় সে গুণগুণ করে গান গেয়েছে, নয়তো বিপরীতমুখি চলমান অন্যান্য রিক্সাওয়ালাদের সাথে সালাম আদাব বিনিময় করেছে, নয়তো রাস্তার দুরবস্থার জন্য মেয়র কমিশনারদের অভিশপ্ত করেছে। গন্তব্যে পৌঁছে রিক্সা থেকে নেমে তার ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কিছুটা অতিরিক্ত একটা নোট দিলাম। সে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘স্যার কত রাখবো’? আমি বললাম, ‘পুরোটাই রাখো’। সে বললো, ‘স্যার বেশী দিলেন’। আমি বললাম, ‘তুমি যেহেতু কারো কাছে ভাড়া চাও না, কেউ না কেউ হয়তো তোমাকে কমও দিতে পারে’। সে আরেক প্রস্থ হেসে নোটটাকে কপালে ঠেকিয়ে সালাম দিয়ে বিদায় নিল। ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবলাম, জীবনে কোন প্রত্যাশা না রাখাই বোধ হয় সুখের পূর্বশর্ত!
০৩ জনুয়ারী ২০২১, সকাল এগারটা। গতকাল রাতে আম্মাকে নিওরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে ছোট ভাই এর বাসায় নিয়ে এসেছি। উনি ওদের সাথেই থাকেন। উনি যখন চলাচল করার মত উপযুক্ত ছিলেন, তখন বছরে দুই একবার ঢাকায় এসে আমার এবং আমার বোনের বাসায়ও থাকতেন। ২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে আমার বাসায় শেষ এসেছিলেন। আগামীকাল আমার কানাডা প্রবাসী বড় ছেলে কানাডা ফিরে যাবে। ডিমেনশিয়ায় আম্মার বোধশক্তি লোপ পেলেও আমি আম্মার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ‘আম্মা, আপনি এখন অনেকটা সুস্থ, খুব শীঘ্রই আরো ভাল হয়ে যাবেন ইন শা আল্লাহ। আমি আজ ঢাকা চলে যেতে চাই’। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, যাও’। আমি বললাম, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন’। উনি আবারো স্পষ্ট বললেন, ‘হ্যাঁ, দোয়া করতেছি’। অবাক কান্ড! গতকালও উনি এসব কথার কোন উত্তর দিতেন না, এবং কথাগুলো তিনি বুঝেছেন কিনা, তাও বোঝা যেত না।
বাসার অদূরে ছিল ‘নভো এয়ার’ এর বুকিং অফিস। আমি প্লেনের টিকেট কাটার জন্য সেখানে যাবার সময় লক্ষ্য করলাম, ওদের অফিসের খানিকটা আগেই, রাস্তার অপর পার্শ্বে ‘আনিসা ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস’ নামে একটি ছোট্ট অফিস। অফিসটা কেবল খুলেছে, একজন ব্যক্তি অফিস ঝাড়া মোছা করছে। আমি এগিয়ে গিয়ে সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনারা কি বিজনেস শুরু করেছেন? আজকের বিকেলের বা সান্ধ্য কোন ফ্লাইটে কি ঢাকা যাবার টিকেট পাওয়া যাবে’? উনি বললেন, ‘একটু বসেন, কেবলমাত্র অফিস খুললাম, আমি ল্যাপটপ অন করেই আপনাকে জানাচ্ছি’। অফিসে কেবল উনিই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন। নিজেই ঘর ঝাড়া মোছা করে টিকেট বিক্রয় করতে বসেন। আমি বললাম, ‘আচ্ছা আপনি দেখতে থাকুন, আমি নভো’র অফিসে যাচ্ছি। যদি নভোতে টিকেট পাই, আপনাকে আমি দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই ফোনে জানাবো। আর যদি নভোতে না যাই, তবে ফিরে এসে আপনার কাছ থেকেই টিকেট কিনবো’। আমি নভোকে একটু প্রিফার করছিলাম, কারণ পাঁচদিন আগে ঢাকা থেকে রংপুরে আসার সময় নভোতেই এসেছিলাম এবং ওদের সার্ভিস মোটামুটি ভালই লেগেছিল। ওনার নাম ‘লিংকন’, এ কথা জনিয়ে উনি আমাকে ওনার একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন। একজন ঐতিহাসিক, বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির নামে রাখা তার নাম। কার্ডটা দেখে আমি আরেকবার তার মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখেও কালো চাপদাড়ি ছিল।
নভোতে গিয়ে দেখি, সেটাও ‘এক-ব্যক্তি’র অফিস, কিন্তু সেখানে সামনে ল্যাপটপে নিমগ্ন ব্যক্তিটি আমার দিকে চোখ তুলেই তাকাচ্ছেন না। আমি টিকেটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই মূল্য জানালেন। কাস্টমারকে গ্রীট করার ন্যূনতম সৌজন্যবোধ তার মাঝে অনুপস্থিত। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিস্টার লিংকন এর কক্ষে ফিরে এলাম। উনি জানালেন, বিকেল চারটার ফ্লাইটে ‘নভো এয়ার’ এবং ‘ইউএস বাংলা’, উভয়টাতেই একই মূল্যে টিকেট পাওয়া যাবে। নভোতে করলে উনি টিকেট ‘ভিআইপি’ করে দিতে পারবেন, ইউ এস বাংলায় আপাততঃ পারবেন না। তবে আমি চাইলে তিনি চেষ্টা করবেন, তার ফলাফল কয়েক ঘন্টার আগে জানা যাবে না। আমি ওনাকে জানালাম, আমি কোন ‘ভিআইপি’ নই, একটি সাধারণ টিকেটই আমার জন্য যথেষ্ট। উনি হাসিমুখে আমার টিকেট প্রিন্ট করে দিলেন, এবং আমার ই মেইল ঠিকানা চেয়ে নিয়ে আমাকে একটা মেইলও করে দিলেন।
