চলে গেলো রুশো

“সার্ভিং দ্য হিউম্যানিটি”, সংক্ষেপে এসটিএইচ (“Serving the Humanity- STH”) নামের একটি ছোট্ট সংগঠন গঠিত হয়েছিল আজ থেকে ৭/৮ বছর আগে। প্রথম প্রথম একটু অগোছালো ভাবেই কাজ শুরু হয়েছিল, পরে স্থপতি জগলুল এর গুলশানের অফিসে বসে একটা আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে এ সংগঠনের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী নিয়ে একটা প্রাথমিক রূপরেখা তৈরী করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের কিছু উপকারে আসা এবং এ লক্ষ্যে যার যার সাধ্যমত অবদান রাখা। সংগঠনটির কোন সাংগঠনিক কমিটি তখনো ছিলনা, এখনো নেই। এর উদ্যোক্তা মূলতঃ মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের (পরবর্তীতে“মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ” নামে নতুন করে নামকরণকৃত – মির্জাপুর এর তৎকালীন এম পি জনাব ফজলুর রহমান ফারুক সাহেবের ইচ্ছায় ও প্রচেষ্টায় এক সরকারী আদেশবলে) কিছু প্রাক্তন ক্যাডেট। এই সভার আগে থেকেই ওরা কিছু সমমনা বন্ধু মিলে সমাজহিতৈষী কাজ করে বেড়াতো, যেমন শীতবস্ত্র বিতরণ, গ্রামের পাঠশালা বা স্কুলঘর মেরামত বা নতুন তৈরীকরণ, বন্ধুদের মধ্যে যারা ডাক্তার ছিল তাদের কয়েকজন মিলে মাঝে মাঝে বিনামূল্যে রোগী দেখে চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান ইত্যাদি। ওরা খেয়াল করেছিল যে ওরা যদি কোন জনহিতৈষী কাজের উদ্যোগ নেয়, তবে প্রচুর সাড়া পাওয়া যায়। অনেক লোকজন অকাতরে দান করতে প্রস্তুত থাকে, যদি তারা বুঝতে পারে যে তাদের দেয়া দানের টাকার সদ্ব্যবহার হবে। কিন্তু যারা প্রাথমিক উদ্যোগটি নিয়েছিল তারা সবাই ছিল চাকুরীজীবি। তাদের পক্ষে বড় কোন উদ্যোগ নেয়া কিংবা ঢাকার বাইরে কোন কাজ করাটা দুরূহ ছিল, এমনকি নিয়মিতভাবে আলোচনা সভা আয়োজন করাও সম্ভব হতোনা।

আমি তখন সদ্য অবসরে গেছি। স্থপতি জগলুল এর আমন্ত্রণে একদিন ওদের একটা আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকি। ওরা আমাকে এবং আমার ব্যাচমেট ডাক্তার হাবীবকে অনুরোধ করে, আমরা যেন সিনিয়র হিসেবে ওদের এসব জনহিতকর কাজকে সমন্বয় করার একটা অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব পালন করি। সেদিন আমি এবং হাবীব ওদের কথায় না বলতে পারিনি। এভাবেই আমিও জড়িয়ে গিয়েছিলাম STH এর দুটো মূল প্রকল্পে- STH ক্লিনিক এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য STH শিক্ষা প্রকল্পে। পরে দেখা গেলো, ওদের এমসিসি সতীর্থরা ছাড়াও, ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু এমনকি পেশাগত জীবনের কিছু কিছু বন্ধুরাও প্রচন্ড রকমের আগ্রহী এসব কাজে অংশ নিতে। তারা স্বেচ্ছায় তাদের নিজস্ব অর্থ, সময় ও মেধা ব্যয় করে, এমনকি কোন কোন সময় কায়িক শ্রম দিয়েও এসব কাজে অংশ নিত। তাদের এতটা আগ্রহ দেখে তাদেরকেও এসটিএইচ এর সাথে সম্পৃক্ত করে নেয়া হয়। আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি প্রায় ৭৫ বছর বয়স্ক একজন প্রকৌশলীও স্বেচ্ছায় একাজে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।

