সেন্ট পল, মিনেসোটা, আমেরিকা। লিবারেল আর্টস-এর এক শিক্ষাঙ্গন ‘ম্যাকাল্যাস্টা কলেজ’’। ‘সাহিত্য আর সৃজনশীল লেখনী’ (লিটারেচার এন্ড ক্রিয়েটিভ রাইটিং) বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। পড়াচ্ছেন ২০০৭ সাল থেকে। তাঁর নিজের পড়াশোনাও ছিল এসব নিয়েই। ‘ভাষা ও সাহিত্য’ (ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার) নিয়ে গ্রাজুয়েশন করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে, ১৯৯১ এ। মাস্টার্স করেছেন ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ বিষয়ে উইল্কস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ২০০৬ এ।
মিনেসোটা, নিউইয়র্ক আর জ্যামাইকা – এই তিন জায়গায় তাঁর নিয়মিত বিচরণ। সাহিত্য নিয়েই কাটাচ্ছেন জীবন। পড়ান, পড়েন আর লেখেন। ছোটগল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন অনেক। ‘স্কয়ার’, ‘গ্র্যান্টা’ কিংবা ‘দ্য ক্যারিবিয়ান রিভিউ অব বুকস’ সেগুলোর যে ক’টা ছেপেছে তা সুখপাঠ্য ও সমাদৃত।
১৯৭০ সালে জ্যামাইকার কিংস্টনে জন্ম নেয়া মানুষটা উপন্যাস লিখেছেন মাত্র তিনখানা। এর মধ্যেই মাত্র এক দশক সময়ের ভেতর উল্লেখ করবার মতোন আটখানা পুরস্কারও জুটে গেছে তাঁর। সর্বশেষ পুরস্কারটি অতি সম্প্রতি বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে মানুষটিকে।
প্রথম উপন্যাসেই নজর কেড়েছিলেন উপস্থাপনা ও বক্তব্যের আঙ্গিকে। ভালো আর মন্দের দ্বান্দিক সংঘাত, ধর্ম, সমাজ, ব্যক্তি, সকল দৃষ্টিকোণ থেকে এক নিদারুন ঢঙে তুলে এনেছেন “জন ক্রো’জ ডেভিল” উপন্যাসে। মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা বিবেচনা এবং ঘটনার মোড়কে ঔপনিবেশিকতা পরবর্তী সময়ে আপন সত্তার সন্ধান, ধর্মান্ধতা আর অরাজকতার বিপরীতে সমাজ ও ব্যক্তি নিজেকে মুক্তির আলোকে উন্মোচিত করবার সংগ্রামকে পাঠকের জন্য বহুমাত্রিক বিবেচনায় দৃশ্যমান করে তুলেছেন তিনি অনন্য সাবলীলতায়। সমালোচকেরা বলেছেন “দশ লক্ষ চোখে যেনো সে দেখেছে সবকিছু আর ঐশ্বরিক বিবেচনায় সেসব কিছুকে তুলে এনেছে শব্দের মোড়কে”। ২০০৫ এ প্রথম গ্রন্থ, প্রথম উপন্যাস দিয়ে এভাবেই তাঁর যাত্রা শুরু।
প্রথম বইটিই তাঁর নির্বাচিত হয়েছিল ‘লস এঞ্জেলেস টাইমস বুক প্রাইজ’-এর বিবেচ্য গ্রন্থতালিকায়। পুরস্কারের বরমাল্য সেবার না জুটলেও পাঠকদের ভালোবাসা আর সমালোচকদের সমীহ তাঁর জুটেছিল অপার। তারপর খুব বেশী দিন তাঁকে অপেক্ষার পিঁড়ি পেতে বসে থাকতে হয়নি।
