রিশাদের কায়াটা এই ভরদুপুরের ফাঁকা গোরস্তানে বেশ বেমানানই লাগে। অন্তত বজলুর তাই মনে হচ্ছে। বজলু পেশায় ছিনতাইকারী কাম পাগল। এলাকায় বজলু পাগলা বলেই সুনাম তার। সুনাম হবেই বা না কেন? আশপাশের ৪-৫ এলাকা জুড়ে এমন মতিভ্রষ্ট পাগল কমই আছে তার ধারণা।সত্যিকারের পাগলেরা জানেনা কীভাবে পাগলামি করতে হয়।কিন্তু মিথ্যাকারের পাগল হিসেবে সে জানে ঠিক কোন অবস্থায় কোন পাগলামিটা করতে হয়। থিয়েটার ফিয়েটার করলে নির্ঘাত বড়মানের অভিনেতা হতো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। এটা অবশ্য অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস নয়, ক্লান্তির হবে।ছিনতাই তো নিজের এলাকায় করা যায় না, বেশ দূরের এলাকায় গিয়ে করতে হয়। এজন্য পরিশ্রমও কম যায়না, বিশাল ঝক্কির ব্যাপার। এইক্ষেত্রে তার সহযোগীরও প্রয়োজন পড়ে।ভাগ বাটোয়ারাটা হয় এই গোরস্তানে। মৃতদের সাক্ষী দেবার ক্ষমতা নেই। বজলুর মাঝে মধ্যেই মনে হয় এই মৃতের দলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে অপলক পড়ে আছে।অবশ্য এই প্রাণহীন দৃষ্টিতে তার কিছু আসে যায় না।প্রাণ আছে যেইসব দৃষ্টির, রাস্তাঘাটে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার সময় সেগুলোও কেমন প্রাণহীন হয়ে যায়। আজকে একটা বড় দান মারা গেছে। ক্যামেরা, দামিই হবে বেশ। তাই এটার বিক্রির ব্যবস্থা কি হবে এবং কে কত ভাগ পাবে তাই নিয়ে কিছুটা বচসা হচ্ছে। কিন্তু রিশাদের উপস্থিতি অনেকটাই অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছে, তাই সহযোগীদের বচসায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না বজলু ঠিকঠাক।
রিশাদের ব্যাপারটা ভিন্ন।সে দাঁড়িয়ে আছে গোরস্থানের পূর্বপাশে।বাবার কবরটা এদিকেই। তবে কোনটা সেটা ঠাহর করে উঠতে পারছে না। সাত বছরে এখানে অনেক কবর হয়েছে, বৃষ্টির পানি জমেছে, মাটি সরেছে। তার উপর আবার মাটি ফেলা হয়েছে। মজে যাওয়া কবরের উপর নতুন কবর হয়েছে।তাছাড়া গত সাত বছরে কদাচিত আসা হয়েছে এখানে তার।এইজন্য প্রায়শই তার অপরাধবোধ হয়। তবে এখন অপরাধবোধের জায়গাটায় ছোট্ট একটা কষ্ট দানা বাঁধছে। বাবার কবরটাও চিনতে পারছে না সে! অথচ প্রথম প্রথম কতো আবেগ ছিল! স্পষ্ট মনে পড়ে, কবর দেয়ার পরদিনই বৃষ্টি নেমেছিল।একদম সকালে হন্তদন্ত হয়ে সে গিয়েছিল অবস্থা দেখতে।কুকুরের পায়ের ছাপ পড়ে আছে ভিজে কবরের উপর দিকটায়।দারুণ বিচলিত হয়েছিল সে।এলাকার হুজুরদের কাছে কতো দৌড়াদৌড়ি করেছে এর কারণ জানতে।বড় হুজুর বলছিলেন আজাবের আলামত।বাবার কবরের আজাবের জন্যই কি এমন হচ্ছে? কতো কোরআন খতম দিল সে, ফকির খাওয়ালো। রাতদিন কবর পাহারা দিল যেন কোনও শ্বাপদের ছায়াটুকুও না পড়ে তার শায়িত পিতার উপর।কবরের উচ্চতা একটু কমে গেলেই সযত্নে নতুন মাটি ফেলে পরম মমতায় লেপে দিয়েছে।আজ সাত বছর পর কেন, কীভাবে হারিয়ে গেল সেই অনুভুতিগুলো ? নাকি সে ভুলে যেতে চেয়েছে? পুরনো কোষের মতো তার আবেগগুলোও কি মরে গেছে নতুন আবেগদের স্থান করে দিতে ? বুঝে উঠতে পারে না রিশাদ। নাকি সে বুঝতে চায়না ? মহাকালের রুঢ় হিসাবটুকু, যা কিনা জলের মতোই স্বচ্ছ, তা মেনে নিতে ভীষণ অনিচ্ছা তার ?
রিশাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে খুব। বাবাকে তার সুপারহিরো মনে হতো। অবশ্য সবারই হয়। মনে হতো ইশ!অতো ভারী বাজারের ব্যাগ কীভাবে অবলীলায় বাবা একহাতে নিয়ে বাজারময় ঘুরে বেড়ায়। একটুও ঋজু হয় না।বাসার ফ্যানটা, চেঞ্জারটা নষ্ট হলে কি আজব দক্ষতায় ঠিক করে ফেলে! আর সবার মতো সেও চাইতো বড় হয়ে বাবার মতোই হবে। কিন্তু যখন বড়োই হলো, তখন বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে ঋজু হতেন, অল্প হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। রিশাদ মেনে নিতে পারতো না।যদিও সে বুঝতে পারতো বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছেন, তবুও মহাকালের সরল সমীকরণের উপর তার অদ্ভুত অভিমান একফোঁটা দুফোঁটা করে জমা হতো। সুপারম্যানরাও বুড়ো হতে জানে, হাত বাড়িয়ে পুত্রের কাঁধের আশ্রয় নিতে জানে, এই চরম শিক্ষাটা তার অবচেতন মন চরমভাবেই অস্বীকার করতে চাইতো। তবে তার এই অমূলক চাওয়ায় প্রকৃতি সাড়া দেয়নি। দেয়ও না।
সে আজ বাবার আলমারি থেকে একটা শার্ট পরে এসেছে। এত বছর পরেও গন্ধটা মিলিয়ে যায়নি। মনে পড়ে, বাবার শরীরের এই গন্ধ তার শৈশবের প্রতিটা বিকেলের সাক্ষী হয়ে আছে। বাবা ঘরে ফিরলেই কিছু একটা নিশ্চিত এনেছেন সেই আশায় দৌড়ে গিয়ে উনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া।মুচকি হাসে রিশাদ। মহাকাল আর সবকিছু কেড়ে নিলেও সেই পরিচিত গন্ধটি কেড়ে নিতে পারেনি, পারবেও না। অথবা মধ্যদুপুরে স্কুলের সামনে বাবার দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি। রিশাদের লজ্জা লাগতো, এত বড় হয়েছে তবুও বাবা তাকে শিশুজ্ঞান করেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়? অথচ আজ সে দাঁড়িয়ে আছে। মানেটাও কি আজ উপলব্ধি হচ্ছেনা কিছুটা?
আজ এখানে হঠাৎ চলে আসার একটা কারণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে সে।গতকালের আড্ডাটা জমে উঠতে গিয়েও উঠেনি। সাব্বিরটার জন্য। তার পিতৃমশাই নাকি ভীষণ চটেছে তার উপর। এই নিয়ে তিনদিন বাসার বাইরে তাই।ঠিক তখনি সিগারেটের মাঝপথের বলকা হয়ে উড়ে যাওয়া ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে বাবার মুখটা উঁকি দিল কি ? রিশাদের তাই মনে হলো। এরকম পূর্বাভাস ছাড়া সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে এক অদ্ভুত বিষাদ, একটা সূক্ষ্ম হিংসে, শরীরের ঠিক মাঝখানে শূন্যতার অনুভব এর আগেও তার হয়েছে। তবে সেটা বাবার প্রতিবছরের মৃত্যুবার্ষিকীতে নয়, কিংবা বাবা দিবসগুলোতে বন্ধুদের বাবাদের সাথে অবাস্তব অন্তর্জালে দেয়া ছবিগুলো দেখেও নয়। এটা আসে আচমকা, লক্ষ্য করার মানদণ্ডে আসতে পারার অযোগ্য কিছু ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে। অথচ সে সবসময় স্বাধীনতা চাইত। চাইতো যেন আয়েশ করে আবেশ ভরে নিশ্চিন্তে সিগারেটে টান দিতে, গভীর রাতে বাইরে থাকতে, পরীক্ষার ফলাফলে বাবার আক্রোশের ভয়ে ভীত না হতে। তবে আজ কেন তার ইচ্ছে করে কেউ একজন বলুক, চোখ রাঙানি দিক, অভিমান করে কথা না বলুক!মধ্যরাতে কারো ভয়ে দরজার নিচে কাপড় দিয়ে অতি সন্তর্পণে টিভি দেখতে আজ বড্ড ইচ্ছে জাগে তার।কারো ভয়ে মাসুদ রানার বই ক্যালেন্ডারের পাতায় মলাট করে বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে খুব। প্রকৃতি সেটাকে অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করে দিয়েছে সাত বছর আগেই।
