[আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, বিনোদনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা কি, আমি এক মুহূর্তও চিন্তা না করে উত্তর দেব- “ভ্রমণ’। এর আগে বেশ ক’টি দেশ ঘোরার সৌভাগ্য হলেও, ভ্রমণকাহিনী কখনোই লেখা হয়ে ওঠেনি। কাজেই যা লিখতে যাচ্ছি, আদর্শ ট্রাভেলগের অনেক বৈশিষ্ট্যই হয়তো সেখানে অনুপস্থিত থাকবে। সবার কাছে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।]
১.
বেশ ক’মাস ধরেই নেপাল ঘোরার একটা ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সব জায়গা বাদ দিয়ে নেপালই কেন, স্পষ্ট জানি না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই, তবে স্বল্প বাজেট সম্ভবত আরো বড় কারণ। কোন এক দুপুরে অফিসে বসে ফাইল উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, গৌতম বুদ্ধের দেশ দেখে আসবো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথে কয়েকজনকে ফোন দিলাম, ভ্রমণসঙ্গী হবে কিনা জানার জন্যে। শেষ পর্যন্ত ভ্রমণসঙ্গী হলো ইমরান রহমান, আমাদেরই ব্যাচমেট, তবে বরিশাল ক্যাডেট কলেজের।
প্ল্যানিং, টিকেট কাটা এসব ক্লান্তিকর বর্ণনা দিতে চাচ্ছি না। নেপালে যাবার জন্যে আগে থেকে ভিসা করার কোন প্রয়োজন নেই- কাঠমান্ডুতে নেমে এয়ারপোর্টে অন এ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে নিলেই চলে। টিকেট কাটতে আলসেমি করাতে, শেষ মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে একটু বেশী দামে বাংলাদেশ বিমানের টিকেট নিতে হলো; যাওয়া-আসা সতেরো হাজার টাকা।
দেখতে দেখতে ২৯.০৫.১৬ তারিখ চলে এলো। টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরে ইয়ো সেজে দুই বন্ধু সকাল সকাল এয়ারপোর্ট গেলাম। সাথে শুধু একটা করে ব্যাকপ্যাক, কোন লাগেজ নেই। চোখে সানগ্লাস। ইয়ো ম্যান!
বাঙালি যাত্রী বোঝাই উড়োজাহাজে সবসময়ই কিছু না কিছু মশলাদার বিনোদনের উপকরণ পাওয়া যায়। অবশ্য সেই মশলা যে সবসময় কেবল বিনোদনই দেয়, তা না।
(দুবাই থেকে ঢাকাগামী এমিরেটসের ফ্লাইটে উঠেছিলাম একবার। প্লেনে উঠেই যাত্রীরা গাট্টি-বোচকা-বস্তা নিয়ে প্রায় মারামারি শুরু করে দিলো। দেখলাম, অনিন্দ্য সুন্দরী ইউরোপীয়ান এয়ার হোস্টেসকে বছর ত্রিশেকের এক ভদ্রলোক ব্যাকুল ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করছেন: “আফা পুস্রাব ধরছে। কুনে যামু?”)
যেহেতু কাঠমান্ডু যাচ্ছি বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে, এজাতীয় বিনোদনের জন্যে তৈরী হয়েই ছিলাম। বিধাতা নিরাশ করলেন না। গোলগাল চেহারার, মধ্যবয়স্ক হলুদ শার্ট পড়া এক মহাপুরুষ টেক-অফের কিছুক্ষণ পর সিটবেল্ট খুলে প্লেনের বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। অনেক আসন খালি ছিল, তিনি একেকবার একেক সিটে বসে সব ধরনের অনুভূতি আহরণের চেষ্টা করলেন। আমাদের পেছনে দু’জন সুদর্শনা নেপালি তরুণী বসেছিলেন। হলুদ শার্ট দেখলাম এক পর্যায়ে তাদের পাশের সিটে বসে সেলফি তুলছে, এবং ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তরুণী দুজনকে ফ্রেমে নিয়ে আসছে (মানে তার হাসিমুখের ঠিক পেছনে)- তাও ল্যান্ডিংয়ের কিছুক্ষণ আগে, যখন কেবিন ক্রুরাও সবাই বসে পড়েছে।
এসব বিচিত্রতার মাঝে একসময় প্লেনের চাকা ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করলো। মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার পথ। পা মাটিতে রেখে মনে মনে বললাম- হ্যালো কাঠমান্ডু, হাউ ডু ইউ ডু?
