সীমার!
আমার তখন সেই বয়স যখন মানুষ শুধুমাত্র দুই ধরনের হয় বলে আমি জানি। ছোট মানুষ বা বাচ্চা মানুষ এবং বড় মানুষ বা বয়স্ক মানুষ! এর বাইরে লিঙ্গভেদ ছাড়া মানুষের ভেতরে আর কোন ধরনের শ্রেণিভেদ হতে পারে সে সম্পর্কে আমার ভেতরে কোন ধরনের ধারনাই তখন জন্ম নেয়নি। কাজেই প্রকারভেদ অনুযায়ী আমি ছোট মানুষদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত।
আমার চাচা চান মাস্টার আমাদের বাড়ির পাশের ঝাড় কাটা বহুমুখী স্কুলের ফিজিক্যাল টিচার। প্রবল ধরনের সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী একজন মানুষ। তার নেতৃত্বে আমাদের স্কুল আন্তঃ স্কুল ফুটবল খেলায় ঢাকা ডিভিশনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে তিনি এবার স্কুলের নির্মাণাধীন নতুন বিল্ডিংএর জন্যে ফান্ড রেইজিংএর জন্যে তিনদিনের যাত্রা উৎসবের আয়োজন করছেন। টিকিট করে এই যাত্রা অনুষ্ঠান দেখতে হবে। অন্যান্য বছরে শীতের এই সময়ে ছাত্রদের অভিনীত নাটক অনুষ্ঠিত হয়। সারা এলাকার মানুষের জন্যে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা ছাড়া এই নাটকই বছরে একমাত্র আনন্দের উৎস। এখানে সফরুদ্দিন ভাই ভাঁড় হিশেবে হাসাতে হাসাতে সবার পিঠে খিল তুলে দেন। তবে এবছরের আয়োজনটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবেই। কি নামের একটা অপেরা হাউজ এবারের যাত্রার অনুষ্ঠান করবে।
এক পক্ষকাল আগেই যাত্রাদলের পক্ষ থেকে একটা অগ্রগামী দল এসে পৌঁছেছে আমাদের স্কুলে। এসবেসট এর দেয়াল এবং ছাদ দেয়া স্কুল-মসজিদের পাশে অবস্থিত অষ্টম শ্রেণীর বি সেকশনের রুমকে খালি করে এই অগ্রগামী দলকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বসবাস করার জন্যে। সেলিম নামের এক যুবক এই অগ্রগামী দলের প্রধান।কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে যখন আমি আমার দাদার সাথে মসজিদে ফজরের নামাজ শেষ করে দৌড় দিয়ে বাড়ীতে ফিরব ভাবছি, সে সময়েই মসজিদের পাশের ইন্দিরার (ইদারা) পেছন থেকে একজন ডেকে বসলো আমাকে, “এই খোকা, নাম কি তোমার?” আমি অবাক বিস্ময়ে পিছনে ফিরে দেখি অনিন্দ সুন্দর এক যুবক আমাকে ইশারা করছে আমাকে কাছে জেতে। সকালের নরম আলোতে তাকে নবাব সিরাজুদ্দউলার মতন লাগছে। আমি তাকে চিনি এবং তার নাম জানি কারন আগের রাতে চান চাচা তার সাথে বসে কিভাবে যাত্রা অনুষ্ঠানের প্রচারকার্য সম্পাদন করা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করে গেছেন। আমি এশার নামাজের পর ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখেছি। আমার পরিচয় দিতেই আমাকে সস্নেহে কাছে টেনে নিলেন। আমি মুগ্ধ। যাত্রার নায়ক হিশেবে আমার তাকে খুবই পছন্দ হয়েছে। দেখতে নায়ক বুলবুল আহমদের মতন। বড্ড বেশি ধরনের ভদ্র চেহারা। একটু পরেই তিন জনের এই দলটি সাইকেলের ওপরে মাইকের একটা হর্ন লাগিয়ে আমাদের গ্রামের বাঁশ ঝাড়ের নীচের রাস্তা দিয়ে প্রথমে আমাদের ফকির বাড়ি, তারপর সরকার বাড়ি, মণ্ডল