যুদ্ধ এবং শৈশব

যুদ্ধ এবং শৈশব

“দেয়ালির আলো মেখে নক্ষত্র গিয়েছে পুড়ে কাল সারারাত
কাল সারারাত তার পাখা ঝ’রে পড়েছে বাতাসে
চরের বালিতে তাকে চিকিচিকি মাছের মতন মনে হয়
মনে হয় হৃদয়ের আলো পেলে সে উজ্জ্বল হ’তো ।“ – শক্তি চট্টোপাধ্যায়

শান্তির সময়ে শিশুদের বয়স দ্রুত বাড়েনা। অর্থাৎ এই মন্থর সময়ে তাদের মানসিক বৃদ্ধির গতি উল্লেখযোগ্য নয়। তবে যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি আপদকালীন সময়ে তাদের মানসিক বৃদ্ধি খেয়াল করবার মতন। যদিও এই সময়গুলোতে তাদেরকে খেয়াল করবার অথবা তাদের দিকে মনোযোগ দেবার মতন কেউ থাকে না।

আপদকালীন সময়ে বড়দের নিবিষ্টতা থাকে অন্যত্র। তারা এমন সমস্ত বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন যেগুলোর উপাদানগুলোই স্বাভাবিক যে কোন সময় থেকে ভিন্নতর। এটা এমন সময় যখন মানুষের মৌলিক অধিকারের বোধও ম্লান হয়ে যায়। অথবা সুপ্ত রূপ ধারণ করে। এই সময়ে বিশেষকরে শিশুরা উপেক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশী। তাদের প্রতি বড়দের অমনোযোগিতার কারণে। ফলে তারা কখনই তাদের স্বভাবগত শিশুসুলভ বৃত্তি সমূহকে লালন বা পরিচালনা করতে সক্ষম হয় না। বরং নিজেরাই বড়দের উপযাচক হিশেবে অথবা বড়দের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের বৃদ্ধিকে গতিময় করে তোলে।

তবে আমার ধারণা খেলাধুলা করা শিশুদের অন্তর্গত স্বভাবের অংশ। তারা কখনোই খেলাধুলাকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে সক্ষম নয়। শান্তি বা যুদ্ধ, কোন সময়েই না। তবে এটা সত্যি যে, আপদকালীন সময়ে তাদের তাদের খেলাধুলার উপকরণ সমুহে ভিন্নতা আসে। শান্তির সময়ে কোন শিশু পুতুল নিয়ে খেলা করলে যুদ্ধের সময়ে সেই শিশুই ন্যুনতম খেলনা অস্ত্র নিয়ে খেলা করে। শান্তির সময়ে সে পুকুরের শান্তজলে ঢিল ছোড়ার খেলা করলেও, যুদ্ধের সময়ে তার হাতের ঢিল হয়ে ওঠে প্রতীকী গ্রেনেড। শান্তির সময়ে সে ঘাসফড়িঙ বা প্রজাপতির পিছনে ছুটলেও যুদ্ধের সময়ে সে কাগজের বোমারু বিমান তৈরি করে। শান্তির সময়ে সে সাগর সৈকতে বালির প্রাসাদ তৈরি করলেও যুদ্ধের সময়ে সে নির্মাণ করে পুকুর পাড়ের ঢাল দিয়ে মাছরাঙার গর্তের মতন অজস্র যুদ্ধের পরিখা সম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খেলাঘর বা গুপ্তস্থান। এমনকি ছবি আঁকার ধরণ বদলে যেতে পারে তার। যে শিশু পুতুলের মুখ আঁকতেই শান্তির সময়ে হিমশিম খেয়ে যায়, যুদ্ধের সময়ে সেই শিশুই আঁকতে সক্ষম হয় স্বৈরাচারীর বিকৃত মুখ। পটুয়া কামরুল হাসানের মতন নৈপুণ্য দিয়ে। এমনকি শিশুরা হয়ে উঠতে পারে বড়দের চেয়েও ভয়ঙ্কর!