২০০৯ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস “দ্য বুক অব নাইট ওম্যান” প্রকাশনার বছরই একটি এবং তার পরের বছর দু’টি পুরস্কার তাঁকে এনে দেয়। প্রতিদিন তিন তিন বার করে গণ ধর্ষণের শিকার নারী শ্রমিক ও যৌনদাসী এক চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত এ উপন্যাস। কোনো এক সকালে ঘুম ভেঙে উঠেই আশ্চর্য মনস্তাত্বিক শৌর্যের অধিকারী এক নারী শ্রমিক উচ্চারণ করে দৃঢ় প্রত্যয়। এরকম ভাবে ক্ষয়ে মরবার চেয়ে মুক্তির অন্বেষায় প্রাণ দিলে তবু জীবনের কিছু মানে থাকবে। এমন ঘরানার কথার মোড়কে আঠারো শতকের চিনিকল রসদ উৎপাদন খামারে দাস প্রথার নির্মম বাস্তবতা আর অনিশ্চিত জীবনের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পাশে প্রেম-দ্রোহ ও জীবনের দ্বান্দিক চিত্রটি এঁকেছেন পূর্ণ বাস্তবতার ছোঁয়ায়। তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন সমাজ পরিবর্তেনের আর সত্য উন্মোচনের এক নতুন উচ্চারণ। যার ঢঙ মানুষকে আকর্ষণ করেছে। করেছে মুগ্ধ। উপন্যাস জুড়ে কথার বুনন আর বর্ণনার শৈলী এমনই নিখুঁত, পুঙ্খ আর দৃঢ় যে তা পাঠককে গভীরভাবে আঁটকে ফেলবেই। সমাজের জাতি বর্ণ বিভেদের ক্লেদ থেকে গভীর ভালোবাসায় ঐতিহ্য, অতীত, সমাজ ও কৃষ্টির সংকটগুলোকে উন্মোচিত করেছেন। কুসংস্কার আর নিয়তির শৃঙ্খল ভঙ্গের ইঙ্গিত তিনি উচ্চারণ করেছেন অবাক দক্ষতায়। পাঠক তাই অনায়াসে বইটাকে ভালোবেসে ফেলবে আবেগে।
সবুজ চোখের কালো চামড়ার এক দাসীকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এর কাহিনী। কাল্পনিক ভাবনা চিন্তা, আবেগ, ভালবাসা, ক্ষোভ, প্রেম, জীবনের টানা পোড়েন, বিরহ, যন্ত্রণা, উপলব্ধি, উপশম সম্ভাবনা এসব চিরকালই সাহিত্যের প্রধানতম উপজীব্য। এসব ছাড়া জীবনবোধের কথা যেমন গড়ে ওঠেনা তেমনি ভাগ্যপীড়িত মানুষের মানবেতর জীবন ও যাতনাকে বাদ দিলে অনেক গভীর এবং শক্তিমান সাহিত্য সৃষ্টির প্রেক্ষিত সভ্যতা পেতোনা। বাস্তব ইতিহাস, অতীত, সমস্যা, সংকট, মানুষের দুর্ভোগ, অন্তর্গত দ্বন্দ, বিক্ষোভ – এগুলোকে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল আঙ্গিকে সমান্তরাল উন্মোচনে টানটান উপস্থাপনায় অভিনব পারঙ্গময়তায় কথার বুননে সাজিয়েছেন তিনি লেখায়। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব। এর স্বীকৃতি ২০১৩ আর ২০১৫ সালে এই লেখককে এনে দিয়েছে দু’টি বিশেষ সন্মাননা পুরস্কার।
তৃতীয় ও সর্বশেষ গ্রন্থটি তাঁর “আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ সেভেন কিলিংস”। ২০১৪ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি প্রথম বছরই তাঁকে দিয়েছে ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল এওয়ার্ড’। পরের বছর ‘এনিসফিল্ড-উল্ফ বুক এওয়ার্ড’। আরো ক’দিন না যেতেই বিশ্বের দরবারে উন্মোচিত হলো তাঁর নাম অনন্য এক সন্মাননা পুরস্কারে। ২০১৫ ‘ম্যান বুকার প্রাইজ’ পেলো তাঁর তৃতীয় উপন্যাসটি।