বাড়ি, ব্যাপারী বাড়ী এবং সবশেষে তালুকদার বাড়ীর পাশ দিয়ে বিনোদটঙ্গী বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অগ্রসর হতে লাগলো। শামিম ভাইয়ের মুখে বিউগলের মতন একটা যন্ত্র। এই যন্ত্রের সুরের অনুরণনে পুরো গ্রাম মুখরিত। আমার সাথে দল বেঁধেছে গ্রামের সকল শিশু কিশোরেরা। আমরা সবাই হ্যামিলনের বংশীবাদকের পিছনে ছোটা ইদুরদের মতন তার বিউগলের সুরে সম্মোহিত হয়ে তার পিছনে পিছনে ছুটছি। মাঝে মধ্যেই কোন ফাঁকা জায়গা পেলেই সাইকেল থামিয়ে মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে,“ভাইসব, আসন্ন ২০ ডিসেম্বর তারিখে ঝাড়কাটা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পর পর তিন রাত ঢাকা থেকে আগমনকারী যাত্রাদলের নাটক এবং বিচিত্রা অনুষ্ঠান হবে। টিকেটের হার…!” শিশুদের ভেতরে আমিই সবচেয়ে বেশি গর্বিত, কারন একমাত্র আমিই এই বিখ্যাত যাত্রাদলের নায়কের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত, যিনি রাঁধার শ্রীকৃষ্ণের মতন একজন বংশীবাদকও বটে! আমি খেয়াল করেছি শামিম ভাই যখন ঢোলের সাথে সাথে তার বিউগলরুপী বাঁশি বাজিয়ে গ্রাম অতিক্রম করেন, তখন শুধুমাত্র কিশোরী বা যুবতীদের নয়, গৃহবধূদেরকেউ আমি দেখেছি ঘোমটা বা প্রাচীরের আড়াল থেকে অনিমেশ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে।প্রতিদিন সকালে শুরু হয় এই আনন্দ যাত্রা, একেক দিন একেক দিকে। উত্তর, দক্ষিন, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, নৈঋত, বায়ু কোন দিকই বাদ থাকেনা। এই আনন্দমেলা শেষ হয় প্রতিদিন সকাল নয়টার দিকে। দশটা থেকে আমাদের সবার স্কুলের ক্লাস শুরু। রেডি হবার জন্যে এই এক ঘণ্টাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট।
যাত্রা অনুষ্ঠিত হবার একদিন আগে যাত্রার নায়িকা ‘উর্বশী’ এসে হাজির। গরুর গাড়ীতে করে তাকে আনা হয়েছে। এবং তাকে থাকতে দেয়া হয়েছে স্কুলের সাইন্স ল্যাব এর ভেতরে বিশাল চৌকি লাগিয়ে। স্কুলের ভেতরে এটাই সবচেয়ে ভাল রুম, এমনকি প্রধান শিক্ষকের অফিসের চেয়েও।সকাল বেলায় আনন্দময় অভিযাত্রায় শরীক হবার জন্যে আমি বাড়ী থেকে বেরুতেই আমি অবাক। স্কুলের পাশের পুকুরে ‘উর্বশী’ তার সকালের দন্তমাজন এবং হাতমুখ ধোয়ার কাজ করছে আর পুকুরের পাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সহস্র মানুষ উৎসুক এবং মুগ্ধ নয়নে তার এই কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। চান মাস্টারের স্ত্রী মেয়েদের এই বেপর্দা কাজকর্ম একেবারেই পছন্দ করেননা। যাত্রা দলকে আনার কারনে ইতিমধ্যেই স্বামীর সাথে তার কয়েক দফা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। তিনি আমার এক চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে আমাকে খবর পাঠালেন ঐ মহিলাকে আমাদের অন্দর বাড়ীর কুয়ার কাছে নিয়ে আসতে। এখন সমস্যা হল কে বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে? আমি তাড়াতাড়ি যেয়ে শামিম ভাইকে বলতেই তিনি দৌড়ে যেয়ে তাকে আমাদের বাড়ীর ভেতরে নিয়ে এলেন। পথে শামিম ভাইয়ের সাথে নায়িকার আচরন দেখে আমি অবাক। ঠিক মনিবের সাথে চাকরের যে সম্পর্ক যা হয়। বিনাকারনেই শামিম ভাই তাকে তোষামোদ করে কথা বলছেন।
