আমি আমগাছ বলছি

 

আমি কেমন জানি একটু অন্যরকম, অন্যদের মতো না। আবেগ একটু বেশি মনে হয়। হ্যাঁ, আমি একটি আমগাছ। বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে পড়া কালের সাক্ষীও বলতে পারেন। অজস্র স্মৃতি আছে আমার কিন্তু ঐ প্রেমিক যুগলের স্মৃতি যেন একটু বেশি ভাবায় আমাকে। শহরতলির এক প্রত্যন্ত এলাকার বিনোদন পার্কে স্থায়ী নিবাস আমার। প্রতিদিন কতো জুটি এসে কতো মান অভিমান আর ভালোবাসার নাটক মঞ্চস্থ করেছে আমার ছায়াতলে। কিন্তু ঐ ছেলেটিকে আমি কখনো ভুলব না। খুব শান্ত স্বভাবের ছিল সে, কথা প্রায় বলতোই না। আর মেয়েটি! তার চঞ্চলতা আমার জড় হৃদয়েও বসন্তের হাওয়ার মতো দোলা দিয়ে যেত। আমার ঠিক সামনেই ছিল নিস্তরঙ্গ একটি দীঘি। মেয়েটি তার পাড় ধরে দৌড়াতো আর ছেলেটি ব্যাকুল হয়ে তার পিছু পিছু ছুটতো। ভালোই লাগতো দেখতে। আর যখন আমার ছায়াতলে এসে বসতো দুজনা, কথা কিছুই বলত না। ছেলেটি শুধু হা করে তাকিয়েই থাকতো মেয়েটির চোখে। কিছু একটা অদ্ভুত ছিল এই জুটির মধ্যে যা আমি বুঝতে পারতাম না।

 

একটা দিনের কথা আমার বেশ মনে আছে। ঐদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দেখলাম সেই জুটি এগিয়ে আসছে। মেয়েটির গায়ে রেইনকোট আর তার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে ছেলেটা। অবাক হলাম। বৃষ্টি তো প্রেমিক জুগলদের প্রিয় একটি সময়। দুজনে না ভিজে ছেলেটি একলা ভিজছে কেন ?

 

‘‘ অ্যাই তুমি ভিজে যাচ্ছ তো, ছাতা নাও ’’ ­­­­ বললো মেয়েটি।

 

“ আরে লাগবেনা, তোমার শরীরে বৃষ্টির হালকা ছাট লেগে যদি জ্বর আসে তাহলে আমার খারাপ লাগবে। ’’  ছেলেটির নির্লিপ্ত উত্তর।

 

সিগারেট পানের বাজে অভ্যাসটি তার ছিল। ওইদিনই তার সেই অভ্যাসের দাঁড়ি টেনে দিয়েছিল মেয়েটি। যেই না সিগারেট বের করল অমনি মেয়েটি খপ করে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে নিয়ে নিল। ভাবলাম নাটক তো ভালোই জমল দেখছি। তারপর থেকে ছেলেটির ঠোঁটে আর একদিনও সিগারেট দেখিনি। মনে হল যাক অন্তত একটি তরুণ তো ধোঁয়ার জগতকে বিদায় জানাল। কণ্ঠস্বর থাকলে ধন্যবাদ দিতাম ঐদিন মেয়েটিকে।

 

আরেকদিনের কথা বলি। যথারীতি মেয়েটি তার চঞ্চলতা দিয়ে আমার চারপাশ মোহিত করে রেখেছে আর একটার পর একটা সফেদা পাড়ছে আশপাশের সফেদা বাগান থেকে। এবার শুরু করল লেবু পাড়া। আর ছেলেটির কথা কি বলব ! সেতো ঐ সফেদা আর লেবু দিয়ে পকেট ভর্তি করছে আর ছুটে বেড়াচ্ছে মেয়েটির পিছু পিছু। এবার আমার পালা। আমার সন্তান স্বরূপ কাঁচা আমগুলো পাড়তে ছেলেটিকেই উঠতে হল আমার ডালে। কিছু অবশ্য মনে করিনি। তাদের তরুণ মনের দোলাচলে যে আমারও মনে দোলা লেগেছিল তা যথার্থই বুঝতে পারছিলাম। একটু অন্যরকম যেন তাদের ভালবাসাটা, একটু যেন পাগলামি মিশ্রিত মাদকতা আছে এই দুজনার প্রণয়ে। আমার গায়ে দাগ কেটে নাম লেখায় শারীরিক ব্যথা পেলেও কেন জানি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল যে একটি অনিন্দ্যসুন্দর আবেগ অনুভুতির খেলার সাক্ষী হয়ে থাকছি আমি। ছেলেটির নৈঃশব্দ আর মেয়েটির কলকাকলি যে অনুপম সুরের সৃষ্টি করতো তার ধ্বনি যেন আজও আমার কানে বাজে, বাজবে যতদিন বাঁচি।

