আমাদের কোরবানি বোধ হয় কবুল হতো। শৈশবের কোরবানি। আমাদের বাড়িতে ছিলো বারোটি ঘর। বারো ঘরের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো বারো রকম। কেউ চারটা গরু কোরবানি দিতো, আবার কেউ কোরবানি দিতে পারতো না অর্থাভাবে। গ্রামের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মুসলিম বাড়ি। ঐতিহ্য ধরে রাখার খাতিরে অনেকেই ধার দেনা করে একটা গরু কোরবানী দিতো। কেউ কেউ ভাগে। দুই পরিবার মিলে একটা বা কখনো তিন চার ঘর।
বাড়ির অদূরেই ছিলো গরুর হাট। হেটে যেতে হতো হাটে। শুক্রবার হাট। জুম্মার নামাজ পড়ে পিতার সাথে হাটে যেতাম। গরু কিনে ফিরতে ফিরতে রাত হতো। তখন শীত কাল। আমাদের উঠোনের এক প্রান্তে বেধে রাখা হতো গরু। ঠক ঠক করে কাপতে দেখে চটের বস্তা এনে গরুকে পড়য়ে দিতাম। কতোই বা বয়স। নয় দশ হবে। এক সপ্তাহ আগেই গরু কেনা হয়ে যেত। যতো আগে গরু কেনা হবে ততো আনন্দ। ততো বেশি রাখাল বালক হবার সুযোগ। মনে পড়ে, কোরবানির আগ পর্যন্ত গরুকে কি যত্নটাই না করতাম। ভাত রান্না শেষে মাড়টুকু রেখে দিতাম। গরুর মাড় খুব প্রিয়। আবার খৈল কিনে আনতাম, বন জংগল ঘুরে কলাপাতা, কাঠাল পাতা সংগ্রহ করতাম, এগুলো গরুর খুব পছন্দের খাবার ছিলো। আর সবসময়ের খাবার খড়তো ছিলোই।
গরুর সাথে কেমন একটা আত্মার সম্পর্ক হয়ে যেত। ওর গলার নিচে আদর করলে চোখ পিট পিট করতো। কখনো হাত বোলালে জিহ্বা বের করে হাত চেটে দিতো। যেন ও আদরের প্রতিউত্তর দিচ্ছে। ঘর থেকে শ্যাম্পু সাবান নিয়ে গরুর গায়ে মেখেও দিতাম। আজো গরুর গায়ের আঁশটে গন্ধ নাকে ভাসে। গরুর চোখে খুব মায়া ছিলো। আমি ছিলো পেচার মতো গভীর পর্যবেক্ষণ। দেখতাম ওর চোখ থেকে পানি ঝরছে। মাকে বলতাম, মা…গরু কাঁদছে। মা বলতেন, গরু সব বোঝে রে। এগুলো জান্নাতি গরু। হাশরের ময়দানে এই গরুর পিঠে চড়েই জান্নাতে যাবো।
আমার বালক চোখে ভেসে আসতো অদেখা বেহেশত। দেখতাম দিব্যি আরামে ঘোড়ার মতো গরুর পিঠে চড়ে বেহেশতে ঢুকছি। আমাকে অভ্যথর্ণা জানাচ্ছে বেহেশতের অনিন্দ্য সুন্দরীরা।
কখনো হাতে তুলে গরুকে খাইয়ে দিতাম। মনে পড়ে,লাউ পাতার ঘ্রাণে গরু পাগল হয়ে যেত। আমি মাচা থেকে লাউ পাতা এনে ওর মুখের সামনে ধরলে গোগ্রাসে গিলে খেত। এছাড়া শীতকালীন সবজি, মূলা, বাঁধাকপি, পাতা কপি, যা পেতাম তাই খাওয়াতাম গরুকে।
কোরবানির আগের রাতে খুব কষ্ট হতো। বালক ছিলাম। দুরন্ত অভিমানের বয়স। মুখ লুকিয়ে কান্না আসতো। রহমতউল্লাহ হুজুর নামে একজন লোক বাড়ির সব গরু জবাই দিতেন। শুধু আমাদেরটা আব্বা নিজ হাতে দিতেন। এ জন্য বাজার থেকে আলাদা ছুড়ি কিনে আনতেন। চারজন লোক ছুড়িতে ধার দিতো। আব্বা বলতেন, জবাই যেন দ্রুত হয় তাই ধারালো ছুড়ি দরকার। গরুর কষ্ট কম হয়।
জবাইয়ের আগে গরুকে গোসল করানো হতো। আখেরি গোসল। আমি দূর থেকে তাকিয়ে দেখতাম। তারপর আর আশেপাশে ভিড়তাম না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতো। ততক্ষণে গরু জবাই শেষ। আমি গিয়ে দেখতাম গরুর পেটে তখনো হজম না হওয়া লাউ পাতা। ভয়ংকর কান্না আসতো। ফিরে যেতাম ঘরে। দেখতাম শরীফা গাছের তলায়, আমাদের সে উঠোনে, যেখানে যত্নে বেধে রাখা হয়েছিল গরুটা সেখানে পড়ে আছে এক গোছা দড়ি। আর চারপাশে কেমন আশটে গন্ধ। সে গন্ধ বড় মধুর, বড় স্মৃতিময় হয়ে নাকে ভেসে আসতো। আর সাতদিনের জন্য রাখাল হয়ে যাওয়া এক বালকের চোখ ঘেষে ঝরে পড়তো অশ্রুর বড় বড় ফোটা।…….
সেই অশ্রুর ফোটা হয়তো পৌছে যেত পরম করুণাময়ের কাছে। আমাদের কোরবানি হয়তো কবুল হতো…..
"কুরবানি নিয়ে রোমান্টিক গল্প!!!" - এটা ভেবে হাসি পেল শেষ করার পর।
তবে পড়ার সময় মিশে গিয়েছিলাম লিখার সাথে।
কোন সন্দেহ নাই......
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
ধন্যবাদ ভাই। শৈশবের কোরবানী বড় মধুর ছিলো।
কুকুর আর গরু দুইটাই আমাদের খুব কাছের প্রাণি।
আমরা খাই গরু আর কোরিয়ান রা কুকুর।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
সত্যি
ভালোবাসা মাখা লেখাটা পড়ে ছোটোবেলার অনেক কথাই মনে পড়লো ...
ধন্যবাদ ভাই। 🙂 🙂
কোমল হৃদয়ের অনুভূতিমাখা লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই। 🙂 🙂 🙂