সবকটা জানালার কাঁচ কালো কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া।
জানালার কপাটও ভেতর থেকে পুরোপুরি লক করা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
ছাদ বরাবর ছোট্ট ভেন্টিলেটরটা দিয়ে সামান্য যা একটু আলো এসে পরছে, তাতে পুরোপুরি লাভ না হলেও অন্ততঃ ঘুটুঘুটে অন্ধকার ভাবটা কিছুটা দূর হয়েছে।
তিতিনা, জ্যাকি আর নিনি হাটু ভেঙে মাথা গুজে উপুড় হয়ে বসে আছে একটা কোনায়। এদিকের বেডের সাথে হেলান দিয়ে আছে নিহাদ, দীপ আর সান। গায়ের এপ্রনও কেউ খোলেনি এখনো। জ্যাকির হাতে টেবিল ল্যাম্পটার সুইচ, শূণ্য দৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে একটু পরপর জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে আনমনেই। কারো মুখে কোন কথা নাই। র্যাংপান মেডিকেল ইউনিভার্সিটির এই ক’জন ছাত্রকে আজ রেস্টিকেট করা হয়েছে। আরো দু’জন আছে ফারিন আর ফিদো। ওরা কোথায় আছে সেই খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। যে ব্যাপারটা সত্যিই ঘটে গেলো তিন ঘন্টা আগেও কল্পনা করেনি কেউই! নিহাদ যখন লেটারটা হাতে পেলো নিজ চোখে বিশ্বাস হচ্ছিলো না প্রথমে। নিচে ডানপাশে স্পষ্টাক্ষরে ডীনের স্বাক্ষর করা, ডাঃ রাউফলিন ক্রেন। ব্যাপারটা পুরো ভার্সিটি জানাজানি হতে এক ঘন্টার বেশি লাগেনি। তার এক ঘন্টা পর যে খবরটা আসলো সেটা এটার চেয়েও ভয়াবহ! ফারিন আর ফিদো-কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে!! স্টেট নিরাপত্তা বিভাগের একটা ভ্যান এসে ওদের দুজনের মাথা কালো কাপড়ে ঢেকে তুলে নিয়ে যায়! কেউ একটা উচ্চবাচ্চও করে নি! ম্যাডাম প্রিয়ন তড়িঘড়ি করে এসে সানকে জানায় গ্রেপ্তারের ঘটনাটা। ওদেরকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে আগে থেকেই আঁচ করতে পেরে প্রিয়ন-এর কথামতই ততক্ষণাৎ পালিয়ে এসে ম্যাডামের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে ওরা ছ’জন। প্রিয়ন বাগান-বাড়ির পেছনের দিকের পড়ে থাকা স্টোর-রুমটায় ওদেরকে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছে। বলা যায় না, ম্যাডামের বাসাও সার্চ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এই ব্যবস্থা। প্রিয়নের সাথে সান-এর ভালো ঘনিষ্টতা আছে। প্রিয়ন খুব বেশি সিনিয়র না। একটা এসাইনমেন্টের কাজে প্রিয়নকে সাহায্য করেছিলো সান, সেখান থেকেই পরিচয়।
নিহাদ-ই প্রথম নীরবতা ভাঙলো।
–“আমরা কী জাস্ট এভাবেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো!!! কিছু একটা তো করা উচিত। অন্ততঃ আমাদের দোষটা কোথায় সেটা তো আমাদের জানানো হোক! মগের মুল্লুক নাকি!!” সাইজে একটু শর্ট হলেও নিহাদ-এর মাথা বেশ শার্প। লজিক ছাড়া এক লাইন বেশি বলে না। অন্যায়কে অন্যায় বলতে দ্বিধা করে না-এমন গোছের।
ওপাশ থেকে ত্রিরত্ন মাথা নাড়লো। তিতিনা, জ্যাকি, নিনি- এই তিন কণ্যাকে ওরা ত্রিরত্ন ডাকে। নামকরণ অযথা না। তিনজনের ব্রেইনই সুপারসনিক। ছোটবেলা থেকেই তিনজনই একই স্কুলে পড়াশুনা করেছে। তারপর এসে একই সাথে এই মেডিকেলেও। তার উপর তিনজনই শোনা গেছে কারাতে ব্ল্যাক-বেল্টধারীও। সমীহ করে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দীপ এপাশ থেকে খোচা দিয়ে বলল, “হ্যা, ত্রিরত্ন শুরু করুন আপনারা। কী বলার আছে?”