 

যেদিন যেদিন ওরা আসতো তাদের স্বপ্নকথায় আমিও হারিয়ে যেতাম। অবাক ভালোবাসার সৌরভ ছড়ানো এই জুটি আমার অলস সময়গুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। মাঝে মধ্যে মনে হতো ওরা আসলে ওদের প্রণয় যেন আমার ডালে বাসা বাঁধা দোয়েল সংসারেও অনুরণিত করতো প্রণয়ের ছোঁয়া। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। মেয়েটির কোমল হাতে ছেলেটির কপালের ঘাম মুছে দেওয়া, ছেলেটির সদা উদগ্রিব দৃষ্টি, মেয়েটির হাসি সবই যেন এক স্বর্গপুরীর অপার্থিব দৃশ্য। মাঝে মাঝে খুব হাসি পেত আমার ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে। মেয়েটি প্রায় সময় হাতের চুড়ি খুলে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলতো, পরিয়ে দাও। হায়রে ছেলেটির সেকি প্রচেষ্টা চুড়িগুলো পরিয়ে দেবার। কিন্তু দুষ্টু মেয়েটির চঞ্চলতার কারণে কখনোই সে ঠিকমতো পরাতে পারেনি চুড়িগুলো। তার ভয়, পাছে যদি তার ভালোবাসার রাজকন্যাটি ব্যথা পায়। রঙিন ঐ মুহূর্তগুলো মনে পড়লে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মানুষ নই আমি, অশ্রু বিসর্জনের ক্ষমতা কেন জানি এই মানুষ প্রজাতিরই প্রবল।

 

সুসময়গুলো কেন জানি দীর্ঘ হয়না। তাই মেঘের ঘনঘটা এই জুটির জীবনেও আসলো। একদিন দেখলাম দুজনে চুপচাপ বসে আছে কিন্তু কোনও কথা বলছে না। শুধু শক্ত করে একজন আরেকজনের হাত ধরে আছে। একপর্যায়ে দেখলাম ছেলেটি অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার কান্না থামেই না। অবাক আমি বুঝতেই পারলাম না কেন এই তীব্র নিস্তব্ধ নিনাদ ! সেদিন তারা অনেকক্ষণ ছিল। কথাহীন নিঃশব্দপুরী বানিয়ে রাখল পুরোটা বিকেল। তারপর, তারপর আর কখনো দেখিনি সেই চঞ্চলমতি তরুণীটিকে। এরপরের গল্প শুধুই নিঃশব্দ আর্তনাদের গল্প।

হ্যাঁ, ছেলেটি প্রতিদিনই আসতো। কিন্তু তার চারপাশে আবেগের বলয় তৈরি করে রাখা মেয়েটি আসতো না। ছেলেটি আগের মতই চুপচাপ ছিল কিন্তু আনন্দের জোয়ারে চারপাশ প্লাবিত করা মেয়েটি নিখোঁজ ছিল। ছেলেটি জানবেও না কখনো নোনা অশ্রুধারায় আমার সুশীতল ছায়া সে কতবার বিষণ্ণতার মৃত্যুপুরী বানিয়েছে। বলতে ইচ্ছে করতো, তরুণ তুমি কেঁদো না, তোমার ঐ বিরহ যাতনা যে আমারও জড় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কিন্তু মানুষ হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি বিধায় বোবা কান্নায় অশ্রুসিক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় আমার ছিলনা। তার শূন্য দৃষ্টি বাতাসের মৃদুমন্দ দোলাকেও স্তব্ধ করে দিত, কোলাহল সেখানে নৈশব্দের। বুঝতে পারছিলাম ছেলেটির সাথে আমারও জীবনীশক্তি ধীরলয়ে কমে আসছে।

 

