জীবন এই মতো
তুমি শুটকি ভালোবাসো জানিয়েছিলে একদিন। আমি সমুদ্র উপকূলের মানুষ। শুটকি খেতে অভ্যস্ত নই। তবুও বাজার তালিকায় শুটকি রাখলাম। আমি বললাম, শুটকি খাওয়া অমানবিক। কিভাবে মাছের লাশগুলোকে রোদে পোড়া হয়েছে দেখেছ। তুমি বললে, মৃত মাছের আবার কি অনুভূতি? তুমি যে আস্ত কই তেলে ভেজে খাও। কই মাছের ছটফটানি দেখে দুঃখ জাগে না?
আমি আর কথায় পারলাম কই। বললাম, শুটকি কখনো রাঁধতে দেখিনি মা কে। কিভাবে রান্না করে?
-তোমার নেট কানেকশান নেই? বলো তুমি।
আছেতো। এই যে চ্যাটিং করছি। উত্তর দেই
ইউটিউব থাকতে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়?তুমি বলো।
-এইসব বিচ্ছিরি ইমোটিকন বুঝি না। অপারগতা জানাই তোমাকে।
শীত এলে রোমান্টিকতা বেড়ে যায় বুঝি? তোমার প্রশ্ন।
-যায়তো। শীত এলে ভাবি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো শুন্যতাগুলো কেউ যদি নিয়ে যেত এসে।
আমার আক্ষেপ শুনে হাসো তুমি। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা কিন্তু আর ফেরেনি। তুমি বলো।
এরপর কিছুক্ষণ নীরবতা। কুয়াশায় ঢেকে যায় অগ্রহায়নের চাঁদ।
জীবনের সবচেয়ে বড় আইরনি কি জানো? আমিই নীরবতা ভাঙ্গি।
-না। আইরনি নিয়ে আর ভাবি না। জীবন চলে যাচ্ছেতো।
-জীবনে যার সাথে ইমোশনাল মিল হয় তার সাথে ইন্টালেকচুয়াল মিল হয় না।
-আচ্ছা, তোমার খরগোশ ঘুমিয়েছে?
-শুনতে চাচ্ছো না, তাইতো।
-অন্যকিছু বলো…
-এটা শেষ করি।
-খুব জেদ করো।
-সরি……
না বলে যেতে নেই। তুমি এবার নীরবতার অনুবাদক।
-যাইনি তো। আছি…বড্ড জানান দিতে ইচ্ছে করে আছি…
-ফের কবিতা?
-অপছন্দের?
-নাতো। আগের বাক্যটা শেষ করো।
জীবনে যার সাথে ইমোশনাল মিল হয় তার সাথে ইন্টালেকচুয়াল মিল হয় না। আর দুটো যখন মিলে যায় তখন দুজন দুই ঘরে।
-দুটোর মিল কি জরুরী? আবেগ আর তত্ত্ব এ মিলিয়ে ফেললে হবে? বলো তুমি।
-হয়ে গেছে।
-কি?
-শুটকি রান্নার কৌশল জানা হয়ে গেছে।
-ভাবলাম, ইমোশন আর ইন্টালেকচুয়ালের মিল বোধ হয়। তুমি বলো।
-রাত নামছে। কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে বলি।
-তোমার স্ত্রী কই? অপ্রস্তুত প্রশ্ন তোমার।
-ঘুমাচ্ছে।
-ওর গায়ে কম্বল আছে কি না দেখে আসো। শীতের রাত।
বিরক্তই হই। হাসির ইমো পাঠিয়ে বলি, জেগে আছো ?
-আছিতো, যাও, যা দেখতে বলেছি দেখে এসো।
-আর তুমি? জিজ্ঞেস করি।
কাল তোমার রান্না করা শুটকি খাওয়ার সময় কোন পারফিউমটা মেখে আসবো, ঠিক করে রাখছি। শুটকির গন্ধতো তুমি আবার সহ্য করতে পারো না…
নাচতে গিয়ে কাচের চুড়ি ভেঙ্গে যাওয়া মেয়েটির গল্প
বছর বিশেক পরের কোন সন্ধ্যায় এই সন্ধ্যাকে রূপকথার গল্প মনে হবে হয়তো। যেদিন তুমি নাচতে গিয়ে কাচের চুড়ি ভেঙ্গে ফেলেছিলে আর আমি ছিলাম দর্শকসারিতে সবার অলক্ষ্যে। দূর থেকে তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো দূরদ্বীপবাসিনী। যাকে দেখা যাচ্ছে, অথচ পৌঁছানো যাচ্ছে না। মাত্র কয়েক মিটারের দূরত্ব আমাদের অথচ মনে হলো, ওই দ্বীপে পৌঁছাতে আমার কয়েক জন্ম লেগে যাবে। নাচ শেষে তুমি রক্ত মাখা হাত নিয়ে যেই দর্শক সারিতে নেমে এলে, আমি কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললাম, অসাধারণ..
