টিকটিকি
ছোটবেলা থেকেই কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের হওয়ার কারনে আমার বন্ধু-বান্ধব তেমন কেউ ছিলোনা। আমার ভাইবোনেরাও আমাকে খুব একটা পাত্তা দিতোনা। অবশ্য এই একাকীত্ব বা ভাইবোনের পাত্তা না দেবার বিষয়টি কখনই আমার মনোকষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং আমি খুশিই হতাম একারনে যে কেউ আমাকে ডিস্টার্ব করছেনা!
আমার সখ্যতা ছিল ঘরের দেয়ালের কয়েকটা টিকটিকির সাথে। মানুষের সাথে অনাদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে এই প্রাণীটি, অথচ মানুষের কোন উপকার বা অপকার কোনটাই করতে পারেনা সে। শুধুমাত্র মানুষের মনের ভেতরে যখন কোন ভাব জেগে সে কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় এবং মানুষের ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে বলে ওঠে ‘টিক টিক টিক’! টিকটিকিদের এই দার্শনিক মতামত ‘ঠিক ঠিক ঠিক’ এরই যে কি মুল্য তা মানুষেরা আজো বুঝে উঠতে পারেনি। অনেকটা হোমিওপ্যাথিক বা কবিরাজি ওষুধের মতন। লেগে গেলে ধন্তধরির মতন কার্যকরী হবে আর না লাগলে আপনার ঘুনাক্ষুরেও মনে হবে না যে টিকটিকিটা আপনাকে একটা এডভাইস দিয়েছিলো।শুধু মাত্র আমি বড় হবার পরেই জেনেছি যে টিকটিকিরা মানুষের পেছনে লাগে এবং তারা মানুষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতেও সক্ষম!
তবে ছোটবেলায় আমি টিকটিকির পেছনে লাগতাম এবং বহু সাধনার পর তাদের ফেলে যাওয়া লেজের মালিক হবার যোগ্যতাও অর্জন করেছিলাম। ফেলে যাওয়া লেজটাকে হাতের মুঠোতে নিয়ে আমি অনুভব করতাম ‘দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরন’!
১৯৯৩ সন। কম্বোডিয়াতে সামরিক পর্যবেক্ষক হিশেবে গিয়েছি। আমার বদলী হয়েছে কম্বোডিয়ার সর্ব উত্তরের প্রদেশ ‘স্তুন ত্রাইন ’-এ (Stung Teng)। একেবারে লাউসের বর্ডারের পাশে। এই প্রদেশে আমি ছাড়া আর কোন বাঙালীর পদধূলি ইতিপূর্বে পরেনি! আমার টীম লিডার অস্ট্রিয়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার সিন্তলার। ২০ বছরের অভিজ্ঞতা তার জাতিসংঘ মিশনের। প্যালেস্টাইন, সিনাই উপতক্যা, কাশ্মীর সীমান্ত সব জায়গায় মিশন কমপ্লিট করে তিনি এখন দক্ষিন এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এসেছেন।আমার সাথে প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে এক পক্ষ হিশেবে দাঁড় করিয়ে দৃষ্টান্ত হিশেবে দেখিয়ে দিলেন যে, একজন পাকিস্তানি ও একজন ভারতীয় যখন পরস্পরের সাথে করমর্দন করে তখন তাদের উভয়ের মুখভঙ্গি কেমন থাকে? আমি মুগ্ধ। আমার সাথে পর্যবেক্ষক হিশাবে আরও আছে আয়ারল্যান্ডের মেজর দিয়ারমুইদ, ফ্রান্সের মেজর বারত্রান্দ, ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন মাইক এবং চায়নিজ ক্যাপ্টেন শি। আর আছে আমাদের কম্বোডিয়ান দোভাষী নারা। আমি প্রথম থেকেই ভেবে নিয়েছি যে এদের সাথে আমার মিলবেনা এবং আমাকে ছোটবেলার মতন টিকটিকিদের সাথে খেলাধুলা করেই বছরটা অতিক্রম করতে হবে।
মাত্র কয়েকদিন হল আমরা এখানে মেকং নদীর পাড়ে বসতি স্থাপন করেছি। এই প্রথম আমি দেখলাম যে মানুষও টিকটিকির পেছনে লাগে! আমাদের তিন ক্যাপ্টেনের আনন্দময় সুখী জীবন আমাদের টীম ক্যাপ্টেনের সুখ কেড়ে নিল। তিনি আদেশ দিলেন আমাদের প্রতিজনকে একরাত একরাত করে ডিউটি অফিসার হিশেবে কাজ করতে হবে। এ সময়ে আমরা রাতের প্রতি প্রহরে কি কি ঘটছে তা একটা লগবুকে লিখে রাখবো এবং তিনি সকালে উঠে তা দেখবেন। প্রথম রাতেই আমার ডিউটি। কাঠের টঙের ওপরে আমাদের বাসস্থান। একজন হাঁটলেই সেই হাঁটার শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে পৌঁছে যায় কাঠের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা প্রতিটি কক্ষে। রাত বারটার দিকে ক্যাপ্টেন মাইক আর ক্যাপ্টেন শি এসে হাজির আমার রুমে। জিজ্ঞেস করল, “ কি করছ?” আমি বললাম, “টিকটিকি শিকার করছি!” দুজনেই ভীষণ অবাক। বলল, “আমরাও অংশগ্রহন করতে চাই”! আমি সানন্দে রাজী। তিনজনে মিলে দেয়ালের গায়ে এঁটে থাকা টিকটিকিগুলোর পিছনে লাগলাম আমরা। রাত যত বাড়ছে আনন্দিত হয়ে উঠছে আমাদের বাড়ীর ধারের মেকং নদীর পানি! রাত চারটে অবধি চেষ্টা করে আমরা একটা টিকটিকির লেজ ধরতে সক্ষম হলাম! ক্যাপ্টেন মাইক আনন্দিতভাবে আমার পক্ষ হয়ে লগবইতে লিখল, “ এট ফোর ও ক্লক, ওয়ান লিজারড উয়াজ রেস্কিউড!” আমি আর ক্যাপ্টেন শি টিকটিকির ইংরেজি নাম জানিনা। ক্যাপ্টেন মাইক জীবনে এই প্রথম টিকটিকি দেখেছে!
পরের দিন সকাল আট টায় টীম লিডার আমাদের তিনজনকেই একসাথে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, “কাল সারারাত তোমরা তিনজনে কি করেছো? শব্দে আমাদের কারুরই ঘুম হয়নি”। ক্যাপ্টেন মাইক লগবইটা কর্নেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। কর্নেল একনজর দেখে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর স্নেহার্ত কণ্ঠে আমাদেরকে বললেন, “ আজ থেকে তোমাদের রাতের বেলায় আর ডিউটি অফিসার হিশেবে দায়িত্ব পালন করার দরকার নেই!” হয়ত বা তার স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল অস্ট্রিয়াতে তার সন্তানদের মুখ, যাদেরকে তিনি গত কয়েক বছরে একবারও দেখতে যাননি!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫
শেষটায় এসে বিষন্ন এক ভালোলাগা তৈরী হলো। ভাল লেগেছে। 🙂
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
মোকার সাথে একমত! 🙂
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
হ, জুনাদার মতৈক্যের সাথে একমত 🙂
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
দারুন লাগলো স্যার :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
😀 😛 😀 😛
একই সাথে মজার এবং অদ্ভুত!!!
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আসাদ ভাই,
আপনার রসবোধ অসাধারণ। খুবই ভালো লাগলো। খুবই।
Thanks a lot
উপুরঝুপুর মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম, ভাইয়া :clap: :clap: :clap: :clap:
ভালো লাগলো, আসাদ ভাই। আমার কিছু ছোট বেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো আপনার লেখা ... :boss:
মোকাব্বির, জুনায়েদ আর ইশহাদের সাথে একমত ... শেষ লাইনের বিষন্নতা নিয়ে।
নিজে কানা পথ চেনে না
পরকে ডাকে বার বার
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ পছন্দ করার জন্যে
অনেক অনেক লেখা চাই । ফেসবুকে যেসব দেখে ফেলেছি তাও চাই। অনেক ভালোলাগা।
বরাবরের মত খুব সুন্দর লেখা। পড়ে মুগ্ধ হ'লাম। গল্পের শেষের বিষন্নতাটুকু গল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
স্যার, অনেক ধন্যবাদ আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্যে