আমি এ-কাল, সে-কাল, এ-দেশ, সে-দেশ এবং যুদ্ধ বা শান্তির সময়ের পরিক্রমা থেকে এধরনের একটা সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি!আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৯২ সনে কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ২০০১ সনে সিয়েরালিওনের গৃহযুদ্ধ। শৈশবে গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ন্যায় ঘটনার পরিক্রমা এবং কিছুটা পরিণত বয়সে সামরিক পর্যবেক্ষক হিশেবে কম্বোডিয়ায় আমার নিবিড় অবস্থান (১৯৯২-৯৩) এবং ২০০১ সনে সিয়েরালিওনে বাংলাদেশ সামরিক কন্টিনজেন্টের সদস্য হিশেবে গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত সিয়েরালিওনে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার উপরোল্লিখিত বোধকে ক্রমাগতভাবে দৃঢ়তাই দিয়েছে। আমি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছি কম্বোডিয়াতে পলপটের অধীনে শিশুদের নিজেদের পিতামাতার প্রতি বিধ্বংসী রুপ ধারণ করতে।বুর্জোয়া আখ্যা দিয়ে তাদেরকে তারা নিয়ে যায় শহর থেকে গ্রামে।অবশেষে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নিজহাতে হত্যা করে তাদের। সিয়েরালিওনে আমি দেখেছি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত কর্পোরাল ফুদে শাংক দেশের বেকার যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলে বিপ্লবী বাহিনী। নাম রেভুলেশনারী ইউনাইটেড ফ্রন্ট (REVOLUTIONARY UNITED FRONT)। সংক্ষেপে RUF।এই সংগঠন ১৯৯২ সন থেকে ২০০২ সন পর্যন্ত সিয়েরালিওনে প্রলয়ঙ্করী এক গৃহযুদ্ধের অবতারনা করে। দেশের কোমলপ্রাণ শিশুদের জোরপুর্বক ধরে নিয়ে তাদের বাহিনীতে শামিল করে। এই শিশু বাহিনীর মাধ্যমে পরিচালিত হয় ‘OPERATION PAY YOURSELF‘ এবং ‘ OPERATION NO LIVING THING’। ফ্যুদে শাঙ্ক নেশায় আসক্ত করে অবুঝ শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। তাদের দিয়ে চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নারী ও শিশু নির্যাতন। ঘটায় মানুষজনদের বিকলাঙ্গ করে দেয়ার মতন চরম পর্যায়ের মানবাধিকার লংঘন।এই ধরনের ঘটনার সমাপ্তি হয় না। আজকের দিনেও সিরিয়া, আফগানিস্থান, ইরাক, লেবাননে নিজভুমি থেকে বিচ্যুত হচ্ছে শিশুরা। তারা ক্রমাগত মৃত্যু, কান্না, আত্নপরিচয়হীনতার শিকার হচ্ছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস)এর নাম করে নিজেদের স্বদেশ ভূমিতেই আত্নপরিচয় বিস্মৃত হচ্ছে!

আমার জন্ম ১৯৬৫ সালে মতান্তরে ১৯৬৪ সালে।তবে বাস্তব হল ১৯৭১ সনে আমি ‘ছোট ওয়ান’ থেকে ‘বড় ওয়ানে’ উঠেছি এবং তখনো আমার ভেতরে পরিপূর্ণভাবে অক্ষরজ্ঞান সৃষ্টি হয়নি। আমি তখন ‘সবুজ সাথী’ নামক স্বপ্নের ছড়াবই থেকে সুর করে অঙ্ক শিখছি – ‘পিঁপড়া পিঁপড়া কয়টা ডিম? – ১ টা, ২ টা, ৩ টা ডিম’ এবং বাংলা ‘ত’, অঙ্কের ‘১’ ও ‘৯’ এর ভেতরে অদ্ভুত রকমের মিল দেখে ভীষণরকম কিংকর্তব্য বিমুঢ় হচ্ছি! এই সময়ের কিছু পূর্ব থেকেই অর্থাৎ ১৯৬৯ সালেই আমার শৈশব আমাকে ছেড়ে যাই যাই করছিলো আমার অক্ষর জ্ঞানকে সমাপ্ত না করেই। একটা সমুহ উপদ্রুত সময় আমাকে দ্রুত শিশু থেকে একজন পুর্নাঙ্গ মানুষে পরিনত করছিল!

স্মৃতি থেকে আমি যতটুকু পুনরুদ্ধার করতে পারি সে অনুযায়ী আমার প্রতি বাড়ীর বড়দের সর্বপ্রথম অমনোযোগিতা প্রদর্শিত হয় ১৯৬৯ সালে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত হননি) শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করতে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং অন্যান্য ছাত্র গোষ্ঠী বা গ্রুপ মিলে ১১দফা প্রনয়ন করে প্রাথমিকভাবে বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছে। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার হীন উদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করেছে। এই মামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দুর্বার ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠছে। ভীত সন্ত্রস্ত সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল সহ রাজপথে নেমে এসেছে লাখো মানুষ। পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী নামিয়েছে শহরে শহরে। রাজপথের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছে একজন উত্তাল কিশোর। নাম মতিউর রহমান। নবম শ্রেণির ছাত্র। উত্তাল হয়ে ওঠেছে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত।