জ্যাকি চোখ গরম করে দীপের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি দিলো। সে দৃষ্টিতে আত্মা শুকিয়ে ভস্ম হওয়ার কথা।
–তোরা একটু সিরিয়াস হবি দয়া করে??? নিহাদ-এর ক্ষ্যাপা গলা শোনা গেলো।
সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো, সিরিয়াস হওয়ার আগে সম্ভবত এভাবেই রেসপন্স করার নিয়ম।
ঠিক এসময়ই দরজায় লক খোলার আওয়াজ এলো। ম্যাডাম প্রিয়ন-এর মুখে আতঙ্ক। খুব ভালো খবর না বোঝাই যাচ্ছে।
–“ভালো করে বুঝাও তো, তোমরা কী করেছ? গত কয়েক সপ্তাহর মধ্যে প্রিন্সিপালের সাথে কোনরকম ঝামেলা, কিংবা কারো বিরুদ্ধে আন্দোলন টাইপ কিছু বা ভার্সিটির আওতাধীন বেয়াইনী এমন কিছু?”
‘না’-সূচক মাথা নাড়ালো সবাই।
প্রিয়ন বলা শুরু করলো-
“Lion House (L.H.) ফার্মাসিউটিক্যালস-এর নামকরা ফার্মাসিস্ট কার্ল লুইস-এর তত্ত্বাবধানে প্রফেসর ক্রেন সহ তোমাদের মেডিকেলের আরো ক’জন প্রফেসরদের একটা টীম গত আড়াই বছর ধরে একটা সেক্রেট রিসার্চের সাথে যুক্ত। তোমরা জানো কিনা জানি না। অনেক চেষ্টা চালিয়েও কোন সংবাদ মিডিয়া এর অস্তিত্বের কথা শুনলেও আজ পর্যন্ত এর লোকেশন, উদ্দেশ্য, সংগঠনটার অর্থায়ন, প্রোডাক্ট কোনকিছুরই হদিস বের করতে পারে নি। তিনমাস আগে এক প্রাইভেট সেক্রেট এজেন্সী এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কথা তুলেছিলো, নিউজে দেখেছো নিশ্চই? সন্দেহর ব্যাপার হলো একমাসের মাথায় গর্ভমেন্ট থেকে ওই এজেন্সী ব্যান করে দেয়া হয়। দ্যাট মিন্স, নিঃসন্দেহে এটায় অনেক গভীর জলের মাছেরাও ইনভলভ্ড”।
কথার মাঝখানে নিনি চিৎকার দিয়ে উঠলো, “কিন্তু মিস্, এর সাথে আমাদের সম্পর্কটা কোথায়! আমাদের রেস্টিকেট করা হলো কেনো!”
তিতিনাও যোগ করলো- “হ্যা, আর ফিদো, ফারিন-এদেরকেই বা গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার মানে কি!!! ওদের প্যারেন্টসকে পর্যন্ত জানাতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে অফিস থেকে!!! কী হচ্ছে এসব!”
সান গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “নিষেধ কি, বলো রীতিমত হুমকি দেয়া হয়েছে! ম্যাম, আমরা কি বড় কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছি?
জ্যাকির নির্ল্পিপ্ত উত্তর, “হুহ্…… তোমার কি মনে হয় বিপদে পড়া বাকি আছে!”
নিহাদঃ “মিস্ প্রিয়ন, আমরা যে আপনার এখানে, আপনি ছাড়া আর কে কে জানে?”
