ভ্রমণ
আমার বয়স তখন ১৪ অথবা ১৫ বছর। নবম শ্রেণীতে পড়ি। মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজের নজরুল হাউজের রিক্রিয়েশন রুমের পার্শ্ববর্তী কক্ষে স্থাপিত পিংপং খেলার টেবিল। মাঝখান থেকে জালটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে।এই টেবিলের ওপরেই আমি আন্তঃহাউজ দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্যে আমাদের হাউজের বাংলা দেয়াল পত্রিকা লিখছি। আমাদের অর্থাৎ নজরুল হাউজের এই পত্রিকার নাম ‘তরঙ্গ’! পাশেই হাউজ মাস্টারের কক্ষে অথবা ১১ নম্বর রুমে ১৪ তম ব্যাচের রফিক ভাই লিখছেন ইংরেজি দেয়াল পত্রিকা। নাম ‘WAVE”। আগে এই দুটো দায়িত্বই পালন করতেন মাহফুজ ভাই। রেখার আঁচড় দিয়ে এক টানে শিল্পী জয়নুল আবেদিনের আঁকা প্রতিটি ছবিই এঁকে ফেলতে পারেন। এমনকি তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সেই বিখ্যাত ছবিও। ইংরেজি দেয়াল পত্রিকার কেন্দ্রস্থলে তার আঁকা ‘ODYSSEY’তে বর্ণিত আগামেমননের জাহাজের ওপরে যখন ঢেউয়ের চূড়া আছড়ে পড়ে কিংবা বাংলা দেয়াল পত্রিকার চারপাশ দিয়ে জামদানি শাড়ীর পাড় নদীর মতন বয়ে যায়, তখন তুখোড় লেখা দিয়েও ‘সোহরাওয়ার্দি হাউজ’ অথবা ‘ফজলুল হক হাউজ’ বছরের পর বছর আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেড়ে ওঠেনা। মাহফুজ ভাই কলেজ থেকে চলে যাবার পর এই গুরু দায়িত্ব হাউজ মাস্টার রফিক ভাইকে আর আমাকে দিয়েছিলেন। রফিক ভাই ইংরেজি পত্রিকার আর আমি বাংলা পত্রিকার।
রফিক ভাইয়ের হাতের লেখা ছাপার অক্ষরের মতন। ইংরেজি, বাংলা দুটোই। পার্থক্য শুধু ছাপার অক্ষরের ভেতরে প্রাণ থাকেনা। রফিক ভাইয়ের হাতের লেখা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। মনে হয় এক্ষুনি গান গাইতে শুরু করবে! আমার হাতের লেখাও ভাল। ক্রমোজমগত বৈশিষ্ট্য এর বাহক। আমার নানার হস্তলিপি খুব সুন্দর ছিল। ছোটবেলায় আমার মা-খালাদের এ বিষয়ে গর্ব করতে শুনেছি। আমার দাদা অশিক্ষিত ছিলেন। তিনি ক্লাস টু’তে পড়ার সময়ে মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে উপমহাদেশে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ হয়েছিল। এই আন্দোলনের সময়েই তিনি ক্লাস বর্জন করেছিলেন চিরদিনের মতন। আর কোনোদিন তিনি কোন বিদ্যালয়ে বা পাঠশালায় প্রত্যাবর্তন করেননি। উনার এই ভাষ্য সত্য বলে গ্রহন করলে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কনিষ্ঠতম সংগ্রামী ছিলেন তিনি। তবে তার ছেলেদের হাতের লেখা প্রকৃতপক্ষেই সুন্দর ছিল। সম্ভতবত পিতৃকুল এবং মাতৃকুল-দুই কুলেরই একনিষ্ঠ উত্তরাধিকার ছিলাম আমি।
ঘটনাটা যদিও এখন থেকে ৩৫/৩৬ বছর আগের কথা তবুও আমার স্পষ্ট খেয়াল আছে। আমি আমার বন্ধু সাহেলের লেখা স্মৃতিচারণ মূলক একটা রচনা দেয়াল পত্রিকার ওপরে আপেল বা কমলা আকৃতির সীমিত পরিসরের মধ্যে লিপিবদ্ধ করছি। পিঁপড়ার চেয়ে বড় বড় অক্ষরে। সাহেল পাশ থেকে আমাকে ডিক্টেশন দিচ্ছে। সাহেল ছোটবেলায় তার পরিবারের সাথে শ্রীমঙ্গলে বসবাস করত। বাবা সম্ভবত সেখানকার কোন চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কিশোরগঞ্জ এলাকায় নিজ বাড়িতে স্থিত হয়েছিলেন। কেন্দুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিশেবে আমৃত্যু! আমার ধারনা চা বাগানের ম্যানেজারগণের অব্যহহিত পরের নিয়োগ হওয়া উচিত প্রাইমারি অথবা হাইস্কুলের শিক্ষক হিশেবে! কারণ চা বাগানের নান্দনিক নির্জনতার ভেতরে একজন ব্যক্তির মানসিক ও মানবিক বিকাশ ঘটতে পারে, তা অন্য কোন জনাকীর্ণ বা অস্থির জনপদে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। সাহেলের পিতা আমার জানামতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকগণের অন্যতম ছিলেন।
