এক
আমাদের একজন জনৈক সিনিয়র ভাই ছিলেন যিনি পৃথিবীর কোন কিছু সম্পর্কেই খোঁজ খবর রাখতেন না। আমরা তাকে বলতাম, সংযোগ বিছিন্ন মানুষ। যেমন ডাইনিং হলে খাবার খাওয়ার সময় প্রায়ই তার পোষাকে তরকারির ঝোল লেগে থাকতো। তার সহপাঠীরা অনেকেই মজা করে বলতো, কি রে তুই খেয়েছিস না তোর শার্ট খেয়েছে?
বেচারা অসহায় ভঙ্গিতে উত্তর দিত, দুটোই। হাতে ঘড়ি পড়লেও তিনি অন্যদের কাছে সময় জিজ্ঞেস করতেন। কথিত আছে তিনি প্রায় সকালেই পেস্টের বদলে কুল শেভিং ক্রিম দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতেন। সেবার বিশ্বকাপ ফাইনাল চলছে। আমরা সবাই টিভি রুমে খেলা দেখার জন্য এসেছি। খেলা চলছে। সেই সাথে সমানে চিৎকার, চিল্লাপাল্লাও। হঠাত দেখি সেই ভাই পেছনে বসে আছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা। সবাই এত চিল্লাপাল্লা কেন করছে?
ভাইয়ের কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম। ভাবলাম তিনি মনে হয় মজা করছেন। আমি বললাম, আপনি জানেন না? আজতো ফাইনাল ম্যাচ।
ফাইনাল ম্যাচ? কিসের? তার মুখে বিস্ময়।
আমি বললাম, ফুটবল বিশ্বকাপ। ভাই আপনি কি খেলা দেখতে আসেন নি?
তিনি বললেন, না তো।
আমি বললাম, তো এখানে কেন এসেছেন?
তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, সবাই এসেছে তাই।
দুই
বিশ্বকাপের খেলাগুলো গভীর রাতে হওয়াতে আমরা সব খেলা দেখার অনুমতি পেতাম না। বিশেষ করে পরদিন নিয়মমাফিক পি টি অথবা প্যারেড থাকতো। এছাড়া স্যারদের ধারণা ছিল, গভীর রাতে খেলা দেখার অনুমতি দিলে আমরা খেলা না দেখে অন্যকিছু দেখবো। কারণ তাদের মতে গভীর রাতে অনেক চ্যানেলেই উল্টাপাল্টা নাচ গান এবং ছবি দেখানো হয়। তবে বিশেষ ম্যাচগুলো দেখার অনুমতি মিলতো। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষক সবসময় নজরদারী করতেন। এক রাতের ঘটনা। ব্রাজিলের খেলা দেখার অনুমতি মিললো। আমরা সবাই খেলা দেখার জন্যে টি ভি রুমে জড়ো হলাম। হঠাত ব্রাজিল গোল করায় ক্যামেরা চলে গেল গ্যালারিতে সাম্বা নাচরত ব্রাজিলিয়ান নারীদের দিকে। ঠিক এই সময় স্যার ঢুকলেন। তিনি বেশ বিব্রত বোধ করলেন। বলাবাহুল্য খেলাধুলা সম্পর্কে স্যারের ধারণা তেমন একটা ছিল না। তিনি ভাবলেন আমরা বোধ হয় খেলা না দেখে উল্টাপাল্টা নাচগান দেখছি। তিনি চিৎকার করে হাউসবেয়াড়াকে ডেকে বললেন, হালিম, এখনি টি ভি রুম বন্ধ করে দাও। ছেলে পেলে খেলা দেখার বদলে হাফপ্যান্ট পড়া মেয়েদের নাচ দেখছে। অস্তাগফিরুল্লাহ।
তিন
বিশ্বকাপের সময়ে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের পতাকা বানানোর ধুম পড়ে গেল। বিশেষ করে সবাই যে যার প্রিয় দলের পতাকা বানাচ্ছে। সে অনুযায়ী একদিন আমিও ব্রাজিলের পতাকা বানানো শুরু করলাম। কিন্তু পতাকা বানানোর মাঝপথে “গেমস” এর বাঁশি পড়লো। এবং বাধ্যতামূলক খেলাধুলা করতে নেমে গেলাম। ‘গেমস’ এর সময় মিশকাত ভাই বললেন, রুম নং ৩২৭ ফল আউট। মিশকাত ভাই ছিলেন আমাদের “জুনিয়র অধিনায়ক”।
আমাদের ওপর খবরদারী করার দায়িত্ব ছিল তাঁর। আমরা ৩২৭ নং রুমের বাসিন্দারা “ফল ইন” থেকে বের হয়ে এলাম। তিনি কমান্ড দিলেন, স্টার্ট ফ্রন্টরোল। অর্থাৎ তিনি আমাদের ডিগবাজি দিতে বলছেন। ডিগবাজি এর সামরিক নাম “ফ্রন্টরোল”। আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কারণ, পানিশমেন্ট খাওয়ার মত আমরা কিছুই করিনি। যাহোক, সিনিয়র এর আদেশ। আমরা আমাদের অপরাধের কারণ জিজ্ঞেশ করার সুযোগ পেলাম না। পানিশমেন্ট খেয়ে রুমে ফিরে দেখি অসমাপ্ত ব্রাজিলের পতাকা মেঝেতে পড়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না তিনি রুম চেকিং করতে এসে ব্রাজিলের পতাকা দেখে আমাদের ওপর খেপেছেন। এবং পানিশমেন্ট দেয়ার কারণ এটাই। পরে জানলাম, তিনি আসলে আর্জেন্টিনার সাপোর্টার।
চার
বিশ্বকাপের সময় আমরা কলেজের ভেতরেই ঘরোয়া ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করতাম। এমন এক ফুটবল ম্যাচের গোল রক্ষকের দায়িত্ব পড়লো আশিকের। আশিক যথারীতি দায়িত্ব পালন করছে। বল তখন মাঠের অই প্রান্তে। এমন সময় এক স্যার এসে বললেন, কি ব্যাপার? সবাই ফুটবল খেলছে, তুমি একা দাঁড়িয়ে আছো কেন? আশিক বলল, স্যার আমি গোল রক্ষক।
স্যার তখন বললেন, তাতে কি হয়েছে? তুমিও ওদের সাথে যোগ দাও বাবা। সবাই বল নিয়ে ছুটোছুটি করছে। আর তুমি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছ। যাও মধ্যমাঠে যাও।
পাঁচ
আমাদের একজন স্টাফ (আর্মির নন কমিশন্ড অফিসার ) ছিলেন যার চেহারা অনেকটাই নাইজেরিয়ানদের মত ছিল। অর্থাৎ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। আমরা মজা করে বলতাম, স্টাফ। আপনি কি নাইজেরিয়া সাপোর্ট করেন?