আজ সন্ধ্যের পরেই প্রথম রাতের যাত্রা শুরু হবে। সন্ধ্যার পর থেকে আমি চটে ঘেরা গ্রিন রুমের পাশে ঘুর ঘুর করছি। শুধুমাত্র দেখার জন্যে যে রাজপুত্রের সাজে শামিম ভাইকে কেমন লাগে। সবাইকে সাজতে দেখি কিন্তু শামিম ভাই সাজেন না। এক অহংকারী লোককে দেখি রাজপুত্রের পোশাক পরে আছে। অবশেষে ‘সালাম সালাম, হাজার সালাম…’ গানের নৃত্তের মধ্যদিয়ে কয়েকজন রুগ্ন কিশোরীর যৌথ নাচের ভেতর দিয়ে যাত্রা শুরু হল। নবাবী আমলের কাহিনী। ষ্টেজের ওপরে উঠেও নায়িকার দাপট শেষ হয়নি। অযথা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। নাটকের দুই অংক শেষ হবার পর শামিম ভাই আমার কাছে এলেন। এতক্ষন তিনি গ্রিনরুমের প্রহরীর কাজ করছিলেন। বললেন, “নাটকের এই অংশে আমার কিছু পাঠ আছে। আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে স্টেজে!” আমি অবাক এবং ভীষণ রকমের ভয় পেয়ে গেলাম। আবারও বললেন, “তোমাকে কোলে করে আমি স্টেজে উঠবো এবং নেমে আসব। তোমাকে কিছুই করতে হবেনা!” এই বলে তিনি আমাকে হনহন করে টেনে নিয়ে গ্রিনরুমের ভেতরে ঢুকলেন এবং আমার মুখে পাউডার অথবা ময়দা মাখিয়ে মেকাপ করিয়ে দিলেন। নিজে পরেছেন একটা কিম্ভূতকিমাকার পোশাক। নাটক পুনরায় শুরু হবার মাত্র ৫ মিনিট পরেই তিনি আমাকে কোলে নিয়ে স্টেজে উঠে গেলেন এবং ‘জো হুকুম মহারাজ’ বলে আমাকে কলে নিয়েই পুনরায় প্রত্যাবর্তন করলেন স্টেজের পেছনে। আমি তাড়াতাড়ি করে জগের পানি দিয়ে আমার মুখ ধুয়ে ফেললাম এবং দৌড়ে গিয়ে স্টেজের সামনে গিয়ে বসলাম। নাটকের ক্লাইমেক্স চলে আসবে যে কোন মুহূর্তেই। আমাকে আমার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুরা কেউই চিনতে পারেনি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে শামিম ভাই আবার স্টেজের ওপরে চলে এসেছেন! এবার তার হাতে একটা থালা এবং হাতে রক্তাক্ত তরবারি। থালার ওপরে একটা শিশুর কর্তিত মুণ্ড। এখনো রক্ত ঝরছে সেটা থেকে। মাটি দিয়ে তৈরি, কিন্তু অবিকল দেখতে আমার মেকাপ করা মুখের মতন!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৯ নভেম্বর ২০১৫
বস লেখা। :boss:
ভাই, তারপর?
"আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"
খুব ভালো লাগলো। বিশেষ করে শেষের ক্ল্যাইমেক্সটি।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
ধন্যবাদ
হঠাৎ, নিজের কাঁটা মুন্ডু দেখার অভিজ্ঞতা!!!
বড়ই তাজ্জব ব্যাপার.........
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
্ধন্যবাদ
দারুন লাগলো।
ব্যপক নাটকীয়।
কি ভয়ঙ্কর কথা! সুপার ক্লাইম্যাক্স!
স্যার, অনেক ধন্যবাদ
ভাবতেছি এই লেখা মিস হইলো ক্যামনে!!!
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