তুমি কি থমকে গিয়েছিলে খুব? বিভ্রান্ত হয়েছিলে অনেক বেশি? সেই কয়েক মুহুর্তে পৃথিবীকে কি মনে হয়েছিল স্বপ্নের কোন রাজ্য? তোমার চোখ জুড়ে ছিলো অসম্ভব তৃষ্ণা। এমন মুহুর্ত আসবে কেউ কখনো ভাবিনি আগে। অথচ জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক দৃশ্যগুলো বলে কয়ে আসে না। কিন্তু তার রেশ থেকে যায় অনেকদিন। তুমি হয়তো জানবেও না, সেদিন তোমার নাচ দেখার জন্য আমি না খেয়েই রাত অব্দি ছিলাম, অথচ একটুও ক্লান্ত মনে হয় নি।
বছর বিশেক পরের কোন সন্ধ্যায় টি এস সি মিলনায়তন যখন কাঁপাবে আমাদের উত্তর প্রজন্ম, তখন কোন তরুণীর নৃত্য দেখে কি মনে পড়বে তোমার কথা? জীবনের নিয়মে হয়তো আমরা যোজন যোজন দূরে। কেউ কারো খোঁজ জানি না । একই শহরেই থাকবো হয়তো। তোমার ডায়বেটিস বেড়ে গেছে । যে চিবুকে জমে থাকতো ক্লান্তির বিন্দু বিন্দু ঘাম সেখানে আজ বার্ধ্যকের ছাপ। যে নগ্ন গলায় আশ্রয় নিয়েছিল মুক্তো বসানো লকেট, সে জায়গা হয়তো শুন্য। তখনো কবিতা লিখবো হয়তো, আজো যেমন লিখি। লিখতে লিখতে একদিন হয়তো জানবে, বছর বিশেক আগে এই কবিতাটা ঠিক তোমাকে ভেবেই লেখা হয়েছিল। অথচ, কি সংকোচ, কেউই কাউকে জানাতে চাইনি বলে এ শহর জানলোনা, এক সন্ধ্যায় নাচতে গিয়ে চুড়ি ভেঙ্গে যাওয়া মেয়েটির নাম…………
রাজহাসের একটি নতুন চিঠি
সেবার বিধবার একঘেয়ে কান্নার মত কি ঝুম বৃষ্টিই না এলো। পুরো আকাশ বুঝি বরিশাল শহরে ভেঙ্গেই পড়বে। আমি ভিজতে ভিজতে টাউন হলের সামনে দাঁড়িয়ে। শরীরের বয়ে বেড়ানো দেড় কেজি ওজনের খাকি পোশাক ভিজতে ভিজতে তিন কেজি হয়ে গেছে। মুঠোফোন নেই, শুধু জানি তুমি আসবে। তুমি আসবেই। শেষ চিঠিতে জানিয়ে ছিলে ছুটির দিন যেন সকাল এগারটার মধ্যেই টাউন হলের সামনে থাকি। আমি জানি তোমার চিঠির অক্ষরের মতো চিরন্তন সত্যি নেই। আমি ছুটি শেষে বাড়ি ফিরবো, দীর্ঘ দিন পর দীর্ঘ দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের দেখাও হয়নি কতদিন। মানুষগুলো তাকিয়ে দেখছে আপাত গার্ডের পোশাক পড়া মাঝারি সাইজের ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কারো জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি তাকিয়ে আছি নির্বিকার। আকাশ আর তোমার পথের দিকে। তুমি এলে এগারোটার কিছু পরে। বাদামি রঙের একটা ছাতা তোমাকে বৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। এসেই বললে, পাগল তুমি। এখানে দাড়িয়ে বৃষ্টিতে না ভিজে কোন দোকানের নিচে গেলেও তো পারতে। বললাম, যদি খুঁজে না পেতে?তুমি তোমার সূতি ওড়না দিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বললে, শহরটা খুব ছোট রে। তোমাক খুঁজে পেতামই। শুধু শুধু খাকি পোশাক ভেজালে। এই ভেজা ইউনিফর্ম নিয়ে বাসায় যেতে যেতে ঠান্ডা লাগবে তোমার। আমি তাকিয়ে আছি তোমার দিকে অসহায়ের মতো। তোমার মাঝে আমার মায়ের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিনই। মা যেভাবে মাথা মুছিয়ে দিত বৃষ্টিতে ভিজে স্কুল থেকে ফেরার পথে, সেভাবে তুমিও।
শাষণের কন্ঠে বললে, তোমার ওই আধাসামরিক চত্বরে ছাতা নেই? কিভাবে কাটাও তোমরা এই বর্ষার দিনগুলো। তোমাকে ব্যাখা দিতে হলো। বর্ষা এলে আমাদের সে কি হুলস্থূল কান্ড। পিটি নেই, প্যারেড নেই, ডিসিপ্লিন চেক নেই, স্টাফের নাম নোট নেই। বৃষ্টি আমাদের আশীর্বাদই ছিলো। যে অদ্ভুত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আমাদের বাস, সেখানে ছাতার কোন ব্যাবহারই ছিলো না। অবশেষে তুমি বুঝলে। “মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে” তুমি সদ্য কলেজে উঠেছ। সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল ছিলো তোমারো। শান্ত কন্ঠে বললে, যাই??
