পিতার স্কন্ধে সন্তানের কফিন

কথায় বলে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু পিতার স্কন্ধে সন্তানের কফিন। গতকাল এমনই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার দুঃসংবাদ পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রাক্তন সহকর্মী এবং প্রতিবেশী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবর রহমান (অবঃ) এর কন্যা সামিনা মাহফুজ এক মর্মান্তিক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে গতকাল ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করে। মৃত্যুর মাত্র পনের দিন আগে সে একটি কন্যা সন্তানের জন্মদান করেছিল। সেই নবজাতক ছাড়াও তার সাড়ে চার বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। জন্মদাত্রী মা এ ধরা থেকে চলে গেলেও, নবজাতক শিশুটি সুস্থ রয়েছে। সে অবশ্য জানতেও পারলো না, জীবনের শুরুতেই কত বড় একটা দৈব ঝাপ্টা এসে তার জীবন থেকে কী ছিনিয়ে নিয়ে গেল, তাকে চিরতরে তার আজন্ম অধিকার মাতৃদুগ্ধ ও মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করে গেল!

১৯৯৫-৯৬ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে মুজিব পরিবার আমাদের পাশের বাসার প্রতিবেশী ছিল। তখন সামিনা খুব ছোট ছিল, স্কুলে যাওয়াও শুরু করেনি। ওর একটা ছোট ভাইও ছিল যে কেবল তখন হাঁটা শিখেছিল। আবার আমি ২০০৭ সালে প্রাক-অবসরকালীন ছুটি কাটানোর সময় কয়েকমাস আমরা একই বিল্ডিং এ ছিলাম। অনেক বছর পর সামিনার আরও দুটি বোন জন্মগ্রহন করে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। সব মিলিয়ে ওরা মোট চার ভাইবোন একটি সুখী পরিবারে বড় হয়েছিল।

গতকাল বিকেলের দিকে মুঠোফোনের ক্ষুদেবার্তায় আচমকা এ দুঃসংবাদটি পেয়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। আসরের নামাযের পর মুজিবের বাসায় এলাম। বাসার প্রবেশপথে জনসমাগম দেখে বুঝতে পারলাম, হয়তো মৃতদেহ আনা হয়েছে। প্রবেশ করে দেখলাম ঠিকই, একটি ‘লাশবাহী গাড়ি’ তে সাদা কাফনে ঢাকা সামিনা শায়িত, নিস্পন্দ। মুজিবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিছু কথা বলতেও চাইলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূক ও বিমূঢ় হয়েই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর কাঁধে হাত রাখলাম, নীরব আলিঙ্গনেই ভাষার আদান প্রদান হলো। ওর কান্না চেপে রাখা মুখটা দেখে আর স্থির থাকতে পারছিলাম না। ঐ অবস্থায় সে তার ছেলেকে নির্দেশ দিচ্ছিল, পরিষদ অফিসে ফোন করে মাইকিং এর ব্যবস্থা করতে, এশার নামাজের পর স্থানীয় মাসজিদে জানাযা পড়ানো হবে এ কথা জানিয়ে। আমি ত্বরিত এ দায়িত্বটা নিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলাম, ‘বিষয়টা আমি দেখছি’। তাড়াতাড়ি পরিষদের একজন প্রশাসনিক স্টাফের সাথে কথা বলে জানলাম যে মাইকিং ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং সেই মুহূর্তে ১ নং রোডে মাইকিং চলছে। আমি মুজিবকে সাথে সাথে জানালাম, সে আশ্বস্ত হলো।

ঘোষণা অনুযায়ী রাতে এশার নামাযের পর জানাযা পড়ানো হলো। জানাযার পূর্বে প্রথমে সামিনার বাবা সংক্ষেপে সামিনার জীবন সম্পর্কে কিছু কথা বললো। মেধাবী ছাত্রী জনসেবা করার লক্ষ্য নিয়ে ডাক্তারী পড়েছিল। এফসিপিএস করেছিল, পরবর্তী উচ্চতর ডিগ্রীর জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমনই একটা সময়ে অকস্মাৎ আসা এক দমকা হাওয়ায় তার জীবন প্রদীপ চিরতরে নিভে গেল! এর পরে সামিনার শ্বশুর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মফিজও (অবঃ) সামিনা সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। তিনি জানালেন, তার কোন মেয়ে নেই, কিন্তু সামিনা সে অভাবটা পুরোপুরি পূরণ করেছিল। তিনি আরও বললেন, সামিনা মাত্র দশ বছর বউমা হিসেবে তার পরিবারের সাথে সংযুক্ত ছিল, এবং ঐ দশ বছরই ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।

আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন প্রসবকালীন জটিলতায় মৃত্যুবরণকারী সামিনাকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে বেহেশ্তের সর্বোচ্চ মাকামের মহিমান্বিত বাসিন্দাদের দলভুক্ত করে নিন, তার শোকসন্তপ্ত মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-সন্তান, ভাই-বোন, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, এবং শোক ভারাক্রান্ত বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্খীদেরকে সবরে-জামিল দান করুন! আর যে কথাটা লিখতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, মানুষসহ তার সৃষ্ট সকল প্রাণীর অভিভাবক, প্রতিপালক এবং রব্ব, দয়াময় আল্লাহতা’লা যেন সামিনার মাসুম বাচ্চাদুটোর জন্য তার অসীম দয়া ও করুণায় একটা সুরক্ষার বর্ম তৈরী করে দেন! এত বড় একটা আঘাতের পর আর কোন ক্ষতি, ব্যথা বেদনা, বড় কোন অসুস্থতা যেন তাদেরকে স্পর্শও করতে না পারে। আদর স্নেহ ভালবাসায় তাদের জীবন যেন পরিপূর্ণ থাকে। ওরা তাদের মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠুক এবং তাদের আলোকপ্রভায় একদিন সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হোক! আল্লাহ হিসেব বিহীন রিযিকদাতা। যে শিশুটি জন্মের মাত্র ক’টা দিন পর মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হলো, আল্লাহ পাক যেন তার জন্য আজীবন উত্তম রিযিকের ববস্থা রেখে দেন এবং একদিন তার অসিলায় পৃথিবীর বহু মানুষের রিযিকের ব্যবস্থা করে দেন! আমীন, সুম্মা আমীন!

ঢাকা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

১১৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “পিতার স্কন্ধে সন্তানের কফিন”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।