প্রিয়নঃ কেউ জানে না। তবে মনে হয় না, আর বেশিক্ষণও তোমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে। তোমরা কী করেছ, আমি জানি না, শুধু বুঝতে পারছি তোমাদেরকে পাগলের মত খুজে বেড়ানো হচ্ছে, আর এর পেছনে অবশ্যই কোন ভালো চক্রের হাত নেই। তোমরা বড় এক বিপদে পড়তে যাচ্ছো।
নিহাদঃ ম্যাম, পরিষ্কার করে বলুন, আপনি কিছু লুকাচ্ছেন।
প্রিয়ন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো, “আসলে আমি শিওর না। জাস্ট মিঃ ক্রেনের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেই যে ফার্মাসিস্ট মিঃ লুইস-এর কথা বললাম যে, ওনাকে দেখলাম তার রুমে। তার কিছুক্ষণ পরেই আমাকে ডেকে তোমাদেরকে পাঠানো লেটারগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দেন উনি। আর তোমাদের নিয়ে জিজ্ঞেসও করছিলেন, আমি তোমাদের কতটুকু চিনি এইসব…”
তিতিনাঃ তাহলে তো ঠিকই আছে। আপনার সন্দেহ তো অমূলক কিছু না। Anyway, থ্যাংক্স ফর হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান্ ফর আস্, ম্যাম”।
এড্রেস লিখা একটা কাগজ বের করে সানের দিকে ধরলো প্রিয়ন। “সি.ও. জোন-এর দক্ষিণের রাস্তা ধরে সামনে সোজা এগিয়ে ফরেস্ট এরিনার কাছে এই জায়গাটা। ম্যাপ দেয়া আছে, নির্দেশনা অনুযায়ী এগুলে আন্ডার-গ্রাউন্ড একটা ঘর পাবে। শহর থেকে দূরে এই জায়গাটা কিছুদিনের জন্য হলেও অনেক নিরাপদ হবে তোমাদের জন্য। আধুনিক অনেক ডোমেস্টিক এ্যপ্লায়েন্সই পাবে ওখানে, হোপ্ মাসখানেক নিশ্চিন্তে চলতে পারবে। আর, যেকোনও দরকারে আমাকে অবশ্যই জানিও। যোগাযোগ রেখো। আর বোধহয় দেরি করা ঠিক হবে না। এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো।”
ম্যাম-কে খুব অহংকারী আর মুডি ভাবতাম, ম্যাম তো পুরো তাক লাগিয়ে দিলো! কী সান, দেখে শুনে ভালো একজনকে চয়েজ করেছো হ্যা!!!- দীপের টিপ্পনী।
সানঃ তোদের মুখে কিচ্ছু আটকে না! ম্যান, শী ইজ আওয়ার টিচার, ইয়ার…
নিহাদঃ হ্যা, জীপ-টা পর্যন্ত দিয়ে দিলো! রিয়েলী ম্যাডাম-কে খুবই ভালো লাগলো! এত্ত রিস্ক্ নিয়ে নিজের বাসায় লুকিয়ে থাকতে দেয়ার মত সাহস, দ্যাট্স নট এ ম্যাটার অফ জোক্, হা?
জ্যাকিঃ হুম, সাহস না ছাই। অতই সাহস, তো নিজের বাসা থেকে টেকনিক্যালি বিদায় না দিলেই পারতো! কি সান? ফোন্ করে অফারটা দেবে নাকি?? দেখবো নে কত কেয়ার করে তোমায়!!