আমি বললাম, যাই না, বলো আসি। এভাবে যাই বলতে নেই। যাই বললেই মনে হয়ে চিরতরে চলে যাচ্ছ। আর ফিরবে না, আর দেখা হবে না। আমার বুকের মধ্যে হাহাকার হয়। আরো কিছুক্ষণ থাকো।তুমি বললে, বিদায় দীর্ঘায়িত হলে কষ্ট বাড়ে। ছাতাটা রাখো। আর ভিজতে দেবো না তোমাকে। সাবধানে বাসে যেও। আমি ছাতা নিতে রাজি হচ্ছিলাম না। তুমি বললে, দেখা তো হবেই আবার তখন না হয় ফেরত দিও। আর জানো, আমার কাছে খুব একটা টাকাও নেই যে তোমাকে নতুন ছাতা কিনে দেব। এই পুরনো ছাতাটাই রেখে দাও। অন্তত যেতে যেতে আর যেন না ভিজে যাও।
আমি লজ্জায় পড়লাম। বললাম,তুমি ভিজতে ভিজতে যাবে?
তুমি বললে, কাছেইতো থাকি। বৃষ্টি আর কত টুকু ভেজাবে আমাকে? তুমি কত দূরে যাচ্ছ। শহর ছাড়িয়ে মাইলের পর মাইলের দূরত্ব। আসি, ভালো থেক।
এটাই ছিল আমাদের শেষ বর্ষা যাপন। বাদল দিনের বর্ষাস্নাত লগ্নে আমাকে কদম নয় ছাতা দিলে। বহুদিন পর তোমার দেয়া সেই ছাতাটা খুঁজে পেলাম বাসার রিজেক্ট জিনিসের মাঝে। ছাতা খুলতেই দেখি আশ্চর্য তোমার নাম। ***** দ্বাদশ শ্রেনী। অমৃত লাল কলেজ। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কত কথা যে মনে পড়লো। ছাতায় মরচে ধরেছে অনেক দিনের অযত্ন অবহেলায়। আচ্ছা মানুষের মনেও কি এভাবে মরচে পড়ে? মরচে পড়ে সম্পর্কে? দীর্ঘদিন অযত্ন, অবহেলা, অভিমানের অনাকাঙ্ক্ষিত দূরুত্বে? মানুষ দূরে গেলেই কি টের পাওয়া যায় এর গভীরতা? দূরুত্ব বাড়লেই কি বোঝা যায় মানুষের গুরুত্ব?