অদ্ভুত খেয়ালি সেই ছেলেটি সেই কুড়ানো লেবুগুলো সযতনে রেখে দিয়েছিল কে জানত! দেখতাম শুকিয়ে চিমসে যাওয়া সেই লেবুগুলো নিয়ে বসে থাকতো সে আমার আম্রতলায়। ঐ চঞ্চলা তরুণীর স্মৃতি সে এভাবে রেখে দিয়েছিল কেই বা জানত ! সিগারেট সে খেত না। কিন্তু বেঞ্চে সিগারেট ছড়িয়ে বসে থাকতো। হয়তো তার অবচেতন মনের আশা যে তার পরীটা এসে আবার ছিনিয়ে নেবে সেই সিগারেট। কি খুঁজত সে আমার ছায়াতলে ? স্মৃতি,বেদনা নাকি ভালোবাসার অবিনশ্বর মুহূর্তগুলো তা আমার চিন্তার অতীত একটি বিষয়। মনে মনে শুধু বলতাম সৃষ্টিকর্তা যেন এর আর্তনাদ শুনতে পাক, যেন আবার আমার চারপাশ এই অদ্ভুত জুটির কোলাহলে মুখরিত হোক। কিন্তু সৃষ্টিকর্তাও হয়তো খেয়ালি তাই সুখের পশরায় দুঃখের প্রলেপ বুলিয়ে দিতে ভালবাসেন। মনে আছে প্রায় তিনটি বছর আমার গিয়েছে ঐ অবাক বালকের অসম্ভব কষ্টের যাত্রা দেখে। তারপর কোনও এক বসন্তের বিকেলের পর আর তাকে দেখিনি।

 

 

কিন্তু আজ একি দেখি ! ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে এসে আমাকে ঘিরে এভাবে দৌড়াচ্ছে কেন ? আরে এতো দেখছি সেই চঞ্চল তরুণীর মতোই লাগছে ! আর, আর ঐ চোখদুটো ? আরে! এতো দেখছি সেই শান্ত তরুণের চোখদুটি। মেলাতে পারছিনা কিছু। ঐ একটু দূরে ওরা দুজন কারা আমার পানে এগিয়ে আসছে? বয়স বেড়েছে তাই আগের মতো দেখতে পারিনা। মনে হচ্ছে যেন সেই ছেলেটি আর ঐ মেয়েটি যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে! তবে কি আমি স্বপ্ন দেখছি? না, তাতো হবার কথা নয়। স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা যে আমার নেই। তবে কি! তবে কি শান্ত বালকটি পেয়েছিল তার পরীর দেখা ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আরে! আমার তো কাঁদবার ক্ষমতা নেই, তবে জল আসছে কেন আজ অশ্রুরুপে !

১,৬২৪ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “আমি আমগাছ বলছি”

  1. দিবস (২০০২-২০০৮)

    রোমান্টিক লেখা ভালা পাই,শেষে নায়ক-নায়িকার মিল হইলে আরো ভাল লাগে।তবে এইখানের নায়ক চরিত্রটাকে আমার ভাল লাগে নাই,অনেক বেশী হ্যাংলা মনে হইছে।এরকম নায়ক চরিত্র আমার পছন্দ না,এখানে নায়িকার উপর নায়কের কোন প্রভাব দেখানো হয় নাই,সে ক্ষেত্রে রোমান্টিকতাটা একটু ঝিমানো লাগছে(যদিও তাদের মিল হওয়াটা একটা সার্বিক প্রেমের প্রভাব),নায়কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট গুলা এখানে পুরাটা অনুপস্থিত।এটা আমার ভাল লাগে নাই।বাংলা সাহিত্যে আমার সবচেয়ে অপছন্দের নায়ক হইল হৈমন্তীর স্বামী।এরকম নির্লিপ্ত পুরুষের নায়ক চরিত্রে আসার অধিকার নাই।

    পুরাটাই নেগেটিভ মন্তব্য করলাম,আশা করি পজিটিভলি নিবি,তবে ভাষার ব্যবহার ভাল লাগছে।:)


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  2. রায়েদ (২০০২-২০০৮)

    গল্প ভাল লেগেছে। তবে জড়হৃদয়গুলোকে উদ্ভিদহৃদয় করে দিস।

    এভাবে জেসিসিদেরকে উদ্ভিদ না বলে জড় বলার পরও যে তারা মাইন্ড খায়নায় এতে বুঝলাম তারা আসলেই উদ্ভিদ।
    😛 😛 😛 😛

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।