এত্ত ঝুট-ঝামেলার মধ্যেও সবাই সান-এর বোকা হওয়া চেহারাটার দিকে তাকিয়ে হো হো হেসে উঠলো।
ড্রাইভিং-এ দীপ ছিলো কিছুক্ষণ। এখন সান চালাচ্ছে। নিহাদ GPS-এ জায়গাটা লোকেট করার চেষ্টা করছে। ম্যাম-এর দেওয়া বর্ণণা অনুযায়ী এখনো আরো এক ঘন্টার পথ।
নিহাদ, দীপ, সান, ফিদো, ফারিন, জ্যাকি, তিতিনা, নিনি। ওরা আটজনই সেইম মেডিকেল স্কুলে পড়ত একসাথে। তখন সবাই একজন আরেকজন এত ভালো করে চিনতো না। র্যাংপানে আসার পরের থেকেই ওদের ফ্রেন্ডশীপটা আরো ভালো হয়। নিহাদ, দীপ, নিনি সার্জারীতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে। তিতিনা, জ্যাকি অনকোলজিতে আর ফিদো, ফারিন এন্ডোক্রাইনোলজিতে।
জীপ ফরেস্ট এরিনার পাশের ছোট রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দূরে অনেকটা আবর্জনার দিয়ে বিশাল স্তুপ করা একটা জায়গা। কাছে আসতেই বোঝা গেলো অনেক দিন ধরে অব্যবহৃত পরিত্যাক্ত গ্যারেজ একটা। নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা শ’খানেক গাড়ির বডি, টায়ার, জং ধরে পড়ে থাকা ইঞ্জিন, একগাদা গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে ভর্তি। প্রিয়নের বর্ণণা অনুযায়ী এই গ্যারেজের ভেতরের দিকের একটা জায়গায় আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ে থাকার কথা। জীপ এসে থামলো জায়গামতই। কাগজে দেয়া ম্যাপ অনুযায়ী সুরঙ্গে ঢোকার রাস্তাও পাওয়া গেলো। প্রবলেম হলো বহুদিন থেকে পড়ে থাকা লোহার দরজাটা জং ধরে পুরো জমে গেছে।
নিহাদঃ “একটা লোহার পাইপ জাতীয় কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখি। তোমরা সব এখানেই থাকো। দীপ আমার সাথে আসো, জঞ্জালের মাঝে খুজে দেখি কিছু একটা পাই কিনা”।
সবাই বিনা বাক্যে সম্মতি দিল যেন। নিহাদের এই গুণটা আছে। টীম ওয়ার্কের মত জায়গাগুলোতে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নেয়া। অবশ্য সানকে খুব খুশি দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের পাহাড়া দিয়ে রাখার দায়িত্ব পেয়ে গর্বিত-এমন একটা ভাব চোখে মুখে ঠিকরে বের হচ্ছে।
তিতিনাঃ আমার কিন্তু বেশ মজাই লাগছে। ক্যামন যেন এ্যাডভেঞ্চার টাইপ একটা ফীল হচ্ছে। কী বলো?
নিনিঃ হুম, কাল এসময়টাতেও কি ভাবসিলাম একবারো, যে আজকে এমন একটা সিচুয়েশনে পড়তে যাচ্ছি!
সানও ‘হু’ সূচক মাথা নাড়ালো দু’বার।
জ্যাকিঃ আমি এখনো পরিষ্কার বুঝতে পারছি না, কী এমন কাজ করলাম আমরা যাতে ক্রেনের পুরো শত্রু হয়ে গেলাম নিমিষেই!!
সান আবারো ‘হু’ সূচক মাথা নাড়ালো!
নিহাদকে ওর চেয়েও লম্বা সাইজের একটা পাইপ হাতে আসতে দেখা যাচ্ছে। দু’জন মিলে একটা বস্তা ভর্তি কিছু টানতে টানতে নিয়ে আসছে।
সানঃ বস্তায় কি নিহাদ?? কোথায় পেলে?