জটা চুলের ফ্যাশনে ঝাঁকড়া মাথাটিকে ঝুঁটিতে সামাল দিয়ে, টাক্সিডো – বো টাই পরিধান করা মানুষটা স্মিতহাস্যে মঞ্চে উঠে পুরস্কার নেবার অনুভূতি বলছিলেন সহজ ভাষায়। “হে আমার ঈশ্বর! আহা কি দারুন! আপনাদের কাছে কথাটা হাস্যকর মনে হলেও – আমার কিন্তু কেবলি মনে হচ্ছে কাল সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠেই আবিস্কার করবো যে আজকের ঘটনাটা আসলে বাস্তবে ঘটেনি।”
অনন্য এই মানুষ, কৃতি লেখকটি হলেন ‘মার্লোন জেমস’। ১৯৭০ সালে জন্মের পর সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, মাদক বানিজ্যের প্রভুদের লাগামহীন দৌরাত্যে বিপর্যস্ত জীবন সমুদ্রের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন। এসবের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা হাজারো মানুষের মধ্যে ব্যতিক্রমী ও অনির্বচনীয় সংবেদনশীলতা আর সাহিত্যিক মননের হাপরে কতোটা ক্ষরণ, কতোটা চেতনার দহন, ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও বিপ্নবের চিৎকার ভেতরে ভেতরে তাঁকে পোড়াচ্ছিল তা অপরিমেয়। তাই এসবের শক্তিমান ও অর্থবহ প্রকাশ তাঁর তিন তিনটি উপন্যাসেরই পরতে পরতে।
সর্বশেষ উপন্যাসটিতে সোজা সাপ্টা তুলে এনেছেন র্যাগে গানের সম্রাট ‘বব মারলে’ আর তাঁর সঙ্গীদের নৃশংস খুনের নির্মমতার ইতিহাস। এটি কেবলি একটি হত্যা প্রচেষ্টা নয়,একটি ঘটনা নয়। এটি গোটা দেশ জুড়ে চলমান অরাজকতার ধারাবাহিকতা। এমন সমাজ দর্পণকে ঘিরে তাঁর উপন্যাসটি নির্মম সত্যের এক শৈল্পিক দলিল। বিপর্যস্ত সমাজের গোপন চেহারাগুলো এখানে বিম্বিত হয়েছে বেলজিয়ান কাঁচের স্বচ্ছতায়।
সত্তরের দশকে শৈশব-কৈশোর থেকেই বাস্তবের নির্মমতা তাঁর মনে কতোটা দাগ কেটেছিলো, অন্ধকার কতোটা বিবমিষায় টেনেছিলো। তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে লেখায়। বুকার পুরস্কারের সাতচল্লিশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন জ্যামাইকানকে নির্বাচিত করতে তাই একটুও বেগ পেতে হয়নি বিচারকদের। বইটার এক অংশে স্থানীয় কথ্য ভাষাকে অবিকৃত ভাবে উপস্থাপন করেছেন মার্লোন। আবার অন্য অংশে বাইবেলীয় কথা ও ভাবনা এবং কুসংস্কার ও অপকে প্রকাশ করেছেন। মিছিলে শ্লোগানের মতো অসংখ্য কন্ঠে উচ্চারণ করিয়েছেন প্রতিবাদের আর মুক্তি সন্ধানের শব্দমালা। গতানুগতিক উপন্যাসের মতোন এক বা দু’চার চরিত্রের বদলে বুকার পুরস্কারের বিচারকেরা পঁচাত্তরটিরও বেশী চরিত্রের ভেতর দিয়ে লেখকের বক্তব্য উচ্চারিত হবার বিষয়টি আবিষ্কার করেছেন। চ্যানেল এইচবিও ইতিমধ্যেই বইটিকে নিয়ে একটি ধারাবাহিক নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
