পাখি,
আমার এখানে এখন দুপুর তিনটে বাজে। তোমার ওখানে রাত তিনটে। আমাকে এ সময় চিরাচরিত দিবানিদ্রায় পেয়ে বসে। আজও আমার দু’চোখ ভরে ঘুম নেমে আসছে। তুমিও এখন এই মধ্যরাতে নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। হয়তো কিছু স্বপ্ন তোমায় ঘিরে রেখেছে, হয়তো নয়। এই সেদিনও এ সময়ে তুমি আমার সাথেই ঘুমাতে, আমার ঘাড়ে কিংবা বুকে মাথা রেখে। আমি গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে ভালবাসি, তুমিও। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তোমার যেখানে ছড়া কিংবা রাইমস শুনে ঘুমানোর কথা, তুমি সেখানে আমার পছন্দের নির্দিষ্ট কিছু গান না শোনানো পর্যন্ত কিছুতেই ঘুমাতে না। এভাবেই মাত্র তিন বছর বয়সেই তোমার অনেকগুলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের কলি মুখস্থ হয়ে গেছে। তুমি ভালবাসতে “সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে” শুনতে এবং সেই সাথে নিজেও গানের কথাগুলো বলতে, না বুঝেই। আমি চাইতাম বন্যার কন্ঠে শুনতে, তুমি ল্যাপটপে শাহানা বাজপাই এর ছবির উপর ছোট্ট তর্জনীটা বসিয়ে ওর কন্ঠেই গানটা শুনতে চাইতে। ‘আমি কান পেতে রই’ গানটাও তুমি শাহানা বাজপাই এর কন্ঠেই শুনতে চাইতে। তোমার তো নয়ই, তোমার বাবার প্রজন্মেরও কেউ হয়তো অখিল বন্ধু ঘোষের নামটাও শুনেনি, হয়তো তোমার বাবাও না। কিন্তু তুমি ঠিকই তার কিছু গান শুনতে চাইতে আমার ল্যাপটপে, যেগুলো আমিও শুনতাম। Rabindra Sangeet instrumentalist V. Balsara এর গীটারে বাজানো ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটা এলেই তুমি আমার ঘাড়ে মাথা রেখে চাইতে যেন গানের সুরে সুরে তোমাকে কোলে নিয়ে আমি মৃদু লয়ে নাচি। সেই ছন্দের দোলায় তুমি নিমিষে ঘুমিয়ে পড়তে। এভাবে কখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু ছন্দে নেচে আবার কখনো বুকে নিয়ে শুয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াতাম। আজ শুধু তোমার ছোট্ট বালিশ আর কোল-বালিশটাই আমাদের শয্যায় রয়েছে, তুমি নেই। বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আমরা দু’জনে কত প্লেন দেখতাম। আজও প্লেন উড়ে যায়, আমি দেখি, তুমি নেই! দখিনের বারান্দার রেলিঙে ঝুলে থাকা গোল গোল মুক্তোর মত বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে আমরা দু’জনে মিলে ভেঙে ফেলতাম। আজও বৃষ্টি হলে অনেক ফোঁটা ঝুলে থাকে। আজ সেগুলো ঝুলতে ঝুলতেই বাতাসে শুকিয়ে যায়, ভাঙবার কেউ নেই!
তোমরা যেদিন মাঝরাতে উড়ে যাবে, সেদিন সন্ধ্যা থেকেই তোমার মা বাবা প্যাকিং নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল। তুমি মাঝে মাঝে এসে তাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলে। এশার নামাযের পর আমি তোমাকে নিয়ে তোমার চিরপরিচিত পার্কটাতে গেলাম। আমার মন খুবই ভারী হয়ে ছিল। কারণ এর মাত্র ৫/৬ ঘন্টা পরেই প্লেন ধরার জন্য তোমাদের বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হবার কথা। কি কারণে যেন তুমিও সে রাতে খুব ছটফট করছিলে। খুব গরম পড়েছিলো, তাই বেশীক্ষণ সেখানে থাকতে পারিনি। ফিরে আসার সময় তুমি কিসের সাথে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলে। একটু কেঁদেও ছিলে। আমার ভারী মনটা আরো ভারী হয়ে উঠেছিলো। এর আগে কোনদিন পড় নাই, আর বিদায়ের সেই দিনই তোমাকে হোঁচট খেয়ে পড়তে হবে? সেদিন ব্যথাটা তোমার চেয়ে আমিই বেশী পেয়েছিলাম। মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়াতে বিমান বন্দরে তুমি বিরক্তবোধ করছিলে। ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে যখন শেষ চোখাচোখি হবার পালা, বাই বাই দেয়ার পালা, তখন তুমি অঝোরে কান্না শুরু করলে, বোধ হয় সেই বিরক্তি থেকেই। তোমার বাবা মা তাড়াতাড়ি তোমাকে আমাদের চোখের আড়াল করলেও, আমাদের ভেতরেও এক চাপা কান্না শুরু হয়ে যায়।
