আমার আকাশবেলা

লেখালেখি জিনিসটা অনেক প্রতিভা দাবি করে। সেই প্রতিভার অনুপস্থিতির কারণে ব্লগে আমার আগমন এলিয়েনসম। কতো মানুষ কতো ডায়নামিক চিন্তা অদ্ভুত সুন্দরভাবে তুলে ধরে। মস্তিষ্কের অধিকাংশ অংশ জুড়ে শুকনা গোবর থাকায় সেইসব চিন্তা করতে আমি অপারগ। লিখতে গেলেই শুধু রাজ্যের স্মৃতিকথা এসে পড়ে। সেই স্মৃতিগুলোও একটা নির্দিষ্ট আকাশের। আমার খুব স্বার্থপর একটা আকাশের। সে আকাশও ২০০৮ এর কোনও এক সকালে হারিয়ে গেছে।

 

বালকবেলা হতেই হীনমন্যতা আমার সঙ্গী। কারণটা সম্ভবত আমার অতি স্থূলকায় রুপ। ২০০ গজ হাঁটলেই হাঁপিয়ে উঠা বালকটি সকলের কৌতুকের খোরাক হতেও বেশি সময় নেয়না। অতি সচেতন বাবা মায়ের ধারণা ছেলেকে পাড়ার ছেলেপুলের সাথে মিশতে দিলে বখে যাবে, পড়াশুনা শিকেয় উঠবে। তাই নিয়ম ছিল পাড়ার ছেলেদের সাথে মেশা যাবে না। বিশ্বাস হয় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই আমি একদম খাঁটি প্রমিত বাংলায় কথা বলতাম ! যারা মফস্বলে বড় হয়েছেন নিশ্চয়ই জানেন যে এরকম অসামাজিক এবং স্থূলকায় বালকদিগকে রাস্তায় দেখলেই সমবয়সীরা টিটকিরি ছুঁড়ে দেয়। ব্যতিক্রম হয়নি আমার ক্ষেত্রেও। ইভ টিজিং এর ভয়ে নাকি মেয়েরা বাসা থেকে বের হয়না। আর আমি ছেলে হয়ে ওইসব টিটকিরির ভয়ে বের হতাম না। উদাহরণ :

–                      এই ভোন্দা আলু, কই যাস ? পেটলা, পেটলা, পেটলা।

আরও ছিল অনেক। খুব ছেলেবেলার কাহিনী বলে ওইসব মনে পড়ছে না। শুধু এইটুকুই স্মৃতিতে গেঁথে আছে। নিজের হাতে খেতে অপারগতা, পায়জামার গিঁট বাঁধতে অপারগতা, মানুষের সাথে মিশতে অপারগতা সব মিলিয়ে নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা একটা প্রাণী ছিলাম।

 

সেই পরিচিত আকাশটা ২০০২ সনে এসে ধুম করে পাল্টে গেল। একটা নতুন আকাশ আসলো। হীনমন্যতায় ভোগা বালকটির সেই আকাশ পছন্দ হলো না। ইহা আরও ভয়ানক একটি আকাশ। এইখানে শুধু বাহারি রকমের বিদ্রুপই না, আরও অনেক যন্ত্রণা যেমন নিজে নিজে মশারি টানানো, পায়জামায় ফিতা ঢুকানোর মতো দুরূহ কাজ, গেঞ্জি, মোজা নিজেই ধোয়া, এমনকি জুতা পালিশের মতো কাজও কপালে এসে জুটল। হ্যাঁ, ২০০২ সালে সিলেট ক্যাডেট কলেজের সেই আকাশটা আমার জন্য আজরাইল রুপে আগত হলো। মার খেতে খেতে জান বের হয়ে যাবে এমন অবস্থা। দুপুরের মিল্ক ব্রেকে দেয়া স্পেশাল আলুর চপ মানুষ অজ্ঞান করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি লুকিয়ে টেবিলের তলা দিয়ে ফেলে দিতাম। কিন্তু বিধি বাম! একদিন সেই চপ গিয়ে পড়লো সিনিয়র এক ভাইয়ের জুতার তলায়। যা হবার তাই হলো। এরপর থেকে টেবিলের সবার চপ আমার একলাই খেতে হতো।

 