ঐ সভায় একজন প্রস্তাব উল্থাপন করে যে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার (কিন্তু দূরত্ব অনুযায়ী ইসলামপুর উপজেলার অধিকতর নিকটবর্তী) নিকটে “দূরমুট” নামক একটি রেল স্টেশন আছে। সেই রেল স্টেশনের খুব কাছ দিয়েই ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত। সেই নদের চরাঞ্চলের মানুষ একেবারেই হতদরিদ্র। ঐ এলাকার দরিদ্র জনগণের জন্য, বিশেষ করে অতি দরিদ্র নারী ও শিশুদের জন্য আমরা কিছু স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি। কেননা এসব এলাকার নারীদেরকে এমনকি অন্তঃসত্তা অবস্থায়ও অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম করতে হয়, অথচ ওরা দু’বেলা ঠিকমত খাবারও পায় না। মহিলাদের রোগ ব্যাধি হলে ওদের স্বামীরা ডাক্তার দেখাতে মোটেই উৎসাহী হয়না এবং সাধারণতঃ মহিলারা একেবারে শয্যাশায়ী না হলে ডাক্তারের মুখ দেখতে পায়না। দেশের এত জায়গা থাকতে ঐ জায়গাটির প্রস্তাব উঠেছিল কারণ ঐ অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির দুই পুত্র একদা এমসিসি’র ক্যাডেট ছিল। বড়ভাই এর নাম সৈয়দ সাবের কামাল জামান। ডাক নাম ফয়সাল। আর ছোট ভাই এর নাম সৈয়দ রিয়াসুজ্জামান রুশো। রুশো ঐ এলাকায় একটি দাতব্য স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওদের কিছু পারিবারিক জমি ছেড়ে দিতে অকাতরে সম্মত হয়। সেই সূত্রে সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ওদের ছেড়ে দেয়া জমিতে আমরা একটি দাতব্য স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করবো। লন্ডন থেকে তার ভাইও টেলিফোন করে তার অনুমতি দেয় এবং আমাদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে। শুরু হয়ে যায় আমাদের কাজ। আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে আজ স্মরণ করছি ক্লিনিকটি নির্মাণের ব্যাপারে ৭৫ বছর বয়স্ক সেই মুরুব্বী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলামের কথা, যিনি ক্লিনিকটি নির্মানের সময় একাধিকবার নিজ গাড়ীতে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং যেদিন প্রথম গ্রাউন্ড ব্রেকিং স্পেড ওয়ার্ক হয়, সেদিন তিনি নিজে বর্ষাভেজা মাঠে নেমে মাপামাপি করেছিলেন। কার্যরত অবস্থায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে অসংখ্য মশার কামড় উপেক্ষা করে তিনি সেই খোলা মাঠের মধ্যেই একটা চেয়ারে বসে মাগরিব এর নামায পড়ে দোয়া দরুদ পাঠ করেছিলেন। তিনি বছর দুয়েক আগে ইন্তেকাল করেছেন, তবে তার আগের বছর তিনি ক্লিনিকটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন।

দুপুরে খবর পেলাম, আজ সকালে রুশো ফজরের নামায পড়ে এসে তার কক্ষে প্রবেশ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। বাড়ীতে তার বৃদ্ধা মা ছাড়া আর কেউ নেই। মাকে দেখভাল করার জন্য রুশো দূরমুট ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি। তিনি তখন ঘুমন্ত ছিলেন। একজন গৃহকর্মী রুশোকে লক্ষ্য করে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে, কিন্তু তাড়াতাড়ি করে ইসলামপুরের চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করার মত কেউ ছিলনা। তাই হাসপাতালে নেয়ার আগেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। সম্ভবতঃ একটা ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এ্যারেস্টই তার মৃত্যুর কারণ। একাডেমিক বর্ষ অনুযায়ী রুশো আমার চেয়ে আট বছরের কনিষ্ঠ ছিল।