বিদায়ের কয়েকদিন আগে একদিন দুপুরেও আমি তোমাকে আমাদের সেই চির পরিচিত পার্কটাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি আমার আঙুল ধরে হাঁটাপথ ধরে চলছিলে। পেছন থেকে তোমার আরেক দাদাভাই (আমার বন্ধু) আমাদের হাত ধরে হাঁটার একটা ছবি তুলে আমাদের বন্ধুদের “হোয়াটস এ্যাপ” গ্রূপে “জীবনের জার্নাল” নামে ছাপিয়ে দেয়। তোমার মনে আছে কিনা জানিনা যে “জীবনের জার্নাল” নামে আমার একটা স্মৃতিকথার বই আছে, সেটার প্রচ্ছদটাও তোমার আমার হাত ধরে হাঁটার সেই দৃশ্যটার মতই, প্রায় একই রকমের। তুমি মাত্র দেড় বছর বয়সের সময় তোমার মা বাবা আর নানুর সাথে বইমেলায় গিয়ে সবাই মিলে বইটা কিনেছিলে। আমি এখনো মাঝে মাঝে সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি যাওয়ার মাত্র তিনদিন আগে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার আরেক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার আরেক দীদা তোমাকে অনেকগুলো চকলেট দিয়েছিল। সেখান থেকে তুমি দু’টো চকলেট হাতে তুলে নিয়েছিলে। একটা সেখানেই খেয়েছিলে, আরেকটা হাতে রেখেছিলে। বাড়ী ফেরার সময় তুমি গাড়ীতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তোমার মুঠো শিথিল হয়ে চকলেটটা আমার কোলে পড়ে গিয়েছিল। আমি সেটা সযত্নে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, পরদিন সকালে তোমাকে দিব। কিন্তু ব্যস্ততার ডামাডোলে সেটা আর তোমাকে দেয়া হয়ে উঠেনি। এরই মধ্যে তুমি চলে গেলে। আমি সেই চকলেটটার দিকে তাকাই, আর তোমার কথা মনে করি, তোমার কচি মুঠোর স্পর্শ অনুভব করি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে বহুদিন চলে গেল। এর মধ্যে আমি সাত দিনের সফরে সিঙ্গাপুর ঘুরে এসেছি। চকলেটটা আমার হাতব্যাগেই ছিল।কয়েকদিন সেটা খোলার জন্য হাতে নিয়েছি, পারিনি। সিঙ্গাপুর ঘুরে হাতব্যাগেই সেটা আমার ঘরে ফিরে এসেছে, এবং আজও সেটা আমার টেবিলে।
প্রায় ছত্রিশ ঘন্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে। তোমার মা বাবারও খুব কষ্ট হয়েছে। ঐ ছত্রিশ ঘন্টা আমরাও খুব কষ্টে আর চিন্তায় ছিলাম। আমি যখন ঈদুল আযহা’র জামাতে যোগ দেয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি, ঠিক তখনই দেখলাম টার্কিশ এয়ারলাইনস এর তোমাদের সে প্লেনটা আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এর আগে ছাদে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম প্লেনটাকে দেখার জন্য। কিন্তু সেটা আধা ঘন্টা দেরী করে ওড়ার জন্য জামাত মিস হবার ভয়ে আমি রওনা দিয়ে ফেলি। যেইনা রওনা দিলাম, অমনি ওটা উড়লো। নামাযে বসেই দোয়া করতে থাকি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের পাখিটাকে ওর মা বাবাসহ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিও! নামাজের পর থেকে অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে গুগল ফ্লাইট রাডারে ফ্লাইট নং টিকে ৭১৩ এর গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রেখেছি। ঈদের দিনটা সারাদিন ধরে তোমাদের কথা ভেবেছি। বিকেলে যখন তোমার বাবার কাছ থেকে ট্রাঞ্জিট বিমানবন্দরে পৌঁছার একটা ছোট্ট মেসেজ পেলাম, কেবল তখনই মনটা একটু শান্ত হলো। ঢাকা থেকে প্লেনটা আধা ঘন্টা দেরী করে ছাড়াতে চিন্তায় ছিলাম, দশ ঘন্টা ওড়ার পর কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য তিন ঘন্টা