তখন ১৯৯৪ সাল। দাপ্তরিক কাজে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায় জেলায় যেতে হয়েছিল। পাবনায় যখন গেলাম, তখন করণীয় কাজটুকু সেরে ফেলার পর হাতে কিছুটা সময় রয়ে গেল। পাবনার ডাঃ ইসহাক একজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ছিলেন, তার নামে একটি সড়কেরও নামকরণ করা হয়েছে। তার ছেলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তিনিও এলাকায় বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তাকে বললাম, পাবনা মানসিক হাসপাতালটি একবার দেখে যেতে চাই। মানসিক রোগীদের ব্যাপারে আমি আজীবন কৌতুহলী। খুব ছোট্ট বয়সে (৪/৫) একবার আমাদের চট্টগ্রামের বাসার সামনের এক বাসায় হঠাৎ এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার ডাক্তার স্বামীর শার্ট-প্যান্ট ও এ্যাপ্রোন পরে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে মুখে সিগ্রেট ধরিয়ে পায়চারি করতেন আর মুখে বিড়বিড় করে কি যেন বলতেন, সে দৃশ্যটা আমার এখনো মনে আছে। এর পরে আরেকটু বড় হয়ে ঢাকায় এসে এক প্রতিবেশি চাচাকে অকস্মাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অশোভন আচরণ করতে দেখতাম। তাকে শেষ পর্যন্ত ঘরে বেঁধে রাখা হতো। এটা দেখে অবাক হয়ে ভাবতাম, একটা ভালো মানুষ হঠাৎ করে কেন এমন হয়ে যায়! আমার এক শ্রদ্ধেয় অংক শিক্ষককে দেখেছি, তিনি কয়েক বছর পর পর একটা নির্দিষ্ট ঋতুতে মানসিক ভারসাম্য হারাতেন। একবার আমাদের চোখের সামনে দিয়ে তার সহকর্মীরা একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে তাকে পাবনা নিয়ে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য, এ দৃশ্যটা দেখে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম।
যারা কোন না কোন কারণে মনোবৈকল্যের শিকার হন, তাদের প্রতি আমি সহজাতভাবে সমব্যথী এবং তাদের ব্যাপারে কৌতুহলী। তাদের মনের এহেন আকস্মিক ভারসাম্যহীনতার কারণ জানতে ইচ্ছে হয়। সেই লালিত কৌতুহল থেকেই পাবনা মানসিক হাসপাতাল পরিদর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। বন্ধুর সহায়তায় সে ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার একটি ছোট্ট স্মৃতি নিয়েই আমার আজকের এই লেখা। সেখানে বিভিন্ন প্রকারের মানসিক রোগী দেখেছিলাম; কেউ সরব, কেউ নীরব, কাউকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, কেউ বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে একটি বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ গলা ছেড়ে গান গাচ্ছে, কেউ ভাষণ দিচ্ছে, ইত্যাদি। এদের আচরণে এবং কার্যে ভিন্নতা থাকলেও, এদের মধ্যে একটা নিবিড় মিল রয়েছে- এদের সবার মনটা কোন কারণে পীড়িত হয়েছে। কারো মন ভেঙ্গেছে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কারো বিশ্বাসভঙ্গের কারণে, কারো ভয়-ভীতিতে, কারো নানাবিধ নির্যাতনে। একটা ওয়ার্ডের সামনে এসে একটা পরিচিত গানের কলি শুনতে পেলামঃ “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ ….”। দেখলাম, বয়স ত্রিশের আশে পাশে এক মহিলা আনমনে গানটা গেয়ে গেয়ে পায়চারি করছেন।
আমাদের গাইড জানালেন, ঐ মহিলা সারাদিন ধরে শুধু ঐ গানটিই গেয়ে চলেন এবং গাইতে গাইতে কখনো কাঁদেন, কখনো হাসেন। দেখলাম ঠিকই, গান গাইতে গাইতে তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে তিনি বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছেন গানের এই অংশটি গাইতে গিয়েঃ
