আমি নিজে বিখ্যাত মানুষ না হলেও অনেক বিখ্যাত মানুষদের সাথে আমার পরিচিতি ও সখ্যতা ছিল। কৈশোরকাল হতেই। এই সুযোগটা মূলত সৃষ্টি হয়েছিলো মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে আমার পড়াশুনা করার সুবাদে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল। ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে সবার একটা সাধারণ ধারণা যে সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর অভিভাবকদের সন্তানরা এখানে পড়াশুনা করে। বিষয়টার বর্তমান সত্যতা সম্পর্কে আমি খুব বেশি ওয়াকিবহাল নই। তবে আমাদের সময়ে, তৎপূর্বে, এমনকি আমাদের পরের অনেকটা সময় জুড়েও ধারণাটা সত্য ছিল না। ওই সময়কালে ক্যাডেট কলেজে গ্রামীণ মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানই পড়াশুনা করতো। শুধুমাত্র তাদের মেধা বা প্রতিভার জোরে! কাজেই কেউ যদি বলে ক্যাডেট কলেজ শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানদের শিক্ষালয়, তাহলে আমি বিষয়টিতে স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কারণে। আমি এটাও জানি যে, এই মেধাবী অথচ গরীব সন্তানেরা যদি ক্যাডেট কলেজে আসতে না পারতেন, তবে তাদের অনেকের প্রতিভার হয়তোবা সেখানেই সমাপ্তি ঘটতো। উদাহরন টেনে আমি বিষয়টিকে দির্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। অনেক উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে আমাদের চোখের সামনেই।
কবি তালিম হোসেনের ভাই তউফিক হোসেন। আমাদের ক্যাডেট কলেজের আর্ট টিচার। আর্টের সমান্তরালে সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ এক ধাপ এগিয়ে। সুতরাং আর্ট ক্লাসের অর্ধেক সময় আমরা ছবি আঁকা শিখি। অর্ধেক সময়ে আমরা তার কাছ থেকে গল্প বা উপন্যাস থেকে শ্রুতিকথন শুনি। মূলত আমাদের চাহিদার কারণেই তিনি নিত্য নতুন গল্প বা উপন্যাস আমাদেরকে শোনান। আমরা তখন ক্লাস এইটে।
এই সময়ে তিনি আমাদের সামনে উন্মোচিত করলেন বাংলা সাহিত্যের ইউনিক উপন্যাস মনোজ বসু এর ‘নিশিকুটুম্ব’। চৌর্যবিদ্যাও যে উপন্যাসের বিষয় হতে পারে বাংলা সাহিত্যে প্রথম নজির হল তার সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘নিশিকুটুম্ব’। এই উপন্যাস ১৯৬৬ সালে ভারতের সর্বাপেক্ষা সম্মানজনক আকাদেমি পুরস্কার অর্জন করে। ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাস এ দেশের সুন্দরবনসংলগ্ন বৃহত্তর যশোর ও খুলনা জেলার এলাকার নদী-নালায় ঘেরা সেকালের জনপদে নিশিকুটুম্বদের চুরির নানান কৌশল অবলম্বনের কাহিনী। অসাধারণ ভাষায় লেখক উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
অপূর্ব কথক আমাদের তউফিক স্যার। উপন্যাসের একটা করে চ্যাপ্টার তিনি আগের রাতে পড়েন। পরের দিন তার মনের সমস্ত মাধুরী মিশিয়ে আমাদেরকে ক্লাসে শোনান।আমরাও মনে মনে হয়ে উঠি এক এক জন ‘নিশিকুটুম্ব’। বাংলার গ্রাম, প্রান্তর, নদী-নালার মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ বড় হতে থাকি। ক্যাডেট কলেজের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থেকেও!
আমাদের অন্য আর্ট টিচার মুস্তফা আজিজ। হিউম্যান পোর্টরেট আঁকায় তার চেয়ে দক্ষ শিল্পী বাংলাদেশে অধ্যাবধি কেউ ছিলেন বা আছেন বলে আমি মনে করি না। মুস্তফা আজিজ স্যার চলে গেলেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে। বদলি হয়ে। সুজা হায়দার স্যার আমাদের অন্য আর্ট শিক্ষক হয়ে এসেছেন। তিনি আমাদেরকে মায়া সভ্যতা, ছবি আঁকায় পারস্পেক্তিভ কি, রঙের বৃত্ত, বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরের ক্যালিগ্রাফি সব কিছুই শিখাচ্ছেন।
কাজেই তৌফিক স্যারের আপাতত বেশি করনীয় নেই। তাকে আমরা ক্লাসমেটরা সবাই মিলে অনুরোধ করলাম তিনি যেন আমাদের জন্যে একটা নাটক রচনা করেন। এই নাটকে আমরা সবাই অভিনয় করবো। যাতে আমরা সবাই আমাদের অভিনয় ক্ষমতা বিকশিত করতে পারি। তৌফিক স্যার আমাদেরকে নিরাশ করেননি। তিনি কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন’কে একটা চমৎকার নাটিকার রুপ দিলেন। আমাদের সবার ভেতরে তিনি তার সৃষ্ট চরিত্র গুলোকে ভাগ বণ্টন করে দিলেন। আমার ভাগে পড়লো একটা আনুষঙ্গিক সন্ন্যাসীর চরিত্র। আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, এতসব চরিত্র থাকতে আমাকে বঙ্কিম চন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের পাষাণ কাপালিক চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে বলছেন কেন? স্যার, আমার দিকে মৃদু হেসে বললেন, “এই চরিত্রের মধ্যে একটা ভারিক্কী ভাব আছে। এর জন্যে একটু গুরু গম্ভীর ধরনের কণ্ঠস্বর প্রয়োজন। ক্লাসের সবার মধ্যে আমি খেয়াল করেছি তোমার কণ্ঠস্বরের মধ্যেই পারসোনালিটি বেশি। তাই তোমাকে এই চরিত্রের জন্য সিলেক্ট করেছি!” আমি ভীষণ খুশী।
আমার যতদূর খেয়াল আছে বাবলা বা শাহরিয়ারকে ‘রাইচরন’ এর ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়েছিল। ‘খোকাবাবু’র বাবার ভুমিকায় মনজুর আলম অথবা সোহেল জামানকে! খোকাবাবুর মায়ের ভুমিকায় অভিনয় করতে দেয়া হয়েছিল সাইফুল হককে! চেহারা ফর্সা আর সুন্দর বলে!