ট্রাঞ্জিট সময় তোমাদের জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে। সেখান থেকে আবার দশ ঘন্টা ওড়ার পর আরেকটা তিন ঘন্টার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে তবে তোমাদের নতুন নীড়ে পৌঁছতে হবে। শরীরের ওপর দিয়ে খুবই ধকল যাবার কথা, তাই খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যাইহোক, যখন তোমার বাবার কাছ থেকে তোমাদের নতুন নীড়ে পরের দিন সেখানকার মধ্যরাতে পৌঁছাবার খবরটা পেলাম, তখন আমি ও তোমার দীদাও ওড়ার জন্য ঢাকা বিমান বন্দরের স্কাই লাউঞ্জে বসা। তোমাদের পৌঁছার খবর পেয়ে আমরাও স্বস্তির সাথেই সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হ’লাম।
তুমিহীন এই শূণ্য ঘরে মন টিকাতে পারবোনা বলেই তুমি যাওয়ার পরের দিনই কয়েকদিনের জন্য একটু ঘুরে আসার পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলাম। ঘুরে এসে আবার শূণ্য ঘরে, খুবই খারাপ লাগছিল। সেই শূণ্যতা নিয়েই আজও আছি। যখন তোমার মা বাবার সাথে মেসেঞ্জারে ভিডিও চ্যাট করি, তখন চোখটা পড়ে থাকে তোমারই দিকে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে যেন তুমি তোমার নতুন নীড়ে গিয়ে লাজুক হয়ে গেছ। আমাদের সাথে কথা বলতে কেন যেন খুব লজ্জা পাচ্ছো। শুনেছি তোমাকে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য তোমার মা বাবা তোমাকে কয়েক ঘন্টার জন্য ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে যায়। তুমি সেখানে কেন্দ্রা নামে তোমার সমবয়সি নতুন এক কানাডিয়ান বান্ধবী পেয়েছো। তোমাদের মুখের ভাষা পৃথক হলেও মনের ভাষা অভিন্ন। সে তার ভাষায় কথা বলে, তুমি তোমার। কিন্তু এজন্য তোমাদের কোন কিছুই বুঝতে অসুবিধে হয়না। যতক্ষণ ও সেখানে থাকে, ততক্ষণ তুমি নিজের বাসায় ফিরতে চাওনা। এটা জেনে আমরা খুশী হয়েছি। আমরা জানি, তুমি সেই ছোট্টবেলা থেকেই কতটা বন্ধুবৎসল। বন্ধু পেলে তুমি নাওয়া খাওয়া ভুলে যাও। বন্ধুদের সাথে নিজের খেলনা ভাগ করে নিতে কখনোই তোমার কোন আপত্তি ছিলনা। সেখানেও তাই। খুব ভাল, তুমি মা, বাবা আর বন্ধুদের নিয়ে সারাদিন হাসি খুশীতে দিন কাটাও, এটাই আমরা চাই। কিন্তু এখন আরেকটা দুশ্চিন্তা আসছে। শীতকালে আমাদের দেশে শীতের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে আসে কিছুটা উষ্ণতার জন্য। শীত চলে গেলে ওরা আবার নিজ দেশে উড়ে যায়। কিন্তু তুমি শীত আসার ঠিক আগে আগে আমাদের উষ্ণ দেশ থেকে পরিযায়ী পাখি হয়ে উড়ে গেলে শীতের দেশে। আর কিছুদিন পর থেকে সেখানে তাপমাত্রা শূণ্যের দিকে নামবে। তারপর ধীরে ধীরে শূণ্যের অনেক নীচে চলে যাবে। তখন তোমার কি হবে, সেকথা ভেবে আমি অস্থির!
ভাল থেকো পাখি! সারাদিন মা বাবার চোখে চোখে থেকো, তাদের চোখের মনি হয়ে থেকো। ভবিষ্যতের পথে তোমার পদযাত্রা যেন নিরাপদ হয়, মসৃণ হয়, সেকথা ভেবেই আমরা আমদের নিজেদেরকে বুঝ দিয়ে রেখেছি। একদিন আবার আমরা অন্ততঃ কিছুদিনের জন্য একসাথে হবো, সে আশায় বুক বেঁধে আছি। নতুন নীড়ে তোমার মা বাবাকে শূণ্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে। খুশী হ’লাম জেনে যে ইতোমধ্যে তোমাদের ঘরে কিছু নতুন আসবাবপত্র এসেছে। আজ দেখলাম নতুন টিভির সামনে তুমি নেচে নেচে গান গাচ্ছো। শুনলাম, তোমার বাবা একটা নতুন গাড়ীর ডেলিভারী নিতে এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন এর কাছে প্রার্থনা করি, প্রবাসে তোমাদের গৃহ নিরাপদ হোক, তোমাদের গাড়ী নিরাপদ হোক, তোমরা তাঁর রাহমাতে, বারকাতে, হেফাযতে, মাগফিরাতে, হেদায়াতে, সালামাতে থাকো। প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’লাহ তোমাদের সহায় থাকুন! আমীন!