সাহেলের লেখার ভেতরে চা বাগানের একটা অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। উঁচু নিচু সবুজ টিলা। এর ঢালুতে নতুন কুঁড়িযুক্ত পাতা নিয়ে চা গাছের সারি। বিস্তীর্ণ সবুজ চায়ের প্রান্তর। এই প্রান্তরের মাঝ দিয়ে কুলু কুলু ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া ছরা বা ঝর্ণা। বাগানের ভেতরে কিছু দূর পর পর মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে রেইন ট্রি কড়াই গাছগুলো। এধরনের বর্ণনাই ছিল সাহেলের সেই লেখার ভেতরে। তবে তার বর্ণনা আমার এই বর্ণনার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। চোখে মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দিয়ে আপনার মনকে অভিভূত করে ফেলবে। আমি এত যুগ পরেও তার বর্ণনার সে প্রান্তরটি মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলতে পারি! যদিও আমি কখনই শ্রীমঙ্গলে যাইনি।
কাজেই ঈদের দিন যখন আমার স্ত্রী আর দুই মেয়ে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার কথা বলল, ঠিক তক্ষুনি আমার চোখের সামনে সাহেলের বর্ণনার শ্রীমঙ্গল ভেসে উঠল। আমি তাৎক্ষণিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম দুইদিনের সফরে শ্রীমঙ্গলে যাবার।
ঈদের পরদিন আমরা সকাল এগারোটার দিকে শ্রীমঙ্গলে পৌঁছলাম। বৃষ্টির ভেতরে নিরাভরণ প্রকৃতিকে দেখে আমরা সবাই উচ্ছ্বসিত। আমি আমার স্ত্রীকে জানালাম সাহেল ছোটবেলায় শ্রীমঙ্গলে ছিল। আমার স্ত্রী বলে উঠলো, “একারনেই সাহেল ভাই কবি ছিলেন!”
সাহেলের চোখ দিয়ে আমরা ফিনলে চা বাগান, মাধবপুর লেইক, লাওয়াছরা অভয়ারণ্য, সাতগাঁও রাবার বাগান, মনিপুরী পাড়া বেড়াতে বেড়াতে মন্ত্রমুগ্ধতা নিয়ে রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলাম!
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬
শ্রীমঙ্গল এর সৌন্দর্য কোনদিন ভলার নয়। নভেম্বর এর দিকে আলাদা মাত্রা পায়। কুয়াশা আর গাছের ফাকে সূর্যের কখনও দেখা কখনও না দেখা সে এক অসাধারণ দৃশ। কোন দিন গুলার নয়।
পার্থক্য শুধু ছাপার অক্ষরের ভেতরে প্রাণ থাকেনা। রফিক ভাইয়ের হাতের লেখা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর - চমৎকার কথা!
আমার ধারনা চা বাগানের ম্যানেজারগণের অব্যহহিত পরের নিয়োগ হওয়া উচিত প্রাইমারি অথবা হাইস্কুলের শিক্ষক হিশেবে! কারণ চা বাগানের নান্দনিক নির্জনতার ভেতরে একজন ব্যক্তির মানসিক ও মানবিক বিকাশ ঘটতে পারে, তা অন্য কোন জনাকীর্ণ বা অস্থির জনপদে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। - প্রশংসনীয় পর্যবেক্ষণ!
আমি এত যুগ পরেও তার বর্ণনার সে প্রান্তরটি মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলতে পারি! যদিও আমি কখনই শ্রীমঙ্গলে যাইনি- হৃদয়বান লেখকের চোখ বলে কথা!
“একারনেই সাহেল ভাই কবি ছিলেন!” - ভাবীর উপলব্ধ কারণটা যথার্থ ছিল হয়তোবা।
সুন্দর ছিমছাম গল্প, নান্দনিক্তায় অলংকৃত।
তোমার প্রোফাইল ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে।