রহমত আলির সাথে পাঁচ মিনিট

প্রায় অন্ধকার কক্ষ। আলো বলতে শুধু জানালা থেকে আসা বিকেলের রোদ। বিছানায় দেখা যাচ্ছে একজন নব্যবৃদ্ধিপ্রাপ্ত মেদবিশিষ্ট চল্লিশোর্ধ পুরুষকে। তার শরীর থেকে নেমে আসা ঘাম মৃদু আলোতেও দেখতে কষ্ট হয় না, মাথার উপরে ফ্যান সর্বশক্তি নিয়ে ঘুরছে। একই সাথে তার হাতে একটা পাখাও দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত তিনি ফ্যানের পরিচর্যায় সন্তুষ্ট নন। পরনের পাঞ্জাবিটা ঘামে পুরোপুরি ভেজা, অন্যহাতে লুঙ্গি ধরে আছেন। মাথায় টুপি আছে এখনো। খাটের উপর বসে আছেন তিনি, খাটের অংশ হিসেবে থাকা টেবিলটার উপর দেখা যাচ্ছে খালি পানির গ্লাস। অনুমান করা শক্ত নয়, কিছুক্ষণ আগে সেটা প্রায় এক ঢোকে খাবার পর শশব্দে টেবিলের উপর রাখা হয়েছে। মাথা নীচু করে থাকায় আলো পড়ছে তার টুপির উপর, আর সেই সাথে আমাদের বঞ্চিত করছে তার এই মুহুর্তের অভিব্যক্তিটি দেখা থেকে। তবে আমরা অপেক্ষা করতে পারি, কিছুক্ষন পরেই হয়ত তা মুখ দেখা যাবে।

আজকালকার অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে আমরা ভদ্রলোকটির সম্পর্কে এতটুকু তথ্য পেয়েই নিশ্চই স্বস্তিবোধ করতে পারছি না, তাই আসুন আরেকটু পর্যবেক্ষণ করা যাক।

এরই মধ্যে আমরা তাকে ভদ্রলোক বলে ফেলেছি; দেখা যাক, সেটাই বা কতটূকু সত্য। এই কক্ষে আমরা আরেকটি টেবিল দেখতে পাচ্ছি, সেখানে কিছু ফাইল, কিছু অফিসব্যবহার্য গোত্রীয় কাগজ দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটি সীল পড়ে আছে, যেটিকে আপনারা যদি কোন কাগজে প্রয়োগ করেন তাহলে দেখতে পাবেন “রহমত আলি, উপ-সহকারী প্রকৌশলী,…………” উনি কোন দপ্তরে কাজ করছেন, সেটি না জানলেও চলবে। তো পূর্বে উল্লেখ করা “ভদ্রলোক” সম্ভাষনটি আমাদের রহমত আলি সাহেবের নামের সাথে রাখতে পারি। আজ শুক্রবার, তাই তার বর্তমান পোষাকের কারণও স্পষ্ট। কিন্তু আমরা এখনো জানতে পারিনি, ছুটির দিনের এই অবসরে কেন তিনি ঘর্মাক্ত অবস্থায় বসে আছেন। হতে পারে তিনি ভীত, বা চিন্তিত, অথবা রাগান্নিত, কিংবা কিছুটা অসুস্থ, তবে সঠিকটি অজ্ঞাত।

একজন সাধারন সরকারি চাকুরিজীবীর মতই তিনি নিয়মিত অফিস যান, সবার সাথে কথা বলেন, সমকালীন রাজনীতি ও দেশ নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দেন, সময় শেষে বাড়ি রওনা হন। তবে ঘুষ খাবার পরিমানটা একটু বেশী, “চিপাচাপা” থেকে “ধনরত্ন” বের করে আনার সুখ্যাতি রয়েছে তার। যেহেতু কিছুদিন আসে তার অফিসে অডিট হয়েছে, তো এই নিয়েও তিনি চিন্তিত থাকতে পারেন। আজকাল আবার তার মত অনেকেই ধরা খাচ্ছেন, মানসন্মান ও চাকরি একসাথে খুইয়েছেন অনেকেই। আজ কি তার কোন খবর এসেছে? অফিস থেকে কোন চিঠি? কিংবা এমন ও হতে পারে, একটু আগে অফিস এর কারও কাছ থেকে ফোনেই কোন অস্বস্তিকর খবর পেয়েছেন? আবার এমনো হতে পারে, তার চাকরি পাশাপাশি যে সামান্য (!) মজুদদারির ব্যবসাটি রয়েছে, সেখান থেকে কোন অপ্রীতিকর সংবাদ এসেছে? আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না, কিছুদিন আগে তিনি দুইজন কর্মচারীকে বের করে দিয়েছেন চুরির দায়ে, ম্যনেজার কাম পিয়ন ফারুককেও তার খুব একটা সুবিধার মনে হয় না। উচ্চরক্তচাপ রোগী রহমত আলিকে বর্তমান অবস্থায় আনার জন্য এরাও দায়ী হতে পারে, আবার হয়ত, এত সব চিন্তার কোনটিই নয়। ছুটির দিনে বাড়িতে আসা কোন ছিচকে চোরকে ধরে আচ্ছামত পিটিয়েছেন, হতে পারে জুম্মার নামজ শেষে খেয়েছেন সারমেয়-ধাওয়া, কিংবা অল্পের জন্য বেচে গিয়েছেন ট্রাকের নীচে পড়তে পড়তে, অথবা পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালীর সাথে সাপ্তাহিক ঝগড়াটা সারলেন এইমাত্র, অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে কোন পারিবারিক কারণ, হয়ত সমাপনী পরীক্ষার্থী তার ছেলের অসমাপিত পড়ার জন্য বেদম ধোলাই দিয়েছেন, বা, তার বাড়িতে আশ্রিত থাকা তার বেকার ছোট ভাইকে তার প্রাপ্য ঝাড়ির আজকের অংশ এইমাত্র দিয়ে আসলেন।