যেমনটা হয়, জড়তা কাটিয়ে, দূরত্বের বলয় ভেঙে আরেকটু কাছে গিয়ে কখনো রিশাদ বলতে পারেনি, “বাবা, তুমি আমার সুপারম্যান”। বাবা কি জানে যে উনাকে শায়িত করার সময় রিশাদ সূরা নাস ভুলে গিয়েছিল! উনি হয়তো জানেনা সারা গায়ের মেখে যাওয়া মাটি সে ধুয়ে ফেলতে চায়নি শুধু এই মাটিতে বাবার শরীরের শেষ ছোঁওয়া ছিল বলে!রিশাদের ডান গাল বেয়ে একটি ফোঁটা জল মাটিতে পড়লো কি? পড়লেও কি? অজস্র নোনাজল বুকে ধারণ করে এই গোরস্তান। তাই হয়তো মাটিটা এমন ভিজে। এখানকার রাত্রিগুলোর অন্ধকারটাও ভারী, অনেক দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ানো সময়ের কাণ্ডারি যেন। রিশাদ অশ্রু লুকায়। যেমনটা লুকিয়েছে অজস্র। নতুবা করুণার দৃষ্টি নির্গত হবে তার দিকে।যেমনটা এই মুহূর্তে বজলুর চোখে দেখা যাচ্ছে।দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে আসে রিশাদ।পিছনে রয়ে যায় গোরস্তান, বজলু।
আর একটি দীর্ঘশ্বাসও ভেসে বেড়ায় গোরস্তানময়,
“ বাবা, ভালোবাসি”।
রিশাদের একার গল্প এটি। বজলুর উপস্থিতি সম্ভবত শুধু পরিবেশ তৈরির জন্যে।
আমার ধারণা এমনিতেই গল্পটি সুন্দর হচ্ছিল। বজলু ছাড়াই।
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
বজলু বেচারার প্রতি অবিচার হয়ে গিয়েছে ভাই। 😐
Prisoner of Own Mind
প্রিয় উদ্দিন, তোমার এই লেখার পেছনের আবহের কিছুটা বোধহয় আমি টের পাই। কি জানি, ব্যক্তিগতভাবে চিনি সে কারণেই হবে হয়তো। ভালো থাকো। নিজের খেয়াল নিও।
সিদ্দিক ভাই, সাইকিয়াট্রি পড়া ধরছেন কবে ? ২৬ তম বসন্ত পার হয়ে গেলে খেয়াল রাখা বড়ই দুষ্কর ভাই। আপনিও নিজের খেয়াল নিবেন। শুকিয়ে যাচ্ছেন।
Prisoner of Own Mind
“বাবা, তুমি আমার সুপারম্যান”
একটা সুন্দর গল্পকে 'ব্লগর ব্লগর' ট্যাগ করা কেন। আমার মনে হল, আরেকটু বিস্তারে গেলে হত।
সাইদুল ভাইয়ের সঙ্গে একমত। বজলু চরিত্রটি কেমন এতিম হয়ে রইলো।
বেশ অনেকদিন পর এখানে তোমাকে পাওয়া গেল।
বজলু বেচারা আলসেমির কবলে পড়ে গিয়েছিল নূপুরদা। আমি তো আসিই । লিখি না, পড়ি। পড়ে পড়ে মুগ্ধ হই।
Prisoner of Own Mind
ভাষা সুন্দর, ছোট গল্পের জন্য বেশ যুতসই। কিন্তু আলসেমির কারনে একটা ভাল মানের লেখা থেকে সবাই বঞ্চিত হলাম। এই আলসেমিটা ঝেড়ে ফেল। তোমার হবে।
ধন্যবাদ মাহবুব ভাই, আলস্য আর ছাড়লো না আমায়।
Prisoner of Own Mind
অনেকদিন পর তোমার লেখা পেলাম মহিউদ্দিন, বেশ লাগলো। :clap:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আহসান ভাই, মনে রেখেছেন এই অভাজনকে। কীভাবে যে ধন্যবাদ দেই!
Prisoner of Own Mind
🙂 🙂 🙂 🙂
পড়ে পড়ে তো অনেক মুগ্ধ হলে ভাইয়া, এবার আমাদের মুগ্ধ করবার ভার তোমার ওপর। তোমার লেখা ভাল লাগলো। এবার নিয়মিত দেখতে চাই আমাদের সাথে।
ধন্যবাদ সাবিনা আপা। চেষ্টা থাকবে। অনুপ্রেরণা ভালো লাগে।
Prisoner of Own Mind
🙂 🙂 🙂 🙂
তোমার থেকে ছবি ব্লগ চাই এবার!
আমার ছবি সংগ্রহ তেমন সুবিধার না আপা। তবে বলেছেন যখন অবশ্যই দিব। আপাতত আমার কভার ফটোটাই থাকুক। আমারই তোলা।
Prisoner of Own Mind
গল্প পড়ে বাবার কথা মনে হওয়াতে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো!
অন্যদের মত আমারও বজলু চরিত্রটিকে অনাবশ্যক মনে হলো।
সালাম ভাই। আসলে লিখতে গিয়ে আমার নিজেরও খারাপ লাগছিল। তাই বজলুকে নিয়ে বেশি আগানো আর হয়নি। আলসেমিও কাজ করেছে।
Prisoner of Own Mind
আমার কেন জানি মনে হয়, বাবারা সত্যিই সুপার হিরো হয়ে থাকে।