আমার এক চাচাও ঝাড় কাটা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত কিশোর। উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান তথা ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার কারনে পুলিশের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। একদিন তিনি তার কৈশোরকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুক্ত আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার জন্যে অথবা পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে বাড়ী থেকে পালিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। কোথায় আমরা তা জানিনা। তবে উনার এই যাত্রা বা অগ্যস্ত যাত্রা আমাকে এবং বাড়ীর অন্যান্য সকল শিশু কিশোরদেরকে রাতারাতি বয়স্ক মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল। আমরা সকল শিশুতোষ শব্দ ভুলে যেয়ে ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ১৪৪ ধারা, হরতাল, এরেস্ট এই শব্দগুলো নিয়েই প্রতিনিয়ত খেলছিলাম।

আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে আমার ছোট চাচা বাড়ী থেকে চলে যাচ্ছেন। বাড়ীতে থাকলে তিনি নাকি এরেস্ট হয়ে যেতে পারেন।অবশ্য তাকে কে কোথা থেকে এসে তাকে এরেস্ট করবে তার কিছুই আমাদের নিকটে স্পষ্ট নয়। পুলিশও হতে পারে। আবার সেনাবাহিনীও হতে পারে। ছোট চাচাকে ঘিরে আমাদের পুরো বৃহত্তর পরিবারে শোকের মাতম লেগেছে। আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি ক্রুদ্ধ নয়নে আমার চাচার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বড় ফুপু হাউমাউ করে কাঁদছেন। যমুনা তীরের ‘গোবিন্দির চর’ তিনি এসেছেন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে। পুরো জনপদ কাঁপিয়ে। আমার অশিক্ষিত দাদা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সন্তানের দিকে। নিরুত্তর। যেন কিছুই বুঝছেন না তিনি।দাদী সুর করে কাঁদছেন। তার সন্তান কি করে সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই! তবে তিনি তার সন্তানকে নিয়ে এই বিপদসঙ্কুল মুহূর্তেও প্রবলভাবে গর্বিত। অদৃশ্য কারো দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কান্না আর গালি মিশ্রিত শব্দমালা সুর করে ছুড়ে মারছেন। আমরা সকল শিশু কিশোরেরা অবাক নয়নে এই সমস্ত বয়স্ক বিষয় সমুহ দেখছি আর গিলছি।আগামীকাল থেকে আমাদের সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে আমার চাচার এবং তার বন্ধুদের ‘দ্য গ্রেট এস্কেপ’!

ছয় মাস অথবা তারও পরে চাচা প্রত্যাবর্তন করলেন। সাথে পালিয়ে যাওয়া আরও দুইজন সহপাঠী। আমাদের বাড়ীতে আনন্দের জোয়ার বইছে। বাইবেলের সেই উড়নচণ্ডী নষ্ট সন্তানের গৃহে প্রত্যাবর্তনের মতন! পিতা তার অন্যান্য অনুগত সন্তানদের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে পালের সবচেয়ে সতেজ মেষটাকে জবাই করছেন। আমার দাদা দাদীর চোখে আনন্দাশ্রু। আমরা শিশুরাও আনন্দে উদ্বেলিত। আমাদের কাছে এখন গৃহ থেকে পলায়ন কোন অপরাধের পর্যায়ে পড়েনা!

চাচার কাছে গল্প শুনেছি যে, তারা নাকি রাতের বেলায় লোকালয় ছেড়ে যমুনা পাড়ের চরের বালিতে আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে আবৃত করে চাঁদের আলোতে শুয়ে থাকতেন। পুলিশ বা সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষুর বাইরে থাকার জন্যে। বিপ্লব নিয়ে এই চরম রোমান্টিকতার গল্পটি আমি তাৎক্ষনিকভাবে বিশ্বাস করেছি। এবং মনে মনে যমুনা পাড়ের বালির ভেতরে কত বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি!

পরবর্তী ঘটনা নিম্নরুপ। আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের মুখে টিকতে না পেরে শেষাবধি ২৫ মার্চ ১৯৬৯ তারিখে পাকিস্তানের ‘লৌহ মানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকরন। মাত্র কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুকে তারা মুক্ত করে দিতে বাধ্য হবে।

(ক্রমশ …)

৫,১৭৮ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।