স্টাফ আমাদের মজা বুঝতে পেরে বলতো, দেখ। আমি দেখতে নাইজেরিয়ানদের মত হতে পারি। কিন্তু সাপোর্ট করি আর্জেন্টিনা।
ছয়
আন্তঃহাউস ফুটবল ম্যাচ প্রতিযোগিতা চলছে। সোহরাওয়ার্দি হাউসের সাথে শেরেবাংলা হাউসের খেলা। রেফারী আমাদের একজন প্রিয় শিক্ষক। হঠাত একদল গোল করলো। রেফারী বাঁশি বাজিয়ে গোল বৈধ করার পর অপর পক্ষ থেকে অভিযোগ এল বল আসলে পা নয় হাত দিয়ে জালে ঢুকেছে। স্যার অভিযোগ শুনে তাৎক্ষনিক জবাব দিলেন, তাতে কি হয়েছে? বল জালেতো ঢুকছে।
সাত
আমাদের এক বন্ধু ছিল। ও যা ভবিষ্যৎবাণী করতো ঘটতো ঠিক তার উল্টো। যেমন যদি ও বলতো আজ বৃষ্টি হবে তাহলে দেখা যেত সেদিনের রোদের প্রখরতা অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। দেখতে দেখতে বিশ্বকাপ চলে এল। আমার বন্ধুটি মহাউৎসাহে প্রতিটি ম্যাচের ভবিষ্যৎবানী করতো আর ঘটতো তার ঠিক উল্টো। শুধু তাই নয়, ও যে দল সমর্থন করতো দেখা যেত সেই দলই হেরেছে। আমরা তাই ওকে “অ্যান্টি পল” নামে ডাকতাম। উল্লেখ্য তখন “পল” নামে অক্টোপাসটি ভবিষ্যৎবাণী করে বেশ সমালোচিত। এদিকে আমরা যারা ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থক তারা প্রচণ্ড ভয়ে আছি। কারণ আমার বন্ধু দুই দলকেই সমর্থন করে। ফলে যা ঘটার ঘটলো। ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা একে একে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল। আমার বন্ধুটিও দীর্ঘদিন নীরব। দেখতে দেখতে ফাইনালে গেল ভিন্ন দুটি দল। এবার ও কোন ভাবেই আর ভবিষ্যৎবাণী করে না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও চুপচাপ থাকে। তাই আমরা কোন ভাবেই নিশ্চিত হতে পারছি না এবার কে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। ফাইনালের রাত এল অবশেষে। সবাই খেলা শেষ করে যে যার রুমে ফিরে যাচ্ছি। হঠাত দেখলাম কেউ একজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আগ্রহ নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি, আমার সেই বন্ধুটি। বেচারার হাতে ব্যানার। যাতে লেখা “নেদারল্যান্ড”।
আমাদের দেখে তড়িঘড়ি করে লুকানোর চেষ্টা করছে।
:clap:
🙂 🙂 🙂
ভাল ছিল। বেশ মজা পেলাম
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
ধন্যবাদ 🙂
দারুন সব স্মৃতি, বেশ মজা পেলাম 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ আহসান ভাই 🙂
স্মৃতিচারণ তো ভালো ছিলো। বেশ আমোদ পেলাম।
তবে
সিসিবিতে এসে ফ্রন্টরোলের সংজ্ঞাসহ দেয়ার অপরাধে এই পোলাকে আমি বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পর্যন্ত সামরিক, আধাসামরিক বা বেসমরিক সবধরণের ফ্রন্টরোল দেয়াতে চাই। x-(
নুপুর দা, আমি ক্যাডেট ঠাট্টা নামে ইত্তেফাকে নিয়মিত লেখি। তাই সিভিল পাঠকদের জন্যেই এই লেখাটা। তাই এত বিশদ বর্ণনা 🙂
😀 😀 😀
সেটা বুঝতে পেরেছি।
ফ্রন্টরোল দেয়া শুরু করলানা তো।