-ভেতরে যাই আগে চলো, বলছি।
অনেক ঘুতিয়ে, চারিয়ে সুড়িঙ্গের দরজা শেষপর্যন্ত খোলা হয়েছে। দরজা না বলে ঢাকনা বললে বেশি এ্যপ্রোপিয়েট হবে। ঢাকনা থেকেই নিচে সিড়ি বহুদূর চলে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিনির তেলাপোকায় এলার্জি আছে। কি একটা গায়ে এসে পড়ায় ইতোমধ্যে দু’বার চিত্কার করে ওঠা শেষ। এত সূচালো উচ্চ কম্পাংকের চিৎকারেও ইকো হয়নি। মানে রুমটা খুব বিশাল না, আর অবশ্যই ফাকা না। লাইটের সুইচ খুজে বেড়ানো হচ্ছে। দীপের লাইটার এর আলোতে হচ্ছে না।
-কারো কাছে টর্চ নাই?, আবারো নিহাদের ভয়েজ।
-“এই নিন টীম লিডার…” , দীপের স্বভাবসুলভ টিপ্পনী।
অবশেষে লাইট জ্বালানো সম্ভব হয়েছে। ইলেকট্রিসিটির উৎস বিশালাকার জেনারেটর। পুরো রুমের অর্ধেকের মত জায়গা ঐ জেনারেটরই দখল করে আছে। একটা তাকে সারি সারি অনেকগুলো গাড়ির ব্যাটারি রাখা। তার নিচের তাকে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেলের ক্যান। ভর্তিই হবে যত সম্ভব। পুরো রুমে তেল তেল গন্ধ। এক কথায় অসাধারণ একটা জায়গা। ঠান্ডা আর ভেন্টিলেশনের জন্য উপরে দু’জায়গায় একটা এ.সি.ও আছে। কাজ করে কিনা এখনো দেখা হয়নি।
ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সঙ্গে আনা শুকনো খাবার দিয়ে ডিনার সেরে ফেলে একসাথে বসেছে সবাই। তিতিনা আর নিনি খুব বায়না ধরেছিলো এই গুহার মত চিপায় না বসে চলো বাইরে চাদের আলোয় বসি। আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে ক্যাম্প ফায়ারের আমেজ নিয়ে আসি। সবাই মনে মনে সায় দিলেও নিহাদের এক কথাতেই সব দমে গেলো।
নিহাদঃ Guys, পুরো ব্যাপারটাকে পেছন থেকে আরেকবার ঘুরে দেখা হোক। গত এক মাসের মধ্যে আমরা কোন এসাইনমেন্ট, কিংবা কোন সোস্যাল ওয়ার্ক, অথবা এমন কী কী কাজ করেছি একটু মনে করার চেষ্টা করি তো, যেটায় মিঃ ক্রেন একটু হলেও ইনভল্ভড এবং যেটায় আমরা সবাই-ই কোন না কোনভাবে জড়িত।
দীপঃ উহু, এমন কিছু তো মনে আসছে না।
সানঃ কী কী কাজ করেছি তার লিস্টটা আগে করি। কি বলো?
জ্যাকিঃ আরে কী করছি আর। হিউম্যান রাইট্স ডিপার্টমেন্টের সেমিনারে স্পীচ-এর দায়িত্বে ছিলো ফারিন আর ফিদো। আর ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডঃ কে. এইচ. সিগার এর সাথে ঐ যে একটা ল্যাব রিসার্চে নিহাদ ছাড়া আমরা বাকি এই ক’জন সবাই ছিলাম। সবাই ছিলাম না, কাজেই এটার কথা বাদ দেয়া যায়। আর কেউ??
ছেচড়াতে ছেচড়াতে আনা বস্তার মুখটা খুলতে খুলতে নিহাদ জিজ্ঞেস করলো- রিসার্চের টপিকটা কী ছিলো, বলো তো?
জ্যাকিঃ “বার্সালিন” নামের একটা মেডিসিন । যেটা দিয়ে ব্রেইন টিস্যুকে, ইনফ্যাক্ট পুরো ব্রেইনের আয়তন অনেকখানি কমিয়ে আনা যায় সেল কাউন্ট না কমিয়ে এমন কি সেলের কোনরকম ফাংশোনাল স্ট্যাটাস পরিবর্তন না করেই। এক কথায় ব্রেইন টিস্যু প্রিজার্ভার।
নিনিঃ হুম, মিঃ ক্রেন নিজে একদিন ল্যাবে এসে আমাদের সবার প্রশংসাও করে গেছেন তো। কিন্তু এর সাথে তো কোনও লিংক আছে বলে মনে হয় না!
নিহাদঃ আরে এটার কথা তো তখনই শুনেছি তোমাদের মুখেই। বার্সালিন দিয়ে তিতিনার ব্রেইন স্রিংক করে রাখবো এমন কত জোক্স করতাম আমরা মনে নাই?
তিতিনাঃ হুম, এ ছাড়া আর তো কিছু দেখছি না যেটায় সবাইই ছিলাম।
সানের হু সূচক মাথা নাড়ানি।
অবশেষে বস্তার মুখ খুলতে সক্ষম হয়েছে নিহাদ। সোনা-দানা টাইপ খুব দামি কিছু না হলেও বেশ মজার একটা জিনিস বের করা হলো ওখান থেকে। ছোটখাটো একটা রোবোটের মত অনেকটা। ভিতরে আরো কয়েকটা সেইম জিনিস। দীপকে বেশ উৎসাহী দেখা গেলো। ইলেকট্রনিক্স জিনিসের প্রতি ওর এক্সট্রা মোহ আছে। ব্যাটা ডাক্তার না হয়ে ইঙ্গিনিয়ারিং সাইডে পড়লে ভালো করতো।
-ওয়াও, এত সুন্দর এই জিনিস বস্তা বন্দী করে ফেলায় গেছে কে!!! নতুনই তো মনে হচ্ছে!!… দীপের চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। ভাবটা এমন এ যেন কালই নিজের হাতে বানিয়েছিলো, আর আজই কেউ ফেলে দিয়ে খুব খারাপ কাজ করে ফেলেছে!
সাথে সাথে ছোট্ট রোবোটটাকে অনেকটা কোলে করে নিয়ে গেলো দীপ। সবাইকে হা করে দিয়ে সে ওটাকে পেট্রোল দিয়ে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্তও হয়ে গেলো! নিজের বাচ্চাকেও পুরুষেরা এত আদর করে গোসল করায় না বোধহয়!
বিপ বিপ… রোবোটটার মাথার পেছনের একটা লেড পয়েন্ট জ্বলে উঠেছে! হঠাৎ শব্দে সবাই চমকায় উঠলো। দীপের পুরোপুরি বিশ্ব জয়ের ভঙ্গি!! এই ভঙ্গির সাথে পাইরেটস অব দ্যা ক্যারিবিয়ানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটা এই মুহুর্তে এ্যাড করে দিতে পারলে সোনায় সোহাগা হতো!
সানঃ ওরে গাধা, এত খুশি হওয়ার কিছু নাই। খেলনা টেলনা হবে। ঘসা-মাজা করতে গিয়ে কোন সুইচে চাপ পরে গিয়ে অন হয়েছে। তোর আলাদা কোন কেরামতি নাই।
জ্যাকিঃ হুম, সান ছাড়া কেরামতি করার মত আর কারো ক্ষমতা আছে?? –শয়তানি চাপা হাসি জ্যাকির। বোঝাই যাচ্ছে প্রিয়ন ম্যামের কথা বলা হচ্ছে।
হঠাৎ বিকট আর তীব্র ধাতব কোন এক শব্দ। শব্দটা থামার কোন নাম নেই, খুব সম্ভবত ওদের উপরে খুব কাছের কোন জায়গা থেকেই আসছে শব্দটা। সহ্য করতে না পেরে কান চেপে ধরে আছে সবাই। পাচ মিনিটের মত থেকে থামলো শব্দটা! হঠাত উপরে কারো যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলো। একটা না, বেশ ক’জন আসছে খুব কাছাকাছি কোথাও। নিঃশ্বাস চেপে ধরে একবুক আতংক নিয়ে ওরা ছয়জন… ।
শক্ত বুটের আওয়াজ ক্রমশঃ জোড়ালো হচ্ছে।
(To be Cont…)