ক্ষণিকের দেখা এ মায়াময় ভুবনে-১

গত ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে অস্ট্রেলিয়া-নিউযীল্যান্ড সফর শেষ করে ঢাকা ফিরে এসে দীর্ঘদিন খুবই কঠোরভাবে ‘স্বেচ্ছাবন্দী’ (Self Quarantined) হয়ে ঘরের মাঝে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম। যা কিছু ঘোরাঘুরি পায়চারি, ঐ ঘরের মধ্যেই। তিনমাস এভাবেই ছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে এ নিয়মে শৈথিল্য আসে। এখন মাসে একবার করে ডাক্তারের পরামর্শ/ঔষধ সংগ্রহের জন্য সিএমএইচ এ যাই, ব্যাংকের কাজগুলোও জমিয়ে রাখি একই দিনে করার জন্য। কয়েকমাস পর পর পেনশনও তুলি ঐ একই দিনে, সমন্বয় করে। মাসে আরেকদিন করে বের হই বাজার করার উদ্দেশ্যে। ব্যস, এ পর্যন্তই আমার বাইরে যাওয়া। গত নয়মাসে মাত্র একটি দিনে পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে বের হয়েছিলাম একত্রে ঘরের বাইরে ডিনার করতে, আরেকদিন আমার এলাকাতেই আমার এক কোর্সমেট এর বাসায় গিয়েছিলাম লাঞ্চ করতে। সেই কোর্সমেট বোধকরি গত নয় মাসে লকডাউনের সদ্ব্যবহার করে বিশেষ অধ্যবসায়ের সাথে তার আগে থেকে জানা রন্ধনশৈলীতে উৎকর্ষতা অর্জন করেছে। হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে সে সকল কোর্সমেটদেরকে এই বলে দাওয়াত দিয়েছিল যে বাজার করা থেকে রান্না এবং পরিবেশনার সকল আয়োজন সে নিজেই সম্পন্ন করবে। আর এ মহত কর্মটি করার জন্য সে বেছে নিয়েছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, বাংলাদেশের বিজয় দিবস- ১৬ই ডিসেম্বর। এমন একটি দিনে তার আন্তরিক আমন্ত্রণকে সম্মান জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হয়েছিলাম, তার রন্ধন উৎকর্ষতা পরখ করার সুযোগ নিতে এবং অনেকদিন পর আমাদের ৪৫ বছরের পুরনো বন্ধুদের সাথে কিছুটা সময়ের জন্য আলাপচারিতায় অংশ নিতে।

উপরের উপক্রমণিকাটুকু আজকের আলোচ্য পোস্টের মূল বক্তব্যের সাথে হয়তো প্রাসঙ্গিক নয়, তবুও কথাগুলো বললাম শুধু এটুকু বোঝানোর জন্য যে করোনার কারণে গত দশ মাস ধরে আমার বাইরে বের হওয়াটা অত্যন্ত সীমিত পরিসরে ঘটছে। উপরোল্লিখিত রুটিন অনুযায়ী আজও ছিল আমার সিএমএইচ ও ব্যাংকে যাওয়ার দিন। ঔষধ সংগ্রহ করে কার পার্কে ফিরে যাবার জন্য কেবলমাত্র লিফটে প্রবেশ করেছি। লিফটে আমি একাই ছিলাম। দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখলাম একজন ব্যক্তি হন্তদন্ত হয়ে লিফটের দুই দরজার মধ্য দিয়ে তার হাতটি ঢুকিয়ে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘ভাই আমার হাতটি একটু ধরেন’। আমি করোনা প্রটোকল ভুলে গিয়ে ডান হাত দিয়ে তার হাতটি ধরলাম, আর বাম হাত দিয়ে লিফটের “ডোর ওপেন” বাটন টিপলাম। লিফটের দরজা প্রসারিত হলে উনি ভেতরে ঢুকে আমাকে বললেন, ‘আমার প্রেশার খুব হাই। ডাক্তার আমার প্রেশার দেখে আর কোন কথা না বলে আমাকে সোজা ইমার্জেন্সি/ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে রিপোর্ট করতে বলেছেন’। ইমার্জেন্সি/ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডটি নীচতলায়, অর্থাৎ আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানেই। আমি বললাম, ‘চলেন, আমি আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেব’। দেখলাম, ওনার হাতে ধরা একটি ‘সিক রিপোর্ট বুক’, তার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা একটি প্রেসক্রিপশন মাথা বের করে আছে। উনি জানালেন, ইতোপূর্বে ওনার দু’বার স্ট্রোক হয়েছিল। তার থেকে অনুমতি নিয়ে তার প্রেসক্রিপশনটি দেখলাম। সেখানে তার ব্লাড প্রেশার ১৫০/১১০ উল্লেখ করে তাকে জরুরি বিভাগে রিপোর্ট করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ওনার পরিচয় পেলাম, উনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার, নাম দলিলুর রহমান (সম্ভবতঃ, ইতোমধ্যে স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে)। লিফট থেকে বের হয়ে ওনার হাত ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে ‘ইমার্জেন্সি/ক্যাজুয়ালটি’ ওয়ার্ডে তাকে পৌঁছে দিলাম। লিফট থেকে নামতে নামতে এবং ঐ টুকু পথ হাঁটতে হাঁটতে তার সাথে সামান্য আলাপচারিতায় জানতে পারলাম, তার বড় মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে একটা জব করছে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াতে তিনি বললেন, ‘আপনি অনেক কষ্ট করলেন। আপনার পরিচয়’? আমার পরিচয় জানালে একটি স্যালুট দিয়ে তিনি আবারও বলতে থাকলেন, ‘অনেক ধন্যবাদ স্যার, আমার জন্য আপনি অনেক কষ্ট করেছেন’। আমি বললাম, ‘কোন ব্যাপার না, আজ আমি আপনাকে একটু সাহায্য করলাম, কাল হয়তো আমাকেও কেউ সাহায্য করবে। দোয়া করছি, আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে যাবেন’।

দুই দুইবার স্ট্রোকে আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি এত হাই প্রেশার নিয়ে একা একা সিএমএইচে এসেছেন দেখে কিছুটা অবাকই হ’লাম। হয়তো কোন সঙ্গত কারণে পরিবারের অন্য কেউ সাথে আসতে পারেনি। তার অবসরকালীন পদবী ‘মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার’- অর্থাৎ তিনি তার পেশাগত সোপানের শীর্ষে আরোহণ করেই অবসরে গিয়েছিলেন। আবার বড় মেয়েকেও লেখাপড়া শেষ করিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকুরি পাবার উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়ে তিনি একজন সফল মানুষ। তারপরেও, তিনি একা!
জগতের সকল প্রবীণেরা সুস্থ থাক, নিকটাত্মীয়দের সান্নিধ্যে থাক, উষ্ণ ভালবাসায় থাক, মায়ায় মায়ায় থাক!

ঢাকা
১০ জানুয়ারী ২০২১

৭৬৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ক্ষণিকের দেখা এ মায়াময় ভুবনে-১”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    মানবজীবনের চলার পথটি স্যার একই হলেও আমরা জীবনের সেই পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত আত্মপোলব্ধি করতে পারিনা বা করার চেস্টা করিনা - এ আমাদের সহজাত আত্ম-প্রবঞ্জনা। তবুও জীবন থেমে থাকে না, সেই ফুরসত কিংবা অবকাশই হয়ত নেই।

    তবুও আমাদের থাকতে হবে একে অপরের পাশে, চলতে হবে হাত ধরাধরি করে - আপনার লেখার এই মর্মার্থ হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।