আজকের দিনে বিশ্ব যখন আধুনিক সামন্তবাদ আর ধর্মান্ধতার থাবায় প্রতিদিন মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে। প্রতিনিয়ত জীবনের পরতে পরতে ভীতি ও ত্রাসের ভাইরাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তখন এমন কোরাস কন্ঠে অন্ধকারের আড়াল উন্মোচন ও মুক্তিকামী প্রতিবাদী উচ্চারণ নিশ্চিত ভাবেই সামাজিক পতন আর ক্ষয় রোধে এক অপূর্ব প্রতিশেধক, কোনো অনন্য পেনিসিলিন। বুকার পুরস্কার যেনো সেই পেনিসিলিনকে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেবার অমোঘ আলাদীনের চেরাগ হয়ে উঠেছে এই পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
ধন্যবাদ বুকার। ধন্যবাদ জ্যামাইকা। ধন্যবাদ মার্লোন জেমস।
১৫ অক্টোবর ২০১৫
জ্যামাইকা শুনলেই বব মার্লের কথা মনে ভেসে ওঠে। অভিনন্দন মার্লের স্বজাতি মার্লোন-কে। :clap:
এনার কোনও বই পড়ি নি, আপনার পড়া থাকলে বিস্তারিত রিভিউ লিখুন না লুৎফুল ভাই। 🙂
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
ছেঁড়া ছেঁড়া একটুখানি পড়েছি।
তাঁর তিনখানা বইই জোগারের চেষ্টায় আছি।
তবে বড় আকারের বই। রিভিউ বা অনুবাদ করতে গেলে লম্বা সময় নিয়ে কাজ করতে হবে।
কিন্তু যতোটা পড়েছি তাতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে আমারও। দেখা যাক।
তোমার আগ্রহ আমাকে আরো খানিক উস্কে দিলো ...
অপেক্ষায় রইলাম 🙂
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
🙂
বই পড়ার মত ধৈর্য্য হবে না।
যদিও টিভি সিরিয়ালে পুরোপুরি সবকিছু উঠে আসবে না, তবুও ওটার অপেক্ষায় থাকলাম।
এইচবিও সাধারণত অনেক যত্ন করে সিরিয়াল বানায়, নিশ্চয়ই এটাও ব্যতিক্রম হবে না।
লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ, লুৎফুল ভাই। 😀
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
এইচবিও বানালে ভালো কিছু হবার কথা তো অবশ্যই।
আর ওটা জানার পর থেকেই আমার মাথায় কেবলি ঘুরছে "রুটস" বই আর তার সেলুলয়েড ফরম্যাটের কথা।
ওর ব্যাপারে আরো কিছু শেয়ার করবার ইচ্ছে আছে। দেখি পারা যায় কিনা।
পড়বার ও মন্তব্যে প্রাণিত করবার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে ভাই। 🙂
খুব চমৎকার লিখেছো, লুৎফুল। ভেরী এনলাইটেনিং।
মার্লোন জেমস সম্বন্ধে মোটেই কিছু জানতাম না। এখন জানলাম এবং ঋদ্ধ হ'লাম।
শেষের অনুচ্ছেদের চারটে লাইন দারুণ হয়েছে। জ্বলজ্বলে, ঋজু বক্তব্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ খায়রুল ভাই। আমি নিজেও তো জানতাম না তেমন কিছুই। তাঁর নামটা ঘোষণা হতেই তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে কিছুটা জানা। আর এখানে শেয়ার করা।
তাঁর বইগুলো পড়বার ইচ্ছে মাথায় চেপেছে খুব। আনাবার পথ খুঁজছি। পড়লে তা নিয়ে আরো বলার ইচ্ছে আছে।
আবারও ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত করবার জন্য।