ফযরের আযান শুনে নীলার ঘুম ভাংলো। উঠি উঠি করেও অভ্যেস বশতঃ কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়েই এপাশ ওপাশ করলো। তারপর গা ঝারা দিয়ে উঠে সে বিছানার পাশে দখিনের জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকলো। দুই একজন মসজিদমুখী মুসল্লীর হেঁটে যাওয়া নির্বিকারভাবে তাকিয়ে দেখলো। জানালার কাঁচটা কিছুটা সরিয়ে দিয়ে নেটের ফ্রেমটা টেনে দিল। ঝিরঝিরে মৃদু সমীরণ শীতের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছিল। নীলা ওযু করে এসে ফ্যানটা অফ করে দিয়ে নামাযে দাঁড়াল। খুব মন দিয়ে নামায পড়ে কিছু দোয়া দরুদ পড়তে থাকলো। এমন সময় একটা উড়োজাহাজ শব্দ করে জানালার ফ্রেম পার করে দূর আকাশে মিলিয়ে গেল। নীলা তাকিয়ে থাকলো তার মিটিমিটি জ্বলা আলোর দিকে, যতক্ষণ দেখা যায়। এটা তার পুরনো অভ্যেস। গতির প্রতি তার চিরকালের আকর্ষণ, কিন্তু গতির পিছু ধাওয়া করার সাধ্য তার নেই। মনটা পিছু নেয়, তাই গতিময় কিছু দেখলেই!
গত কিছুদিন থেকে নীলা তার অবচেতন মনে শুধু গোরস্থানের ছবি দেখে। দেখে, সে দুর্বা ঘাস আচ্ছাদিত মাটির নীচে চিরনিদ্রায় শায়িত, আর তার ক্ববরের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু চেনা অচেনা মুখ তার জন্য দোয়া করে যাচ্ছে। চেনামুখগুলোর প্রতি তার তেমন কোন ঔৎসুক্য নেই, কিন্তু অচেনা মুখগুলো কাদের? তারা কেন তার জন্য দোয়া করছে? জীবনে সে কি কখনো তাদের জন্য কিছু করেছে? কৃতজ্ঞতায় ঘুমের মধ্যেও তার চোখে পানি এসে যায়। ঘুম ভেঙ্গে গেলে স্বপ্নটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। কাউকে ভালবেসেও তার দোয়া পাওয়া যায় না, আবার কাউকে জীবনে কোনদিন না দেখেও অন্তিম শয্যায় চিরনিদ্রিত থেকে তার দোয়া পাওয়া যায়! জীবনের অনিবার্য পরিণতি থেকে কোন মুক্তি নেই, এ কথা ভেবে সে গুড গ্রেসে সৃষ্টিকর্তার এ অমোঘ নিয়মকে মেনে নিয়ে কিছুটা শান্তি পায়, কিন্তু তার পরই আবার তার সন্তান সন্ততিদের কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে ওঠে। অনেক দিন ধরেই এ ধরণের দ্বৈত দ্বন্দ্ব নীলাকে ভোগাচ্ছে, কিন্তু এসব নিয়ে সে কারো সাথে আলোচনা করতে চায় না। সে আনমনে একটা কাগজের টুকরো টেনে নিয়ে তাতে খসখস করে লিখে ফেললোঃ
‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’- কথাটা আছে প্রবচনে,
এটা কে না জানে,
কিন্তু ‘বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত’ গোপনে গোপনে
করে আনাগোনা মোর হৃদয় গহীনে।
শরতের ঝলমলে রোদেও যেমন হঠাৎ করে আসা ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি প্রকৃতিকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়, তেমনি হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভাবনা এসে চির হাসিখুশী নীলার চোখ আর মনকেও আর্দ্র করে যায়। তখন নীলার কিছু ভাল লাগেনা। কেন ভাল লাগেনা, তাও সে জানেনা। সে তার জীবনের সুখের স্মৃতিগুলোর কথা ভাবতে চেষ্টা করে কিন্তু দোদুল্যমান দ্বিধাগ্রস্ততা তাকে অসাড় করে দেয়, সুখ দুঃখের ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে সে গান শোনে, কবিতা পড়ে, অকারণে গাছপালা আর উড়ন্ত পাখির দিকে তাকিয়ে রয়। অবিন্যস্ত ভাবনাগুলো এক এক সময় একেক রকমের অনুভূতি বয়ে আনে। ভাবতে ভাবতে এক সময় মনটা উদাস আর দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে ওঠে। ঝাপসা হতে হতে চোখে কখন দানা বেঁধে ভেসে ওঠে মূল্যহীন এক মুক্তো, তা সে টের পায় না। ঝুপ করে একসময় সেটা পড়েও যায়, সবার অগোচরে শুষ্ক প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যায়- কখনো মাটিতে পড়ে, কখনো চোখে ঝুলতে ঝুলতে শুষ্ক বাতাসে মিশে। নীলা একসময় চোখ মুছে উঠে আবার গান শোনেঃ
এত জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলে বল কে?
টলমল জল মোতির মালা দুলিছে ঝালর –পলকে!!!
ঢাকা
২৮ অক্টোবর ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
ভালো লাগলো... 🙂 🙂
অনেক ধন্যবাদ, প্রীত হ'লাম।
লেখাটা পোস্ট করার প্রায় সাড়ে সাত মাস হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে এটা ৭৬৫ বার পঠিত হয়েছে, কিন্তু কেউ সময় করে কিছু বলে যান নি। আপনি ভাল লাগার কথাটি জানিয়ে গেলেন, এতে নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত হ'লাম। 🙂
শুভেচ্ছা....