বাসায় ফিরে লাঞ্চ করে আম্মার কাছে বিদায় নিতে গেলাম। ‘আম্মা আসি’ বলে কিছুক্ষণ ওনার গলা জড়িয়ে বসে থাকলাম। তারপর ওনার ডান হাতটা আমার দু’হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আয়াতুল কুরসি ও কিছু দোয়া দরুদ পাঠ করলাম। দেখলাম, উনি আস্তে আস্তে ওনার বাম হাতটিকেও টেনে এনে আমার দু’হাতের সাথে মেলালেন। বুকটা ভারী হয়ে আসছিল। আমি ওনার দু’পায়ে সালাম করে বাসার অন্যান্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম। বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক, রংপুর শাখা’র কাছ থেকে ইউএস বাংলার একটি কোস্টার অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে ৪০ কিমি দূরে অবস্থিত সৈয়দপুর বিমান বন্দরে যাত্রীদেরকে নিয়ে যায়। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখি, চালকের পাশের আসনে একজন পুরুষ যাত্রী বসা, চালকের ঠিক পেছনের তিন জনের আসনে আরেকজন পুরুষ যাত্রী বসা এবং তার পেছনের তিন জনের আসনে একজন মহিলা যাত্রী বসা। একেবারে শেষের চারজনের আসনগুলো ফাঁকা। চালক আমাকে বসানোর জন্য দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশের ইঙ্গিত করলো। কিন্তু দরজার সন্নিকটস্থ ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিটি দু’পা সামনে মেলে আরামে বসে সেলফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন, তিনি ‘নট নড়ন, নট চরন’। অগত্যা চালক দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমাকে ওপাশের দরজার কাছে নিয়ে এসে দরজা খুলে ধরলো, আমি ভেতরে আসন গ্রহণ করলাম।
তরুণ বয়সে রংপুর-সৈয়দপুর আমার কর্মক্ষেত্র ছিল। সে উপলক্ষে তখন আমি বহুবার, প্রতিমাসে কয়েকবার, রংপুর-সৈয়দপুর যাতায়াত করতাম। এ কারণে সড়কের এবং তার আশে পাশের চিত্র আমার প্রায় মুখস্তের মত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পর সেদিন আমার পরিচিত সড়কটাকে অনেকটাই অপরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি বসেছিলাম চালকের ঠিক পেছনে। সামনে কিছু দেখা যাচ্ছিল না বলে আমি মাঝে মাঝে সামান্য একটু বাঁয়ে চেপে সামনের রাস্তা ও তার আশে পাশে তাকাচ্ছিলাম, আমার সেই চির-পরিচিত সড়কটাকে খুঁজে পাবার জন্য। কিন্তু এতে মনে হলো পাশে বসা সেই সেলফোনে ব্যস্ত (অ)ভদ্রলোকটির কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে। মাঝের আসনে ছড়িয়ে রাখা জ্যাকেটটাকে তিনি কিছুটা সরিয়ে নিলেন, হয়তো করোনা ভীতির কারণে। আমিও তার অস্বস্তি টের পেয়ে খানিকটা সরে এলাম।
হঠাৎ গতকাল মিস্টার লিংকন এর কাছ থেকে ফোন পাই। তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেদিন ঠিকমত পৌঁছেছিলাম কিনা, এবং পথে কোন অসুবিধে হয়েছিল কিনা। পরবর্তীতে কখনো ওনার সেবা গ্রহণ করলে উনি ওনার সর্বোত্তম সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন।
চলার পথের ক্ষণিক দেখা মুখগুলোকে মানুষ স্মরণে রাখে, কোনটা ভাল স্মৃতি হিসেবে, কোনটা মন্দ।
ঢাকা
১১ জানুয়ারী ২০২১
ভাইয়া ক্যামন আছেন?
এটা কি গত বছরের ঘটনা নাকি এই বছরের?
এই বছরের হলে লেখায় সন ২০২২ হবে।
আন্টি ক্যামন আছেন এখন?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আমি ভালো আছি। অনেকদিন পরে তোমাকে এ ব্লগে দেখে ভালো লাগছে।
হ্যাঁ, এটা গত বছরের ঘটনাই। ব্লগে একেকটা পোস্ট একাধারে কয়েকমাস পর্যন্ত প্রথম পাতায় থাকে বিধায় আগে পোস্ট করতে পারিনি।
আম্মা এখন চলৎশক্তিহীন, এ ছাড়া ভালোই আছেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।