দাগ

১।
লোকটা মুচী না হয়ে, কোনো মাসাজ পার্লারেও কাজ করতে পারতেন! এমন সুনিপুণ হাতে জুতার উপর ব্রাশ ঘষছেন যে, আরামে জুতা যখন তখনই ঘুমিয়ে যেতে পারে। মুচী জনার্দন হলের কাছের ক্যাম্পাসের এ পাশটায় বেশ পরিচিত মুখ। তার হাতে পালিশ করা জুতা পরে, কত পদযুগলের মালিক আজ সমাজে উঁচু পদে অসিন হয়েছেন!
আজও যেমন একজনের ইন্টার্ভিউ। তার কাছেই জুতা পালিশ করাচ্ছে।
জনার্দনের বুট পালিশের সুগন্ধে একটা মাছি সেই তখন থেকেই পেরেক ঠোকার হাতুড়িটার উপর বসার চেষ্টা করছে।

২।
আদারুর আজ দিন ভালো। ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙ্গেছে। তাই, ঠিক সময়ে পত্রিকার চালানটাও আনতে পেরেছে। সাধারণত তার ঘুমটা বেশ বেলা করেই ভাঙ্গে। পত্রিকার চালান আনতে গেলে প্রায়ই মালিকের কাছে বকা শুনতে হয় তাকে।
যদিও সকালবেলার ট্রেনগুলো সব তাদের বস্তি কাঁপিয়ে চলে। তবে, সেসব ট্রেনের আওয়াজও ব্যর্থ হয়ে যায় আদারুর নিদারুণ ঘুম ভাঙ্গাতে।
আজ অবশ্য এমনি এমনি ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার। সম্ভবত গতকালের উত্তেজনায়। কি মারামারিটাই না হলো ক্যাম্পাসে। নিজের চোখে দেখা। সে খবর যে আজ পত্রিকার হেডিং হবে তা সে কালই আন্দাজ করেছিলো।
তাই, সকাল সকাল উঠে মালিকের কাছ থেকে একটু বেশি পত্রিকাই চেয়ে এনেছে। গ্যাঞ্জামে পত্রিকা ভালোই বিক্রি হয়। পত্রিকা বেচতে বেচতে সরাসরি মারামারি দেখার উত্তেজনাই অন্যরকম। ক্যাম্পাসের ফুটপাথ ধরে তাই সকাল থেকেই তার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে – গরম খবর …গরম খবর ..ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র।

৩।
`এক শালারপুতরেও ছাড়বি না ! পোলা মাইয়া নাই কোনো, সব কয়টারে পিটা। কালকের মাইরে পেট ভরে নাই! আবার আসছে! নিমক হারাম্যার দল। টেংরি ভাং …সবগুলার …আসতেছি …’
ফোনে কোথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত ভাবে বের হয় শাফিন। গতকালের ধোলাইয়ে কাজ হয়নি । আবার বেশকিছু ছেলেপিলে নাকি জড়ো হয়েছে শাহবাগের মোড়ে। এতো এতো ভালো কাজ করে যাচ্ছে সরকার, সেগুলায় নাম নেই, শুধু গ্যাঞ্জাম পাকানোয় ওস্তাদ। আজ আর একটাকেও রেহাই দেয়া হবে না ।
কথা বলতে বলতেই জনার্দন মুচির হাতুড়িটা নিয়ে নেয় সে। তারপর হাঁটতে থাকে জোর কদমে।

হলের চিকন রাস্তা ছেড়ে ক্যাম্পাসের মেইন রোড। ভিসির বাসার সামনে থেকে একটা চলন্ত খালি রিকশায় লাফ দিয়ে উঠে পরে সে। উত্তেজনায় খেয়াল করেনি রিকশাওয়ালা বেশ বয়স্ক।
হাতুড়িটাকে হাত বদল করে, তাড়া দেয়- ওই! তাড়াতাড়ি টানেন …
প্যান্টের পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে তার।
গুরুত্বপূর্ণ ফোন ভেবে বের করে দেখে- নাজিয়া কলিং…। কেটে দিয়ে ফোনটা আবার পকেটে ভরে।

আবার তাড়া দেয় – কি! কথা কানে যায় না! টানো মিয়াঁ ..
জবাবে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা পিছনে তাকিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করে। রিকশা এগুতে থাকে ধীর গতিতে।
শাফিন চট করে সিগারেট ধরায়। রিকশাওয়ালার প্যাডেল এর তালে প্রায়ই তার দাদা গেঞ্জিটা কোমরের কাছটায় ওঠা নামা করে। শাফিন সেটা খেয়াল করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই বলে- পারো না তো, এইসব ব্যাথা বুথা নিয়া রিকশা চালাইতে আসো ক্যান ??
রিকশাওয়ালা কোনো কথা না বলে প্যাডেল এর গতি বাড়িয়ে দেয়।
এমন সময় আদারু `ক্যাম্পাসে ছাত্র পুলিশের তুমুল সংঘর্ষ’বলতে বলতে পত্রিকা নিয়ে শাফিনের রিকশার দিকে আসতে গেলে বৃদ্ধের রাগটা আদারুর উপর ঝাড়ে।
– গেলি !!
বলেই হাতুড়ি দিয়ে এমন এক ভঙ্গি করে যে, ভয়ে আদারু দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়।

রিকশা প্রায় পৌঁছে যায় শাহবাগ। তুমুল যুদ্ধ চলছে সেখানে। টিয়ার শেল এর ধোঁয়ায় আশপাশ পুরোটাই ধোঁয়াশা। তার মধ্যেই পুলিশের লাঠিচার্জ আর ছাত্রছাত্রীদের দৌড়াদৌড়ি।
রিকশাটা পুরোপুরি থামার আগেই শাফিন সিগারেটটা ফেলে লাফ দিয়ে নেমে পরে, ঠিক যেভাবে উঠেছিলো।
টিয়ার শেলের ধোঁয়ার সাথে সিগারেটের ধোঁয়া মিশে যায়।
চলেই যাচ্ছিলো শাফিন, হঠাৎ কি মনে করে একবার পিছন ফিরে। দেখে বৃদ্ধ রিকশাওালা হাঁপাচ্ছে। পকেট থেকে ১০টা টাকা বের করে গুঁজে দেয় রিকশাওয়ালার হাতে। তারপর ঘুরে হাতুড়ির বাট টা শক্ত করে চেপে ধরে প্রস্তুতি নেয় অ্যাকশনের। এমন সময় বৃদ্ধ একটু গলা খাকড়ি দিয়ে বলে – বাবা একটু শুনবেন !
শাফিন বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বৃদ্ধ বলে- এই টাকাটা পালটায়ে দিবেন! এইটা আমি নিতে পারব না …
মুহূর্তে ক্ষেপে যায় শাফিন । হাতুড়ি ধরা হাত তার নিশপিশ করে ওঠে। বলে – দিছি এই কত ! আবার…
রাগে কথা জড়িয়ে যায় তার।
বৃদ্ধ একটু অসহায় ভাবে কোমরটা দেখিয়ে বলে- একাত্তুরে যেই মানুষটার কথায় হাসিমুখে শরীরে গুলি নিবার পারছি… সেই মানুষটার মুখে দাগ দেওয়া টাকা তো বাবা আমি নিতে পারুম না !
শাফিন বৃদ্ধের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারে না।
`আমারে ক্ষমা কর’ বলতে বলতে বৃদ্ধ হাতের টাকাটা স্থাণু শাফিনের কাছে ফেরত দিয়ে চলে যায়। শাফিন অবাক বিস্ময়ে টাকাটা ঘুরিয়ে ফিরেয়ে দেখে।
কে বা কারা যেনো টাকার উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিতে কালি ফেলে দিয়েছে।

৪।
এক হাতে দাগওয়ালা টাকা আর অন্য হাতে হাতুড়ি নিয়ে শাফিন দ্বিধায় পরে যায়।

৬,৬৭৪ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “দাগ”

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।