আমি জানি না। দেখ, মানুষ চলে গেলেও রেখে যাওয়া জিনিসগুলো কি অসীম হাহাকারে মনে করিয়ে দ্যায় সবকিছু। বুকের ভেতরে খুব ভাংচুর হয়, তুমুল ভাংচুর।ষড়ঋতুর এই দেশে প্রকৃতির পালাবদলে আরো পাঁচবার বর্ষা এলো। কত কিছুই তো বদলালো এর মাঝে। শুধু আমিই সেই পুরনোটা রয়ে গেলাম। আজো ছাতা ছাড়া বৃষ্টিতে বের হই। ভিজে চুপ চুপ হই। টি এস সি থেকে কার্জন, কার্জন থেকে শহীদ মিনার, শাহবাগ, কলাভবন, ফুলার রোড, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, পলাশী। ভিজতে ভিজতে পৌঁছে যাই গন্তব্যে, জানি কোথাও কেউ নেই ছাতা নিয়ে অপেক্ষায়। কেউ থাকে না। এই শহরটা তোমার শহরের মতো নয়, তোমার ওড়নার মতো অগাধ মমতার গাঢ় আচ্ছাদন নিয়ে ঝুম বর্ষায় কোন নারী কি দাঁড়িয়ে আছে ? খুঁজিনি কখনো, পাবো না বলেই হয়তো। শুধু মাঝে মাঝে সদ্য প্রেমে পড়া যুবক যুবতীদের দেখে আমার খারাপ লাগে। বর্ষা এলে যারা হুড তোলা রিক্সায় শরীরের তীব্র উত্তাপ ভাগাভাগি করে ন্যায়। যারা প্রেমে পড়ে কোনদিন বর্ষায় ভেজেনি, ছাতা নিয়ে অপেক্ষা করেনি, কেউ কারো মাথার চুল মুছে দ্যায়নি, অথচ শহর জুড়ে রাজত্ব করছে সেইসব বিষাক্ত প্রেম। সত্যিই আমি হাপিয়ে উঠেছি পানকৌড়ি। তবুও মাঝেমাঝে মনে হয় ওদেরকে আমাদের গল্প শোনাতে। তাই লিখি, লিখবো না ভেবেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারি না। চলে গেছ চিরতরে, ফিরবে না। ফেরার কথাও না। তবুও সেই কবিতার কথা মনে পড়ে,
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণেজেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে,
কাকে বলে নীলআকাশের হৃদয়ের, কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে
আমি মুক্ত, উড়ে গেছো, ফিরে এসো, ফিরে এসো চাকারথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীনসুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবির সকল আকাশে।
রাজহাঁস
২৯ জুন, ২০১৫
নতুন লেখক
নীলখেতের পুরনো বইয়ের দোকানে নিজের লেখা বইটি দেখে ধাক্কা খায় শান্তা। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে কাপাকাপা হাতে বইটি তুলে নেয়। নিজের প্রথম গল্পের বই পুরনো বইয়ের দোকানে কিভাবে এলো এই কৌতূহল চেপে বসে। প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই মিশরের মমির মতো রহস্য উন্মোচিত হয়।
উতসর্গ পাতায় শান্তার হাতে লেখা অটোগ্রাফ। ‘ লেখালেখির অনুপ্রেরণা ও প্রিয় লেখক মাঝহার স্যারকে শুভেচ্ছা স্বরূপ’
মাঝহার খন্দকার শহরের বিখ্যাত লেখক। শান্তার সাথে তার একবারই দেখা হয়েছিল মেলায়। মেলায় দেখা হতেই শান্তা খুব অনুনয় করে বলেছিল, স্যার প্লিজ পড়বেন।’
মাঝহার খন্দকার হাসিহাসি মুখ করে বলেছিল, অবশ্যই। পড়ে জানাবো তোমাকে।
শান্তা দীর্ঘদিন কোন অচেনা নাম্বার থেকে ফোনের অপেক্ষায় ছিলো। যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।
দীর্ঘক্ষণ ধরে শান্তা নিজের বইয়ের ওপর তাকিয়ে থাকে। দোকানি বলে ওঠে, একদাম বিশটাকা আফা। নিলে ন্যান, না নিলে সাইড করেন।
বিশটাকা দিয়ে বইটি কিনতে কিনতে শান্তা জিজ্ঞেস করে, মামা এই বইগুলো কোত্থেকে কেনেন আপনারা?
দোকানি এই আচমকা প্রশ্নে অবাক হয় হয়তো। তারপর বলে, বিভিন্ন বাসা থেইকা পুরনো কাগজপত্রের সাথে কেজি দরে কিন্না আনি….
বেলি
একটি সুন্দর সম্পর্কের শুরুতে ছেলেটি মেয়েটিকে একটা বেলি ফুলের গাছ দিয়েছিল উপহার হিসেবে। অন্যসব টিপিকাল গল্পের রোমান্টিক নায়িকাদের মতোই মেয়েটির পছন্দের ফুল ছিলো বেলি। কিন্তু ছেলেটির কাছে বেলি ছিলো অভিশপ্ত ফুল। বিচ্ছেদ আর বেলি, দুটো শব্দই ব দিয়ে শুরু বলে, ছেলেটি বিশ্বাস করতো বেলিফুল দিলেই সম্পর্কে বিচ্ছেদ আসবে। ছেলেটি যদিও বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, তবুও কিছু কুসংস্কার সে বিশ্বাস করতো। মেনেও চলতো। তাই মেয়েটি যখন ছেলেটির কাছে বেলিফুল চাইলো, ছেলেটি কিছুটা এড়িয়েই গেল। কারণ, ছেলেটি চাইতো না একটি সুন্দর সম্পর্কে বিচ্ছেদ আসুক। একটি লোকজ ছড়া ছেলেটিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বহুকাল। ‘ দিয়েছিলাম বেলি, পেয়ে কোথায় গেলি….’
ছড়াকার কেন বেলিফুলের কথাই লিখেছিল ছেলেটি জানতো না। বেলি ফুল দেখতে সাদা, মনে হয় আকাশের টুকরো টুকরো শংখ মেঘ ফুটে আছে গাছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন সদ্য স্বামীহারা কোন বাংগালি নারীকে জোর করে সাদা শাড়ি পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হয়তো তাই বেলি ফুল নিয়ে এক ধরণের কুসংস্কার। একদিন মেয়েটির মনে অভিমানের প্রভাতফেরী ভর করলো। বেলি ছাড়া সম্পর্ক পূর্ণতা পায় না বলে, মেয়েটি খুব গো ধরলো। ছেলেটি তখন নিরুপায়। একদিকে বিচ্ছেদ ভয়, অন্যদিকে অভিমানের প্রভাতফেরী… বাধ্য হয়ে টবসমেত একটা বেলি গাছ কিনলো। তখন বর্ষা আসি আসি করছে। বেলি গাছগুলো যৌবনবতী। ফুল ফোটেনি তখনো। একবিকেলে ১৮০ টাকা দিয়ে সে একটি বেলিফুলের গাছ কিনে রওয়ানা দিলো মেয়েটির হোস্টেলে। মেয়েটি তখন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। হঠাত করে লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজল মুছতে নেই, এই সূত্র মেনেই ছেলেটির সামনে হাজির। বেলিফুলের গাছ পেয়ে সেদিন তার দারুণ উচ্ছ্বাস। ছেলেটি ভাবলেশহীন নির্লিপ্ত। ছেলেটি জানতো, যেদিন এই গাছে বেলিফুল ফুটতে শুরু করবে সেদিন থেকেই বিচ্ছেদ আসবে। ছেলেটি তবুও মেয়েটিকে সতর্ক করে দিলো। বললো, প্রতিদিন সকালে গাছে পানি দেবে। যেন আমার যত্ন নিচ্ছ। যেদিন থেকে যত্ন বন্ধ হবে, গাছটি তার সতেজতা হারাবে।
মেয়েটি তখন দারুণ খুশি। নিয়ম মেনে প্রতিদিন সকালেই গাছে পানি দিতো। কিছুদিন পর গাছ ভরে উঠলো ফুলে ফুলে। বেলির গন্ধ ছড়িয়ে গেল পুরো করিডোরে। মেয়েটির তখন মাত্র একুশ। ভার্সিটি প্রথম বর্ষ। চারদিক থেকে অজস্র শুভাকাং্খির হাত। ছেলেটি তখন দারুণ ব্যস্ত। ফোর্থ ইয়ার। ক্যারিয়ার ভাবনা।
এরপর একদিন কোন সাংঘাতিক অজুহাত ছাড়াই দুজনের মাঝে দূরত্ব বেড়ে চললো। মেয়েটি আর খুব সকালে ওঠে না, গাছে পানিও দেয়া হয় না। ম্যারম্যারে হয়ে গেল সবকিছু। এভাবে একদিন বিচ্ছেদ বুকে নিয়ে বেলিফুল গাছটা মরে গেল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মেয়েটি দেখলো তার রুমের সামনে পড়ে আছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। বর্ষা পেরিয়ে তখন বসন্ত। মেয়েটি আলগোছে গাছটি বেলিফুল গাছের টবে বসালো।
আর মরে যাওয়া শুকনো বেলিফুল গাছটি ফেলে দিলো বাগানে। কিছুক্ষণ পর মালি এসে আরো আগাছার সাথে বেলিফুল গাছটিও দেখলো। গাছটি হাতে নিয়ে বুঝলো এ দেহে প্রাণ নেই আর, তবু সে গাছটিকে লাগিয়ে রাখলো বাগানের এক কোণে। আর গুনগুনিয়ে গাইলো,
দিয়েছিলাম বেলি, পেয়ে কোথায় গেলি….
চিরচেনা দুটো লাইন ভেসে এলো মেয়েটির কানে, আর সে মনে মনে ভাবলো, বেলী ও ছেলেটির গল্পতো অন্য কারো জানার কথা নয়…
ভালো লেগেছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