পাঠক, এমনও হতে পারে, আমরা ব্যপারটিকে হাল্কা করে দেখছি, হয়ত, দৈনিক ঝগড়া চলাকালে তিনি কিছুক্ষণ আগেই তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন, এখন তার ছেলেকে ফাকি দিয়ে লাশ সরানোর বন্দোবস্ত করছেন। সম্ভবত, একারণেই তিনি অতিচিন্তায় ঘেমে একাকার, ভাবছেন ধরা পড়লে কি হবে? আমরা যদি নিয়মিত খবরের কাগজের পাঠক হই, তবে মোটেই বেশি সন্দেহ করছি না, আজকাল এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এমনকি ইতঃমধ্যে হয়তবা অনেকেই ভাবতে পারেন, শুধু স্ত্রী নয়, তার একমাত্র ছেলেটিও স্বীকার হতে পারে কোন ভয়াবহ পরিনতির। এবং এর পেছনে থাকতে পারে সদ্য নিয়োগ পাওয়া গৃহপরিচারিকা, কিংবা অন্য কেউ, হয়ত এর পেছনে রয়েছে কোন নারীঘটিত কেলেংকারী! লাশ নিয়ে কি করবেন তিনি? ফ্রিজে রেখে দেবেন? তার ফ্রিজ যেহেতু ছোট, তাকে সম্ভবত টুকরো করতে হবে লাশকে। তবে ফ্রিজে রাখাটা নিরাপদ নয়, নিজের বাড়ি বলে কথা, কেউ যদি বিন্দুমাত্র আচ করতে পারে, তাহলেই তো সমস্যা। সবচেয়ে ভাল হয়, তিনি যদি লাশটাকে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রেখে আসতে পারেন, সন্দেহটা অনেক কমে যাবে। তাছাড়া, তার সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক অনেক ভাল ছিল; অন্তত পাড়া-প্রতিবেশীরা তাই জানে, তারাও হয়তবা তাকে সন্দেহ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করতে পারে। আর তদন্তের যে অবস্থা, তাতে কিছুদিন চলে গেলে এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে, সবাই ভুলে যাবে, হয়তবা আমাদের রহমত আলি তখন একটা নতুন সংসারও শুরু করতে পারেন। সম্ভবত আজকের সুযোগটাই তার জন্য সবচেয়ে ভাল ছিল। তবে, এরকম ঘটনা অনেক ঘটলেও কালকে যখন পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদ হিসেবে আসবে, পাঠক কিন্তু ভালই খাবে। দু’টাকার পত্রিকার বিক্রি হুহু করে বেড়ে যাবে, হকার প্রাণপণে চিৎকার করে তাজা এ খবরটা সবাইকে জানিয়ে আরও বেশী টাকা কামাই’র ধান্দায় নামবে। একজন বাসযাত্রীকে দেখা যাচ্ছে, তিনি তার পাশের সহযাত্রীকে বলছেন, “বুচ্ছেন ভাই, দ্যাশটার আর কিচচু হইল না”।
হয়ত প্রথম-আলোর নতুন বিজ্ঞাপন দেখলেও বোঝার মত ক্ষমতা তার হয়নি।

এইমাত্র রহমত আলি মুখ তুলেছেন, হাল্কা আলোতেও তার লাল চোখ দেখা যাচ্ছে, হাতের পাখা রেখে তিনি উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিলেন। তার পুরো চোখেমুখে ক্রোধের ছাপ সুস্পষ্ট। টুপিটা মাথা থেকে খুলেই উঠে পা বাড়ালেন কক্ষের বাইরে, (পাঠক আমাদের অনুমান সত্যি, এখনি তিনি লাশের বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছেন)।খুন্দ্রুত শ্বাস নিচ্ছেন তিনি , পারলে মুখ খুলেই শ্বাস নেন (অতিউত্তেজনার উত্তেজনার কারণেই এমনটি হচ্ছে)। পাশে রান্নাঘরের দিকে তাকালেন…নাহ, সেখানে তার স্ত্রীই দাঁড়িয়ে আছে…তবে ঘটনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আমরা যেটিকে ঘটনা পরবর্তী উত্তেজনা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম, হয়ত সেটা ছিল ঘটনাপূর্ব পরিকল্পনার সময়। তাছাড়া এখন তিনি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে তার পছন্দমত অস্ত্রই রয়েছে। পাঠক, আমরা সম্ভবত এই ভয়াবহ নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হতে যাচ্ছি। তিনি রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন, এখনি তিনি হয়তবা তার স্ত্রীর সাথে শেষ কথপোকথনটিও করে নেবেন, হ্যাঁ তিনি কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন, অন্তত তাকে দেখে তেমনই মনে হচ্ছে…………………………

“ও পিন্টুর মা, এইডা কি রানসো?? তরকারীর কিসুই অয় নাই, খালি ঝাল আর ঝাল, তারাতারি আরেক গ্লাশ পানি দাও দেহী…”

২,২০৪ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “রহমত আলির সাথে পাঁচ মিনিট”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আরে সাকিব নাকি? লাগা ১০ টা :frontroll: (সম্পাদিত)


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    বরিশাইল্যা এই পোলাডা তো সেই রকম লেখে ! সি সি বি তে স্বাগতম ।


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।