ফলোড বাই দাঁত কেলানো সেলফি…
————————-
এয়ারপোর্ট থেকে নেমে কিছুক্ষণ এগুনোর পর হঠাৎ এক সিলেটি ভদ্রলোক এসে ধরলেন। খাঁটি সিলেটি ভাষায় বললেন: “ভাই, ইংরেজী-নেপালি-হিন্দী খিছুই জানি না। খই যাইতাম, খ্যামনে যাইতাম, খ্যামনে থাখতাম, খ্যামনে খাইতাম???
মনে মনে বললাম, “তাইলে ব্যাটা তুই এইখানে আসছিস কীজন্যে?” সেটা তো আর মুখে বলা যায় না, তাই অনেক কষ্টে ভদ্রলোককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা হোটেলের দিকে পাঠালাম। বাঙালি খুবই অদ্ভুত!
নেপালিরা যে অতি ভদ্র জাতি সেটার প্রমাণ কিছুক্ষণের মাঝেই পেলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটে হেঁটে মেইন রোডে এসেছি, ইচ্ছে করেই ট্যাক্সি নিইনি। দুজনেই ঠিক করলাম, প্রথম রাইড হবে লোকাল বাসে। ট্যুরিস্টদের থাকার সব হোটেল মূলত ঠামেল এলাকায়। কিন্তু সেখানে কোন বাসে, কোথা থেকে যাবো তা তো জানি না! এমতাবস্থায় স্থানীয় এক ট্রাফিক পুলিশ আমাদের যেভাবে সাহায্য করলো সেটা অভাবনীয়। সে নিজে মিনিট বিশেক দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বাসে উঠিয়ে দিলো। চশমা পড়া সহজ-সরল নেপালি, নাম রাজ। সে আবার নিজে থেকে ফেসবুকে এ্যাড করে নিয়েছিলো আমাকে।
রাজের সাথে এই কিছুক্ষণের পরিচয়েই আমরা বুঝে গেলাম, বোকাসোকা এই লোকটার মন দারুণ পরিষ্কার।
বাসে উঠে বেশ আনন্দ পেলাম। ঢাকা শহরের মতই লোকাল বাস, ভেতরে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে (আমরাও)। কিছু হিপ্পী ধরনের ইউরোপীয়ান কপালে লাল রঙ মেখে বসে আছে। নেপালের অর্থনৈতিক অবস্থা যে খুব সুবিধের না, তা কিছুক্ষণের মাঝেই টের পেলাম। রাজধানী শহরকে খুব বেশী উন্নত মনে হলো না। বেশীরভাগ ঘরবাড়িই জীর্ণশীর্ণ, রাস্তাঘাট-গাড়িঘোড়া কোনকিছুই অর্থনৈতিক অগ্রসরতার খুব একটা সাক্ষ্য দেয় না।
সিটে বসার পর কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম। কোল্ডপ্লে-র হাইম ফর দ্য উইকেন্ড।
আহ, হিমালয় কন্যা! অবশেষে!
২.
বাস এসে থামল রত্নাপার্ক বাসস্ট্যান্ডে। ঠিক করলাম, এখান থেকে হেঁটেই যাবো। রত্নাপার্ক থেকে ঠামেল পনেরো-বিশ মিনিটের হাঁটাপথ।
শহরের প্রধান সড়ক ‘কান্তিপথ’ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটছি আর চারপাশে দেখছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কাঠমান্ডুর গড় উচ্চতা সাড়ে চার হাজার ফিট, মে মাসেও তাই আবহাওয়াটা বেশ আরামদায়ক। শহরের চেহারা অনেকটা বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোর মতন। মানুষ, ভীড়, হইচই সবই আছে। বাড়তি যেটা, সেটা হচ্ছে ট্যুরিস্ট। যতই ঠামেলের দিকে এগুচ্ছি, ততই সাদা চামড়ার সাহেব-মেমের সংখ্যা বাড়ছে, এই অফ সীজনেও!