এর মধ্যে রুমে এক গুন্ডা টাইপ বালক খুবই জ্বালাতন করতো। কোনও ব্যাপারেই তার সাথে বনিবনা হতো না। অশান্তি আর অশান্তি। ভূতের ভয়ে কাতর আগেও ছিলাম। এখন আবার ঠিক জানালার পাশেই আমার বেড। এর মধ্যে এক সিনিয়র বলে গেলেন রাতের ২টার পরে নাকি জানালার বাইরে থাকা ল্যাম্প পোস্ট যেটা কিনা কখনোই জ্বলে না, রক্ত লাল হয়ে জ্বলে উঠে। আর যাই কোথায় ? রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গেল। কতো রাত যে নীরবে বালিশ ভিজিয়েছে সেই বালক, কেউ জানে না। দিনের শুরুতেই আবার আছে প্যারেড শেখার অদ্ভুত যন্ত্রণা। বালকটি মোটা বলে সব মুভ ঠিকমতো করতে পারত না। চান্স পেলেই একটু ফাঁকি দিয়ে জিরিয়ে নেবার চেষ্টা করতো।  তাই ড্রিল প্রশিক্ষকদের চক্ষুশূল হতেও বেশি সময় লাগেনি। এতো এতো যন্ত্রণা তাও আবার কিছু কিছু ক্লাসমেটের পোদ্দারি মাথা নষ্ট করে দিতো। কতো কিছু জানে তারা, কতো কিছু পারেও। আমার জন্য দুরূহ অনেক কাজই তাদের কাছে ছেলেখেলা। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল সব। ধীরে ধীরে মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া শুরু করলো। বালকটি টের পায়নি ততদিনে তার সাদাকালো আকাশে রঙের আবির্ভাব ঘটেছে।

 

নিজের মতো কিছু সময় পেলেই ভাবতাম কেন এমন হবে ? প্রতিদিন কেন ঘুম থেকে উঠে সেই একই আকাশ দেখবো ? সেই একই মানুষগুলো, একই সময়ে, প্রতিদিন একই জায়গায়, একই রুপে দেখা দিবে কেন ? প্রতিদিন একই কাজ করা। একটাই আকাশ প্রতিদিন ঘুরেফিরে দেখা। বন্দী, বন্দী, বন্দী। এসব ভাবি আর কাঁধের দাগগুলো অজান্তেই বেড়ে চলে। কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যও আসি আসি করে। আকাশটাও একই রয়ে যায়। পরিবর্তন হয়না কিছুই। তবে পরিবর্তন হই আমি।

 

ভাবছেন নিশ্চয়ই এই শুরু হলো আবার ক্যাডেট কলেজের প্যানপ্যানানি। নাহ, এতো বড় স্মৃতিকথা লিখা আমার কম্ম নয়। তবে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, কোরআন শিক্ষা ক্লাসে হুজুরের অলক্ষ্যে দেয়াল ঘড়ির কাঁটা আধাঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া, খাটিয়ায় গিয়ে শুয়ে থাকা, নামাজের সময় সামনের কাতারে থাকা সবার পাঞ্জাবিতে গিঁট্টু লাগিয়ে অনেকের পাঞ্জাবি ছেঁড়ায় অবদান রাখা, রাতের বেলা কমান্ডো অ্যাকশনে কাঁঠাল চুরি, স্যারদের নাভিশ্বাস তোলা। এইসব সেই হীনমন্যতায় ভোগা স্থূলকায় বালকটির কাজ। একবার তো আমার যন্ত্রণায় কলেজ মসজিদের ইমাম আমাকে তাড়া করেন। দুইজনেই খালি পায়ে ছিলাম। মনে আছে কলেজ গেট পর্যন্ত আমার পিছে দৌড়ে উনি রণেভঙ্গ দেন। পরে শান্তির দূত হিসেবে সিদ্দিকীকে পাঠান আমার কাছে যেন মসজিদে ফেরত আসি। সব কিছুর ফিরিস্তি দিতে গেলে শেষ হবে না লিখা। আজকে যেটা বেশি মনে পড়ছে সেটাই আপাতত বলি।

 

নতুন ক্লাস টুয়েলভে উঠেছি। মোবাইল নামক বস্তুটা তখন কারো কাছে প্রিয়ার কণ্ঠে একটুখানি “কেমন আছ ? ” শব্দযুগল শোনার আকুতি, কারো কাছে পার্ট নেবার অস্ত্র। দুই দলের কোনটাতেই ছিল না কয়েকজন লাগামছাড়া বালক। একখান মোবাইল আমারও ছিল। উদ্দেশ্য অবশ্যই ভিন্ন। তাসনীম আর তৌফিক, দুজনেই অসম্ভব সুন্দরভাবে নারীকণ্ঠ অনুকরণে পারদর্শী। ব্যস, খেলা শুরু। কিছুদিন পরেই লাল হাউস আর সবুজ হাউসের দুইজন বালককে উদাসী উদাসী ভাবে চলাফেরা করতে দেখা গেল। প্রতিদিন রাতেই এই দুইজন তাসনীম আর তৌফিকের ফোন পেত। সে কি আবেগঘন কথাবার্তা! আর আমাদের সেই খারাপ ছেলের দল একবার নীল হাউসে বসে তাসনীমের মেয়েলি কণ্ঠের আলাপ শুনে পেট ফাটিয়ে হাসতাম, পরক্ষণেই ছুটে যেতাম লাল অথবা সবুজ হাউসে ভিকটিমের রুমে। দেখতাম তাদের লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া চেহারা আর গড়াগড়ি খেতাম পাশের রুমে। তাসনীম আজ বড় মালটিন্যাশনাল কোম্পানির গুরুগম্ভীর অফিসার। চেহারায় ভারিক্কী ভাব আনতে গোঁফও রেখেছেন। আর তৌফিক দুঁদে সেনা কর্মকর্তা। মাঝে মাঝে যখন ভাবি এদের ফিউচার বউ বাচ্চাদের যদি তাদের অতীত কাহিনী শুনাই, তাহলে কেমন হবে ? ভাবি আর একলা বসে নিজেই হাসি।

 

দেখতে দেখতে সেই চিরচেনা আকাশের দিনগুলিও শেষ হয়ে আসলো। সেই স্থূলকায়, হীনমন্যতায় ভোগা বালকটিও অদ্ভুতভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল এতদিনে। কিন্তু এই পরিবর্তনটা সে ধরতে পারেনি। ভাবতে ভালোই লাগতো, যাক এতদিনে এই বন্দী কারাগার থেকে বের হতে পারবো। মনে আনন্দ। কিন্তু চলে আসার আগের কয়েকটা দিন কেন এমন বিষণ্ণতা পেয়ে বসলো ? সেই একই জায়গায়,একই সময়ে প্রতিদিন দেখা মানুষগুলো আর আকাশটার জন্য কেন এতো মায়া হতে লাগলো ? যে কলেজে ছুটি শেষে ফেরত আসার সময় অসম্ভব মন খারাপ হতো, আজ সেই কলেজ ছেড়ে যাব। আনন্দের জায়গায় বিষণ্ণতা তো আসার কথা নয় ! অবশেষে দিনটি এসেও পড়লো। ব্রেকফাস্টে বসে আছি। ভাব ধরছি সবকিছু স্বাভাবিক আছে। নিজের প্লেটের খাবারে মনোনিবেশের চেষ্টায় আছি। কিন্তু খাবার তো দেখা যাচ্ছে না ! মুখ তুলে সামনে চাইলাম। দেখি টেবিলের হতচ্ছাড়া টাইপ জুনিয়রগুলো কাঁদছে। আর কি ধরে রাখা যায় নিজেকে ? এবার পুরা দুনিয়া ঝাপসা হয়ে আসলো। সেদিনের মতো কান্না আজ পর্যন্ত কাঁদিনি। পুরা রাস্তা কেঁদেছি। বাসায় এসে যার দরুণ প্রচণ্ড মাথাব্যথা আর জ্বরে আচ্ছন্ন হলাম। কতোগুলা সপ্তাহ যে ছ্যাঁক খাওয়া প্রেমিকের মতো মনমরা হয়ে পড়ে থেকেছি তা বিধাতাই জানেন। হ্যাঁ, সে ভয়ানক আকাশটি, সেই হতচ্ছাড়া আকাশটি যা একটি হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন বালকের জীবন পাল্টে দিয়েছিল আজ সেই আকাশটিই বড় রঙিন লাগে। সেই নির্দিষ্ট আকাশটিই যার একপাশে কালো মেঘ আর অন্যপাশে সূর্য কিরণ খেলা করতো, আমার পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আকাশ হয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকলো। এরপর অনেক আকাশই দেখেছি। মিলিটারি একাডেমীর আকাশ, নর্থ সাউথের মেকি রঙিন আকাশ, সিভিল জীবনের মিশ্র আকাশ। তবে সিলেট ক্যাডেট কলেজের সেই হতচ্ছাড়া আকাশ আর কোথাও পাইনি, পাবও না। আজ হয়তো খুব ভালো ছাত্র অথবা খুব প্রতিষ্ঠিত কেউ নই। তবে সেই কঠিন, একই সাথে মমতা ভরা আকাশটি আমাকে আত্মসম্মান, সারভাইভেল আর জীবন শিখিয়েছিল। দিয়েছিল কিছু প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু। সচেতন অথবা অবচেতন মন জুড়ে তাই আমার সেই আকাশবেলাই জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময় হয়ে আছে, থাকবে। যতদিন বাঁচি।

১,৯১০ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “আমার আকাশবেলা”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)
    চেতন অথবা অবচেতন মন জুড়ে তাই আমার সেই আকাশবেলাই জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সময় হয়ে আছে, থাকবে।

    ::salute::

    ভাই, মোবাইলের কাহিনী আমরাও ঘটাইছিলাম। ভিক্টিম ওই বন্ধু এখনও অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলে সাবধান হয়ে যায়। এমনকি আজকেও সে আমাকে একটা নাম্বার দিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওটা চিনি কিনা। 😀


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. মুরাদ (২০০২-০৮)

    আমাদের সবার আকাশটাও তোর আকাশের সাথেই মিশে আছে রে সেই ২০০২ থেকেই। খুব ভাল লাগল এবং আরো চাই 😀 😀
    [বিঃ দ্রঃ তৌফিক এখনও তেমন উন্নতি করতে পারে নাই। ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানে =)) =)) ]

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।