সমস্যাটা শুরু হল ছোট খোকাবাবুর ভুমিকায় কে অভিনয় করবে? আমাদের ক্লাসের ভেতরে আকৃতিতে মামুন সবচেয়ে ছোট! কিন্তু সে এতোটা ছোট নয় যে, তাকে দিয়ে শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করানো যায়! কিছুদিন আগে আমি আর ওয়াহিদ কলেজের ‘নেক-টাই’ এর ডিজাইন করার জন্যে তৌফিক স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। তৌফিক স্যারের একমাত্র সন্তান! ৪/৫ বছর বয়স হবে। স্যার ঘুমন্ত ছেলের কয়েকটা পোট্রেট করেছেন পেন্সিলে। অপূর্ব সুন্দর। আমরা সবাই সমস্বরে বললাম, “ স্যার, আপনার ছেলেকে খোকাবাবুর ভূমিকায় সবচেয়ে চমৎকার মানাবে!” স্যার, কিছুটা দ্বিধা করলেও আমাদের সবার সনির্বন্ধ অনুরোধে তার ছেলেকে দিয়ে ‘খোকাবাবু’র ভুমিকায় অভিনয় করাতে রাজি হলেন। শুরু হল আমাদের অনুশীলন।
কি একটা কারণে ঐ টার্মে আমাদের পক্ষে নাটকটা মঞ্চস্থ করা সম্ভব হলনা। সিদ্ধান্ত হল পরের টার্মের প্রথম দিকেই নাটকটা মঞ্চস্থ করা হবে। আমরা সবাই চলে গেলাম টার্ম শেষের ছুটিতে। ছুটি থেকে ফেরত আসার পর কলেজের সবার মন বিষণ্ণ! তৌফিক স্যারের ছেলে সামান্য জ্বরে মারা গেছে। কোন স্নেহ -ভালোবাসাই তাকে নিয়তির নির্ধারিত পথ থেকে ফেরত আনতে পারেনি। আমরাও আর কোনদিন আমাদের সেই নাটকের কথা পুনর্বার উচ্চারন করিনি। তৌফিক স্যারের কাছ থেকে আমাদের ‘নিশিকুটুম্ব’ এর পরের সিরিজগুলোও আর আমাদের কোনোদিন শোনা হয়ে ওঠেনি!
১৯৮৩ সালে ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছি। আমার বন্ধু এবং সতীর্থরা বিদ্যা শিক্ষার জন্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে। এদের অনেকের সংগে আমার কখনোই দেখা হয়নি। অনেক স্যারদের সাথেও। জীবন এমনই নিষ্ঠুর!
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সপরিবারে ভারতে বেড়াতে গিয়েছি। কলকাতার এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের লাঞ্চ করছি। ট্রেনে করে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। লাঞ্চের সময়ে পাশের টেবিলে তৌফিক স্যারের সাথে দেখা। স্যার, সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক যুবককে নিয়ে লাঞ্চ করছেন। আমাকে যুবকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমার ছেলে। ওর চোখে সামান্য একটু অসুবিধা আছে, তাই এখানকার ‘শঙ্কর নেত্রালয়’–এ দেখাতে নিয়ে এসেছি!”
কিছুক্ষণ কথা বলার পর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন স্যার। সন্তানের হাত ধরে রাস্তা অতিক্রম করে। দুজন অসম বয়সী মানুষ পরস্পরকে ভর করে রাস্তা ক্রস করছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম না! বারবার খের আলো নিভে যাওয়া মানুষের জন্যে সবচেয়ে কষ্টের!
তউফিক স্যারের সাথে আমার আর কখনোই দেখা হয়নি। অথচ আমার বাসস্থান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে গাজীপুরে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় তিনি থাকতেন! জীবনের ব্যস্ততায় আমার কখনোই দেখতে যাওয়া হয়নি। আজ কিছুক্ষণ পূর্বে বজলুর রশিদ স্যারের ফেসবুকে ট্যাগ করা একটা পোস্টে দেখলাম গত ১৪ জুলাই ২০১৭ তারিখে তউফিক স্যার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। যেমন করে সবাই যায়!