ঠামেল পৌঁছে এক দোকানে ঢুকলাম মোবাইলের সিম কিনতে। লাইনে আমাদের আগে তিনজন চৈনিক তরুণী। হঠাৎ প্লেনের সেই হলুদ শার্ট ভদ্রলোক তার দলবল (আরো ৩-৪ জন) নিয়ে হুড়মুড় করে এসে হাজির হলেন। অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে আবিষ্কার করলাম, অদ্ভুতুড়ে এই মধ্যবয়স্ক বাঙালির দল বিকট শব্দে উল্লাস করছে: “এ এ এ…. ছাইনিজ মাইয়া, ছাইনিজ মাইয়া!”
ওখানেই একটা রেস্টোর্যান্টে লাঞ্চ সারলাম। নেপালি মেন্যু- চিড়া, মুরগির মাংস, সব্জী-টব্জী মাখিয়ে কী যেন একটা করে, নাম ভুলে গেছি। খেতে আহামরি না হলেও মন্দ না।
ঠামেল এলাকায় হোটেল, রেস্টোর্যান্ট, বার, দোকানপাট, ট্রাভেল এজেন্সি কোন কিছুরই অভাব নেই। বেশী অপশন থাকলে যে সমস্যাটা হয়- আমরা কোন হোটেল রেখে কোনটাতে উঠবো সেটা ঠিক করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত উঠলাম ব্যাকপ্যাকার’স লজ নামে এক হোটেলে। দরদাম করে ভাড়া ঠিক হলো প্রতিরাত এক হাজার নেপালি রুপি, মানে বাংলাদেশি টাকায় সাড়ে সাতশ’র মত। বেশ সস্তা।
প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। তাই ঠিক করলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর সন্ধ্যায় বের হবো, আর হেঁটে হেঁটে ঠামেল ঘুরবো।
হেঁটে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। আগেই বলেছি, ঠামেল হচ্ছে এখানকার ট্যুরিস্টদের থাকার জায়গা, কাজেই কোন কিছুরই অভাব নেই। পুরো অঞ্চলটা গলি- তস্য গলি- তস্য গলিতে বিভক্ত। এর মাঝে রিকশা চলছে, ট্যাক্সি চলছে, তার চেয়ে বেশী মানুষ হাঁটছে। ঘুরতে ঘুরতে আমরা চা খেলাম, নেপালি সিঙ্গারা সমুচা খেলাম। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা ব্যাপারটায় আনন্দ আছে। কোন চাপ নেই, তাড়া নেই, পিছুটান নেই। হাঁটো, দেখো, ভাবো- নো টেনশন!