সৈয়দ রিয়াসুজ্জামান রুশো অনেক বড় মনের মানুষ ছিল। সৈয়দ বংশের ছেলে, সেরকমই ছিল তার আচার ব্যবহার। আমি তাকে একজন খুবই দয়ালু ব্যক্তি হিসেবে চিনে এসেছি। আমার সাথে পরিচয় হবার পর রুশো আমাকে অনেকদিন বলেছে, ‘খায়রুল ভাই, একমাত্র আপনিই আমার নামটি (Rousseau) সঠিকভাবে লিখতে কোনদিন ভুল করেন নি; অনেকেই আমার নামের বানানটা ভুল করে লিখে”। বোধ করি ওদের পিতা ফরাসী দার্শনিক Jean-Jacques Rousseau (জন্ম সুইজারল্যান্ডে) এর নামানুসারেই রুশোর নামটি রেখেছিলেন, যার একটি বিখ্যাত উক্তিঃ What wisdom can you find that is greater than kindness? এই kindness কথাটা ওর নামের সমার্থক ছিল। যেসব বাচ্চারা আমাদের শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ছিল, প্রতিবছর কুরবাণীর ঈদ এলেই রুশো মেসেজ পাঠাতো বাচ্চাদের নিয়ে ঈদ করার জন্য একটা গরু কুরবাণী দিতে চায়। সাথে সাথেই স্পনসর যোগার হয়ে যেত, কেউ না কেউ এগিয়ে আসতো, অনেক সময় একাধিক জন। Ex Cadets’ Forum (ECF) এর Toys R Urs (Toys Are Yours) নামে একটা প্রকল্প আছে, যেখানে তারা স্বচ্ছল ও দয়ালু ব্যক্তিদের কাছ থেকে পুরনো ব্যবহারোপযোগী খেলনা সংগ্রহ করে দরিদ্র শিশুদের মাঝে বিতরণ করে। ওদের সাথে যোগাযোগ করে একবার আমরা অনেক খেলনা সেখানে পাঠিয়েছিলাম। খেলনাগুলো শিশু ও বালক বালিকাদের মাঝে বিতরণ করার পর ওদের মুখে যেমন আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিল, রুশোর মুখেও তেমনি একটা ঔজ্জ্বল্য ভেসে উঠেছিল। বাচ্চাদেরকে যে রুশো এত ভালবাসতো, সেই রুশোই আজীবন অকৃতদার রয়ে গেল, কে জানে মনের কোন দুঃখে! খুবই সরল মনের মানুষ, কিছুটা পাগলাটে স্বভাবেরও। কিন্তু আমার কাছে মনে হতো, সে ছিল এক বিজনবাসী, নিভৃতচারী সাধু। হাসতো, খেলতো, সিগ্রেট খেতো দেদারসে, বৃদ্ধা বিধবা মাকে দেখাশুনা করতো পরম নিষ্ঠায়, গরীব আম জনতাকে চিকিৎসা সেবা দিত তার নিজস্ব স্টাইলে- কখনো পথ চলতে চলতে, সিগ্রেট ফুঁকতে ফুঁকতে অথবা চলন্ত রিক্সা থামিয়ে খস খস করে হাঁটুর উপরে ধরে রাখা একটা যেমন তেমন কাগজে সে প্রেসক্রিপশন লিখে দিত। সবাইকে তুই তুই করে বলতো, সবাই সেটাকে আপন করে নেয়ার অভিব্যক্তি বলেই মনে করতো। দিনশেষে সে একলা ঘরে থাকতো, কখনো গান শুনতো, কখনো কোন অধরা সুখের সন্ধানে অজানা কল্পনায় ভেসে বেড়াতো। এই রুশোই একাদশ শ্রেণীতে থাকা কালে কলেজের বার্ষিক এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় প্রথমে নিজ কলেজে, তার পর আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতায় “দ্রুততম ক্যাডেট” শিরোপা অর্জন করেছিল। পরবর্তী জীবনে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় সে সেখানেও দাপটের সাথে এ সাফল্য ধরে রাখে। ফিল্ডট্র্যাকে এতটা ক্ষিপ্র রুশো জীবনের ট্র্যাকে উঠে কি কারণে তার স্টীম হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা নিয়ে কেউ ভাবেনি, সে নিজেও কখনো না।

আগামীকাল বাদ জুম্মা দূরমুটে ওর জানাযা ও দাফন অনুষ্ঠিত হবে। আমার দুঃখ, এই মহান প্রাণের চিরবিদায়ের শেষ আনুষ্ঠানিকতায় আমি উপস্থিত থাকতে পারবো না। আজ ২০ শে সেপ্টেম্বর। গতবছর ঠিক এই দিনে এখানে আমি আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করেছিলামঃ
একদিন শুধু ছবি হয়ে যেতে হবে

তারিখ সহ কবিতাটা কতই না কাকতালীয়ভাবে রুশোর জীবনে সত্য হয়ে গেল! আজ থেকে রুশো শুধু একটি নির্বাক, ফ্রেমাবদ্ধ ছবি হয়ে রবে। তার ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে বাড়ীর দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার মত তার বাড়ীতে আজ কেউ নেই। সে রবে আমাদের সবার অন্তরে- কখনো নির্বাক ছবি হয়ে, কখনো সবাক চলচ্চিত্র হয়ে এক বেদনা বিধুর জীবনের কাহিনী শুনিয়ে আমাদের কাঁদিয়ে যাবে।

ঢাকা
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পুনশ্চঃ ঢাকা থেকে নামাযে জানাযায় অংশ নিতে যাওয়া রুশোর একজন ব্যাচমেটের ভাইবার মেসেজ থেকে উদ্ধৃত করছিঃ
“প্রতিদেনের মতো গতকালও শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে হেঁটে ক্লিনিকে এসে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছে, মাযারের কাছের মসজিদে গিয়ে ফজর পড়ে আবার ক্লিনিকে এসে সূর্যোদয়ের পর এশরাক নামাজ পড়ে হেঁটে নিজের রুমে গিয়ে ফ্লোরে পাতা তার বিছানায় শোয়ার আগে বললো……. তুস্টি, চা দে…….এই তার শেষ কথা….. ৪ মিনিটের মধ্যে সব শেষ….. সময় তখন সকাল ৬ টা।”

তুষ্টি ওদের বাসায় আশৈশব থাকা এবং বড় হওয়া একজন বিশ্বস্ত গৃহকর্মী তথা কেয়ার টেকার। এখন তার বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। যারা একবার ওদের দুরমুটের বাসায় গিয়েছে, তাদের সবার ওকে চেনার কথা। খালাম্মা ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। তিনি এখন আর রুশোর বন্ধুদেরকে চিনতে পারেন না, এমনকি যারা বছরে বছরে বহুবার ওদের বাসায় যাতায়াত করেছে, তাদেরকেও না। তাঁকে জানাযার আগে পর্যন্ত খবরটা ভেঙে বলা হয়নি। তবে তিনি বাড়ির চারপাশে অনেক মানুষ দেখে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘চারিদিকে এত মানুষ কেন’? জানাযার ঠিক আগে আগে ওনাকে খবরটা ভেঙে বলার সময় উনি কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসেছিলেন, অশ্রুপাতও করেছিলেন, কিন্তু তার পরে মনে হয় আবার সবকিছু ভুলে গিয়েছেন। কতই না ঠুনকো মানুষের এ স্মৃতিময় জীবন! বোধশক্তি এবং স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেললে মানুষের জীবনটা কতটা অসার হয়ে পড়ে!

উপরে রুশোর দুটো ছবি দিলাম। প্রথমটা একাদশ শ্রেণীতে সে যখন “দ্রুততম ক্যাডেট” হয়েছিল, সে সময়ের রুশো বিজয় স্তম্ভে দাঁড়ানো। পরেরটা পরিণত বয়সের, ক্ষিপ্রতা হারানো শান্ত, সৌম্য রুশো।
ছবি সৌজন্যঃ মোস্তাক আহমেদ

৬,৮৩৩ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “চলে গেলো রুশো”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।