“ও যে আমায় ঘরের বাহির করে
পায়ে পায়ে পায়ে ধরে,
মরি হায় হায় রে…
ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে
যায় রে কোন চুলায় রে…
আমার মন ভুলায় রে”।।
আমরা তাকে দেখছিলাম একটা গ্রিলের এপার থেকে, তিনি গাইছিলেন ওপারে। গান শেষ হলে তিনি গ্রিলের কাছে এসে আমাদেরকে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “ও আমারে ঘরের বাহিরে কেন আনলো স্যার”? আমরা কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে অন্য একটি ওয়ার্ডের দিকে অগ্রসর হ’লাম, কিন্তু আমি তার প্রশ্নটাকে ক্যারী করলাম।
একটা মানসিক হাসপাতালের কিংবা অন্য যে কোন হাসপাতালের ‘মানসিক রোগ’ বিভাগের ওয়ার্ডগুলোর দেয়ালে দেয়ালে অনেক দীর্ঘশ্বাস এসে আঘাত করে করে ফিরে যায়। সেখানে অনেক চাপাকান্না গুমরে মরে। চিকিৎসার পাশাপাশি এসব শিশুসম ‘মন ভোলানো’ (‘যাদের মন ভোলানো হয়েছে’, এমন অর্থে) রোগীরা মানবিক আচরণ এবং স্নেহ ভালবাসার পরশ পেলে অনেক সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান (উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সাগরিকা’ ছায়াছবিটি’র কথা মনে পড়ছে)। আবার অনেকে চিরতরে বাকি জীবনটা বিচরণ করতে থাকেন নিত্য নিপীড়িত হয়ে এক প্রতিকূল জগতে- ব্যর্থতার গ্লানি, বিশ্বাসভঙ্গের শূন্যতা, প্রিয়জন হারানোর বেদনা অথবা ভয়ঙ্কর সব ভয়ভীতির প্রতিবিম্বকে সঙ্গী করে।
আমি দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন টেস্ট পরীক্ষার আগে আগে আমাদের বাংলা শিক্ষক হঠাৎ একদিন ক্লাসে এসে একটা রচনা লিখতে দিয়েছিলেন “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ ….” শিরোনামে। উনি সব সময় রচনার বিষয় এমনভাবে নির্বাচন করতেন, যা কোন বই এ পাওয়া যাবে না। সেদিন আমি কী লিখেছিলাম তা আজ মনে নেই, তবে শিক্ষক আমাকে আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি নম্বর দিয়েছিলেন, এবং সম্ভবতঃ সেটাই ছিল শ্রেণির সর্বোচ্চ নম্বর, তা মনে আছে। আজ যদি সে রচনাটা লিখতাম, তবে তার চেয়েও হয়তো বেশি নম্বর পেতাম বলে আমার মনে হয়। “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ ….” গানটিকে আমি একটি প্রকৃতির গান হিসেবে ভাবতাম। আমি সঙ্গীতজ্ঞ নই, যারা সঙ্গীত চর্চা করেন তারা ভাল বলতে পারবেন, এটা কি প্রকৃতির, নাকি প্রেমের, নাকি বিচিত্র পর্যায়ের গান। আমি গান শুনতে ভালবাসি। রবীন্দ্রসঙ্গীতই বেশি শোনা হয়, এখনো নিয়মিত শুনি। এই গানটি শুনতে শুনতে “ও যে আমায় ঘরের বাহির করে” অংশটায় আসা মাত্রই আমার এখনো এটাকে একটি গভীর বেদনার গান, নিরাশার গান, বিরহের গান, নষ্ট, ভ্রষ্ট ও ব্রাত্য স্মৃতির মাঝে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ওঠা একটি স্ফুলিঙ্গের গান বলে মনে হয়, সাতাশ বছর আগে দেখা কেবল ঐ একটা দৃশ্যের জন্যই, ঐ একটা উত্তর না জানা প্রশ্নের জন্যই!
ঢাকা
২৯ জুলাই ২০২১
পাবনা মানসিক হাসপাতালে একবার গিয়েছি ভাই। সত্যি খুব খারাপ লাগে। আপনার লেখাটি পড়ে তেরে নাম মুভিটার কথা মনে পড়লো হঠাৎ
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
অনেক ধন্যবাদ টিটো, পোস্ট পড়ে ভাবনা ও স্মৃতি এখানে উল্লেখ করে যাবার জন্য। কিভাবে যেন তোমার এ মন্তব্যটা আমার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। বিলম্বিত উত্তরের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।