খুব বেশি যে জিনিসটি চোখে পড়ছিলো, সেটা হচ্ছে একটু পর পর নানারকম হস্তশিল্পের দোকান। সেখানে বিখ্যাত নেপালি কুকরি (ওরা বলে ‘খুকুরি’) থেকে শুরু করে ছোট মূর্তি, হাতি-ঘোড়া-বাঘ-সিংহ, পাখা, মালা, জপযন্ত্র অনেক কিছুই পাওয়া যায়।
এই জপযন্ত্র, আর দোকানগুলো থেকে ভেসে আসা একটানা “ওঁম্ মণি পদ্মে হুঁম” বৌদ্ধমন্ত্র শুনে বেশ স্মৃতিকাতর ও রোমাঞ্চিত হয়ে গেলাম। যারা সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ উপন্যাসটি পড়েছেন, তারা সবাই এই জপযন্ত্র আর সংস্কৃত বৌদ্ধমন্ত্রটির সাথে পরিচিত। জপযন্ত্রটি আকারে মিনি-সাইজ মুগুরের মত। মাথায় চেইন দিয়ে ছোট একটা বলের মত বাঁধা থাকে, সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে মন্ত্রটা পড়তে হয়। ফেলুদার সেই বিখ্যাত অভিযানে তাঁর সঙ্গী জটায়ু এই জিনিস কিনেছিলেন, এবং এটা দিয়ে মাথায় মেরে এক শত্রুকে ঘায়েলও করেছিলেন।
মনে মনে লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর ভাষায় বললাম, “ভাই তপেশ, বেশ একটা স্পিরিচুয়াল ভাব হচ্চে এখানে এসে…”
—————————
আমরা দুজনেই অলস প্রকৃতির। সে রাতে হেঁটে শহর দেখার মাঝেই আমাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রইলো। হোটলে ফিরে এসে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল, কারণ পাশের রুমে দু’জন চাইনিজ ট্যুরিস্ট উঠেছে- দু’জনই মেয়ে, তার মাঝে একজন বেশ সুন্দরী।
সে রাতে ডিনার হোটেলেই সারলাম পাস্তাটাস্তা দিয়ে। ভালই রাঁধে, দামেও সস্তা।
রাতে রুমে রাজ্যের গল্প, আর পরবর্তী দিনের প্ল্যান। ভ্রমণে গেলে একটা জিনিস আমি করি, যেটা অন্যেরাও করলে উপকৃত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। যেখানে যেখানে যেতে চাই, সে জায়গাগুলো মোবাইলে গুগল ম্যাপে স্টারমার্ক করে রাখি। এতে দুরত্ব, সময়, আর সব ফিচারগুলো চোখের সামনে চলে আসে বলে প্ল্যানিং অনেক সহজ হয়ে যায়।
মন ক্লান্ত না হলেও দেহ ক্লান্ত, তাই ঘুম আসতে খুব বেশী দেরী হলো না। শেষ হলো আমাদের নেপাল ভ্রমণের প্রথম দিন।
(চলবে)
অসাধারন ছিল স্যার 🙂
টাকার এমাওন্ট টা উল্লেখ করাতে আমারও প্ল্যানিং করতে বেশ সুবিধা হচ্ছে। ;;)
ধন্যবাদ মেহেদী। পরের পর্বগুলো তো তাহলে তাড়াতাড়ি লিখতে হয়... যাবা কবে?
খুব শীঘ্রই হচ্ছে না, তবে সময় বের করে ফেলবো
:guitar: :awesome: :frontroll: :tuski: :-*
\\\"।নিউট্রন বোমা বোঝ. মানুষ বোঝ না ! ।\\\"
বউ নিয়ে ঘুরে আয়। রোমান্টিক জায়গা।
টি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার পরে ইয়ো সেজে দুই বন্ধু সকাল সকাল এয়ারপোর্ট গেলাম। সাথে শুধু একটা করে ব্যাকপ্যাক, কোন লাগেজ নেই। চোখে সানগ্লাস। ইয়ো ম্যান! - ছবিটা যেন চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছি! 🙂
উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা ব্যাপারটায় আনন্দ আছে। কোন চাপ নেই, তাড়া নেই, পিছুটান নেই। হাঁটো, দেখো, ভাবো- নো টেনশন! - এই ভাবনাটাই একটা আনন্দের অনুভূতি।
প্রথম পর্বটা তো বেশ ভালই লাগলো। দ্বিতীয় পর্বের খবর কি?
মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ স্যার।
দ্বিতীয় পর্বের একটা খসড়া শুরু করেছিলাম, কিন্তু সেসময়েই হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর এগুনো হয়নি। এবং ফ্লো কেটে গেলে যেটা হয় আরকী, আলস্য পেয়ে বসেছিলো! তবে পরবর্তী পর্বগুলোও লিখবো ইনশাআল্লাহ- সেই ইচ্ছে এখনো ভালমতই আছে। দোয়া করবেন স্যার।
:thumbup: